কাকলী দেব
অনিমা পাঁচ মাস ধরে কাজ করছে এই দিদির বাড়ীতে। দিদির ব্যবহার বড্ড ভাল। মিথ্যে কথা বলতে গেলে একটু খারাপই লাগে। কিন্ত অনিমা জীবনে ঠোক্কর খেতে খেতে শিখেছে, এবং সম্যক বুঝেছে যে এই সব আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং এর বড় বড় বাড়ীতে থাকা লোকগুলো আসলে তাদের জাতশত্রু ! এদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা শুধু টাকার। এরা সব কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক। মুখে মিস্টি ব্যবহার করে আর তাদের আসল প্রাপ্য টাকার অঙ্ক কমিয়ে দেয়। যতদিন বরের কাজ হয়নি ততদিন তার করুন মুখের কাঁদুনি দিদিকে অনেক শুনিয়েছে। দিদিও কত সমবেদনা জানিয়েছে! বসে বসে তার কথা শুনেছে, তাকে সকালের জলখাবার আর দুপুরের গরম ভাত দিয়েছে, তার সঙ্গে, নিজেরা যা খেয়েছে তাই খাইয়েছে। কিন্ত চেনে না তো অনিমাকে! সে শুধু সময়ের অপেক্ষা করেছে কবে বর কাজ পাবে আর সে ও দিদিকে তার আসল রূপটা দেখাবে।
আজ যেন সকাল থেকেই দিদি কাজ নিয়ে একটু বেশীই কথা বলছে, অন্যদিন তো কোনও কিছুই বলে না। অনিমা কে বিশ্বাস করে পুরো সংসার ছেড়ে দিয়েছে! দিদির আবার লেখালেখি আছে, তাই সকাল থেকেই হয় বই পড়ছে নাহলে কিছু লিখছে খাতায়। নয়তো ল্যাপটপ খুলে গম্ভীর ভাবে কিসব দ্যাখে। আজ যখন অনিমা গজগজ করতে করতে ঘর মোছার জল নিচ্ছে তিন নম্বর বাথরুম থেকে তখন হঠাৎ উঠে এসে দিদি আলতো হেসে জিজ্ঞেস করে, "কি হল, তুমি সারভেন্ট রুমের বাথরুম থেকে জল নিচ্ছ না কেন?"
"ঐ বাথরুমটা কী নোংরা, আপনি দেখে আসুন গিয়ে!" ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে অনিমা। "মিস্ত্রি রা একদম নোংরা করে রেখেছে, আমি কী করে ওখান থেকে জল নেব?"
সুতপা মানে অনিমার কাজের বাড়ীর দিদি বলে, "ও আচ্ছা, তাহলে তো ওদের বলতে হবে, অনিমা, তুমিও বোলো, আমিও বলে দেব। এরপর সুতপা নিজেই যায় দেখতে, সারভেন্ট রুম সার্ভে করতে, কিন্ত অনেক খুঁজেও কোনও নোংরা চোখে না পড়ায়, আবার এসে অনিমাকে বলে, "অনিমা, নোংরা কোথায়, বেশ তো পরিস্কারই দেখলাম! অনিমা ঘর মুছতে মুছতে কড়া ভাবে বলে "না, নীচে মেঝেতে পায়ের ছাপ!" বিস্মিত ভাবে সুতপা বলে, "ওটুকু তো থাকবেই, দ্যাখো, ওরা ব্যবহার করছে তো!"
বরের কাজ ছিল না গত দুবছর ধরে। আজ হঠাৎই খবর এল একটা কাজ জোগাড় হয়েছে। একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন সোসাইটির রাতের গার্ডএর চাকরী। যে রকম টি তারা চেয়েছিল। তাদের ন বছরের ছেলের দেখভালে তাহলে সুবিধে হয়! অনিমা দিনে কাজে বেরোবে আর বর রাতে! ছেলেই হল তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান, ছেলেকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন এখন। আর শ্বশুরের করে যাওয়া এই বাড়ী টাকে সে নিজের প্রাণের থেকেও বেশী ভালবাসে। বিয়ে করেছিল চন্দনকে ভালবেসেই। কিন্ত আজ তার সমস্ত ভালবাসার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে এই বাড়ী খানা আর তার ছেলে। কুড়ি বছর বয়সে চন্দনের সঙ্গে ভালবাসা করে বিয়ে। তার চোখে চন্দন আজও রাজপুত্র! কসমেটিক্সএর দোকানে সেলস গার্ল এর একটা কাজও করছিল তখন অনিমা। ক্লাস টেন পাস হওয়াতে কাজ পেতে সুবিধে হয়েছিল। তার বাপের বাড়ির ওখানে সরকারী স্কুলে ক্লাস টেন পর্যন্ত অনিমা রীতিমত ভাল ছাত্রী ছিল।
স্কুলের সব ফাংশানে অনিমা যোগ দিত, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বরাবর প্রাইজ পেত।রবীন্দ্রনাথের কত কবিতা এখনও তার মুখস্থ। আজও সে বাড়ীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া কিছু শোনেই না। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করে সে ইলেভেনে ভর্তি হবে, ঠিক তখনই বাবা মারা গেল। দাদা তাকে খুব ভালবাসত কিন্ত সদ্য বিবাহিত দাদার জীবনে তখন বৌদির কথাই শেষ কথা। তাই তার আর পড়াশুনা করা হল না। মাকে আর তাকে তবুও কখনও খাওয়ার কষ্ট পেতে হয়নি। দাদা সিপিএম করত তখন, সমাজ তন্ত্র আর শ্রেণীশত্রুদের কথা সেও তখনই শুনত দাদার মুখে! সমাজের সমস্ত মানুষের সমান হওয়ার গল্প শুনতে তার খুব ভাল লাগত। এখন অবশ্য দাদা তৃণমূল, তবে সেই গরীব মানুষেরই পার্টি! অনেক টা একই কথা বলে ওরা। তাই তো অনিমার বাপের বাড়ী আর শ্বশুর বাড়ির সব লোকই 'দিদি' কেই ভোট দ্যায়।
রোজ সকালে এই দিদির বাড়ী আসতে তার নির্ধারিত সময়ের থেকে সবসময়ই দেরী হয়! যখন কাজে লেগেছিল তখন করোনা তার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়বে পড়বে অবস্হা! ঠিক পনেরো দিন কাজ করিয়ে দিদি বলল," থাক না হয় কিছুদিন, তুমি আবার পরে এস" ,কিন্ত বসিয়ে বসিয়ে তাকে পুরো এপ্রিল মাসের মাইনে হিসেবে হাফ স্যালারি দিল। তার আগেই, সে যাতে কোভিডের গা বাঁচিয়ে কাজে আসতে পারে, সেজন্য সাইকেল কেনার জন্য লোন দিল পাঁচ হাজার। সেই লোন মাসে পাঁচশো টাকা করে কাটে।
সেই দিদি র সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে গেল আজ।
সুতপা এবার বলতে এসেছিল, "অনিমা, তুমি, বারান্দায় যে জল ঢেলেছ, সেটা একটু ওয়াইপার দিয়ে টেনে দিও, কেমন! কারণ জল থাকলে আমরা যে কেউ,বারান্দায় যেতে গিয়ে পড়ে যেতে পারি, আর জলের দাগ ও থেকে যায় শুকিয়ে গেলে!" এই কথা শুনেই গেল অনিমার মাথা গরম হয়ে! এত বড় বড় বারান্দা মুছতে কত কষ্ট হতে পারে সেটা এই বড়লোক মহিলা কি বুঝবে! একটু কষ্ট কমানোর চেস্টায় বুদ্ধি খাটিয়ে জল ঢালার উপায় যে সে বার করল, তা এনার সহ্য হল না! কঠিন থমথমে মুখে নিজের শেষ কাজ, কাচা জামা কাপড় মেলা, সেটা সারল, তারপর দুমদাম পা ফেলে রান্নাঘরে ঢুকল।
ইদানীং বাড়ীতে কাঠের মিস্ত্রীরা কাজ করছে বলে তাকে প্যান্ট্রির ঘুপচি ঘরে ঢুকে জামা বদলাতে হয়! সকালে এসে একবার বাইরের জামা ছেড়ে নিজের আনা ম্যাক্সি পড়ে আবার কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় আর একবার চেঞ্জ করে। যত্তসব বড়লোকি ব্যাপার স্যাপার এত কাপড় ছাড়াছাড়ির সময় আছে নাকি! তবে সে আবার নিজেই কিনা একটু পিটপিটে বাতিকগ্রস্ত, তার নিজের বাইরের জামা যাতে কাজ করতে গিয়ে খারাপ না হয় , তাই এই ব্যাপার মেনে নিয়েছে!
নিজের চুড়িদার পরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সে বাইরের দরজার সামনে এসেছে, দিদি তখন তাকে দেখে অবাক, "একি, কোথায় যাচ্ছ তুমি? ভাত বেড়ে রেখেছি তো!"
"না, আমি খাব না, আমার ভাল লাগছে না!"
অনিমা বোঝে, দিদিকে একেবারে মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছে! এবার বুঝবে, অনিমার পেছনে লাগার, তার কাজের ব্যাপারে কথা বলার ফলটা!
দিদি দৌড়ে আসে, ততক্ষনে সে মেন দরজার বাইরে, কিছুটা যেন মিনতি করার ভঙ্গি, "খেয়ে যাও অনিমা, বাড়া খাবার ফেলে রেখে যেওনা। "দিদির মুখে বিস্ময়ের ছাপ, গলায় অনুরোধের সুর। ঠিক এটাই তো চাইছিল অনিমা, এদের এইসব লোকদেখানো মিস্টি কথার পেছনে আছে খালি তাদেরকে খাটিয়ে মারার অভিসন্ধি!
না, আজ একটু শিক্ষা দেবে এই মহিলাকে! রাস্তাঘাটে ফক্কর ছেলেরা যখন তার পেছনে লাগতে আসে তখন আচ্ছা কষে তাদের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার অভ্যাস তার!
সেই একই ভাবে দিদির রোজ রোজ মিষ্টি কথা বলার, তাকে কেবলই, খাও খাও বলে খাওয়ানোর ভরং আজ বার করবে! তাকে ছাড়া যে দিদির চলবে না, এটা দিদির ও বোঝা উচিত! তাই অকারন, তার কাজের খুঁত ধরতে এলে এই অবস্হাই হবে।এবার, গটগট করে ব্যাগ কাঁধে অনিমা লিফটে র দিকে এগোয়, পেছনে দিদি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাড়ী ফিরে তার বর চন্দনের সঙ্গে বসে পরামর্শ করে। আয়েশ করে বেঁচে থাকা র একটা জন্মসিদ্ধ অধিকার আছে চন্দনের । তার বাবুগিরি র জোগান এখন দিচ্ছে এই অনিমা ই ।বছর দুয়েক বউ ই রোজগার করে সংসার খরচা চালাচ্ছে ,তাদের টালির চালের দুকামরার এই বাড়ী টাকে বুক দিয়ে আগলাচ্ছে ,তাদের ছেলে কে তোলা তোলা করে মানুষ করছে! রোজ সকাল থেকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে, মুখে স্বীকার না করলেও,কথা টা তো ঠিক! কাজেই মুখরা অনিমা কে সে রীতিমত ভয় পায়। সবে একটা নতুন চাকরীর সম্ভাবনায় সে ও বেশ উত্তেজিত এখন!,"বেশ করেছ বলেছ! মাঝে মাঝেই তুমি যে ওদের বাড়ী থেকে ডাব্বা করে করে মাছ ,মাংস , পোলাও ফ্রায়েড রাইস এনেছ, সে তো তোমারই খাটুনীর ফল,ঐসব বাড়তি খাবার তোমাকে দিত বলে কি তোমাকে কিনে ফেলেছে?" "দিদি কে বল এবার মাইনে বাড়াতে। পাঁচ মাস হয়ে গেল, আর কত কম টাকায় কাজ করবে?চাপ দিতে শেখো, এরা তো নিজেরা কাজ করতে পারেনা, এখন তোমাকে ছাড়া দিদির চলবে নাকি?"
সুতপা, সারাদিন ধরে ঘটনার অভিঘাতে মূহ্যমান! কি হল, কেন অনিমা এরকম করল, সে কি তাহলে ওকে আঘাত দিয়ে ফেলেছে কোনও কথার মাধ্যমে? এই চিন্তা করে যাচ্ছে সে। ওর জন্য বেড়ে রাখা খাবার শেষে আজ ফেলে দিল সব।জীবনে সে খাবার ফেলে নি। সন্ধ্যে বেলা অনিমার ফোন এল।
অনিমা বলতে লাগল, "দিদি, আমি আপনাকে এতদিন 'কনসিডার' করেছি, এখন মাইনে না বাড়ালে আর কাজ করতে পারব না ।"
সুতপা বলল, "অনিমা, আজ তুমি যা করলে, তাতে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। কোনদিনও কি তোমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি?"
অনিমার রুক্ষ স্বর ভেসে আসে, "সেটাই তো আপনার 'প্রতিভা' ! খারাপ ব্যবহার না করা !"
"কি বলছ তুমি, প্রতিভার জন্য করিনি, মন থেকে ভালবেসেই করেছি।"
"মাইনে তো বাড়ানোর কথাই ছিল ছ'মাস পর থেকে, কিন্ত তুমি আজকে এরকম করলে কেন? বাড়া খাবার ফেলে চলে গেলে! রোজ খেয়ে যাও অথচ আজ, কী এমন হল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ! মাসের মধ্যে সাতদিন তোমার কামাই বাঁধা, রোজ তোমার কিছু না কিছু শারীরিক প্রবলেম থাকে। আমি এ মাসে যে ছিলাম না পাঁচ দিন, তোমাকে ডাক্তার দেখাতে বলে গেলাম, সেই সময়ে ,তুমি সেটা না করে বাপের বাড়ী বেড়াতে চলে গেলে, আমার গাছ গুলো সব শুকিয়ে গেল, তোমাকে বলেছিলাম দুদিন বাদে বাদে এসে একটু জলটা দিয়ে যেতে!"অনিমা র মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে, দিদির ভাষণ শুনতে শুনতে, ইচ্ছে করছে ফোনটা কেটে দিতে! পাশ থেকে চন্দন ও ইশারা করছে, ফোন কেটে দেওয়ার জন্য। তাই করল সে। মনে হল, আর একবার জিতে গেল!
রাতে খেতে বসেছে, তখন চন্দনের মোবাইলে ফোন এল দালালের, যে চাকরী টা হবার কথা ছিল, সেটা পেতে গেলে পাঁচ হাজার টাকা আগে ঘুষ খাওয়াতে হবে, নাহলে হবে না!
অনিমা আর চন্দনের খাওয়া মাথায় উঠল, একটু আশার আলো যাও বা দেখা গেছিল, সেটাও নিভে গেল। হঠাৎ এখন এত টাকা কোথায় পাবে, দিদির কাছে আর চাইলে কি দেবে, সাইকেল কেনার লোন ই শোধ হয়নি। তাহলে আবার সেই দিদি র কাজের মাইনে ই ভরসা করে সংসার চালাতে হবে। মাইনে হিসেবে সেটা ভালই আবার অনিমা র দুবেলা র খাওয়া খরচ টা ও বেঁচে যায় ঐবাড়ীতে।। তবে কিনা আজকাল কার দিনে তাদের ও তো অনেক ঠাট বাট বজায় রাখতে হয়! টিভি, গ্যাস, ফ্রিজ তাদের ও আছে আর তার পেছনে খরচা ও কিছু কম নয়।মোবাইল এ নেট নিতে হয়, 'হোয়াটস অ্যাপ','ফেসবুক' আর 'ইউ টিউব' দেখতে হয়।
তাদের মত মানুষের বারে বারে তাই ফিরে যেতে হয় তাদের 'শ্রেণীশত্রু' দের কাছে। তারা কিছুতেই কেন সমান হতে পারেনা? অনিমা আর চন্দন মণ্ডল ,স্বপ্ন দেখতে শিখেছে কিন্ত সেই স্বপ্ন পূরণের রাস্তা টা তাদের জানা নেই।
===========
কাকলী দেব, কলকাতা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন