বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ:
বঙ্গে শৈব থেকে বৈষ্ণবীয় ধারার ভাবান্তর
সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়
১
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে বাংলায় পাল রাজবংশের প্রভাব স্তিমিত হতে থাকলে সেন বংশের আধিপত্যের উদয় ঘটে। সেনরাজা বিজয় সেন হুগলী জেলার ত্রিবেণীর নিকট তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। নামও দেন তাঁর নামানুসারে 'বিজয়পুর।' প্রসঙ্গত, পূন্যতোয়া ত্রিবেনীতীর্থের গঙ্গাতীরের আধ্যাত্ম রম্যতা এবং নিকটে সপ্তগ্রামের নৌ-বানিজ্যের সুবিধার্থেই এই বিজয়পুরের পত্তন। পরবর্তী সময়ে রাজা হন বল্লাল সেন। 'দানসাগর' এবং 'অদ্ভুতসাগর' গ্রন্থের প্রনেতা এই নৃপতি অত্যন্ত প্রতিভাধর ও সুপণ্ডিত ছিলেন এবং সেই ধারা আরও বেশি সম্প্রসারিত হয় লক্ষ্মণ সেনের সময়কালে। কারণ, লক্ষন সেনের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন পঞ্চরত্ন উমাপতি ধর, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন আচার্য এবং জয়দেব। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকাল ১১৮৫ - ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তারপরই তুর্কী আক্রমণ। শুরু হয় অন্ধকার যুগ; বাংলা সাহিত্যের ভাবধারার এক পট পরিবর্তনের সূচনা।
প্রাচীন যুগের বাংলা ভাষার সাহিত্যিক নিদর্শন 'চর্যাপদ' আর মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।' একটি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনতত্ত্ব এবং অপরটি কৃষ্ণ-রাধা বিষয়ক নাটগীতি। এর মাঝামাঝি যে অন্ধকার রাস্তা তার নিরিখেই কি সাহিত্যের এই বিবর্তন? নাকি বাংলা সাহিত্যের অভিমুখ পাল্টাতে শুরু করেছিল পূর্ব থেকেই। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য তুর্কী আক্রমণের পূর্বে সেন বংশের প্রথম যোগ্য নৃপতি ছিলেন বিজয় সেন। 'সেকশুভোদয়' থেকে জানা যায় তিনি প্রত্যহ শিবপূজা না করে জল গ্রহণ করতেন না। আবার তাঁর পুত্র বল্লাল সেন, তিনিও শৈব ছিলেন। কারন তাঁর আবিষ্কৃত তাম্র শাসনে 'ঔঁ নম: শিবায়:' নামক মহাদেব বন্দনা পরিলক্ষিত হয়। অথচ তার পরবর্তী কিছু সময় পরই পুত্র লক্ষ্মণ সেন পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত শৈবতাকে ছেড়ে আকৃষ্ট হন বৈষ্ণবীয় ভাবধারায়। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি মত ও প্রমাণ প্রনিধানযোগ্য—
১. "লক্ষন সেনের সভায় কৃষ্ণলীলা কাহিনীর বিশেষ সমাদর ছিল।" (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস— সুকুমার সেন / ১ ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯২)
২. তাম্রশাসন গুলিতে লক্ষ্মণ সেন "পরম বৈষ্ণব", "পরম নরসিংহ" প্রভৃতি বিশেষনে বিভূষিত হয়ে ছিলেন দেখতে পাওয়া যায়। (হুগলী জেলার ইতিহাস— সুধীর কুমার মিত্র, পৃষ্ঠা ১৪৩)
এছাড়া, লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে জয়দেবের গীতগোবিন্দের অবতারণা, যা বৈষ্ণবীয় ভাবধারার সব থেকে বড় নিদর্শন। কিন্তু কীভাবে ঘটল এই ভাবধারার বিবর্তন তা রীতিমতো আলোচ্য একটি বিষয়।
২
আসা যাক, আলেকজান্ডারের সময়কালে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে দিগ্বীজয়ী বীর আলেকজান্ডারের 'পঞ্চনদ' আবিষ্কারের পর তাঁর কাছে খবর আসে 'গঙ্গরিডয়' (Gangaridae) নামক এক সমৃদ্ধ শক্তিশালী রাজ্যের। যার রাজধানী বাণিজ্য নগরী 'গাঞ্জী।' এই 'গঙ্গরিডয়' রাজ্যই 'বঙ্গদেশ' এবং এর রাজধানী 'গাঞ্জী' হল 'সপ্তগ্রাম।' আবার এই সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ 'গঙ্গা-কুন্তী-সরস্বতী'র মিলনস্থল 'ত্রিবেণী' তীর্থের পাশেই অবস্থিত। সপ্তগ্রাম লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে মুরারি শর্মার আয়ত্বে ছিল বলেও জানা যায়। কবি কৃষ্ণরামের 'ষষ্ঠীমঙ্গল' কাব্যে দেখি —
"সপ্তগ্রাম যে ধরণী তার নাহি তুল।
চালে চালে বৈসে লোক ভাগিরথী কূল
শক্রজিৎ রাজার নাম তার অধিকারী।
ঠিকরয়ে কতগুন বলিতে না পারি।"
অর্থাৎ, সপ্তগ্রামের শক্রজিৎ বংশীয় রাজার রাজত্বকালের প্রমানও মেলে সেই সময়। তবে এও সত্য ১২৯৮ খ্রি. জাফর খাঁ সপ্তগ্রাম অধিকার করে নেন। ত্রিবেণী এবং সপ্তগ্রামের দুটি দেবমন্দির তিনি ধ্বংস করে মসজিদে পরিণত করেন। পরবর্তী কালে ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করলে ওই স্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। যা বর্তমানে 'জাফর খাঁ এর দরগা' নামে খ্যাত। এই জাফর খাঁর সাথে পূর্বতন 'গঙ্গরীডয়' এর প্রসিদ্ধ জনপদ 'মহানাদ' এর একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে। জাফর খাঁর পূর্ববর্তী সময় থেকেই বঙ্গে তুর্কীর আক্রমণ এক আমানিশা ডেকে আনে বঙ্গের বুকে। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সবিশেষ বৃদ্ধি পায়। মহানাদের অদূরে অবস্থিত পাণ্ডুয়া ছিল দিল্লীরাজ জালালুদ্দিন খিলজি ফিরোজ শাহের ভগ্নীর অধিনস্থ আবাস। আর পাণ্ডুয়ার হিন্দুরাজা সেই সময় বাস করতেন মহানাদে। জাফর খাঁ ফিরোজ শাহের ভগ্নীকে সাথে নিয়ে সেই সময় পাণ্ডুয়া ও মহানাদকে মুসলমান কারায়ত্ত করেন। আসলে, মহানাদ ছিল চিরকালীন 'নাথ-শৈব' সাধনার পীঠস্থান। জাফর খাঁ এর আক্রমণে মহানাদে যে শৈব সাধনার প্রাচুর্য ছিল তা ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়ে বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু চিরকালীন নাথ-শৈব সাধনার এই পীঠকেন্দ্র জাফর আক্রমণের পরই ম্লান হয়ে আসে নাকি তুর্কি আক্রমণের পূর্বে প্রাচীন যুগেই উক্তস্থান সহ 'বঙ্গ' প্রদেশে নাথ-শৈব সাধনা ফিকে হয়ে আসে এনিয়ে গবেষণার অবকাশ থেকে যায়। আর এই প্রসঙ্গে শৈবধাম মহানাদ প্রসঙ্গও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
'মহানাদ' জনপদ যোগ সাধনার মহাক্ষেত্রে পরিনত হয়েছিল যোগাচার্য্যের সময় থেকে। পরবর্তীকালে বশিষ্ঠনাথ 'নাদ বিন্দু' যোগসাধনার জন্য এই মহাক্ষেত্রে আসেন এবং জীবন্ত সমাধি নেন। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রভাস চন্দ্র পালের 'নাথতীর্থ মহানাদ' গ্রন্থে এই তথ্য বিবৃত হলেও সত্যাসত্য নিয়ে কিঞ্চিত সংশয়ের অবকাশ থেকে যায়। তবে বর্তমানে মহানাদে যেখানে জটেশ্বর নাথের শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত সেখানের স্তম্ভাকৃত শিবলিঙ্গটি গুপ্তবংশীয় সম্রাট প্রথম কুমার গুপ্তের রাজত্বকালে বলে প্রমাণিত হয়। আর জটেশ্বর মন্দিরটি সম্ভবত যোগীরাজা মহেন্দ্রনারায়নের সময়কালের। সুধীর কুমার মিত্রের মতে "দেশাবলী বিবৃতি গ্রন্থে যোগীরাজা মহেন্দ্রনারায়ণের নাম লিখিত আছে, সম্ভবত তিনি এই মন্দিরের একজন মোহান্ত ছিলেন এবং সাথে মহানাদ শাসন করতেন। জটেশ্বরনাথের মোহান্তগন নাথপন্থী। তাঁরা গৈরিক বসন পরিধান করতেন এবং বিবাহ না করে চিরকুমার থাকতেন।" অর্থাৎ মহানাদ নগর যে প্রকৃতই বঙ্গের 'শৈব' ধর্মের অন্যতম সেরা পীঠস্থান একথা স্বীকার্য। পাশাপাশি নাথযোগীরা কালের অন্তরালে নাথশৈব ঘেঁষা হয়ে বৈদিক-সনাতনে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে; যা গোটা বঙ্গদেশ জুড়েই পরিলক্ষিত হয়। (প্রসঙ্গত "কর্ণাটে দ্বাদশ শতকে নাথপন্থী বাসব কর্তৃক বীর শৈব মত প্রচারিত হয় এবং নাথেরা যে শৈবই ছিলেন একথা স্পষ্ঠ হয়ে ওঠে।"— নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধনপ্রণালী, শ্রী কল্যানী মল্লিক।) কিন্তু, প্রশ্ন হল এই শৈব ধর্মের প্রাচুর্যতা হারিয়ে গিয়ে বঙ্গে বৈষ্ণবীয় ভাবধারা আগমনের প্রকৃত কারন কি? উপরন্তু সেন সাম্রাজ্যের রাজধানীর অনতিদূরে মহানাদের মতো ঐতিহ্যশালী এমন একটি শৈবপীঠ থাকা সত্ত্বেও কেন এই ভাবান্তর! এই প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক সত্যবতী গিরির দুটি মত উত্থাপন জরুরি হয়ে পড়ে—
১. "একই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বীকৃত দুই দেবতা শিব ও বিষ্ণু। শৈব সেন বংশের কৌলিক ঐতিহ্য ত্যাগ করে লক্ষন সেনের বিষ্ণুতে প্রবনতান্তরনের পিছনে সময়কালের কতখানি প্রভাব ছিল তা হয়তো প্রমানের অভাবে অনুমানের বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমাদের ধারণা তেমন কিছু প্রভাব নিশ্চয়ই ছিল।" (বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ, পৃষ্ঠা- ৬০)
২. "আমরা অনুমান করি সেই কারণটি হল আগে থেকে কৃষ্ণকথা সাধারণ লোকসমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং এই কৃষ্ণকে আশ্রয় করেই সেকালের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে সনাতন ধর্মে উদ্বুদ্ধ করা সহজতর উপায় ছিল। লক্ষ্মণ সেনের বৈষ্ণব হওয়ার পিছনে এই সামাজিক শক্তিটি ক্রিয়াশীল হয়েছে।" (বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ, পৃষ্ঠা- ৪৮)
শৈব ছেড়ে বৈষ্ণবীয় ধারার বিবর্তনের নিরিখে প্রাবন্ধিকের এই অনুমান কিছুটা ভাবিয়ে তোলে। তুর্কী আক্রমনের পূর্বে কৃষ্ণকে আশ্রয় করে সনাতন ধর্মে উদ্বুদ্ধ হতে চাওয়াই নাকি রাষ্ট্রনৈতিক-সাংস্কৃতিক অন্য কোনো বিষয় এই পরিবর্তনের প্রধান মানদণ্ড! সেই বিষয়টি নববিশ্লেষনের প্রয়েজন হয়ে ওঠে।
৩
বল্লাল সেনের শেষ জীবন অতিবাহিত হয় শাস্ত্রচর্চায়; ত্রিবেণীর গঙ্গাতীরে। আবার পিতা বিজয় সেনও মহানাদ নিকটস্থ গঙ্গাতীর 'ত্রিবেণী'র পাশে 'বিজয়পুর' এর প্রতিষ্ঠাতা। দুই পুরুষ ধরে তাঁরা অন্যত্র রাজত্বসীমা বর্ধিত করলেও ত্রিবেণী তীর্থের পুন্যার্থের ভাবনা এবং মনোরম আবহাওয়াজনিত নিজেদেরকে উক্ত স্থানেই নিয়োজিত রাখেন। পাশাপাশি 'মহানাদ জনপদ' থেকে 'সপ্তগ্রাম' পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য তৈরি হওয়া যে প্রসস্থ পথ এবং সেই পথের দুই পাশে জলপথে নৌকারোহন সহজেই সেন বংশের প্রাদেশিক যাত্রাকে সহজলভ্য করে তোলে। সেই হিসাবে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম থেকে প্রসিদ্ধ মহানাদ অঞ্চলে যে তাঁদের যাতায়াত অক্ষুণ্ন ছিল তা সহজেই অনুমেয়। কারন মহানাদ প্রসিদ্ধ নগরী; তার ওপর শৈব্য ধর্মের আকরস্থান। মহানাদ অঞ্চলের গর্ভ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রভাসচন্দ্র পাল পরবর্তীতে প্রচুর শিবলিঙ্গের আবিষ্কারই শুধু করেননি, পাশাপাশি অকপটে স্বীকারও করেছেন "গঙ্গা রাঢ়ের মধ্যে একমাত্র মহানাদেই এত মূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে যেগুলি রাজপরিবারশ্রিতও হতে পারে।" সেনদের মহানাদ যাত্রার আরোও একটি সম্ভাব্য কারণ হল মহানাদ অঞ্চলে ওই সময়ে প্রতিভাশীল শাস্ত্রজ্ঞ বিদ্বানদের জন্ম নেওয়া। সেক্ষেত্রে বল্লাল সেনও নিজে সুপণ্ডিত এবং শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। তাই যাতায়াতের এই যোগসূত্রকে অস্বীকার করা নিছকই অপ্রতুলতা। সেই কালপর্বে টীকাকার শ্রীধর কর্তৃক লিখিত হয়েছে 'পদার্থ ধর্ম সংগ্রহের টীকা', জয়হরি সিংহের 'কক্ষোল্লাস', পুরুষোত্তমের 'ভাষাবৃত্তি' প্রভৃতি একাধিক প্রাচীন প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। প্রতিটি গ্রন্থই যেমন আজও আড়ালে রয়ে গেছে, তেমনই মহানাদনিবাসী এইসব গুণী লেখকেরা আজও হয়ে রয়েছেন উপেক্ষিত। যদিও পরবর্তী রাজা লক্ষন সেনের পঞ্চরত্নের আলোয় তাঁরা ম্লান হলেও পূর্ববর্তী বিজয় সেন এবং বল্লাল সেনের রাজত্বে মহানাদ অঞ্চল সহ পাশাপাশি অঞ্চলের সাথে সেনদের যোগসূত্র এবং প্রসিদ্ধতা অস্বীকার করার জায়গা নেই। বল্লাল পুত্র লক্ষন সেন সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্যাচর্চার আরও প্রসার ঘটান। ত্রিবেণীর গঙ্গার ঠিক অপর পাড়ে 'নওদিয়া' ( বর্তমানে নদীয়া) জনপদে লক্ষন সেন নিজেকে স্থিত করেন। এক্ষেত্রে 'নওদিয়া'র পাশাপাশি অঞ্চলের গঙ্গাবক্ষে নতুন নতুন পলি সঞ্জাত দ্বীপ'এর (আজও প্রচুর 'চর অঞ্চল' জেগে উঠছে) জেগে ওঠার কথাও অবিদিত নয়। লক্ষ্মণ সেনের সমসাময়িক এডু মিশ্র বলেছেন —
"গঙ্গা গর্ভোস্থিত দ্বীপ দ্বীপপৌজ্ঞৈবর্হিধূত
প্রতিচ্যাং যস্য দেশস্য গঙ্গাভাতি নিরন্তরম।"
কর্ণপুরের চৈতন্য চরিতামৃতে 'নবীনদ্বীপ' এর উল্লেখ দেখা যায়। আবার কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণে দেখা যায় —
"গঙ্গারে লইয়া জান আনন্দিত হইয়া
আসিয়া মিলিল গঙ্গা তীর্থ যে নদীয়া
সপ্তদ্বীপ মধ্যে সার নবদ্বীপ গ্রাম
একআরাত্রি গঙ্গা তথা করিল বিশ্রাম।"
আসলে এই 'নতুন দ্বীপ' বা 'নবদ্বীপ' হল নদীয়া নগর। (নদীয়া বর্তমানে সম্পূর্ণ একটি জেলা এবং নবদ্বীপ তৎমধ্যবর্তী প্রসিদ্ধ নগর।) মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের 'নবদ্বীপ ইতিবৃত্তে' জানা যায় সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের উচ্চারিত 'নবদ্বীপ'ই, বখতিয়ার খলজির শাসনে ফার্সি ভাষার প্রভাবে 'নদীয়া' হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নবদ্বীপেই ছিল লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী। যে স্থান চৈতন্য মহাপ্রভুর পূন্যজন্মভূমি, সেই স্থানেই লক্ষ্মণ সেন বৈষ্ণবীয় চেতনার বীজকে অন্তর্নিহিত করেন তুর্কী আক্রমণের আগে। এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ লক্ষ্মণ সেন পরবর্তীতে বৈষ্ণব হয়ে ওঠেন। এমনকি তুর্কী আক্রমণের পূর্বে 'সস্ত্রীক বিষ্ণুমূর্তি'র পূজারও আয়োজন করেন (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস/ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৯৩), যা গোটা নবদ্বীপেই সেই সময় সুবিদিত ও প্রচারিত হতে থাকে। আবার লক্ষন সেনের সভাকবি 'পবনদূত' প্রণেতা ধোয়ী, 'সুভাষিতাবলী' খ্যাত উমাপতি ধর প্রমুখও ছিলেন নবদ্বীপ নিবাসী। তাঁরা যে উভয়েই জয়দেব দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত যে হয়েছিলেন তা তাঁদের কাব্য অবলম্বনেই অনুমেয় হয়। আর বীরভূমের 'কেন্দুবিল্ব' নাকি উড়িষ্যার 'কেন্দ্রবিল্ব' সে প্রশ্নের থেকেও বড় জয়দেব 'কেন্দুবিল্ব' থেকেই নিজ প্রতিভার সাথে রাধাকৃষ্ণের লীলাসুরভিত বৈষ্ণবীয়ানাকে বয়ে এনেছিলেন। যার দ্বারা দ্বাদশ সর্গে লেখা 'গীতগোবিন্দ' থেকেই বৈষ্ণবীয় রাধার সুপ্রতিষ্ঠা প্রায় পাকা হয়ে যায়। পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণের পার্থিব কামনা-বাসনা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ছবি ভক্তিমূলক দৃষ্টিকোন থেকে লৌকিক দৃষ্টিকোনে পর্যবসিত হয়ে বিপুল জনসমাজে সমাদৃত হতে থাকে। জয়দেব পুরাণাশ্রয়ী ব্রাহ্মণ্য রাজধর্মের বিষ্ণুভক্তির সাথে লৌকিক কামকেলিরত কৃষ্ণকে মিলিয়ে দেন। ফলত ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক রাজসভা থেকে মরমী জনমানসের উপভোগ্য হয়ে ওঠে এই গ্রন্থ। তুর্কী বিজয়ের পরবর্তী সাহিত্যে শত শত বছর পরেও বড়ুচণ্ডী দাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডীদাসের পদাবলী, সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতীতে গীতগোবিন্দ যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে তাতে তা যে তৎকালীন জনসমাজকে ব্যাপক প্রভাবিত করবেই তা বলাই বাহুল্য। সেক্ষেত্রে জয়দেব ও তাঁর এই গ্রন্থ যেমন একাধারে বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যনদের সেতুবন্ধন ছিল, তেমনই অপরপক্ষে শৈব টপকে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় আগত বেশ কিছু সংখ্যক মানুষের গন্তব্য-ডিঙা হয়ে উঠেছিল।
দ্বিতীয়ত— 'রাঢ়', 'বরেন্দ্র' এবং 'বঙ্গ' নিয়ে গঠিত তৎকালীন বাংলাদেশের 'বঙ্গ' প্রদেশে শৈবধর্মের বাহুল্য থাকলেও 'রাঢ়'প্রদেশ মূলত ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধিপত্যকে জারি রাখেন। রাঢ়প্রদেশের রাজা ছিলেন আদিশূর। তিনি তাঁর রাজধানীতে কনৌজ থেকে পঞ্চগোত্রের পঞ্চব্রাহ্মন এনে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলত ব্রাহ্মণ্যসনাতনবাদের আকরস্থান হয়ে মাথাচাড়া দেয় রাঢ় প্রদেশ। অপরদিকে বঙ্গরাজ বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেনকে আদিশূরের দৌহিত্র বলে মনে করা হয় (কূলপঞ্জিকায় সেই উল্লেখ আছে)। অর্থাৎ আদিশূরের কন্যা বিলাস দেবীর সাথে বিজয় সেনের বিবাহ হয়। শৈব বিজয় সেন মহানাদের নিকটস্থ এক স্থানে সুউচ্চ, সুদর্শন মন্দির স্থাপন করেন। সেখানে বিভিন্ন প্রকার দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে আদিশূরের আনিত ব্রাহ্মণগণ এর সহযোগে নিত্যপুজা চলতে থাকে ( ঐ স্থান বর্তমানে 'সুদর্শন' গ্রাম নামে পরিচিত হয়েছে) এবং ক্রমেই বহু দেবদেবীর পূজার্চিত বিখ্যাত আধ্যাত্ম-স্থান হয়ে ওঠে। রাজমাতা কর্তৃক বহু দেবদেবীর এই নিত্যপুজা প্রচলন এবং তার ওপর রাজা বল্লাল সেনের ধর্মানুশাসনহীন উদারতা থাকার ফলে যে বঙ্গে শৈব ধর্ম ছিল, যে মহানাদ নাথ-শৈবতীর্থের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল তা ক্রমে বহু দেবাশ্রিত সনাতনপন্থী হয়ে ওঠে। হরগৌরীর পাশে লক্ষীনারায়ন বিগ্রহ অঞ্চলজুড়ে পূজিত হতে থাকে। আর এক্ষেত্রে কিছু পরে বল্লাল পুত্র লক্ষণ সেনের আমলে শৈবতা কালক্রমে বৈষ্ণবীয়তার দিকেই হেলে যায়। অর্থাৎ রাঢ় প্রদেশের সাথে বঙ্গ প্রদেশের এই বিবাহসূত্রই নাথপন্থী শৈবতন্ত্র থেকে সনাতনত্বের দিকে ঠেলে দেয় বঙ্গ প্রদেশকে।
তৃতীয়ত— সারা বাংলাদেশের বরেন্দ্র প্রদেশ ও বঙ্গপ্রদেশে বৌদ্ধধর্ম ও নাথ ধর্মের প্রচলন ছিল। তবে মুসলমান আক্রমণের পূর্ব থেকেই এই বৌদ্ধ ও নাথপন্থীরা অত্যাচারিত হতে থাকে সনাতনপন্থীদের দ্বারা (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র /প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা- ১১১)। ফলত বৌদ্ধ ও নাথপন্থা ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে। আর বঙ্গপ্রদেশে শিব ছেড়ে আঁকড়ে ধরার মতো পরিচিত দেবতা ছিল বিষ্ণু। সোজা কথায় হর থেকে হরিতে আসা সনাতনত্বে উত্তীর্ণ হবার সহজ উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
চতুর্থত— সেন রাজাদের পূর্বে পালরাজাদের সময়েই বৌদ্ধ ভাবাদর্শ ব্রাহ্মণ্য মতের সাথে মিলে যেতে থাকে। ফলত বুদ্ধদেবও সেইসময় দশম অবতার রূপে পূজিত হতে থাকেন৷ নবম-দশম শতাব্দী থেকে দেওয়ালে মূর্তি এঁকে বা মাটি দিয়ে গড়া দেবদেবীর পূজা প্রচলিত হয়। এমনকি মহাযান তান্ত্রিক উপাসনাতেও অদ্ভুত ভাবে এই প্রকার রীতি জায়গা করে নেয় (বঙ্গভূমিকা, সুকুমার সেন)। পাল পরবর্তীযুগে সেনরাজ বিজয় সেনের ব্রহ্মন ও শিবভক্তিতে রাজমুকুট প্রাপ্তির গল্প 'সেকশুভোদয়া'তে মিললে, পাশাপাশি সেখানে (সেকশুভোদয়া) বল্লালের ব্রাহ্মণ্য ভক্তির খবরও মেলে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতিবান রাজা লক্ষনের সময়ে শৈব্ ও ব্রাহ্মণত্ব একছাতার তলায় চলে আসে। বৌদ্ধতান্ত্রিকতা এবং শৈব নাথপন্থায় 'যোগাচার' ক্রমেই পাল এবং সেনযুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য আদলে পড়ে পুরাণাশ্রিত হয়ে পড়ে। লক্ষন সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রের 'ব্রাহ্মন সর্বস্ব' গ্রন্থে চণ্ডী পূজা যে ব্রাহ্মনের নিত্যকৃত্য তা বলা আছে। আসলে এই 'চণ্ডী' প্রকৃতার্থে শক্তির উপাস্য। যে শক্তি সাধনা বৌদ্ধতান্ত্রিক এবং শৈবরা করে এসেছে, তা চণ্ডীর সাথে একীভূত হতে থাকে। তন্ত্রশাসন কার্যত শাস্ত্রশাসনের অধীন হয়ে পড়ে। শাস্ত্রগত অন্য দেবতা হিসাবে শিব এর পাশে বিষ্ণু এবং গ্রাম্যদেবতার অন্যান্য লৌকিক দেবদেবীর পাশে কৃষ্ণকথার সন্নিবেশ ঘটে। তাই 'সুভাষিত রত্নকোষ' (দ্বাদশ শতাব্দী) এর সংকলক বিদ্যাকর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়েও 'হরি'বিষয়ক আদিরসাত্মক প্রাকৃত প্রেম কবিতাকে সংকলিত করতে পারেন। 'সুগতব্রজ্যা' (বৌদ্ধ) ব্যতীত সারাগ্রন্থ জুড়েই সেখানে হিন্দু দেবদেবীর চিত্রণ প্রকাশ পায়। বিষ্ণুলক্ষীর প্রেমলীলায় 'শাস্ত্রের বিষ্ণু' ক্রমেই কৃষ্ণকথায় পর্যবসিত হয়। লোককথায় যে কৃষ্ণ বহু পূর্ব থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা লক্ষন সেনের সহজাত গ্রহণে রাজউষ্ণীষ প্রাপ্ত হয়। বাঙালি বৈষ্ণবীয় ভাবধারার গোড়াপত্তন করে ফেলে।
পঞ্চমত— নাথ পন্থীদের যোগসাধনা এবং শৈব ধর্মের আগল বহু পূর্ব থেকেই পৃথক রূপে পর্যবসিত হয়। মহানাদ অঞ্চল এবং পাশাপাশি অবস্থিত অঞ্চলসহ বঙ্গে নাথ-শৈব ধর্মের যে প্রসিদ্ধতা তা শিথিল হতে থাকে। মূলত যোগজ নাথ ধর্ম পুরুষপ্রধান একটি ধর্ম-দর্শন। তাছাড়া ইন্দ্রিয়সমূহ বশে এনে দুঃখ-কষ্ট নিরোধ এইরূপ দর্শন-ভাবাদর্শিত সাধনা ধীরে ধীরে শিথিল হয়। যোগসাধনায় পরম পুরুষ ঈশ্বর হলেও সেখানে যোগ সাধনার দ্বারা কিভাবে মনের চঞ্চলতা দূরীভূত হয় তা প্রধান বিবেচ্য। কিন্তু কালক্রমে বিভূতিলাভের উদ্দেশ্যেই যোগকর্ম সম্পন্ন হতে থাকে। সেখানে আত্মার স্বরূপ সন্ধান তো দূরের কথা আত্মস্বরূপ ভুলতে বসে অনুগামীরা। এছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে বেদানুগত ধর্মদর্শন অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে। মহর্ষি পতঞ্জলির 'যোগ' দূরে সরতে থাকে। কারণ উভয়ই বেদস্বতন্ত্র এক ধর্মীয় ভাবধারা।
ষষ্ঠত— বল্লাল সেনের আমলে তিনি নিয়ম করে ছিলেন প্রতি ছত্রিশ বৎসর অন্তর কুলিনদের নির্বাচন হবে এবং অকুলীন সদাচারী ব্যক্তি পুনরায় কৌলিন্যের অধিকারী হবে। কৌলিন্যপ্রাপ্ত দু:শীল ব্যক্তি সেক্ষেত্রে কৌলিন্যভ্রষ্ঠ হতে পারে। কিন্তু তাহার পুত্র লক্ষনসেনের রাজত্বে কৌলিন্য নিয়ে গণ্ডগোল উপস্থিত হওয়াই কৌলিন্য বংশানুগত হবে এমন স্থির হয়। ফলত ব্রাহ্ম আধিপত্যের সমাজপতিত্বের সুযোগ চলে আসে ব্রাহ্মণের হাতে। তারা একদিকে রাজসভায় থেকে সংস্কৃত শাস্ত্রশাসিত বেদানুগত আচার-অনুষ্ঠান সংস্কৃতির বাতাবরন ছড়াতে থাকে, প্রচারের আলোয় আসতে থাকে পুরাণকথা। ফলত শিবের উপাসনায় অন্য দেব-দেবী সহজেই থাবা বসায়।
সেনযুগে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় কর্তৃক পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যমতে শিবের পাশাপাশি বিষ্ণুর উপাসনা করার রীতি পরিলক্ষিত হয়। যোগ সাধানার থেকে যজ্ঞ সাধনা প্রাধান্য পেতে থাকে। বাড়তে থাকে আচার-উপাচারের দরবারী ও লৌকিক তান, কমতে থাকে আধ্যাত্বসাধনার অনুশীলন গান। খুব সহজেই লক্ষন সেনের সময় থেকে কৃষ্ণলীলার লৌকিক কাহিনীর সমাদর বাড়ে। রাজা লক্ষণ সেনও কৌলিক দেবতা সদাশিবের উপাসনা টপকে বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে ওঠেন।
সপ্তমত— গুপ্ত শাসন থেকেই ব্রাহ্মণ্য উপনিবেশ স্থাপন হতে দেখা গিয়েছিল। আগে থেকে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ্য ডেরায় উপনিবেস্থ নবাগত ব্রাহ্মণ্যদের সুন্দর ঐক্যের মধ্যেও বিভেদ বৈচিত্র ধরা পরে সেই সময়। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের দুটি ভাগ সহজেই পরিলক্ষিত হয়। একটি প্রবীন ব্রাহ্মণদল এবং অপরটি নবীন ব্রাহ্মণদল। মূলত দেশীয় প্রবীন ব্রাহ্মণরা ততটা যোগনিষ্ঠ, তত্ত্বজ্ঞানপুষ্ট ছিলেন না কিন্তু নবীনরা ছিলেন নিষ্ঠাযুক্ত আধ্যাত্মনিষ্ঠ সংস্কৃতাশ্রয়ী। তারা প্রবীনদের মতো ভাববিলাসী ছিলেন না। সেক্ষেত্রে "শিব যখন শাস্ত্রপন্থী নবীনদের দেবতারূপে পুজ্য হতেন তখন তিনি হয়ে ওঠেন যোগীশ্রেষ্ঠ, আবার যখন তিনি ভাববিলাসী প্রবীনদের দেবতা তখন তিনি হয়ে ওঠেন ভোলানাথ; গঞ্জিকাধূস্ত, চাষী এবং নীচ পরনারীর লোভে হীনকর্মে রত" (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস/ ১ম খণ্ড, সুকুমার সেন, পৃষ্ঠা- ৭৯)। বাংলায় ব্রাহ্মন্যবাদের মধ্যেও সংস্কৃতিগত, ধর্মবিশ্বাসগত এই মিশ্রণ শৈবসাধনার যোগপন্থা ও তন্ত্রপন্থাকে সরিয়ে লৌকিক দেবদেবীর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। শক্তি-সাধনা সরে এসেছিল প্রেমে। ফলত কংসাসুরমর্দন কৃষ্ণ বাঙালী মনে গোপাল-গোবিন্দ রুপে ঠাঁই করে নেয় সহজেই।
অষ্টমত— উচ্চবিত্তরা বিষ্ণুমূর্তিতে নিত্যপূজা সম্পন্ন করতে থাকে। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রভাস চন্দ্র পাল মহানাদ দক্ষিণ পাড়া অঞ্চল থেকে সেন আমলের তিনটি বিষ্ণুমূর্তি আবিষ্কার করেন (যা বর্তমানে সারদাচরন মিউজিয়ামে রাখা)। সুকুমার সেন আবার তুর্কী আগমনের পূর্বে লক্ষন সেনের আমলে সস্ত্রীক বিষ্ণুমূর্তি পূজার আয়োজনের কথাও বলেন। তবে 'শালগ্রাম' যেখানে দরিদ্রের সহায় সেখানে নি:সন্দেহে 'বিষ্ণুমূর্তি' রাজশ্রেণী এবং রাজকর্মচারী কর্তৃক পূজিত হত। পাশাপাশি লক্ষন সেনের সভাকবি উমাপতি ধর'এর কৃষ্ণলীলা পদ কিংবা জয়দেবের গীতগোবিন্দের ঢেউ রাজশ্রেণী ও কর্মচারীদের সংস্পর্শিত করে প্রভাবিত করলে অবাক হবার বিষয় হবে না।
৪
মহানাদ অঞ্চল ও পাশাপাশি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যোগ সাধানার ধারায় মোহন্তগনের উদ্ভব হয়েছিল একথা আগেই বলা হয়েছে। মোহন্ত মৃত্যুর পর তাঁদের প্রধান শিষ্যই হতেন নতুন মোহন্ত। সুধীর কুমার মিত্রের মতে, "এই মোহন্তগন উত্তর পশ্চিম প্রদেশীয় ব্যক্তি, বাঙালী নহেন।" যোগসাধনায় যেহেতু শিলা প্রাসঙ্গিক নয় তাই ধারণা করায় যায় পরবর্তীতে এই উত্তর পশ্চিম প্রদেশীয় মোহন্তরা বাঙালী ভাবধারার সাথে মিশে হয়তো শিলা প্রস্তরের অনয়ন ঘটান। সেক্ষেত্রে বৈদিক ধর্মযোগের ঢেউও এসে পড়ে। পুরুষ গ্রাম দেবতার প্রতীক — শিলাখন্ড; যা লিঙ্গরূপী। আর পাশাপাশি শক্তির আধাররূপ স্ত্রী গ্রামদেবীর প্রতীক— জোড়াঘট, যা স্তনরূপী। একটি দেবতা শিব আর অপরটি শিবশক্তির আধার রূপ চণ্ডী। একটি পৌরষ বীর্যবত্তার প্রতীক হয়ে আর অপরটি পুষ্টতার প্রতীক হয়ে জায়গা করে নিতে থাকে বাঙালী মনে। এই শিলা প্রস্তর পূজার অনয়নেই আবার প্রবেশাধিকার পেয়ে যায় 'শালগ্রাম শিলা', অর্থাৎ বিষ্ণুর আধাররূপ উপাসনায়।
অন্যদিকে শিবকে নাথযোগীরা 'ভৈরব', 'কালভৈরব', 'নন্দভৈরব', 'একলিঙ্গ' প্রভৃতি মূর্তিতে পূজা করে থাকতেন। 'ভৈরবমূর্তি' আবার শৈব্য ও শাক্ত উভয়েরই উপাস্য। মহানাদ জটেশ্বর মঠ সংলগ্ন ভৈরব মূর্তির নিদর্শনও পাওয়া গেছে। মহানাদ অঞ্চলের অনতিদূরে 'ভৈরবপুর' নামক গ্রামের নামও যে ওই ভৈরব উপাসনা থেকেই একথা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে মূল বিষয় উক্ত অঞ্চলে শিব এবং শক্তি উভয় উপাসনার চল থাকলেও কালক্রমে সেখানে সনাতন বলি প্রথার প্রচলন ঘটে। অর্থাৎ 'ভৈরব' প্রথমে নাথ-যোগ সাধনার ডিঙা টপকে পরবর্তীকালে সনাতনত্মে পৌঁছায়। আর যোগী নাথরাও সনাতনী শৈব হয়ে ওঠে অধিক ক্ষেত্রে। গুরু পরম্পরায় মন্ত্র মনে রাখার প্রনালী না থাকায় হয়তো কিছু ক্ষেত্রে পুরাণাদি কিংবা 'শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ'এর (খ্রি:পূ: ৪০০-২০০ অব্দে লেখা) সম্মুখীন হন তাঁরা। আর এভাবেই মিশ্র ধর্মদর্শন মিশ্র সংস্কৃতিতে পৌঁছায়।
৫
লক্ষ্মণ সেন অসামান্য দানশীল ও প্রজাবৎসল ছিলেন। সেইসময় দরিদ্র প্রজা এবং বিস্তীর্ণ জনপদের জনগন তাঁর বাৎসল্য প্রভাবের দ্বারা সহজেই নিজেদের ধর্মকে রাজার দ্বারা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। 'তবকাত-ই-নাসিবী'র লেখক মিনহাজ-উস-সিরাজ সঙ্গতভাবেই তাঁকে বাংলার 'মহান রায়' হিসাবে উল্লেখ করেন এবং তাঁর 'পরম বৈষ্ণব' উপাধি ধারনের কথাও জানান। ফলত প্রজাপ্রেমী লক্ষ্মণ সেনের বৈষ্ণবীয় ধর্ম প্রচার বাংলার বুকে যে ঢেউ এনেছিল শৈবধাম মহানাদও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। তুর্কী আক্রমনের বহু পূর্বেই এবং ১২৯৮-এ মহানাদে মুসলমান করমর্দনের আগেই বৈষ্ণবীয় ধারা সূচিত হয়। লক্ষনের রাজত্বকালে মহানাদ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে গ্রাম্য বিবাহ উৎসবের রীতিতে গ্রাম্যদেবতার বিবাহ দেওয়া হত আড়ম্বর করে। গাওয়া হত লৌকিক প্রেমের গান। আধ্যাত্ম যোগচর্চা সরিয়ে বাঙালি সেইসময় মঙ্গলগানের লৌকিক দিককে এক করে নিতে পেরেছিল। শিবগৃহিনীর গার্হস্থ দু:খের বর্ণনা যেমন স্থান করে নিয়েছিল বঙ্গ বহির্ভূত 'প্রাকৃত পৈঙ্গল'এর ছত্রে, তেমনই বঙ্গের 'সদুক্তিকর্ণামৃতে'ও তা উজ্জ্বলরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল। 'সদুক্তিকর্ণামৃত' তো লক্ষন সেনের রাজপ্রতিনিধি বটুদাসের ছেলে শ্রীধর দাসের লেখা। শ্রীধর দাসের এই সংকলন গ্রন্থই যেন চিরন্তন বাংলার পল্লীজীবনের এক চিত্রিত রূপ। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদসংকলনে এই গ্রন্থের ভূমিকা প্রায় বারোয়ানা। যেখানে সিংহভাগ জায়গাজুড়েই রাধাকৃষ্ণলীলার বৈষ্ণব ভাবাদর্শ প্রষ্ফূটিত হয়েছে—
"রত্নচ্ছায়াচ্ছুরিতজলধৌ মন্দিরে দ্বারকায়া
রুক্মিণ্যাপি প্রবলপুলকোদ্ভেদয়ালিঙ্গিতস্য।
বিশ্ব্য পয়ান মসৃণ্যযমুনাতীরবানীরকুঞ্জে
রাধাকেলিভরপরিমলধ্যানমূর্ছা মূরারেঃ।।"
আসলে ব্যক্তি শ্রীধর দাস নিজেই মহানাদনিবাসী ছিলেন। 'সদুক্তিকর্ণামৃত' ও শ্রীধর দাস যেন মহানাদ নগরীর ধূসর পান্ডূলিপিতে পরিচয় করিয়ে যাচ্ছে বঙ্গসভ্যতার। সম্মুখীন করিয়ে যাচ্ছে শৈবতান্ত্রিক নাথ সংস্কৃতির, আলিঙ্গন করিয়ে যাচ্ছে বৈষ্ণবীয় মিলনান্তক সুর। আর আত্মঘাতী মহানাদনিবাসী, আত্মবিস্মিত বঙ্গবাসী ভুলতে বসা শ্রীধর দাসকে আজও সেই দারুচিনি দ্বীপে দেখে বলে উঠছে—
"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের'পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?"
————
লেখক :সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়, কবি, গবেষক ও শব্দশ্রমিক।
নিবাস : ভৈরবপুর, মহানাদ, হুগলী।
গবেষণাধর্মী লেখাটি পড়ে ভালোলেগেছে।
উত্তরমুছুন