শিক্ষা ও সমকাল: একটি ভগ্নাংশ
-----------------------------------------------
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বতঃস্ফূর্ত উষ্মায় বলে
ফেলেছিলেন, শিক্ষাদপ্তর একটা ঘুঘুর বাসা। শুনলে প্রাথমিকভাবে অবাক হতেই
হয়। বিশেষত একটা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যখন এমন প্রতিক্রিয়া দেন,তখন
ভাবনা থেকে যায়। বছর দশ আগে কলকাতার ডিরোজিও ভবনে একজন শিক্ষকের একটা
অফিসিয়াল সমস্যা নিয়ে নির্দেশ মতো তদবির করতে যাই। প্রথমত ঐ ভবনে
দৈনন্দিন অফিসের কাজ যে খানিকটা বেলার দিকে শুরু হয়, তা উপস্থিত কর্মীদের
শারীরিক ভাষা বুঝিয়ে দেয়। বেশ কিছু কর্মী অনুপস্থিত থাকাও যেন প্রচলিত
রীতি বলে মনে হলো। এক টেবিল থেকে তাড়া খেয়ে অন্য টেবিলে ছুটে ,এবং শেষ
পর্যন্ত সঠিক টেবিল খুঁজে পেয়ে যখন সমস্যা সম্পর্কে ভদ্রলোককে জানানো হলো
,তিনি রীতিমতো ধমক দিলেন। তার বক্তব্য, ডি. আই অফিস সমস্যাটা মেটাবে।
কাজটা নাকি সেই অফিসের। উত্তরে ভদ্রলোককে জানানো হলো, ডি .আই অফিসে যাওয়া
হয়েছিল, সেখান থেকে কাজ মেটেনি। সঙ্গে সঙ্গে ঐ ভদ্রলোক বললেন, 'আরে
সেখানে টাকা পয়সা ফেলুন ,তবে তো হবে!' অত এব বিফল হয়ে ভগ্ন মনে সেদিন
ফিরতে হয়েছিল। আর পরবর্তীতে টাকা পয়সা ফেলা হয়নি, তবে কাজটা হয়েছিল জনৈক
ডি. আই অফিসের ল'সেকশনের তৎপর ও মানবিক একজন কর্মীর দায়িত্বে।
ওটা অবশ্য সামান্য একটা প্রসঙ্গ মাত্র। তাছাড়া সেটা শিক্ষকদের
নিজস্ব সমস্যা। শিক্ষা দপ্তরের আরও অনেক কাজ আছে যা শিক্ষার্থীদের নিয়ে।
সিলেবাস নির্মাণ থেকে শুরু করে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনমুখী ক্রম
পর্যবেক্ষণ। শিক্ষকদের আচরণবিধি তৈরী থেকে নবতম বিষয়কে ইতিহাস হিসেবে
বইতে অন্তর্ভূক্তিকরণ। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাশ-ফেল চালু হবে কি হবে না
,তাই নিয়ে রীতিমতো হাজার পিপে নস্য খরচ। শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন নিয়ে মিটিং
সভা ট্রেনিং কত কি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাবতে অবাক লাগে ,সরকারের বহু অর্থ
এক্ষেত্রে জলবৎ তরলং । জাতীয় শিক্ষানীতি ,২০১৬ অনুসারে যখন সকল
স্তরে শিক্ষার মান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এবং সমাজের সব
স্তরের শিশুর জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে মনোযোগ দেবার কথা বলা হচ্ছে,
তখন শিক্ষা- শিক্ষক-শিক্ষাব্যবস্থা এই ত্রিমুখী ফিগার একটা স্থিতিশীলতার
প্রশ্নে জেরবার। আজকের ভারতবর্ষ চায় সোজাসুজি শিক্ষার পূর্ণ বেসরকারীকরণ
। অথচ বেসরকারী শিক্ষার হাল আমলের যে সার্ভে রীপোর্ট তা রীতিমতো হতাশার
সঞ্চার করে। অন্য দিকে সরকারি শিক্ষা পরিকাঠামোটি আজও মান্ধাতার।
প্রতিবছর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শুধুমাত্র পরীক্ষার ফল দিয়ে একটা
ব্যলেন্স করার বোকা চেষ্টা নিপুণভাবে চালানো হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার দিকটা
ততটাই রাজনীতি আর ব্যবসায়ীক নিয়ন্ত্রণে। ছাত্রছাত্রীরা কতটুকু জানলে বা
শিখলে বেশিরভাগ অংশ কর্মসংস্থানের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে, এই শিক্ষার হাল
সে দিকে চলে না। যারা উন্নততর গবেষণায় নিয়োজিত হতে চায়, তারা দেশীয়
সুযোগহীনতায় ক্রমে বিদেশমুখী হয়ে চলেছে।দেশে নতুন নতুন প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ার যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাক না কেন কার্যক্ষেত্রে তা
হাতে গোনা। অথচ বেসরকারী উদ্যোগে লাগাম দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরীই
হয় নি। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি না পাওয়া পর্যন্ত বেকারত্ব
ই যে শিক্ষার সবচাইতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বরং গীতাকে অবশ্যপাঠ্য করতে পারলে একটা ধর্মীয় বাতাবরণে
শিক্ষাকে ঢেকে দেওয়া যাবে ---এই সত্য রাস্ট্রীয় পরিচালকদের মাথায় জায়গা
করে নিয়েছে। ধর্ম যে আফিম ,সে তো প্রাচীন কথা। বরং স্যাটেলাইটের আমলে
ধর্মের নতুন আবহ সৃষ্টি করতে পারলে শিশু কিশোর মনে যুক্তিবাদের পরিবর্তে
ভক্তিবাদ এসে বেকারত্ব ভুলিয়ে দিতে পারে। গরুর গোবরে, মূত্রে যদি হাজার
অসুখ সারিয়ে তোলার বিশ্বাসটা একবার চারিয়ে দেওয়া যায়, তবে আর ডাক্তারি
পড়ার এতো হিড়িক থাকবে না।বরং আয়ুর্বেদ ক্যান্সার থেকে এইচ আই ভি সকল
রোগের অব্যর্থ হয়ে একুশ শতকের অরণ্য ভারত গড়ে তুলবে। ড. সর্বপল্লী
রাধাকৃষ্ণানের জন্ম যে এই ভারতেই হয়েছিল তা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের
স্মৃতিতে যদি নাও থাকে ,হয়তো তার জন্যে আমাদের হতাশ হবারও কিছু থাকবে না।
ভারতীয় অথবা আন্তর্জাতিক বহু শিক্ষাবিদ যা-ই পথনির্দেশ করুন না কেন,
মহাভারতের সময় ইন্টারনেট ছিলো----এমন বিশ্বাসে হয়তো নতুন ছাত্রপাঠ শুরু
হবে। আর রাজনৈতিক শিক্ষা এই দেশে কোনও দর্শনেই যে আজ লক্ষ্য স্থির না, তা
বলাই বাহুল্য। সেখানে দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি, হঠকারী সিদ্ধান্ত অথবা খুন
জখমের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের শিক্ষাকেই শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিপন্ন করেছে।
একজন শিক্ষক সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক অত্যাচার, দারিদ্র্যতা ও
অস্পৃশ্যতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছাত্রকে বোঝাতে গেলে এখন ভয় পাবেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শক্তি শিক্ষককে ঠিক যতটুকু বলার পারমিশন দেবে, বলতে
হবে ততটুকুই। প্রতিবাদ ,বিপ্লব ,অধিকারের লড়াইকে বলতে হবে সন্ত্রাস।
ফ্যাসিবাদী রাস্ট্রীয় আচরণকে কোনও ভাবেই সমালোচনা করা চলবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুল ও এখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণভাবে
চালিত। ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে ডিগ্রি অর্জন সেই ক্ষমতার আষ্ফালনে থরহরি।
শিক্ষক শিক্ষিকার স্বতন্ত্র সম্মান আদৌ সমাজ অনুমোদন পাচ্ছে না। বরং
ঘেরাও থেকে কটুক্তি উত্তীর্ণ হয়ে শারীরিক আঘাত পর্যন্ত এখন আকছার।
এমতাবস্থায় দেশ রাজ্য কোথায় যে শিক্ষা ও শিক্ষক নিজস্ব
দৃষ্টিভঙ্গি, পঠনপাঠন ,পদ্ধতিতে নতুন নতুন ধ্যান ধারণার প্রয়োগে যত্নশীল
হবেন---তা তাদের বোধগম্য নয়। এর বাইরে সাম্রাজ্যবাদী প্রযুক্তির আর
যোগাযোগ মাধ্যমের হাতিয়ার হয়ে ইন্টারনেট দুনিয়া পূর্ণ সাক্ষরতাহীন
ভারতবর্ষে এমন একটা বিভ্রান্তিকর যুবসমাজ তৈরী করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে,
যা জাতীয় চরিত্রে চরম বিপর্যয়ের বার্তা বাহক। তাই গুরুত্ব থাক বা না থাক,
সম্মান পুনরুদ্ধার হোক বা না হোক শিক্ষককেই এগিয়ে আসতে হবে এই রাহুমুক্তি
ঘটাতে। শিক্ষক যে শুধুমাত্র চাকুরীজীবী নন, ইতিহাসে তার হাতেই বিস্তৃতি
লাভ করেছে বিদ্যা ও জ্ঞান। সচেতনতা তার সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। বিপদ থেকে
মুক্তি খুঁজে আনা তার কাজ। প্রজন্মের জন্য, দেশের জন্য, জাতির জন্য এমনকি
এই পবিত্র পেশাটার জন্যও।।
------অ-নিরুদ্ধ সুব্রত
ঠিকানা:সুব্রত বিশ্বাসগ্রাম ও পোষ্ট- ধর্মপুকুরিয়াবনগাঁ, উত্তর ২৪
পরগনাপিন-৭৪৩২৩৫, ফোন -৬২৯৫৯৫৭৫৯৩ই-মেল -
biswassubrata1168@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন