তাহাদের কথা...
শাশ্বতী মণ্ডল
আজকাল বড়ো পুরোনো মানুষ দের কথা মনে পড়ে। বিকেল হয়ে আসা ধানখেত,হৈমন্তী রোদের মন কেমন করা মায়া, ভাঙা চণ্ডী মণ্ডপে খড়ের কাঠামো,কোন জীর্ণ দোতলা বাড়ির কার্নিশ থেকে ঝোলা তাঁতের শাড়ির লাল নরম আঁচল ... সব কিছুতে মনে পড়ে।
সাদা ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা আমার নিরাপদ দাদু।মায়ের মেসোমশাই।চার ছেলে তাঁর।দুটো চালু মুদিখানার দোকান।বাজারের উপর সারের গোডাউন।পৈতৃক সম্পত্তি ও নেহাৎ কম না। তখনও বুড়োর হাতেই সংসারের সবকিছু।নাতি,নাতনী,বৌমা ছেলে নিয়ে ভর ভরন্ত সংসার! অভাব কিছুই নেই।শুধু একটি মেয়ে ছাড়া।ওই দাদু দিদার মেয়ে নেই,তাই মাসে একবার অন্তত আসতেই হবে আমার মায়ের কাছে।যখন আসবেন পুঁটুলি ভরে আনবেন কত্ত কিছু।
হলুদ কমলাভোগ মিষ্টি মা ভালোবাসে বড্ড।লবঙ্গ লতিকা,একটি করে লবঙ্গ গাঁথা তাতে,বড়ো বড়ো সিঙ্গাড়া,তাতে ফুলকপি বাদামের স্বাদ।একটা থলিতে করে ধুতির কোমরে বাঁধা নোট আর খুচরো টাকা ।নাতি নাতনীদের কাছে আসতেন বলে সব টাকাই খরচ করবেন ভাবতেন।
এসে থাকতেন চার পাঁচ দিন,তার মধ্যে মেলা বসলে আমাদের দিয়েই তাঁর সব খরচ হয়ে যেত।
_ কি দিদিভাই লাল কাঁচের চুড়ি নেবে? আর পুঁতির মালা? ওই একটা ভালুক আছে নাও না?
এই করেই মোটামুটি দিন চার পাঁচের মধ্যে খরচ টরচ করে যাবার দিন মাথা চুলকাতে চুলকাতে মাকে বলতেন- মা রে দশ টা টাকা দিবি?বাস ভাড়া দিতে লাগবে।
মা বকাবকি করতেন আমাদের - কেন দাদুর খরচ করিয়ে দিস এত?
আমাদের থেকেও আরো অপ্রস্তুতে পড়ে যেতেন সেই মানুষ টি।
বিউলির ডাল,একটু ঝিঙে পোস্ত কুমড়ো বড়ি মুলোর টক ভালোবাসতেন।মা অন্য কিছু রান্না হলেও ওই টুকু রান্না করতেন বাড়তি।
কাঁসার থালায় পরিপাটি বাটি চেপে ভাত,একপাশে নুন লেবু,বিউলির ডালের বাটিটা ঢেলে একটু লেবু চিপে নিলেন,তারপর একটু পোস্তর চাখনা মুখে তুলে চোখ বুজিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন।তারপর বললেন - আহা মেয়ে নইলে কি বাপের মর্ম বোঝে কেউ?
শেষ দিকে ছেলেদের নামে দোকান,জমি জমা লিখে দেবার পর আর তেমন কিছু হাতে ছিল না বৃদ্ধের।তখন চেয়ে চিন্তে দশ টা টাকা নিয়ে আসতেন মেয়ের বাড়ি।নিজের লুকোনো কোন পুরানো নারকোল তেলের কৌটো খুঁজে বাজারের সস্তা দোকান থেকে কিনে এনেছেন গজা,তেলচিটে গন্ধের বালুসাই।
সে বহুকাল আগের কথা! বড়ো জেঠিমার মুখে গল্প শুনেছিলাম,তাঁর বোনঝির শাশুড়ির কথা।ভাগের মা তিনি, আশি বছরের বৃদ্ধা।কর্তা বেঁচে থাকতে আদরে সোহাগে ছিলেন।পুকুরের মাছ,তিন পদে রান্না হত।মাছের ঝোল ,ঝাল আর টক।এ বউ ছিল মাছের পোকা।এত টাই মাছ ভালোবাসতেন যে সকলে তাকে বিড়াল বউ বলে ডাকতো।
বিধবা হবার পরও মাছ খাওয়া ছাড়েন নি।যতদিন নিজের হাতে কর্তৃত্ত্ব ছিল,মাছ খেয়েছেন।বউরা কর্ত্রী হবার পর আর তেমন জুটত না। বয়স হচ্ছে,মাছ টাছ খেলে পেট ছাড়বে এই অজুহাতে।পুকুর বিক্রি হয়ে তখন আর তেমন মাছ আসতো ও না।ছেলে পুলে থাকতে বুড়ি কে কে দেয়?
সেদিন বোধ হয় ঘরে কোন পার্বণ উপলক্ষে কুটুম জন এসেছে।মাছ ও কিনে আনা হয়েছে কিছু।সকাল থেকেই ভাবছেন আজ নিশ্চয়ই এক টুকরো মাছ পাবেন তিনি। পটল আলু মাছের ঝোল সাঁতলানোর গন্ধ পেয়েছেন।বড়ো ভালো খাবেন আজ! ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়েছে । কুটুম জনের খাওয়া শেষ।
বৌমা আসন পেতে জল গড়িয়ে দিয়ে গেছে।ভাত, ঝোল আর ঝিঙে ভাজা।ঝোলের বাটিটা টেনে পুরোটা বাটি তেই মেখে নিয়েছেন তিনি। ভেবেছেন বউ বোধ হয় ঝোলে শুধু আলু পটল দিয়েছে,মাছ ভাজা দেবে বোধ হয়। এদিকে বউ কুটুম দের সামনে মাছ ভাজা না দিয়ে শাশুড়ির বাটি তেই একটা ছোট্ট পিস দিয়ে দিয়েছে।সেটা ঝোল আলু পটলের সাথে মেখে দিয়েছে শাশুড়ি। তারপর মাছ খুঁজেছে সে,
_ বউ আজ এক পিস দিবি না আমায়?
_ দিয়েছি তো তোমায় দেখো বাটিতে।
_ কই রে?আমি কখন থেকে আপিক্ষে করছি মাছের লেগে।
বাটিতে টুকরো কাঁটা, ছাল,দু একটা টুকরো দেখে হাউ হাউ কেঁদেছে _
একবার বলে দিলিনা বউ,আমি যে মেখে ফেললাম রে,ওর সোয়াদ আর কি পাব আমি?
কুটুম ঘরের মেয়েরাও মুখ টিপে হেসে বলেছে_ নো লা দেখো বুড়ির। মরতে চললো এখনও লালিসে দেখো।
পাতের কাছে ছড়িয়ে আছে ক্ষুধার অন্ন,ঝোল মাখা এঁটো।আর এক আশি বছরের বৃদ্ধা কেঁদে চলেছে হাউ মাউ করে... এ স্বপ্ন আজও দেখি আমি।
কুন্ডু বাড়ির তুলসী ঠাকুমা একদিন গজা খেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে।তখন শরৎ কাল,পুজোর গন্ধে মিশে গেছে নাড়ুর গন্ধ।মায়েরা মুড়কি করছে,কুঁচি নিমকি,গজা।হাতের লাঠি টি নিয়ে ঠকঠক করে উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে তুলসী ঠাকুমা বলছে_
দিবি লা পাতা,একটা গজা আমাকে? কেউ দেয় না আমায়,বলে পেট ছাড়বে।হ্যাঁ লা বছর কারের জিনিস,পেট ছাড়বে বলে খাব না? বল তুই?
মা স্টিলের প্লেটে দুটো গজা দিয়েছে।ফোকলা মাড়ি তে পাকলে পাকলে সবে মাত্র আধটা খেয়েছে,এমন সময় তুলসী ঠাকুমা র মেয়ে এলো_ মা কি নোলা গো তোমার।দিনরাত কাপড়ে চোপড়ে হচ্ছো।এখনও এত লোভ!
তারপর মায়েদের বলেছে_ এত দরদ যদি,গু মুত ও করবে তো? সে বেলায় তো এই রাই মণি ছাড়া কেউ নেই।
স্টিলের প্লেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে,তারপর টেনে টেনে তাকে নিয়ে গেছে।উঠোনে ছড়ানো প্লেট আর ভাঙা গজা গুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেছে ঠাকুমা।তার ঠোঁটের কাছে তখনও গজার কুঁচি লেগে আছে।
আর শুনেছিলাম বাবার পিসির কথা।তখন খাওয়া জুটত না তাদের,এ বাড়ি,ও বাড়ি ঘুরতেন খিদের জ্বালায়।কারোর বাড়ির মুড়ি কি চিঁড়ে, পান্ত ভাত তুলে আনতেন,এমন এক বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাদের কুয়ো তলা থেকে তুলে এনেছিলেন এক বাটি ভর্তি পায়েস।তাতে দুদিনের ছাতা পড়ে গিয়েছিল।
তাতে কি? এমন অমৃত স্বাদ। ছাড়া যায় নাকি? কবে আর তাদের কে ডেকে এমন বাটি ভর্তি পায়েস খাইয়েছিল কে? তৃপ্তি ভরে খেয়েছিলেন তিনি।পরদিন চল্লিশ বার দাস্ত বমি করে মারা যান তিনি।
আজও যখন পায়েস হয় এ বাড়িতে,বাবা তাঁর পিসির গল্প বলেন। তখন কিসমিস গুলি টোপা টোপা হয়ে ফোটে দুধের সাথে। মাছের ঝোল ফুটে ঘন হলে,একটু গরম মশলা দিয়ে ঢাকা দেন বড় মা,তারপর ঘাম ঘাম মুখ মুছে বলেন_ পুতুর শাশুড়ির মত মেখে ফেলবো বাটিতে,এমন ছোট পিস করেছে।
বিউলির ডাল আর ঝিঙে পোস্ত রাঁধতে রাঁধতে আজও মায়ের চোখে জল গড়িয়ে পড়ে।আর আমি কাঁচের বাক্সে লুকোই দাদুর শেষ বার কিনে আনা লাল কাঁচের চুড়ি,ধুলো পড়ে গেছে তাতে। আর অবসর সময়ে বেশি করে ময়ান দিয়ে পাতলা পাতলা বেলে,একটু ভাঁজ করে নিই ,প্রতি ভাঁজে লুকিয়ে থাকে তুলসী ঠাকুমার ফোকলা মুখের হাসি।ভেজে ফেলি লালচে করে,তখন পুতু দিদির শাশুড়ি এসে হাত পাতে,গরম রসে ফেললে না দেখা পিসি ঠাকুমা উবু হয়ে এসে বসে দুয়ারে। ওদের না পাওয়ার দুঃখ,ছেলে মানুষের মত লোভ আর ভালোবাসা ভবিষ্যতের বেঁচে থাকার দিকে তাকায়...
===============
শাশ্বতী মণ্ডল
ছোটবইনান কালীতলা
পোস্ট_ ছোট বইনান
জেলা_ পূর্ব বর্ধমান
পিন_ 713423
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন