Featured Post
নিবন্ধ ।। মুর্শিদাবাদ জেলার অর্থনীতিতে নদনদীর প্রভাব ।। আবদুস সালাম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মুর্শিদাবাদ জেলার অর্থনীতিতে নদনদীর প্রভাব
আবদুস সালাম
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদ এক উজ্জ্বল নাম। মুর্শিদাবাদ না থাকলে হয়তো আমরা অন্য ভারতবর্ষ দেখতাম। মুর্শিদাবাদ নাম শুনলেই মনের মনিকোঠায় নবাবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। আরও একটা চিত্র ভেসে ওঠে তার হলো ক্ষমতা দখলের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস।
মুর্শিদাবাদ জেলার সর্বপ্রাচীন নাম উত্তির লাঢ়ম বা (উত্তর রাঢ়) ।এর পর গৌড় নগরকে কেন্দ্র করে নাম হয় গৌড় দেশ। গৌড় দেশের পরবর্তী রাজধানী হয় কর্ণ সুবর্ণ। গৌড়ের স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের আমলে সীমানা বিস্তার হয় - পশ্চিমে বানারসী, দক্ষিণে উড়িষ্যা, পূর্বে সমগ্র দেশ হয়ে আসামে গিয়ে ঠেকে।নবম দশম শতাব্দীতে পাল আমলে মুর্শিদাবাদ এর রাজধানী ছিল মহিপাল।দেবপালের আমলে গৌড় দেশের সীমানা ছিল আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত।
গৌড়েশ্বর নাম নিয়ে এরা এখানে ৪০০বছর রাজত্ব করেন। সেন রাজারা ও গৌড়েশ্বর নামেই রাজত্ব কায়েম করেছিলেন।
কালের পরিক্রমায় নাম পাল্টে হয় মৌরসুধাবাদ এবং পরে মৌরসাবাদ। পরবর্তীতে মাসুম বাজার,তার পর মখসুসাবাদ বা মখসুদাবাদ।নানক পন্থী এক সন্ত্রাসী মধুসূদন দাসের নাম অনুসারে নাকি মখসুদাবাদ।১৭০৪ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলের ইতিহাস বলতে নন্দ ,মৌর্য,সুরঙ্গ, কুষান, গুপ্ত যুগের আলো আঁধারির যুগ।গৌড় নগরীর উত্থান, রাজা শশাঙ্ক,কর্ণসুবর্ণের খ্যাতি,পালযুগ,সেন যুগ,সুলতানী আমল, গৌড়ের কাহিনী, পরে নবাবী আমলে সুবা বাঙলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ ।বৃটিশ যুগ এলে শুরু হয় মুর্শিদাবাদ এর পতনের ইতিহাস। এগুলো ই আমরা বুঝি।
কিন্তু ঐতিহাসিকগণ প্রমাণ করেছেন মুর্শিদাবাদের অস্তিত্ব ছিল খৃষ্টপূর্ব পাঁচ শো বছরের ও আগে। অবশ্য এর কোন সুস্পষ্ট দলিল বা স্বীকৃতি নেই।
রাজবৃত্তের উত্থান পতনের কাহিনী মূলত শহর কেন্দ্রিক জীবন প্রবাহের কথা। সমাজে পরজীবী উচ্চবর্গদের কথা আমরা জানি বা পড়ি। জেলার বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ মানুষ শ্রমজীবী। রাজনৈতিক উত্থান পতনের আবর্তে থেকে উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে আছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার যথার্থ উত্তরাধিকার বলতে গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের কথা বলতেই হয় । এরাই তো আসল দেশের রূপকার। নবপ্রস্তর যুগ থেকেই মানুষ পশুপালন, কৃষি কাজ শিখেছে। আর এই কৃষিকাজ মানুষ কে ধীরে ধীরে স্থায়ী বসত গড়তে যুগিয়েছে প্রেরণা। মুর্শিদাবাদের নব্যপ্রস্তর যুগের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ছোটনাগপুরের মালভূমিতে।ছোটনাগপুরের মালভূমির সাথে রয়েছে আমাদের নাড়ীর যোগ।
মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমে গুমানী ,বাঁশলৈ ,পাগলা ,ব্রাহ্মণী ,ময়ুরাক্ষী ,অজয় প্রভৃতি নদী । ছোট নাগপুর তথা সাঁওতাল পরগণার রাজমহল পর্বতমালা থেকে অজস্র প্রবাহ গঙ্গা তথা ভাগিরথী নদীতে গিয়ে পড়েছে।
পৃথিবীর প্রত্যেক সভ্যতা গড়ে উঠেছে এই নদী কে কেন্দ্র করে।যেমন সিন্ধু নদীর তীরে সিন্ধু সভ্যতা, নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। নদী কে কেন্দ্র করেই মানুষের যতো বিচিত্র লীলা সংগঠিত হয়েছে। নদী মানব জীবনে কখনও রূদ্রমূর্তি কখনও স্নেহময়ী। নদী মানুষের ব্যবহারিক জীবনে যেমন নানা প্রয়োজনে মিটিয়ে এসেছে তেমনি আবার সর্বশান্ত করতে ও কুন্ঠাবোধ করে নি।
নদীর সমার্থক শব্দ তটিনী,তরঙ্গিনী,সরিৎ ইত্যাদি। নদী হলো মিষ্টি জলের স্বাভাবিক এক প্রাকৃতিক জলাধারা যা বর্ষার জল, বরফগলা জল অথবা ঝর্ণা থেকে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে সাগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এভাবেই নদীর জন্ম হয়। নদীর গঠন অনুসারে আমরা নদীর বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকি।
নদী কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনপদ।যা এখন বিভিন্ন নগর ও শহর নামে পরিচিত। সাধারণত নদীর নাম মেয়েদের নামের সাথে মিল থাকে।M Moriswa. এর মতে নদী হলো ( River is a canal flow). নদী কে কেউ পথ বাতলে দেয়নি। উচ্চ ভূমি পাহাড় ঝর্ণা থেকে বা গিরিখাত থেকে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠকে ক্ষয় করে শত বাধা অতিক্রম করে নিজের পথ নিজেই বানিয়ে নিয়েছে।
নদী কে ঘিরেই তৈরী হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি শহর,নগর বন্দর, এবং বাজার। শহর বন্দর নগরীর স্বাভাবিক অবস্থা কে সচল রাখতে নদীই ছিল একমাত্র সহায় ও সম্বল।মাল পরিবহন ও সহজ চলাফেরা করতে কম খরচে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাবস্থা।তাই সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ নদী কে বিভিন্ন উদ্যেশে কাজে লাগিয়েছে। একসময় পালতোলা নৌকা বহুল পরিমাণে ব্যাবহৃত হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পালতোলা নৌকার পরিবর্তে ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালু হয়েছে। মাঝ নদীতে জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে।
কথিত আছে হাজার নদীর দেশ হলো আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশে কতো যে নদী আছে এবং তাদের উৎপত্তি ও সমাপ্তি স্থল যে কোথায় তার সঠিক তথ্য নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে ও নেই। বাংলাদেশে নদীর বিচিত্র গতিপথের বর্ণনা আজও মানুষের কাছে অজানা। অনেক গবেষক বলেন বাংলাদেশের নদী উপনদী ও শাখানদী মিলিয়ে ২২৫টি সক্রিয় নদীর হদিশ তারা দেন। বহু নদী এ ওর সঙ্গে মিশেছে , মিশেছে এক নদী অন্য নদীর সাথে । (River erosion hazard study of river ganga up strem of Farakka gangase:) Praveen Kumar Thakur।
অজস্র জলধারা বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত। বড়ো নদী ছোট নদী মিলিয়ে অধুনা বাংলাদেশ ও আমাদের পশ্চিমবঙ্গ মিলে হাজার খানেক নদীর সন্ধান পায়। এতো সব নদী মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে আবার কেউ কেউ তার অস্তিত্ব কে বিলীন করে অন্য নামে বিরাজ করছে।
২০১৩সালের হিসেব অনুযায়ী গঙ্গা নদীর উভয় তীরে ২.৪মিলিয়ন লোক লোক বাস করে।গঙ্গার মূল প্রবাহ ফরাক্কা ব্যারেজের নীচ থেকে জলঙ্গী পর্যন্ত ৯৪কিলোমিটার ব্যাঙ্ক লাইন আছে। এর তীরবর্তী সমস্ত লাইন ভাঙনের কবলে জর্জরিত। জঙ্গীপুর থেকে খানিকটা উজানে এবং ফরাক্কা থেকে ২০কিলোমিটার নীচে গঙ্গার বাম তীর বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর প্রবাহিত।১৯৩১থেকে ১৯৭১সালের মধ্যে প্রায় ২৭.৭৬৯ হেক্টর জমি ভাঙনের কবলে পড়েছে। অনেক গ্রাম এখন ও জলের তলায় নিমজ্জিত।
ভাগীরথী এই জেলাকে দুভাগ করে এগিয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। নদীর পশ্চিম পাড়ের নাম রাঢ় আর পূর্ব পাড়ের নাম বাগড়ী। পদ্মা -ভাগীরথী নদী প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা কে চার ভাগে ভাগ রেখেছে। রাঢ় বাগড়ী বরেন্দ্রভূমি ও বঙ্গাল। পদ্মা, ভাগীরথী নদী মাতৃক বাংলার প্রাণ ধারার মতো। গঙ্গা কিংবা পদ্মার মূল স্রোত কিন্তু ভাগীরথী। সমগ্র বাংলা একসময় নাকি সমুদ্র গর্ভে ছিল। এমন ই ইঙ্গিত প্রত্নতত্ববিদগণ জন সমক্ষে এনেছেন। তখন গঙ্গার সাগর সঙ্গম ছিল দক্ষিণে শক্তিপুরের কাছে ।রাঢ় এলাকা দিয়ে ময়ুরাক্ষী, কংসাবতী,দ্বারকা, ব্রাহ্মণী প্রভৃতি বহু ছোটখাটো নদী ভাগীরথী তে এসে মিশেছে। মুর্শিদাবাদ জেলাতে ও ভাগীরথী নদী দুই বা তিন ধারায় বিভক্ত ছিল।ফল স্বরূপ সমগ্র বাগড়ী এলাকা হয়ে থাকতো জলমগ্ন। বর্ষা নেমে গেলে পলীমাটি বুকে নিয়ে জেগে উঠতো চর বা জমি।পার্শবর্তী নানা জায়গা থেকে লোকজন ছুটে আসতো । চাষ করতো মনের আনন্দে।রাঢ়ের জমি ,বাগড়ীর জমি অপেক্ষা উঁচু। মুর্শিদাবাদ জেলায় কোন পাহাড় না থাকলে ও রাজমহল পাহাড়ের জের এখনও চলে আসছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার মানচিত্রের দিকে তাকালে ঠিক মনে হয় এটি একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ। উত্তর পশ্চিম বাহুটি সাঁওতাল পরগণা , বীরভূম, বর্ধমান জেলার সঙ্গে সীমান্ত রচনা করেছে।অন্য দিকে উত্তর পূর্ব বাহুটি মালদা ও রাজশাহী জেলার সাথে সীমান্ত রচনা করেছে। জঙ্গিপুর শহরের বেশ কিছুটা উত্তরে ছাপঘাটির মোহনায় গঙ্গা ভাগ হয়ে গেছে দুভাগে। দক্ষিণমুখী পূর্ব ও মূখ্য ধারাটি পদ্মা নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে । দক্ষিণমুখী ক্ষীণ ধারাটি মুর্শিদাবাদ জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করে নদীয়া ও হুগলি জেলার ভিতর দিয়ে হুগলি নদী নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
ভাগিরথী ও হুগলি স্রোতধারা সাগর মোহনায় (গঙ্গা সাগর ) দ্বীপের অবস্হান হিসেবে স্বীকৃত এবং এর তীরে নবদ্বীপ, ত্রিবেনীর মতো তীর্থক্ষেত্রের উপস্থিতি এই সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায় যে এখানে গঙ্গা পদ্মার স্রোতধারার অবস্থান ছিল। রেভারেন্ড জেমস লং সাহেব (J A S B1850 Page 538) ১৮৪২সালে বলেন গঙ্গাসাগর দ্বীপের উপর অবস্থিত কপিল মুনীর মন্দিরটি এবং কপিল মুনী ও মাধবের মূর্তি জলের তলায় বিলীন হয়ে যায়। তবে মন্দিরের একটি শিলালিপি থেকে অনুমান করা হয় শিলালিপিটি ৪৩০ কিংবা ৪৩৭ খ্রীষ্টাব্দের ।এর থেকে আমরা সহজে অনুমান করতে পারি এখানে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে মূল ধারাটি প্রবাহিত ছিল। তবে এগুলোর বাস্তব কোন দলিল নেই ।সবই অনুমান নির্ভর।
মুর্শিদাবাদে যে সকল নদী এখন ও নীরবে বয়ে চলেছে তারা হলো,___গঙ্গা, পদ্মা, ভাগীরথী, দ্বারকা নদী, ময়ুরাক্ষী. , জলঙ্গী, ভৈরব,সুতীনা,শিয়ালমারী নদী, কুয়ে নদী।।
খাল বিলের যে অস্তিত্ব আমরা এখন ও দেখতে পায় তারা হলো ____ভাড়ারদহ বিল,ডুমনী বিল ,পাত বিল,তেল কর বিল, দাদপুর বাঁওড়,আহিরন বিল, সুজাপুর, দামোস, বসিয়ার বিল,আয়েস ঘাট বিল, চালতিয়া বিল , পাগলা দাঁড়া,খয়রামারা বিল।
ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪১ সালে দেশ ভাগ করেছেন। আন্তর্জাতিক প্রভাবে ও পুঁজিবাদ ব্যবস্থা অনুসরণের ফলে ৯০ঐর দশকে ঢালাও ভাবে নদী ধ্বংসের বিড়ম্বনা বেহাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর দাঁড় করিয়েছে। এর তিনটি মূল কারণ একত্রিত হয়ে নদী গুলির করুণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। হিমালয় থেকে জল এসে স্বাভাবিকভাবে সাগরে মিলিত হতে পারে না। ফলে মরুকরণ শুরু হয়েছে , কৃষিখেত ধ্বংস, মৎস সম্পদ নির্মূল, মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক দূষণ,জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস, পরিবেশ ভারসাম্য হীন হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেখা দিয়েছে বেকারত্ব , উদ্বাস্তু সমস্যা,অকাল বন্যা ইত্যাদি। জনজীবনে নেমে এসেছে করাল ছায়া। জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে উঠেছে।
মিঠা জলের উৎস হলো নদী আর লবনাক্ত জলের উৎস হলো সমুদ্র। সমুদ্রের উত্তাল গর্জন যেন স্তব্দ করে দিতে চাইছে চলমান জীবন।
মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো নদী ভাঙ্গন সমস্যা। ফারাক্কার বাঁধ তৈরি হওয়ার পর বহরমপুরের কাছে ভাগীরথীর জলস্তর উঠে যায় এগারো মিটার আর নবদ্বীপ এর কাছে নয় মিটার। নদী বিজ্ঞান একে বলে হাইড্রোলিক ড্যাম।
একদিকে জলঙ্গী নদীর চাপ অন্যদিকে কাটোয়ার কাছে অজয়ের চাপ। দুই নদীর চাপ মিলে মুর্শিদাবাদ এর নদী ভাঙন কে তীব্রতর করে তুলেছে। জঙ্গীপুর মহকুমায় এর ব্যাপকতা আরও বেশি। অতিরিক্ত বৃষ্টির জল ফারাক্কার বাঁধ ধরে রাখতে পারে না। আবার ফারাক্কা জল ছাড়লে ই সরাসরি ধাক্কা মারে আখেরি গঞ্জ ট্রলিতে। নদীর জল বেশি হলে জল ঢুকে পড়ে বালিতে। আবার জল নেমে গেলে বালি সমেত চলে আসে। শুরু হয় ভাঙন।
তাই পাগলা ,বাঁশলৈ,মাধবজানি,গুমানী নদীর জল ধরে রাখার ব্যাবস্থা অতীব জরুরি। গঙ্গা দূষণ গঙ্গা তীরবর্তী বসবাসকারী কয়েক কোটি মানুষ সহ একশো চল্লিশ রকমের মাছের প্রজাতি ও শুশুকসহ তিন শো রকমের উভচর প্রাণীর পক্ষে বসবাস করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে।
নদী গুলো যেন কত কালের পুষে থাকা রাগ দিয়ে বদলা নিতে বদ্ধ পরিকর। অজগরের মতো গিলে নিচ্ছে সব বাড়ি ঘর জমি জায়গা মন্দির মসজিদ গির্জা। গ্রাম কে গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে সবাই। দিশেহারা মানুষের দল পালাতে বাধ্য হচ্ছে পৈতৃক জন্ম ভিটে ছেড়ে। কালোখালী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে বাগড়ী অঞ্চলের লোকজন বাস্তুহারা হয়ে এদেশে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।আখ্যায়ীত হচ্ছে পারিযায়ী শ্রমিক হিসেবে ।
লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি শ্রমিকদের দুর্দশা। এদের বেশিরভাগ পরিবারই নদী দ্বারা আক্রান্ত। নিজেদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে হয়ে গেছে রাজমিস্ত্রি, রিক্সা চালক, কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মুর্শিদাবাদের অর্থনীতি কে ধরে রেখেছে বিড়ি শিল্প।এই শিল্পের বেশিরভাগ শ্রমিক নারী। নারীরাই ধরে রেখেছে তাদের ক্ষয়ে যাওয়া অর্থনীতির অনেক অংশ। পুরুষেরা বিদেশে যায় পারিযায়ী শ্রামিক হিসেবে। বাড়ির মেয়েরা ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া,অসুখ বিসুখ ,সংসার সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে থাকে। ভঙ্গুর অর্থনীতি মাথায় নিয়ে বেঁচে আছে নদী ভাঙ্গনে বাস্তুচ্যুত মানুষের দল । হয়তো তাদের দিন চলে যায় কিন্তু শিক্ষা দীক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে তারা। পেটের তাগিদ ও বাঁধন ছাড়া শৈশব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠছে । পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার আঙিনা থেকে। এজন্যই তো মুর্শিদাবাদ সবচাইতে পিছিয়ে পড়া জেলা গুলির অন্যতম জেলা । এক সময় এই জেলায় বাস করতো নবাবগণএবং আমরা যে সেই জেলার লোক এই কথা বলতে গিয়ে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আমরা ছিলাম কি আর হয়েছিই বা কি?
জেলায় কোনো কলকারখানা নেই। তবে এই জেলাকে দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করে দেয় বিড়ি শিল্প।। মূলত ফরাক্কা ,ধুলিয়ান,জঙ্গীপুর, লালগোলা এলাকায় এই শিল্পের কর্মক্ষেত্র। জলঙ্গী,হরিহর পাড়া, ইসলামপুর,জিয়াগঞ্জ, লালগোলা, ভগবানগোলা, কাবিলপুর প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপক পাটচাষ হতো। গ্রামীণ অর্থনীতি তে পাটচাষীরা প্রভূত লাভবান হতো। কৃষিকে হাতিয়ার করে অর্থনীতি তে যখন জোয়ার আসতে শুরু করেছে তখন নদী আচমকা ফুঁশে ওঠে গ্রাম কে গ্রাম গিলে নিচ্ছে। হাহাকার রবে ভরে উঠছে আকাশ বাতাস। মুর্শিদাবাদের কিছু নিজস্ব শিল্প যা বাজার অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতো সেই সকল বিশেষ শিল্প যেমন কাঁসা পিতলের বাসন তৈরী,হাতির দাঁতের কাজ,রেশম শিল্প ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদের রেশম শিল্পের বিশেষ করে মির্জাপুরের তাঁতিদের খ্যাতিতো বিশ্বজোড়া । নতুন নতুন মেশিন আসার ফলে তাঁত শিল্পের এখন করুন দশা । নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের দিকে ঝুঁকতে চাইছেনা। অর্থনীতি তে আসছে অন্য সুর ।পাল্টে যাচ্ছে জীবন যাপনের প্রচলিত ধারা।
অদূরে ভাগীরথীর পাড় দিয়ে বিশেষ করে বাগড়ী অঞ্চলে তে বিপুল পরিমাণ সব্জী চাষ হতো তা দিন দিন কেড়ে নিচ্ছে ভাগীরথী।পদ্মার ভাঙনে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে কালোখালী, ঐতিহাসিক গিরিয়া সেকেন্দ্রা ইত্যাদির মতো বহুজনপদ। এদিকের এক গৃহবধূ বিলাপের সুরে বলে চলেছেন "আল্লাহ এই পদ্মা হামাদের কেঢ়্যা লিয়্যাছে বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি। হামাঘো জমি জিরেত সব খেলি রে পদ্মা।অ্যাখুন কুনঠে যাবো ,কিরে খাবো, একগুন্ডা ছেল্যামেয়্যা নিং কি যে করবো । আল্লাহ তুমি দিশ্যা দ্যাও।"চোখের জলে ভেসে যায় তাদের বুক। একদিকে গঙ্গা এপারে ভাগীরথী আপন গর্ভে টেনে নিচ্ছে গ্রাম কে গ্রাম । এভাবেই সর্ব শান্ত হয়ে চলেছে বহু পরিবার। উদ্বাস্তু হয়ে বাসা বাঁধছে যে যেখানে সুবিধা পাচ্ছে। নদী মুর্শিদাবাদ জেলার মানচিত্রে ভাগাড় স্বরূপ।নবাবী আমলের সব ঐতিহ্য কে বিলীন করে দিচ্ছে। নদী আমাদের জীবনে আশির্বাদ নয় অভিশাপ।এর ফল স্বরূপ প্রতিটি ঘরে আজ পারিযায়ী শ্রমিক এর বাড়বাড়ন্ত। ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যে গেলে দেখা মিলবে মুর্শিদাবাদের পারিযায়ী শ্রমিকদের।
পরিশেষে একথায় বলা যেতে পারে মুর্শিদাবাদের অর্থনীতি তে জোয়ার আনতে গেলে নদী ভাঙ্গনের মোকাবেলা করা একান্তই প্রয়োজন।
আর প্রয়োজন নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন।
################
আবদুস সালাম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
অনবদ্য সংখ্যা।আষাঢ়স্য শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুন