আমাকে মনে পড়ে ক্রন্দসী? পন্ডিচেরির সমুদ্র সৈকতে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল ।আপনি খানিকটা দূরে একা বসেছিলেন। আপনার শীর্ণ করুণ মুখশ্রীতে গোধূলিবেলার করুণ আলো এসে পড়েছিল। আমিও খানিকটা দূরে বসে উচ্ছ্বল ঢেউয়ের ভেতর উচ্ছ্বাসে মেতে থাকা নারীপুরুষদের দেখছিলাম। খুব গরম ছিল সেদিন। আপনার পুরুষসঙ্গীটি স্নান করছিলেন তার পাশে আরও দুজন নারী পুরুষের জুটি সমুদ্রস্নানে মেতে উঠেছিল। একটি উত্তুঙ্গ ঢেউ এলো। স্নানরত নারী পুরুষদের টেনে নিল তার ভেতর। ঢেউ সরে গেলে পর দেখা গেল আপনার পুরুষ সঙ্গীটি আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছেন এক মহিলার সাথে, প্রায় মিনিটখানেক এই আলিঙ্গনাবদ্ধ নারীপুরুষ এক স্থিরচিত্রের মত বাঁধা রইলেন। গোধূলিবেলার আলোয় তখন আমি আপনার মুখ দেখছিলাম। আপনি আমার চোখ চোখ রেখে দেখলেন, যেন বিষম লজ্জায় অতঃপর চোখ নামিয়ে নিলেন। আমরা তো একই হোটেলে উঠেছিলাম। আপনারা তিনটি জুটি নারীপুরুষের। অথচ আপনার সঙ্গীটি পাশের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতেন আর আপনি সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হোটেলের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে থাকা অজানা বৃক্ষের আন্দোলন দেখতেন, আর উল্টোদিকের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি দেখতাম আপনাকে। আপনার বিশীর্ণ চেহারায় অদ্ভুত এক আকর্ষণ ছিল। আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে চাইছিলাম। সুযোগ খুঁজছিলাম কিন্তু পাইনি। শুধু আপনাদের কথাবার্তা শুনছিলাম একদিন হোটেলের ডাইনিং হলে বসে,মনে হলো আপনার নাম ক্রন্দসী। শুধু নামটি জেনেও ভেবেছিলাম আপনার অনেক কাছাকাছি চলে গেছি।
ক্রন্দসী, আপনি আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন সেটা বুঝতে পারলাম বাড়ি ফিরে এসে। কিন্তু আপনার সাথে যোগাযোগ হবার তো কোন রাস্তাই আর খোলা ছিল না। সুলগ্না, আমার বান্ধবী আমাকে না জানিয়ে ভিন্ন যুবকের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যাবার পর আমি একাকীত্বই পছন্দ করতাম। কিন্তু আপনার ক্লান্ত শীর্ণ চেহারায় এমন কিছু ছিল যা আমাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছিল। এরই মাঝে এসেছে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ। চেনাপরিচিত মানুষগুলো ভাইরাসের ছোবলে মারা পড়ছে। এমন আকস্মিক লাগামছাড়া মৃত্যু ভাইরাসের প্রথম আক্রমণে হয়েছে বলে মনে হয় না। ভাবলাম কিছু জিঙ্ক ও ভিটামিন সি আগে থেকেই নিয়ে নেওয়া যাক ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্যে। ওষুধের দোকানে ফোন করে জানতে পারলাম ওষুধগুলো আছে ঠিকই কিন্তু কতদিন সেটা পাওয়া যাবে বলা শক্ত। সাংঘাতিক চাহিদা। শৈবাল, মানে দোকানের ছেলেটি বলল - বাবলুদা দেরি করো না। আজই এসে নিয়ে যাও। - দেরি না করে বেরিয়ে পড়েছি। দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন। ওষুধ শেষ অব্দি পাবো কিনা কে জানে! আমার ঠিক আগে এক ক্ষীণদেহী মহিলা দাঁড়িয়ে। লাইন শম্বুকগতিতে এগোচ্ছে। মে মাসের দুপুর। আশেপাশে কিছু গাছগাছালি আছে, আকাশে ও হালকা মেঘ খানিকটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে তবু একটা ভ্যাপসা তাপ আছে। আচমকা আমার সামনে দাঁড়ানো মহিলাটি আমার উপর এসে পড়ল। ক্ষিপ্রহাতে ধরে ফেললাম। মুখে মাস্ক, মাথায় ওড়না জড়ানো, কেন যে আমার আপনার কথা মনে পড়ছিল। লোকজন চারপাশে ভিড় জমিয়েছে, শৈবালকে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করলাম। সাধ্যমত শুশ্রূষার পর মহিলাটির চেতনা এল। চোখ খুলে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম। গোধূলিবেলার সমুদ্র সৈকতের সেই সন্ধ্যায় আপনার করুণ অসহায় দৃষ্টির সাথে এই মহিলার দৃষ্টির কোথায় যেন ভীষণ মিল আছে। এরইমধ্যে এক মহিলা ভিড় কেটে এগিয়ে এলেন। ঝুঁকে মহিলাটিকে দেখেই বললেন - আরে ক্রন্দসী, তুই কেন এসেছিস এখানে? দেখো কান্ড! ঠিক আছে, আমি একে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। ভাই, আপনি ওকে একটু গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন? - ক্রন্দসী! তাহলে আপনিই! সেজন্যেই বারবার আপনার কথা মনে পড়ছিল! আমি আপনাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিলাম। আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমার ওপর নির্ভর করছিলেন। আপনাকে ওভাবে অচেনা মহিলাটির কাছে ছেড়ে দিতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। আপনাকে বললাম - আপনি আমাকে কি চিনতে পেরেছেন ক্রন্দসী? - আপনি নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মহিলাটি বললেন - আগের চেনা নাকি? বললাম - হ্যাঁ। - কোথায়? কবে? - বললাম - দু'তিনমাস আগে, পন্ডিচেরির সমুদ্রতটে।- মহিলাটি কপাল কুঁচকে কী ভাবল। তারপর বলল - তুই কবে পন্ডিচেরি গেলি? জানি না তো! - হ্যাঁ, অবশ্যই গেছেন। - এবার আপনি আপনার হাতব্যাগ খুলে একটি ছোট্ট ভাঁজ করা কাগজ দিয়ে বললেন - এটাতে আমার ফোন নং আছে।কণ্ঠস্বরে এমন মাধুর্য আপনার! আমার অস্থির লাগছিল। মহিলাটি গাড়ি ছাড়বার আগে আমার কাছে এসে বলল - যোগাযোগ করে লাভ নেই। যেমন আছেন খুব ভালো আছেন, এটা জানবেন। শুধু শুধু নিজেকে ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলবেন না। ছুঁড়ে ফেলে দিন ফোন নং। ধন্যবাদ আপনাকে সাহায্যের জন্যে। - জিজ্ঞেস করলাম - আপনি ওর কে হন? কোথায় বাড়ি ক্রন্দসীর? - আমরা একই আবাসনে থাকি। ওর লাগোয়া ফ্ল্যাটে আছি।- তারপর গলা খাদে এনে বলল - ঝামেলায় জড়াবেন না মশাই। আচ্ছা আসি। -আপনার মুখ জানালায়। কী আকূতিভরা দৃষ্টি! আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। গাড়ি ছাড়ল।
ফোন নং টা সেভ করে রাখলাম। রাতে ফোন করলাম, কেউ ওঠালো না। সেই থেকে রোজ কতবার করে ফোন করছি, বেজে বেজে যায়, কেউ তোলে না। কতদিন এভাবে চলবে জানি না।
........................................
-বিজয়া দেব ।
225 Purbachal Road North
Kolkata - 700078.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন