শিক্ষক বিভুতি স্যারের বিভূতি
সালটা ১৯৬৪ ৷
অমার বাবা তখন কর্মসুত্রে নৈহাটিতে পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টার ৷ অামরা তখন
নৈহাটিতই কাঁঠালপাড়ায় সি অাই অফিসের কোয়াটারে থাকি ৷ এবং বর্তমান উত্তর চব্বিশ
পরগনার ভাটপাড়া হাই ইস্কুলে পড়ি ৷ ক্লাস নাইনে ৷
ওই ইস্কুলে একইক্লাসে পড়ার সুবাদে অামার সাথে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরশ বসুর
ছোট ছেলে নবকুমরের সাথে বন্ধুত্বটা দারুন ভাবে জমে ওঠে ৷ ওরা থাকতো নৈহাটি
সিনেমা হলের পিছনটাতে - জর্জেস রোডে ৷
বিভুতি বাবু অমাদের ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ৷ কাঁঠালপাড়াতেই থাকতেন ৷ ইস্কুলে
অামাদের অঙ্ক করাতেন ৷ সরল সাদাসিধে মানুধ ৷ সারাক্ষন খদ্দরের পাঞ্জাবি ,
হাঁটু পর্যন্ত তোলা খদ্দরের ধুতি অার বগলে একটা দাদু মার্কা ছাতা নিয়ে - কি
শীত , কি গ্রীষ্ম কি বর্ধা সব সময়েই চলা ফেরা করতেন ৷ ওনাকে দেখলেই অামাদের
চোখের সামনে ফুটে উঠতো - মনোজ কুমার মিত্রের লেখা সেই মানুষ গড়ার একমাত্র
কারিগরের একটা চলমান জীবন্ত ছবি !
ভদ্রলোকের চেহাড়ার মধ্যে ছিলো যেমন একটা অাকর্ষন এবং শ্রদ্ধার-ভক্তির ব্যাপার
, তেমনি ছিলো একটা সমীহ ও ভীতির ব্যাপার ৷ কোনদিন স্যারের মুখে শুনিনি - কারোও
নিন্দা বা কাউকে উচ্চস্বরে বকাবকি করতে ৷ ছাত্ররা কোনও অন্যায় করলে , বিভুতি
স্যার কোনও দিন কাউকে মারধোর বা বকাবকি না করে , ডেকে সবাইকে শান্তভাবে
বোঝাতেন ৷ বলতেন - অাজকে অামি মাস্টার অার তোমরা ছাত্র ৷ কিন্তু , অাগামী কাল
তোমরাও মাস্টার এবং বাড়ির গর্জেন হবে ৷ সেইসব দিনের কথা ভেবে এখন থেকেই
নিজেদের তৈরি করো ৷ তোমাদের মতো অামিও একদিন ছাত্অার ছিলাম ৷ এই কথাগুলো
সেদিন অামাদের শিক্ষকরাই অামাদের শিখিয়ে ছিলেন ৷ মনে রাখবে অামরা সবাই
নিজের এক একজন শিক্ষক ৷ তোমাদের কাছে শাসনের ব্যাপারে অামি তো নিমিত্ত মাত্র ৷
অামার এখনো মনে অাছে সেই দিনটার কথা - ক্লাস টেনের পরীক্ষার রেজল্টটা বেরিয়েছে
৷ অামরা কয়েকজন অঙ্ক অার ফিজিক্সে খুব খারাপ নম্বর পাওয়ায় বিভুতি স্যার একদিন
পাড়ার রাস্তায় যেতে যেতে অামাকে দেখে ডেকে বললেন - এই শোনো ৷ তোমাদের কিন্তু
রেজাল্টটা মোটেই স্যাটিসফ্যক্টারী নয় ৷ এভাবে চললে কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে
সমস্যা হবে ৷ একটু নজর দতে হবে ৷ অমি কিছু বলতে চষ্টা করতেই উনি অামাকে থমিয়ে
বললেন - সোমবার থেক সকালে সাতটার মধ্যেই তোমরা যে ক"জনা খারাপ নম্বর পেয়েছো ,
অামার বাড়িতে যাবে ৷ অামি তোমাদের অঙ্ক অার সাইন্সের সাবজেক্ট- ফিজিক্স এবং
কেমিট্রিটা পড়বো ৷ সবাইকে বলে দিও ৷
জানতে চেয়েছিলাম - কত টাকা দিতে হবে ?
অামার কথা শুনে স্যর খুব বিব্রত হয়েছিলেন ৷ গলার স্বরটা ভারী করে বলেছিলেন -
মাস্টারকে টাকা দিয়ে শিক্ষা কিনতে চাও ? তোমার ধৃষ্টতা দেখে অামি অবাক হয়ে
যাচ্ছি ৷ শিক্ষকদের কাজ শিষ্যকে সত্যিকারের শিক্ষিত করে তোলা ৷ সেখানে দেনা
পাওনার কোনও গল্প থাকতে পারে না ৷ ছত্র অার শিক্ষকের সম্পর্কটা সেই প্রাচীন
কালের গুরু শিষ্যের সম্পর্কের মতোই ৷
অাজোও অামার কানে বিভুতি স্যারের সেই কথাটা বাজে ৷
অারোও একটা ঘটনার কথা অামার এখনো মনে অাছে ৷ একবার ওই এলাকায় ম্যলেরিয়া
মহামারির অাকার ধারন কয়েছিলো ৷ নৈহাটির কল্যাণী সিনেমা হলের পর থেকে ভাটপাড়া
হাই স্কুল পর্যন্ত গোটা এলাকাটা রেল লানের পূর্ পাড় জুড়ে ছিলো শ্রমিকদের বস্তি
৷ ঘিঞ্জি নোঙরা এবং স্যাঁতসেঁতে এলাকা ৷ জঙ্গল অার ময়লা জল ভর্তি নর্দমা ৷
যেহেতু , এলাকাটা রেলের জবর দখল করা জমি এবং দুস্কৃতি প্রবন ৷ কোনও পৌর সভাই
- না নৈহাটি , না ভাটপাড়া কেউই ওই এলাকায় নজর দিতো না ৷ বিভুতি স্যার নিজে
উদ্যোগী হয়ে ইস্কুলের মাস্টার এবং ছাত্রদের নিয়ে ওই এলাকার জঙ্গল কাটা এবং
নর্দমার নোঙরা পরিস্কার করে নিজেদে টাকা ব্লিচিং পাউডার কিনে ছড়ানোর ব্যবস্থা
করেছিলেন ৷ বলেছিলেন - মানুষের এই বিপদের সময় কে কার দায়িত্ব পালন করলো কিনা ,
কা দোষ এবং অন্যায় সেই বিতর্কে না গিয়ে অামরা শিক্ষক এবং ছাত্ররাও দেশের
নাগরিক ৷ দেশের কাজে ঝাঁপিয় পড়ে অার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই অাসল কতর্ব ৷
অামাদেরও এই সময় ওদের সেবার কাজে হাত লাগানো উচিৎ ৷
মহামারির প্রকোপ থেমে গেলে ওই বস্তির সব লোকজন একদিন অামাদের ইস্কুলের সব
মাস্টার এবং ছাত্রদের নিয়ে মিটিং করে সম্মান জানিয়েছিলো ৷ বলতে দ্বিধা নেই ওই
বস্তি বাসিদের চোখে সেদিন অামি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান অার ছাত্রদের উপরে
ভালবাসা দেখেছিলাম , অাজোও সেই দৃশ্য ভুলতে পারিনি ৷ সত্যিই সেদিন মনে
হয়েছিলো - বিভুতি স্যারের বিভূততে অামরা বিভাবিত হয়ে পড়েছিলাম ৷
অাজ জীবনের সাহাহ্নে এসে যখন দেখি শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শিক্ষা
বিক্রি করতে সদা ব্যস্ত , ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনৈতিক দাদা ভাইয়ের সম্পর্ক তৈরি
করেছেন , এটা যে কতটা বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করেছে সেটা পরিস্কার বুঝা যায়
যখন ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের শিক্ষক অধ্যাপকদের কারন অকারনে অপমান করছে ,
গালাগালি করছে -শ্রদ্ধা-ভক্তির লেশটুকুও দেখাচ্ছে না ৷
রাজনীতি অাগে যেমন শিক্ষরাওকরতেন , ছাত্র-ছাত্রীরাও করতো ৷ কিন্ত , সবাই
সেটাকে সামাজিক রীতিনীতির বাধ্যকতার মধ্যে বেঁধে রেখেই করতো ৷ অাজ সেটাই যেন
শুূধু অালগাই হয়নি , উলঙ্গ হয়ে পড়েছে ৷
জানিনা এর থেকে মুক্তি কিভাবে ঘটবে ?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন