সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
তীব্র দাউদাউ করে জ্বলছে বাসটা। দমকলের গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল জগন্নাথ ,চেতনা তার শেষ বিলুপ্তির পথে। বাসটা সম্পূর্ণ আগুন ধরে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে কিছু ভালো মানুষ তাকে স্টিয়ারিং থেকে জোর করে নামিয়ে আনে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ ভ্যান - রাজনৈতিক ফড়েদের ব্যস্ততা জায়গাটাকে ভাগাড়ের চেহারা দিলো যেন। তখন ও কেউ যেন বলছিলো ড্রাইভারটাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হোক এখনও চেষ্টা করলে বেঁচে যাবে।
জগন্নাথ হালদার ৫'৬" রোগা অর্ধবয়স্ক পোড়ো জংধরা চেহেরা।বাড়ি - নামখানা। 37A হাওড়া স্টেশন থেকে নয়াবাদ- গড়িয়া অবধি রুটের মিনিবাসের ড্রাইভার কাম মালিক। এক বিবাহযোগ্যা মেয়ের আর এক অটিজম আক্রান্ত ছেলের বাপ। খুব ছোটবেলায় দু - মুঠো বাড়তি অন্ন আর সুখ - স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় শহরে চলে এসেছিলো।জগন্নাথের বাপ ছিলো ভাগচাষী। আর মা ছিলো বছর পোয়াতি। দু বছর অন্তরই তার পেটে নতুন অতিথি বাসা খুঁজে নিতো। যেন মা ষষ্ঠীর কৃপালাভ করা গেরস্থ বেড়ালিনী। ছানাপোনার অভাব নেই।যদিও সবগুলো বাঁচে নি।আটখানার মধ্যে মেরেকেটে ওই তিনজন মাত্র টিকে ছিলো অথবা আছে।
নাকের নীচে একটু সরু রেখা দেখা দিতেই , একটু সমর্থ জোয়ান হতেই জগন্নাথ এক ট্রাক ড্রাইভারের সাথে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে শহরে চলে এসেছিলো।বললেও যে কেউ বিশেষ ধরে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতো তা নয়।মদ্দা ছেলে খানিক ডাগর হতেই হয় রাখালগিরি করবে নয়তো ভেড়িতে কাজ নেবে এই তো নিয়ম।তা সে শহরে এসে রোজগার যদি করে তাতে আর আপত্তি কোথায়। কিন্তু তবুও জগন্নাথ বাড়িতে কাউকে কিছু না বলেই চলে এসেছিলো। আসলে সেই টান, সেই স্নেহ , সেই আগলে রাখার আঠা না ছিলো বাপের ,না ছিলো মায়ের।অভাবের সংসার ,সেখানে পেটের খিদেই মূল কথা বাকি সব বাড়াবাড়ি।
বাড়ি থেকে চলে এসে বড়বাজারের কাছে একটা পাইস হোটেলে কাজ করেছিলো বছর দুয়েক। খাওয়া দাওয়া থাকা সবই ওই হোটেলে। তবে বাঁধা জীবন ওই বয়সে জগার একেবারেই ভালো লাগতো না ।'অতিথি 'র তারাপদর মতো তার মন ছিলো চঞ্চল। আবার কূলের মায়া ছেড়ে পাড়ি দিলো অনির্দিষ্ট জীবনের দরিয়াতে।
জগা ,জগন্নাথ হালদারের মতো পোশাকি নামের বাহার তার সইবে কেন। নিজের গায়েই যখন পোশাকের কোনো বাহার নেই। ছেঁড়া রংচটা জামা আর একটাই প্যান্টালুন তখনও অবধি সঙ্গী। বড়বাজার নানা কিসিমের মালপত্তরের হোলসেল মার্কেট, নানান জায়গার মানুষ রোজ আসে আর যায়।হোটেলে এসে দুপুরে রাতে শান্তি করে দু- মুঠো মুখে দিয়ে পেটের আগুনটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় থাকে।তা জগার হোটেল মালিকটা খারাপ ছিলো না। খুব ভালো ব্যবহার করতো খদ্দেরদের সাথে।বলতো - আমি তো কাউকে মাগনায় দু -মুঠো দিয়ে উপকার করতে পারবু নি।তাদের হকের কষ্টকরা ঘামধোয়া টাকাটা যেন বৃথা না যায়।যে চাট্টিখানি খাবে সে যেন শান্তি করে খায়।
তা এখানেই জগন্নাথের সাধন মোল্লার সাথে আলাপ।ট্রাকের ড্রাইভার ছিলো। মস্ত চেহেরা আর তেমনি বাজখাঁই গলা। মাঝে মাঝে যাতায়াতের সূত্রেই জগা তার বেশ ভালোবাসার লোক হয়ে গেলো।একদিন জগাকে সে ট্রাকের খালাসি করে হোটেল থেকে নিয়ে গেলো।মালিক আপত্তি কিছু করে নি। বলেছিলো অকূল গাঙের মতো অন্তহীন রাস্তাকে আশ্রয় করলি বাপু ,ঘর টুকুর খোঁজ রাখিস বিবাগী হয়ে যাস না। বাপ - মা টার কথা মনে রাখিস।তা সাধন মোল্লার সাথে বছর চারেক ভারতের ইদিক- উদিক অনেক গেছে।দিনের পর দিন রাস্তাটাই ঠিকানা আর ট্রাকটাই বাড়ি ঘর হয়ে গেছে।যখন সে বছর একুশের জোয়ানমদ্দ তখন একবার প্রথম সাধন মোল্লার সাথে তার দেশের বাড়ি বীরভূমে এলো।সাধন মোল্লার পথই ঘর।কিন্তু এদিকে আবার দেশের বাড়িতে দুটো বিবি। তাদের আবার চারখানই মেয়ে।বড় মেয়েটা বেশ ডাগুর ডুগুর মতো। বছর ষোলো ছিলো তখন।সাধন তাকে কেন তার দেশের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলো তা অতো তলিয়ে ভাবে নি তখনো । সে সাধনের সারাক্ষণের সঙ্গী, এখন সে নিজেই ভালো ড্রাইভারি করে। সাধন তাকে বাবার মতো ভালোওবাসে আবার ভুল হলে মুখে খিস্তির বন্যা ভাসিয়ে খাল খিঁচে দেয় তার।তবে পরে বুঝেছিলো তাকে ঘরের জামাই করার কথা সাধন মনে মনেই ভেবেছিলো।নইলে সমত্ত বয়সী মেয়ের সাথে বাইরের একটা ছেলের অবাধ মেলামেশাকে সে কেন প্রশয় দিয়েছিলো।
আনোয়ারার সাথে মন্দিরে গিয়ে একটা কোনোরকম বিয়ে তার হয়েছিলো। তাতে অবিশ্যি এতবছরের বিবাহিত জীবনে খুব অসুবিধে কিছু হয় নি। গরীবের আবার বিয়ে নিয়ে বিলাসিতা ,ধর্ম নিয়ে ভাববার অবকাশ। বিয়ে মানেই অভাবের আরেকটা সংসার।তাতে ছেলেপুলের জন্ম , আনন্দ যতটা তার চেয়ে ভারের বোঝা অনেকটা বেশি।তারপর তার ছেলেটাতো একটু ল্যালাখ্যাপা ধরনের ।জগার মা -বাবা অবিশ্যি দূরত্বের কারণেই হোক আর অন্যজাতে বিয়ে করার জন্যই হোক, জগার বিয়েতে আসে নি।মাসে মাসে তারা টাকা পেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে।
তবে আনোয়ারা ছিলো লক্ষীমন্ত মেয়ে।তার চেষ্টাতেই ট্রাকের ড্রাইভারি থেকে আজ জগা একটা মিনিবাসের ড্রাইভার কাম মালিকও বটে।নামখানাতে ছোটো একটা পাকাবাড়িতে ছেলে -মেয়ে নিয়ে আনোয়ারা থাকে। জগা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির ড্রাইভারী করে রাতে একটু পিঠটাকে সোজা করার জন্য বাড়ি যায়। তাও মাঝে মাঝে যায় না। বাসেই থেকে যায়।
কিন্তু সেই বাসটাই যে জ্বলে পুড়ে চোখের সামনে খাক হয়ে গেলো - এবার কি হবে ? করোনার জন্য দীর্ঘ লকডাউন হাতে যা টাকাকড়ি ছিলো সবই তো একবছর বসে বসে খেয়ে শেষ।ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে।গ্রামে গঞ্জে ভদ্রঘরে ও মেয়ের বিয়ে দেওয়া সোজা কথা নয়। মা মুসলমান বাপ হিন্দু।জেনেশুনে কেই বা আর নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চাইবে। গ্রাম্য সমাজের মিথ্যে অহংকার।
তারপর অনেকদিন বাদে কিছু বাস চালানোর অনুমতি দিয়েছিলো সরকার এতদিনে।অর্ধেক লোক নিয়ে বাস চালালে তাদের কি করে পেট চলে? এদিকে দিনকে দিন ডিজেল পেট্রোলের দাম তো বেড়েই চলেছে। বাসের ভাড়াতো বাড়াতেই হবে।সরকার নারাজ।তার জনোমোহিনী নীতিতে তাহলে ধাক্কা আসবে যে। তেলের দাম বাড়াতেই হয় কারণ ধনকুবের ধনপতীদেরতো আর সরকার চটাতে পারে না।যত জ্বালা মধ্যবিত্তদের ।তাও যা হোক সামান্য কিছু ভাড়া বেড়েছে।আর তাই দিতেই লোকজনের আপত্তি।
আজ সন্ধ্যেতে কন্ট্রাক্টর কাম খালাসি সেই ভাড়া চাইতে গিয়েই যতো গন্ডগোল।একে কয়েকদিন পরেই ভোটের বাজার চারিদিকে জমায়েত মিছিল.. সবে গরম পড়ছে।এবার অনেকদিন বৃষ্টি নেই। ঠান্ডা এবার শহরে এমনিতেই পড়ে নি। রাস্তাজুড়ে জ্যাম।গাড়িও জোরে চালানো যাচ্ছিলো না।এমনিতেই প্যাসেঞ্জার অধৈর্য হচ্ছিলো।তারউপর কিছু উঠতি বয়সের অপ্রকিতস্থ ছেলে বাসে চেপেছিলো , তাদেরকে ভাড়া চাইতেই বিপত্তি।
আসলে মানুষের ভিতরে যখন দীর্ঘদিনের শোষণ - বঞ্চনা - অবিশ্বাস - দারিদ্র্য - বেকারত্ব - একসঙ্গে মিলেমিশে মনের ভিতর পেটো বোমার মতো জমে থাকে।তারপর যখন সেটা ছোঁড়া হয় কোথায় কখন কারউপর কিসের জন্য ছোঁড়া হচ্ছে একথা বোধহয় কারোরই খেয়াল থাকে না।গলগল করে লাভা উদ্গীরণের মতো বেরিয়ে আসতেই থাকে। যখন তা আপাত শান্ত হয় ততক্ষনে ক্ষতির বোঝা কয়েকগুন বেড়ে যায়।
রতনকে বাস থেকে নামিয়ে মারতে দেখে ,বাস থামিয়ে জগাও ছুটে গিয়েছিলো বাঁচাতে।কিন্তু তার মধ্যেই কে যেন বাসে কিভাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। তা দেখে জগা আর সহ্য করতে পারে নি।ছুট্টে আবার হটবুদ্ধির মতো বাসে উঠে স্টিয়ারিং চেপে ধরে বসে পড়েছিলো। বাসটা দাউদাউ কর জ্বলে উঠেছিলো। কর্তব্য ট্রাফিকপুলিশ আরও অন্য বাসের ড্রাইভার খালাসীরা ছুটে এসে তাকে প্রায় জোর করে বাস থেকে নামায়। ততক্ষণে তার শরীরও কিছুটা আগুনের গ্রাসে আর ঘটনার তীব্রতায় সেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁজাকোলা করে আয়ম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে।তখন তার একটু হলেও জ্ঞান ফিরে আসছিলো।সেইসময় যদি কেউ কান পেতে শুনতো তাহলে পেতো হয়তো জগা ঠোঁটদুটো নেড়ে যা বলার চেষ্টা করছিলো। সে বলছিলো -- " বাঁচতে হবে আমাকে বাঁচাও ।আমাকে মরলে হবে না।এখনো অনেক যুদ্ধ বাকী। মধ্যবিত্তদের যুদ্ধ কখনো শেষ হয় না। তার প্রত্যেকটা দিন শেষের শুরু।"
--------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন