আগুনে ধাঁধা - বিজ্ঞান না অবিজ্ঞান!
অনিন্দ্য পাল
২০১৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি চেন্নাইয়ের বিল্লাপুরমের বাসিন্দা 'কে. রাজেশ্বরী' , মাত্র ২২ বছর বয়সে সদ্য মা হওয়া তরুণী তার ছ'দিনের ছেলেকে নিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সরকারি হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন, তরুণী সেই মায়ের দাবী ছিল তার এই ছদিনের বাচ্চার শরীরে আগুন ধরে গেছে। এই ঘটনা, যথারীতি কেউ বিশ্বাস করেনি। অনেকে এর পিছনে শিশুনিগ্রহের ছায়া দেখতে পেয়েছেন । ডাক্তাররাও ঠিকঠাক কারণ বলতে পারেন নি।
তবে একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, এরকম অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছে- যার ব্যাখা আজও সঠিক ভাবে দেওয়া যায়নি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে Spontaneous human combustion বা (SHC) নামে একধরনের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে ,আবার এ রকম ঘটনার উল্লেখ বেশ কিছু পত্রপত্রিকাতেও পাওয়া যায়। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত Larry E. Arnold এর Ablaze! বইটিতে দাবী করা হয়, বিগত ৩০০ বছরে সমস্ত পৃথবীতে প্রায় ২০০টি এরকম ঘটনার উদাহরণ আছে।
'ঘটনা' বলতে যেটা বোঝানো হচ্ছে, তা এককথায় বেশ রোমহর্ষক। কোনও জীবন্ত মানুষের শরীরে বাইরের কোন আগুন বা ইন্ধন ছাড়াই অগ্নিসংযোগ ঘটছে, ফলতঃ মারা যাচ্ছে সেই ব্যক্তি, আর এই ঘটনা কেই বলা হচ্ছে SHC ।
১৯৬৬ সালের একটা ঘটনা। ওই বছর পেনসিলভেনিয়াতে, ডিসেম্বরে ৯২ বছর বয়সের এক ব্যক্তিকে তার বাড়ির মেঝেতে অদ্ভুত ভাবে দগ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। শুধুমাত্র তার পায়ের কিছুটা অংশ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, আর বাকি শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তবে, যেটা অদ্ভুত ব্যাপার, ওই ভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেল একটা মানুষ, কিন্তু মেঝেতে একটা ছোট্ট গর্তে পোড়ার চিহ্ন ছাড়া আর কোথাও কোনও ছাপ পাওয়া যায় নি! ঘরের বাকি সব কিছু যেমনটা আগে ছিল, পরেও ঠিক তেমনি ছিল।
এই ঘটনার প্রথম উদাহরণ হিসেবে যে ঘটনাকে দেখা হয়, সেটা ১৬৬৩ সালের থমাস বার্তোলির বিবরণ। তাঁর বর্ণনায় প্যারিসের এক মহিলার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছিল বলে জানা যায়। বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই মহিলা ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হন এবং অদ্ভুত ভাবে তিনি যে ঘাসের মাদুরের উপর শুয়ে ছিলেন সেটি অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ১৬৭৩ সালে ফ্রেঞ্চ লেখক Jonas DuPont তাঁর লেখা "De Incendiis Corporis Humani Spontaneis " বইতে একশোর বেশী এরকম ঘটনার বিবরণ সংগ্রহ করেছিলেন।
এরকম আরও কিছু ঘটনার কথা এই শতাব্দী এবং বিগত শতাব্দীতেও ঘটেছিল, এমনটা জানা যায়। যেমন, ১৯৮০ সালে সাউথ ওয়েলস এর রাসাউ কাউন্সিল এস্টেটের কাউন্সিল হাউসে নিজের লিভিং রুমে ৭৩ বছর বয়সী হেনরী থমাসের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
তার সম্পূর্ণ দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলো, শুধু মাত্র মাথার খুলি আর হাঁটুর নিচ থেকে পা-এর অবশিষ্টাংশ
অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এমনকি সেই অংশের পায়জামার কাপড়ও পোড়েনি! পুলিশ এবং ফরেনসিক অফিসাররা এই ঘটনাকে SHC বলেই রিপোর্ট করেন। তাদের দাবী অনুসারে, থমাসের নিজের শরীরটাই তাকে দগ্ধ করেছে।
আবার ২০১০ সালে আয়ারল্যান্ড এ এরকম একটা ঘটনার কথা জানা যায়। সেখানে মাইকেল ফাহেরীর মৃত্যুকে ডাক্তার সিরান ম্যাকলোগ্লিন পুরোপুরি SHC বলে উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ এই ধরনের ঘটনার কথা এবং তার ব্যাখা বিশ্লেষণ আজকের দিনে শুনতে অদ্ভুত বা হাস্যকর মনে হলেও এর বীজ কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন। এই SHC - এর কারণ বিজ্ঞান স্বীকৃত ব্যাখা না পাওয়া গেলেও ১৮২৩ সালে এল. এ পেরির " মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স" নামে একটি গবেষণাপত্রে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছিল, যেমন আক্রান্ত ব্যক্তিরা অধিকাংশই ছিলেন অভ্যাসগত মদ্যপ এবং তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মহিলা।
কিন্তু ১৯৮৪ সালে জো নিকেল এবং জন ফিসার অষ্টাদশ, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ৩০টি SHC এর ঘটনাকে নিয়ে গবেষণার যে ফল প্রকাশ করেন, তাতে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আগুন ধরে যাওয়ার তত্ত্ব মানতে চাননি। তাঁদের মতে ছোটখাটো কোন আগুনের উৎস, যেমন মোমবাতি, লন্ঠন অথবা ফায়ারপ্লেস থেকে এই ঘটনা ঘটে যাওয়া সম্ভব। এই গবেষকদের মতে দগ্ধ ব্যক্তি মদ্যপ অবস্থায় আগুন থেকে বাঁচার জন্য কোন চেষ্টাই করতে পারেন নি। তবে একটা ব্যপারে তাঁরা একমত ছিলেন, তা হল দগ্ধ ব্যক্তির শরীরের ফ্যাট গলে গিয়ে জ্বালানির কাজ করেছে এবং এই দহনকে ইন্ধন দিয়েছে। এই ব্যাপারটা কে বিজ্ঞানের ভাষায় Wick effect বলা হয়।
তবে বিতর্ক আজও থামেনি। SHC এর সঠিক ব্যাখা বা ঘটনাটির বাস্তবতা বা অবাস্তবতাও প্রমাণিত হয় নি। বিজ্ঞান এখনও ঘটনার সত্যতা আর তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যার পিছনে ছুটছে, কে জানে ৩০০ বছরের পুরানো মিথ নাকি সত্যিই কোন অদ্ভুত বাস্তব লুকিয়ে আছে এই Spontaneous Human Combustion - এর আড়ালে, এর উত্তর সময়ই দেবে।
=========================
অনিন্দ্য পাল।
চাম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন