রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবোধ
শেফালি সর
রবীন্দ্রনাথ জীবনে দেশকে ও বিশ্বকে সমান স্থান দিয়েছিলেন। পৃথিবীর একপ্রান্তে,এমনকি ভারতবর্ষের বা বাংলার এক কোনে পল্লী পরিবেষ্টিত যে বিদ্যালয় গড়েছিলেন তার নাম দেন বিশ্বভারতী অর্থাৎ বিশ্বের নীড়।১৯১৬সালে এক চিঠিতে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন -মানবী বিদ্যাচর্চায় বিশ্বভারতীকে হতে হবে পৃথিবীজোড়া মানুষের গবেষণা কেন্দ্র।
বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা সম্বন্ধে নির্দ্বিধায় ঘোষনা করেছিলেন তিনি "এই বিশ্বভারতী ভারতবর্ষের জিনিস হলেও একে বিশ্বের সমস্ত মানবের তপস্যার ক্ষেত্র করতে হবে।" তপস্যার লক্ষ্য হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা মিলিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞান ও স্বাধীনতার আদর্শ স্থাপন করা।১৯৩৩ সালে রামমোহনের মৃত্যু বার্ষিক সভায় তিনি বলেছিলেন-"মানব সমাজের সর্বপ্রধান তত্ত্ব হল মানুষের ঐক্য।
মানুষের সহিত মানুষের সম্বন্ধকেই তিনি বড় বলিয়া জানিয়াছেন।সেখানে তিনি দেশী কি বিদেশী ভাব ভাবনাকে কখনো প্রশ্রয় দেননি।তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝিয়েছেন যে বিদেশী শিক্ষাকে সার্থক করতে হলে হৃদয়ের যোগ স্থাপন করা একান্ত আবশ্যক।তিনি বারবার বলেছেন -মনের মিল না ঘটলে বিদেশী অধ্যাপকের নিকট শিক্ষা লাভ করা হবে নিতান্তই বিড়ম্বনামাত্র।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'আত্মপরিচয়' গ্রন্থটিতে বলেছেন -"আমার স্বাতন্ত্র্য গর্ব নাই।বিশ্বের সহিত আমি কোনো বিচ্ছেদ স্বীকার করি না।"
বিশ্বমানব কথাটির মধ্যেই রবীন্দ্র ভাবধারার উৎকৃষ্ট রূপ খুঁজে পাওয়া যায়।তাঁর ৩০ বছর বয়সে আন্দোলন শুরু করেন বাংলা ভাষাকে নিয়ে।তিনি বললেন-বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালি কে শিক্ষা দেওয়া চাই অর্থাৎ শিক্ষা দেওয়া হোক।এ নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছিল সেই সময়ে। বিশ বছর ধরে আমরা যে সকল ভাব-শিক্ষা করে আসছি জীবনের সহিত তার একটা রাসায়নিক মিশ্রণ হয় না বলে আমাদের মনের ভারি একটা অদ্ভুত চেহারা বেরিয়ে পড়ে।শিক্ষিত ভাবগুলির কতকটা আঠা দিয়ে জোড়া থাকে আবার কালক্রমে কিছু ঝরেও যায়। একই ব্যক্তি একদিকে ইউরোপীয় দর্শন, বিজ্ঞান এবং ন্যায়শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, আবার অন্যদিকে চিরন্তন কসংস্কারগুলি সযত্নে পোষণ করছেন। একদিকে স্বাধীনতার উজ্জ্বল আদর্শ মুখে প্রচার করছেন,অন্যদিকে অধীনতার শত সহস্র নীতিতন্ত্রের পাশে আপনাকে এবং অন্যকে প্রতি মুহূর্তে আচ্ছন্ন ও দুর্বল করে ফেলছেন।শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য সাধনাই এখনকার দিনের সর্বপ্রধান বিষয়। এই মিলনকে সাধন করতে পারে একমাত্র বাংলাভাষা সাহিত্য।
ক্রমশঃ রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় চেতনায় ও লেখায় বিশ্বমানবের আদর্শ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।১৮৯৩ -১৯০১ এই সময়ে উনি বিশেষভাবে ভারতবর্ষ আর ভারতবর্ষের সাধনা কি,জাতীয়তা কি,পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি কি-এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও লেখালেখি করেছেন।
তিনি বলেছেন ইউরোপের জাতি বলতে যা বোঝায় আমরা তাহা নই। আমাদের সকলের মধ্যে বেদনাবহ,বার্তাবহ কোনো সাধারণ স্নায়ুতন্ত্র নাই।অর্থাৎ আমাদের মধ্যে সাধারণ সুখ দুঃখ বলে কোনো পদার্থ নাই।তাই বারবার তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে -ভারতীয় সমাজে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে যে ভেদ,তার মধ্যে এক জাতি বা নেশন হবে কি করে? এই প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি দেখতে চাইলেন যে ভারতবর্ষের সাধনার মধ্যে একাধিক সভ্যতার মিলন ঘটেছে।একটা হল নাগরিক সভ্যতা অপরটি হল পল্লীসমাজ। এদের মিলন ঘটিয়ে দিচ্ছে তপোবন। এই থেকেই শান্তিনিকেতন নিয়ে তিনি তাঁর ছাতিমতলায় বিদ্যালয় স্থাপন করলেন তপোবনের আদলে।তিনি আরও বললেন- এই বিদ্যালয়কে আশেপাশের সমস্ত গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের দৈনিক জীবনযাত্রার মধ্যে সাধারণ পল্লীবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। এইসব থেকেই বোঝা যায় তাঁর বিশ্বমানবতাবোধ কতখানি প্রখর ছিল।
--------------------:--------------------
শেফালি সর
জনাদাঁড়ি
গোপীনাথপুর
পূর্ব মেদিনীপুর
৭২১৬৩৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন