Featured Post
প্রবন্ধ ।। "কোনখানে রাখবো প্রণাম" ।। শ্রীজিৎ জানা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
"কোনখানে রাখবো প্রণাম"
শ্রীজিৎ জানা
বাঙালী চিরকাল ঠাকুর বলতে অজ্ঞান। তার নিত্যদিনের যাপনে, সমারোহে, উদযাপনে, দুঃখ-শোকের অভিঘাতে,প্রেমে, বিরহে আরোপিত হয়েছে ঠাকুর-দেবতার ভাবাদর্শ। তার হৃদিমাঝে বারবার অনুরণিত হয়ে চলেছে ওই একই সুরতরঙ্গ -"দেবতারে প্রিয় করি/প্রিয়রে দেবতা"। বাঙালী যাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে তাকে অনায়াসে, নিঃশর্তে বসাতে পারে দেবত্বের আসনে। ফলত পুজোর ঘরে অথবা দেয়ালের গায়ে লক্ষ্মী-গনেশ-কালী-দুর্গা-সরস্বতী-শিবনারায়ণের পাশে আরেক ঠাকুর পরম শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় ঠাঁই পেয়েছেন। তিনি আর কেউ নন--তিনি বাঙালীর 'নিয়তি ও নৈঋত',তিনি বাঙালীর ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ, তিনি বাঙালীর আশীর্বাদ ও আশ্রয়, তিনি বাঙালীর প্রাণের ঠাকুর--রবি ঠাকুর!
তিনি তো সত্যিকারের ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আর সারদাসুন্দরী দেবীর অষ্টম পুত্র সন্তান তিনি। বাঙালী সেই কোন যুগ থেকে অষ্টমগর্ভের সন্তানকে সৌভাগ্যের, দুঃখহরণের,প্রেমের ঠাকুর মেনে নিয়ে বসিয়েছে মনে ও মন্দিরে। মহর্ষিও তাঁর অষ্টম পুত্রসন্তানকে শৈশবেই চিনেছেন 'বিস্ময়বালক' রূপে! পরবর্তীতে দীর্ঘকায়, প্রলম্বিত, হীরকদ্যূতি চোখ,দাড়ি-গোঁফভরা শান্ত মুখশ্রী আর আলখাল্লা ও জোব্বা পরিহিত আশ্চর্য মানুষটির তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়ালে আজও ঠাকুর ভাবে প্রণতিতে মাথা নত হয় বৈকি! মৃন্ময় ও প্রস্তরময় ঠাকুর নন তিনি;অস্থিমজ্জা, রক্তমাংসে গড়া তিনি জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ। তিনি 'মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই'-এর মতো তীব্র আকুতিভরা উচ্চারণের রবি ঠাকুর। শান্তিনিকেতন আম্রকুঞ্জে ঘুরে বেড়ানো প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভাবসঙ্গমের বিশ্বভারতী গড়ার প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ। তিনি আপামর বাঙালী ও বিশ্বের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঠাকুর মানে দেবালয়ের রত্নসিংহাসনে তিনি উপবিষ্ট নন।তিনি কামারের, কুমোরের,মুটে,মুজরের,কৃষকের,জেলের,জোলার,তাঁতির সর্বজনের। তিনি উচ্চবিত্তের আবার অতিসাধারণের। তাঁর মন ঘুরে বেড়াতে চেয়েছে 'গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথে' প্রান্তরে। তিনি অনায়াসে সম্পদের গজদন্ত মিনার থেকে নেমে শরীক হতে চেয়েছেন সর্বহারাদের।তিনি কৌলিন্যের উন্নাসিকতাকে হেলায় ছুঁড়ে এই বলে স্পষ্ট করে দিয়েছেন নিজ অবস্থান--"মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/আমি তোমাদেরই লোক"। তিনি কত অবলীলায় নির্মোহ অনুচ্চ স্বরভাষে--"এই মণিহার আমার নাহি সাজে"' বলে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন খ্যাতি-সম্মানকে।
মৃত্যু যন্ত্রণা,প্রিয়জন বিচ্ছেদ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় রণোন্মাদনা,হিংসা,আগ্রাসন তাঁর চিত্তকে পীড়িত করেছে অহরহ। হিংসায় উন্মুখ পৃথিবীকে শুনিয়েছেন 'শান্তির ললিত বাণী'; মানবতার জয়গান। জীবনে মৃত্যু অনিবার্য জেনেছেন বলেই তাঁর অনায়াস উচ্চারণ 'মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান'। কিন্তু তা'বলে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি তিনি নন," সত্যের কঠিন মূল্য লাভ করিবারে/ মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে " এই রূপময় জগত- জীবনকেই আঁকড়ে ধরেছেন বারবার।
ঋষির মতো জ্ঞানযোগের শিক্ষামন্ত্রে "চিত্ত যেথা ভয়শূন্য /উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত…"র বাণী উচ্চারণ করেছেন। প্রকৃতির কোলে গড়ে তুলেছেন আনন্দের পাঠশালা।মেধায় নয়,মননে, হৃদয়-সম্পদে প্রকৃত মানুষ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। খাঁচাবন্দী তোতাপাখির জীবন নয়,আপন আনন্দে ইচ্ছের বিস্তৃত নীলাকাশে ডানা মেলে উড়বার ফুরসত তিনি দিতে চেয়েছেন শৈশবকে।
ধর্মকারার প্রাচীরে হেনেছেন বজ্র। কুসংস্কার আর গোঁড়ামির মর্মমূলে করেছেন কুঠারাঘাত। মুক্তমনা গুরু অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে বইয়ে দিয়েছেন মুক্তির সুবাতাস। বদ্ধ ধারণার গোড়া ধরে সপাটে টান দিয়েছে যুক্তিবাদী পঞ্চক।নীচুজাত বলে যাদের দূরে ঠেলে রেখেছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে, তাদের বুকে টেনে নবীন প্রাণের পঞ্চক শুনিয়েছেন নতুনের গান--ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জোতির্ময়/তোমারি হোক জয়। যন্ত্রসভ্যতা কখনো যে প্রাণের সহজ-স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করতে পারে না,যন্ত্রসভ্যতার কাছে প্রাণময় সত্ত্বা যে হেরে যেতে পারে না তা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে অভিজিৎ। কংক্রিটের পাহাড় ঠেলে, জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে ফুটে ওঠা রক্তকরবী তো আসলে প্রেমেরই প্রতীক হোয়ে ধরা দ্যায়। নন্দিনী-রঞ্জন সেই চিরন্তন প্রেমের যুগলরূপ,যাদের মধ্য দিয়ে ঘোঘিত হোয়েছে চিরন্তন বাণী-"প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই,প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা"। অমল আর দাদাঠাকুর শোনায় সীমা-অসীমের রহস্যময় লীলাখেলা। 'বিসর্জন'নাটকের অপর্ণা আর গোবিন্দমাণিক্যর গলায় উচ্চারিত হোয়েছে দেবত্বের দোহাই দিয়ে হিংসার যে নারকীয় রীতি,তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।নাটকের মর্মবাণীই হল--"দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ"। 'রাজা' নাটকে রাণী সুদর্শনার রূপের মোহভঙ্গ ঘটেছে। এই তত্ত্বই প্রতিভাত হয়েছে--"রূপে তোমায় ভোলাবোনা/ভালবাসায় ভোলাবো"। অমিত-লাবন্য-কেতকি শুনিয়েছে প্রেমের নব নব অনুভূতির ভাবতরঙ্গের কথা। বর্তমানের প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত ভাবসকল সমাজের উৎকর্ষ বিধানে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। অথচ চতুর্দিকে ঘটমান ঘটনা প্রবাহ,যা ধর্ম,প্রেম,রূপ-সৌন্দর্য,যন্ত্রসভ্যতা প্রভৃতি বিষয়কেন্দ্রিক অত্যুগ্র ও হিংসাত্মক প্রকাশ রবীন্দ্রভাবনার চরম পরিপন্থী।
জীবনের সকল অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছেন রবি ঠাকুর। দুঃখ-শোকে,প্রেমে-পূজায়,প্রকৃতি-প্রার্থনায়,
প্রতিবাদ-প্রতিরোধে,বিরহ-অভিমানে তাঁকে আশ্রয় করেই বাঙালী নিজেকে মেলে ধরতে পারে।তাঁর সৃষ্টি সম্ভার যেমন বিদ্বানের গভীর অনুধ্যানের বিষয়,যেমন সাহিত্য পিপাসুর তৃষ্ণা নিবারক, তেমনি সাধরণের রসাস্বাদনের একমাত্র উপাদেয় পুষ্টিকর মহাপ্রসাদ।তাঁর গানের বিচিত্রগামীতা,সুরের বৈচিত্র্য আর বাণীর মাধুর্য বাঙালীর আজন্মের প্রাণের সামগ্রী হোয়ে থাকবে। তাঁর গান অন্তরের প্রশান্তি,তিমিরনাশী প্রদীপের অনির্বাণ শিখা,যা শুধু মনকে আনন্দ দ্যায় না,আমাদের অন্তর্লোককে আলোকিত করে। দুশো বছর পূর্বে জন্মানো মানুষটির গান যখন আজকের রোবোটিক এরার আল্ট্রামর্ডান সোসাইটির গায়ক-গায়িকা সোৎসাহে গায়,আর হিট এ্যালবামের শিরোপা লাভ করে,তখন তাঁর সুরও বাণীর বিস্ময়ভরা যুগলবন্দীর ক্যারিশমাতে বিস্মিত হতে হয় বৈকি!
বাঙালীর কাছে তিনি সত্যিকারের ঠাকুর। নিরকার নন তিনি। ঠাকুর তিনি সাকার এবং সারাজীবনের।তাঁর পূজায় ষোড়শোপচার লাগে না।তাঁর আবদার মাত্র ওইটুকুই-"ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো/তোমার মনের মন্দিরে"। বাঙালী তাঁকে বেঁধে রেখেছে আয়োজনে এবং প্রয়োজনে।তিনি ও তাঁর সৃষ্টি সম্ভার মানেই তো বাঙালীর সেভ ইকনমি। তাঁকে মুখস্ত করেছে বাঙালী,আত্মস্থ করতে চায়নি। তাঁকে বহন করে চলেছে কিন্তু তাঁর ভাবসমুদ্রে অবগাহন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি।আজকের বাঙালীর কাছে রবি ঠাকুর বেঁচে আছেন বাসস্টপের মিউজিক সিস্টেমে,মেট্রোর গানে,মেট্রোস্টেশনের নামকরণে,হোটেল,রেস্তোরা, পার্ক ও আবাসনের নামকরণে,নেতা-নেত্রীদের ভূল কোটেশন উচ্চরণে,হোর্ডিংযে, পোস্টারে,ফেস্টুনে,বাহুবলী নেতাদের কার্টআউটের পদতলে,পাঞ্জাবি -শাড়ি-ব্লাউজের নক্সায়, উদ্দাম রিমেক গানে, শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকোর দোল উৎসবের অশ্লীল আবীর লিখনে। রবি ঠাকুর মানেই বাঙালীর টু প্রাইস কামানির পুঁজি,সাতখুন মাফের ছাড়পত্র,সপ্তাহান্তে খোয়াই আর সোনাঝুরিতে ঢুঁ মেরে আসার অছিলা ।কিম্বা থিসিস লিখে ছাতিমপত্র প্রাপ্তির তোড়জোড়। আর পশ্চাদে ভঙ্গি দিয়ে শুধু চোখ ভোলানোর আয়োজন।
তিনি তো ঠাকুর কর্মযোগের। শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে,প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনে,পল্লী উন্নয়নে, সমবায় ভাবনায় তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা অবাক করে। তিনি ঠাকুর প্রতিবাদের। ব্রিটিশবিরোধীতায়,দেশভাগ রোধে,ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর মতো করে গর্জে উঠেছেন। তিনিই একমাত্র অনায়াসে সকলের কবি হোয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
তাঁকে কোনদিন প্রতিবাদের জন্য বুদ্ধিজীবী সাজতে হয়নি। দলদাসে পরিণত হোতে হয়নি। মঞ্চ বেঁধে নিজেকে জাহির করতে হয়নি।
রবি ঠাকুর শিশুদের চোখে স্বপ্নাঞ্জন, কৈশোরকালের ইচ্ছেপূরণ,তারুণ্যে সবুজের অভিযান,যৌবনের নিকষিত প্রেম, প্রৌঢ়ত্বের অতল প্রশান্তি,বার্ধক্যের পূজা-প্রার্থনা।
বাঙালী তাই অতি সহজেই তার ঠাকুরঘরে রবি ঠাকুরের জন্য একটা আসনপিঁড়ি পেতে দিতে কুন্ঠিত হয় না। খোলা মনে সে উপনিষদের পাশে রাখতে পারে রবি ঠাকুরের গীতবিতান, বেদান্তের পাশে গীতালি -গীতিমাল্য-সঞ্চয়িতা, মহাভারতের পাশে উপন্যাসসমগ্র, রামায়ণের পাশে গল্পগুচ্ছ। বাঙালী জীবনে ঠাকুর-দেবতার মতোই রবি ঠাকুর সর্বব্যাপী। তিনি বাঙালীর জীবনদেবতা। তবে তাঁকে শুধু মেহগনির মঞ্চে সাজিয়ে রেখে,আবেগমথিত কন্ঠে গেয়ে,খোঁপায় ও গলায় পলাশফুল সাজিয়ে বৈতালিকে হেঁটে গেলেই কর্তব্য ফুরোয় না। তিনি তো নিজেই নরোত্তম ঠাকুরের মুখ দিয়ে শুনিয়েছেন সেইকথা, মন্দিরে দেবতার বাস নয়,যিনি বিশ্বেশ্বর তাকে ক্ষুদ্র আয়তনে বাঁধা মূর্খামি। একদিকে দেশজুড়ে মন্দির নির্মাণের আস্ফালন,পাশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার অসহায়ত্ব যেমন অসহনীয় একইভাবে রবি ঠাকুরকে ঠাকুরের মতো করে কেবল দরকারের আর বিপদভঞ্জন ও মানরক্ষার শংসাপত্র স্বরূপ ব্যবহারের মানসিকতা সমান যন্ত্রণাদায়ক! রবি ঠাকুরকে ঠাকুরের মতো সর্বত্রগামী ভাবে জীবনে ও সমাজে অনুসরণ হোক। কেবলমাত্র কথায় নয়,কর্মে ঘটুক রবীন্দ্রায়ণ। সেখানেই বোধকরি রবি পূজার সার্থকতা।নইলে পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে আর্দ্র কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ আউড়ে লাভ নেই। বড্ড মেকি লাগে শুনতে এবং দেখতে।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন