Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

গল্প ।। কথা রাখার কথা ।। সুপ্তা আঢ্য


কথা রাখার কথা         

সুপ্তা আঢ্য
বড়ো রাস্তা ছাড়িয়ে দুটো গলি পেরিয়ে তিন নম্বর গলির একটু ভেতরে বড়ো পাঁচতলা আবাসনের চতুর্থ তলার দক্ষিণমুখো ফ্ল্যাটের বসার ঘরে সৌপর্ণ ওর স্ত্রী হিয়া আর ওদের মা বিতস্তা দেবী এই মুহূর্তে গভীর আলোচনায় মগ্ন ।আধুনিকতার সাথে সাবেকিয়ানার মেলবন্ধনে সাজানো ফ্ল্যাটের ভিতরটা দেখলেই এ বাড়ির মানুষদের রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।বছর খানেক আগে বাড়ির কর্তা রণিতেশ সেন রিটায়ারমেণ্টের পর পরই ইহলোকের মায়া কাটিয়েছেন। আর মিসেস বিতস্তা সেন এই একমাস হলো স্কুল জীবনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিজের সাথে সময় কাটাচ্ছেন । ওনার ছেলে সৌপর্ণ আর ওর স্ত্রী দুজনেই মুম্বইয়ের এক বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত, ওদের একমাত্র ছেলে সৌহার্দ্য পাশের ঘরে আপনমনে ভিডিও গেম খেলতে ব্যস্ত। সৌপর্ণ ওর মাকে বলে উঠল "তুমি এখন কি করবে---কিছু ভেবেছ?" "ঠিক বুঝলাম না রে----কী করব বল তো?" "না মানে - - - তোমার তো রিটায়ারমেণ্ট হয়েই গেল - - - - বাবাও এখন নেই। এই ফাঁকা বাড়িতে তুমি একা কী করবে? বরং তুমি আমাদের সঙ্গে চল---ওখানে তুমি ভালো থাকবে মা।" "ও--এই কথা। কিন্তু - - - - " " কিন্তু কি মা! " "দেখ বাবা----আমি তোর ঘাড়ে বোঝা হতে চাই না। ষাটের কোটা পেরিয়ে এলাম----যে কটা দিন বাঁচব _---চতুরাশ্রমের তৃতীয় আশ্রম বাণপ্রস্থকেই না হয় বেছে নিলাম। কিন্তু এখন জঙ্গলে তো থাকতে পারব না - - - - তাই শহর ছাড়িয়ে ভাগীরথীর তীরে একটা বৃদ্ধাবাসের খোঁজ পেয়েছি। ওখানেই থাকব রে । " বিতস্তা দেবীর এহেন সিদ্ধান্তে সৌপর্ণ আর হিয়া স্তব্ধবাক হয়ে বসে রইল - - - সারা ঘরজুড়ে এখন পিন ড্রপ সাইলেন্স। পরিবেশটা হাল্কা করার জন্য উনি বলে উঠলেন" তুই এত বড়ো হয়ে গেছিস আর এই একটা ছোট্ট কথায় মন খারাপ করে বসে পড়লি? " " এটা ছোট কথা নয় মা----তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে----এটা ভাবলে কি করে?" "তোদের ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি----শুধু এই ফাঁকা বাড়িটা ছেড়ে অন্য বাড়িতে যাচ্ছি। ছুটি ছাটায় তোদের আসার খবর পেলে এসে সবাই একসাথে কাটিয়ে যাব। আর শোন, এই কাগজগুলো রাখ----" " এগুলো কিসের কাগজ মা! " " এই বাড়ি আর ব্যাংকের পেপার্স---এগুলো সাবধানে রাখবি।" " কবে যাবে তুমি? " " কাল বিকেলে যাব। হিয়া, তোমাদের ফ্লাইট কখন? " " সকালে মা। " " ঠিক আছে, আমি ঘরে গেলাম - - - কিছু গোছানোর আছে----ওগুলো কমপ্লিট করে নি। তোমরাও শুতে যাও।" কথাগুলো বলে নিজের ঘরে গিয়ে পরেরদিনের যাত্রার সবকিছু গোছগাছ কমপ্লিট করে নিল বিতস্তা। শেষ মুহূর্তে স্বামী রণিতেশের একটা ছবি সঙ্গে নিয়ে নিল ও। সমস্ত গোছগাছ সারা হতে ঘড়ির দিকে মুখ তুলে তাকাতেই দেখল ঘড়ির ছোট কাঁটাটা একটার ঘর প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। টেবিলের ওপর রাখা বোতল থেকে জলটা খেয়ে বিছানার দিকে একঝলক তাকিয়ে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে বারান্দার চেয়ারে এসে বসল বিতস্তা। পাশের ছেলের ঘর থেকে তখন চাপাস্বরে স্বামী স্ত্রীর আলাপনের আওয়াজ আসছে। ওদের কথার আওয়াজে মুচকি হেসে চেয়ারে বসে বাইরে গহীন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল ও। এত বছরের সংসার জীবনের আজই শেষ রাত ওর----তাই প্রথম রাতের মতো শেষ রাতটাও না ঘুমিয়ে থাকার সিদ্ধান্তই নিল ও। বাইরের নিঝুম নিশার নীরবতা যখন চারপাশকে ঘিরে রেখেছে তখন মাঝে মাঝে পথ কুকুরদের চিৎকার ওর মায়া জাল ছিন্ন করলেও তাকে পূরণ করতে বেশী সময় লাগছিল না নিশার। এরকম রাত বড়ো প্রিয় বিতস্তার----এমন রাতেই তো ভেলায় চড়ে সময় সাগরের স্মৃতির ঢেউয়ে নিমগ্ন হওয়া যায়। অন্ধকারকে চোখে জড়িয়ে স্মৃতির অতলে ডুব দিতেই ছবির মতো ওর চোখে ভেসে উঠতে লাগল সবচেয়ে প্রিয় কিশোরীবেলা। মনে পড়ে গেল স্কুল থেকে পাঁচজন মিলে বাড়ি ফেরার কথা। ও, দীপন, পাঞ্চালী, শ্যামল আর স্মৃতিকণা---পাঁচবন্ধুর মিলেমিশে থাকার কথা বড্ড মনে পড়ছিল ওর আজ। ওদের বন্ধুত্বের বিষয় ছোট্ট গ্রামটায় চর্চিত থাকলেও ওদের কোনো হেলদোল ছিল না এই ব্যাপারে। এই পাঁচজনের দলে বিতস্তা আর দীপন ছিল সবচেয়ে কাছের বন্ধু - - - - আর এই বন্ধুত্ব যে কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি কেউ। পাঞ্চালী এ নিয়ে আড়ালে বিতস্তাকে খ্যাপালেও পাত্তা দেয়নি ও কখনও। দীপ ওর প্রেমিক - - - এটা ভাবলেই চাপা হাসিতে মুখ ভরে উঠত ওর। আর ওকে মুখ চেপে হাসতে দেখে পাঞ্চালী বলল"তুই আমার কথা মানছিস না তো---পরে কিন্তু তুই পস্তাবি।" "শুধু শুধু পস্তাতে যাব কেন?" "দীপ তোকে সত্যিই ভালোবাসে রে----ওর চোখ দুটো দেখিসনি তুই? এই স্মৃতি, তুই কিছু বল না!" স্মৃতিকণা কিছু বলার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বিতস্তা বলে উঠল "ও কি বলবে রে? আর দীপের চোখে আলাদা কি আছে বলতো! তুই একটু বেশীই ভাবিস এসব নিয়ে। " ওদিকে শ্যামলও দীপনকে তাগাদা দেয় মনের কথা বিতস্তাকে খুলে বলার জন্য। কিন্তু যাকে নিয়ে এত আলোচনা - - - সেই দীপন ছিল নিজের জায়গায় অটল। ও বলত"তিস্তাকে নিজেকেই বুঝে নিতে দে ওর ভালোবাসাকে। আজ আমি বললেও ও বুঝবে না রে---- এতে ওর সাথে বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এর চেয়ে এটাই ভালো - - - - ।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপন চলে গেলে শ্যামল মুখ নামিয়ে উপায় ভাবতে থাকত বিতস্তাকে জানানোর। ওরা তিনজন কোনো উপায় না পেয়ে নীরব দর্শকের মতোই দীপনের একতরফা ভালোবাসার যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে বুক ফেটে গেলেও মুখ ফোটাতে পারে না দীপনের মুখের দিকে তাকিয়ে। এর মধ্যে কলেজ জীবন শেষে হায়ার এডুকেশনের জন্য দীপন বাইরে চান্স পেয়ে যায় আর বিতস্তার বাড়িতে পাত্রপক্ষের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। পাত্রপক্ষের পাকা কথার খবরটা বিতস্তা উত্তেজিত হয়ে দীপনকে জানাতে গিয়ে ওর মায়ের কাছে শুনল "দীপ একটু বেরিয়েছে বিতস্তা।" "কখন ফিরবে ও কাকীমা?" "ও তো পরশু চলে যাচ্ছে - - - তারই কেনাকাটা করতে গেছে।" "ও কোথায় যাচ্ছে কাকীমা?" "ওমা, তুই জানিস না - - - ও তো পিএইচডি করতে দিল্লী যাচ্ছে। তুই ওর ঘরে বস - - - ও এখনই চলে আসবে।"

Supta sent Today at 7:54 PM

বিস্মিত বিতস্তা দীপনের ঘরে ঢুকে চারিদিক দেখতে দেখতে হঠাৎই ওর চোখ পড়ে গেল টেবিলের ওপরের রাখা ডায়েরিটায়। এত বড়ো খবরটা দীপন ওকে না বলায় মনে মনে রাগ হলেও ডায়েরিটা দেখার কৌতুহল চাপতে পারছিল না ও।পায়ে পায়ে টেবিলের কাছে গিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ল ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের কথা কি অসামান্য ভাবব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে প্রতি পাতায়। পড়তে পড়তে চমকে উঠছিল বিতস্তা - - - - দীপনের চোখে নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করে মুক্তোর মতো জলবিন্দু শ্রাবণের বারিধারার মতো অঝোর ধারায় কপোল, চিবুক হয়ে কণ্ঠদেশে মিলে বড়ো বড়ো ফোঁটায় ভিজিয়ে দিচ্ছিল ডায়েরির পাতাগুলো। সময়ের কোনো হুঁশ ছিল না ওর - - - - বাইরে দীপনের গলার আওয়াজ পেলেও কোনোমতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে স্থানুবৎ বসে রইল বিতস্তা । মায়ের কাছে বিতস্তার আসার খবর শুনে কোনওরকমে সাইকেলটা রেখে ঘরে ঢুকে ওকে টেবিলের কাছে বসে থাকতে দেখে একটু ভয় পেয়ে কাছে গিয়ে দেখল দামাল মেয়েটা শান্ত হয়ে বসে আছে - - - কোলের ওপর ডায়েরিটা খোলা আর ওর সারা গালে চোখের জলের আঁকিবুঁকি। ডায়েরির সাথে এই অবস্থায় বিতস্তাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত ভাবে ওকে ঝাঁকিয়ে বলল "কি রে তিস্তা, কী হয়েছে তোর?" "কিচ্ছু না - - - কী হবে - - - তুই তো সব জানিস---তুই বল আমার কী হয়েছে।" "আমি স্যরি তিস্তা - - - ওগুলো এমনিই পাগলের প্রলাপ - - - - ওগুলো দেখে তুই কিছু মিন করিস না রে।" দীপনের মুখে একথা শুনেই কোনওরকমে ডায়েরিটা রেখে ওর কাছে গিয়ে দুহাতে ওর জামার কলারটা ধরে বলে উঠল" কোনটা এমনিই - - - দীপ----তুই - - তুই - - - আমাকে এত ভালোবাসিস - - - আর সবটাই এমনি! "ওর কলারটা ধরে ওকে আরও কাছে টেনে ঝাঁকিয়ে ফিসফিসে গলায় বলল" তুই কি ভেবেছিলি---তুই একাই ভালোবেসে মহান হতে পারিস - - - - সব ছেড়ে চলে যেতে পারিস - - - - আমি কিচ্ছু পারি না? দেখ আমি কি করতে পারি?" তিস্তা রেগে গেলে কি করতে পারে সে সম্পর্কে খুব ভালোই জানে দীপন----সরলমনা মেয়েটা রেগে গেলে জাস্ট পাগল হয়ে যায় - - - - আর দীপনের প্রতি ওর পজেসিভনেস তো ওর জানা----তবু কেন যে মেয়েটা এতদিন নিজের মন বুঝতে পারেনি কে জানে! দীপন ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল "একটু শান্ত হ----আমার ভুল হয়ে গেছে - - - - তোকে বোঝানোর দায়িত্ব ছিল আমার - - - - আমি পালন করিনি - - - আমাকে যা সাজা দেওয়ার দে----কিন্তু তুই একটু মাথা ঠাণ্ডা কর, লক্ষ্মীটি। কথা শোন আমার - - - - সোনা মেয়ে তুই।" দীপনের বাহুডোরের বাঁধনের পরম আশ্রয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল তিস্তা। ওকে কাঁদতে দিয়ে ওকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ওর মাথায় ভালোবাসার পরশ বোলাতে লাগল দীপন। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর একটু শান্ত হয়ে দীপনের বাহুডোরে আরও নিশ্চিন্তে নিজেকে সঁপে দিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলে উঠল "এখন কী হবে দীপ? তুই চলে যাবি আমাকে ছেড়ে? পারবি থাকতে---বল না?" বিষণ্ণ হাসি মুখে ফুটিয়ে ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল"তুইও তো তোর চলে যাবার খবরটাই আমাকে দিতে এসেছিস পাগলী!এখন একটু নিজেকে শান্ত কর তো।" "এরপরেও তুই আমাকে শান্ত হতে বলছিস! কী হবে এখন----বাড়ি গিয়ে মাকে সবটা বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে হবে রে---আমি এখন যাই রে! বিকেলে দেখা করি বরং---" "শোন - - - একটু ঠাণ্ডা হ' তুই---একটা কথা কেন বুঝতে পারছিস না - - - তোর বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে - - - এখন কিচ্ছুটি করিস না সোনা! " " তাতে কী হয়েছে - - - - বিয়েটা তো আর হয়ে যায়নি। তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজী আছিস তো? " " তুই ভুল করছিস তিস্তা - - - এত কিছুর পর বিয়েটা ভেঙে গেলে কাকুর সম্মানের কী হবে ভেবেছিস! শুধু নিজের কথাই ভাববি - - - ওই মানুষটার কথা ভাববি না একবারও? " " তাহলে এখন কী করব তুই বলে দে? আমাকে সারাজীবনের জন্য অন্য কারোর হাতে হাত রাখতে হবে---এটা কী ভাবে সম্ভব দীপ? " তিস্তার উত্তেজনায় গুরুত্ব না দিয়ে শান্ত স্বরে দীপন বলল" তুই যে আমার ভালোবাসাকে---আমাকে - - - গ্রহণ করেছিস - - - এতেই আমি ধন্য রে। " " তুই এত কম পাওয়ায় কী করে ধন্য হতে পারিস দীপ! আমি যে আরও বেশী চাই----" " তুই এখন যা করতে চাস---সেটা করে তোর বাবা মাকে অথৈ জলে ফেলে দিস না তিস্তা - - -" "তাহলে - - -" তিস্তার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে দীপন বলল" এই পৃথিবীটা বড্ড ছোট রে---তুই আমি একদিন ঠিক মিলবই। দেখিস তুই---" " তুই চলে যাচ্ছিস - - - আর আমিও কটাদিন পর অন্য লোকের সংসার করতে যাব---কী করে দেখা হবে তোর-আমার! " " ভালোবেসে দূরে থাকা যায় না বলেই এক হব---কবে---কোথায় - - কিভাবে - - - কিচ্ছু জানি না রে - - - শুধু জানি, দেখা আমাদের হবেই। তুই এখন বাড়ি যা - - - - কাকীমা চিন্তা করছেন। তোর বিয়েতে আসব না রে--। তোর-আমার এটাই শেষ দেখা---বিকেলে সবাই আজ আড্ডা দেব---আসিস কিন্তু।" কথাগুলো বলে হাতে ধরা তিস্তার হাতটা ছেড়ে দিতেই ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ও। দীপন ওর হাল্কা নীলচে শার্টের প্রতিটি সুতোয় জমিয়ে নিচ্ছিল ওর চোখের জল ।বেশ কিছুক্ষণ পর বিতস্তা নিজেকে সামলে চোখ মুছে একবারও পিছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সেদিন বিকেলে ওরা ডাকতে এলেও মাথা ধরার অজুহাতে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল বিছানায়। পরদিন দীপনও চলে গেল আর তার কয়েকদিনের মধ্যেই একমাথা সিঁদুর পরে কনের সাজে সেজে রণিতেশের হাত ধরে এ বাড়িতে চলে আসে বিতস্তা। সেদিনের পর থেকে দীপনের আর কোনও খোঁজই পায়নি ও। নিজেদের চাকরির সুবাদে অনেক মানুষ দেখলেও ওই একজোড়া চোখ কোথাও খুঁজে পায়নি ও। বাপের বাড়ি গিয়ে শ্যামলের কাছে শুনেছে, বাইরের কোনো এক কলেজে দীপন পড়ায় - - - গ্রামে প্রায় আসেই না। ভীষণই জানতে ইচ্ছে করছিল---দীপনের বিয়ের খবর---ওর বউ কেমন হয়েছে - - - কিন্তু শ্যামলের সামনেও লজ্জায় জিভ জড়িয়ে যাচ্ছিল ওর। বোধহয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরে শ্যামল বলেছিল"জানিস বিতস্তা - - - দীপন একাই থাকে - - - বিয়ে করেনি। কতবার বললাম বিয়ের কথা----কিন্তু - - -"

Supta sent Today at 7:55 PM

কিন্তু কী" সেটা আর জিজ্ঞেস করতে জিভ সরল না ওর---বদলে প্রসঙ্গ পাল্টে দুএক কথা বলার পর চলে এসেছিল বিতস্তা। এক অপার আনন্দে বুক ভরে উঠেছিল ওর----দীপ এখনও ওরই আছে----এটা ভেবে দীপের সেদিনের স্পর্শের কথা মনে পড়তেই শিহরিত হয়ে উঠেছিল ওর সারা শরীর। সেদিনের পর থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিল ও। তবে এখনও একলহমায় যেমন ও দীপকে নিজের ভাবতে পারে----এতদিন সংসার করার পরেও ও যেমন রণিতেশের হতে পারেনি তেমনি ওই মানুষটাকেও নিজের ভাবতে পারেনি কখনও। প্রতি মুহূর্তে দীপনের স্মৃতি কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে ওকে - - - - সকালে ঘুম থেকে উঠতই ওর দীপকে সাথে নিয়ে আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওর দীপের দুচোখ নিজের চোখে জড়িয়ে ঘুমোতে যেত বিতস্তা। একমাত্র ছেলে সৌপর্ণ বাইরে চলে যাওয়ার পর থেকেই সংসারের বাঁধন আলগা হতে শুরু হয়েছিল ওর আর এখন রণিতেশের মৃত্যুর পর সে বাঁধনটা পুরোপুরি ছিঁড়ে গেছে। এখন এই সংসার থেকে মুক্তি নিয়ে নতুন করে দীপের স্মৃতি সাথে নিয়ে বাঁচবে ও। দীপের সাথে দেখা হওয়ার স্বপ্ন আর দেখে না তিস্তা - - - - দীপ যতই বলুক পৃথিবীর পরিসর ছোট - - - তিস্তা কিছুতেই মানতে পারে না সে কথা। পৃথিবী ছোট হলে দীপের দেখা ও ঠিক পেত, এতবছরেও যখন ও দীপের দেখা পায়নি তখন বাকি জীবনটা একা দীপের সঙ্গে কাটানো সময়ের সাথেই সহবাস করবে ও। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ভোরের পাখির সুরেলা আওয়াজে চমকে তাকিয়ে দেখল মিলনপিয়াসী প্রভাকরের সাথে মিলনের পর ঊষার কপোলের আবীরের লালিমার আগুন রাঙা রঙে সেজে উঠছে ভোরের আকাশ। সকালের এই সময়টা বরাবরই ওর খুব প্রিয়। ভোরাইয়ের সুরের মূর্চ্ছনায় মোহিত হয়ে আবীর রাঙা আকাশের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিতস্তা । হঠাৎ নীচে সাইকেলের বেলের আওয়াজে ঘোর কাটতেই মনে পড়ে গেল, একটু পরেই সৌপর্ণ হিয়ারা বেরোবে আর তাছাড়া ওর নিজেরও বেরোনোর তাড়া আছে। ওরা বেরিয়ে পড়লেই সবকিছু গুছিয়ে রেখে বিতস্তাও বেরিয়ে পড়বে ওর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে । প্রত্যেকবার সৌপর্ণ আর হিয়া হইহই করতে করতে যায় আবার আসার তাগিদে। কিন্তু এবার বোধহয় সেই মায়ের কাছে আসার তাগিদটা নেই বলেই ওদের যাবার তাড়াটাও ছিল কম। মায়ের সিদ্ধান্তের বদল হবে না বুঝে মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে ছোট থেকেই মায়ের ভালোবাসার কাঙাল সৌপর্ণর। যাবার আগে আজ একটু বেশী সময় নিয়েই প্রণাম করতে গিয়ে নিজের অলক্ষ্যেই একফোঁটা জল বিতস্তার পায়ে পড়তেই ছেলেকে তুলে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন "এত মনখারাপ করছিস কেন? আমি ভালো থাকব এটা ভেবে খুশি থাকতে পারবি না তুই?" চোখের জল মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে সৌপর্ণ মায়ের হাত ধরে বলল "তাই হোক মা---তুমি ভালো থেকো আর - - -" "আর কী---বল---" "আমাদের ভুলে যাবে না তো মা?" নাতিকে বুকে জড়িয়ে হিয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন " তুই আমার সন্তান - - - - আমার প্রতিটা নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছিস তোরা। নিশ্বাস নেওয়া বন্ধ না হলে তোকে কি করে ভুলব বল। তুই চিন্তা করিস না - - - আমি ভালোই থাকব। " ওরা বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়িটাকে শেষবারের মতো একবার দেখে নিয়ে একটা গাড়ি বুক করে রওনা দিল নিজের নতুন ঠিকানার দিকে। প্রায় ঘন্টাখানেকের জার্নির পর যখন 'নবনীড়ে' এসে পৌঁছল তখন গোধূলিবেলার শেষের আবেশটুকু চোখে জড়িয়ে বিকেল অপেক্ষায় রয়েছে সন্ধ্যারানীর সন্ধ্যাতারা জ্বালানোর। ফোনে সবকিছু আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখায় এখানে এসে কোনো অসুবিধে হয়নি বিতস্তার। দোতলার দক্ষিণ - পূব খোলা বারান্দাসংলগ্ন এক কামরার ঘরটা বেশ মনোমতই হয়েছে ওর। বারান্দার সামনের বাগানের নাম না জানা গাছের সারির ফাঁক দিয়ে দেখা একফালি চাঁদের আবছা আলো মুগ্ধ করছিল ওকে। আজ প্রথম দিন হওয়ায় সন্ধ্যের প্রার্থনায় না গিয়ে চুপচাপ নিজের বারান্দায় বসে সন্ধ্যের এই আমেজটুকু উপভোগ করছিল ও। বহুদিন এরকম আমেজি সন্ধ্যে না দেখা বিতস্তা যখন সন্ধ্যের রেশটুকু নিতে ব্যস্ত তখন সন্ধ্যের চাঁদ হঠাৎই লুকিয়ে কালো ধোঁয়ার মতো একখণ্ড মেঘকে জায়গা দিতেই ধীরে ধীরে সেই ধোঁয়া জড়ানো মেঘরাজি কখন যেন নীলাকাশকে ধোঁয়ার চাদরে মুড়ে ঝড়কে সাথী করে তার অসামান্য বাজনার দুন্দুভিতে প্রকৃতিরানীকে মাতিয়ে তুলতে হাজির হয়েছে ওর সামনে। গ্রামের মেয়ে বিতস্তা এই ঝড়ের সন্ধ্যেটা বেশ উপভোগ করছিল----দীর্ঘদিন শহুরে হাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে এই ঝড়ের আবেশটুকু প্রায় ভুলতেই বসেছিল । বাইরে ঝড় শুরু হওয়ার সাথে সাথেই লোডশেডিং হয়ে যাওয়ায় অফিস থেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। প্রতিটা বিল্ডিং - এ ইনভার্টার থাকলেও ঝড়ের রাতের সুবিধার্থে সন্ধ্যেটা মোমবাতিতেই কাজ চালায় এরা। এতে অবশ্য বিতস্তার সুবিধেই হয়েছে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকারে এলোমেলো করে দেওয়া ঝড়ের দাপট আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকানিতে নিজের অবছায়াকে অশরীরি বলে ভ্রম হলেও হতে পারে। ঝড়ের বাজনার সাথে বৃষ্টিও সুরের রোশনাই বাড়ানোয় বারান্দা থেকে ঘরে এসে জানালার ধারটাতে বসে বিতস্তা। ঘরের বন্ধ দরজা জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছিল মোমবাতিটা আর তার কম্পনের জাদুতে দেওয়ালে যে অসামান্য শিল্পকলা সৃষ্টি হচ্ছিল মোহিত হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে বসে ছিল ও। হঠাৎই বাইরের দরজায় আওয়াজ শুনে দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিতস্তা - - - - বাইরে আধো অন্ধকারে আধভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দীপন----চেহারায় অল্প বয়সের ছাপ ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয়নি ওর---সেই এক মুখ - চোখ - চেহারার দীপনের ব্যাকব্রাশ করা সামনের কিছু চুলে পাক ধরা ছাড়া বাকীটা একই আছে। "কীরে, ভিতরে আসতে বলবি না?" হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে বিতস্তা বলে উঠল "ও---হ্যাঁ - - - আয় - - - কিন্তু----তুই এখানে?" ওকে পাশ কাটিয়ে দীপন ভিতরে ঢুকতেই এক ঝলক শিরশিরানি ঠাণ্ডা হাওয়ায় নিভে গেল মোমবাতিটা। "যাঃ! কী হবে এখন - - - আমার কাছে তো দেশলাইও নেই।" " এতে এত ভাবছিস কেন তিস্তা - - - -এরকম ওয়েদারে অন্ধকার বেশ লাগছে রে। " " বেশ তো - - - তোর অসুবিধা না হলে আমারও অসুবিধা নেই।"

Supta sent Today at 7:57 PM

কেমন আছিস তিস্তা - - -" "এই তো যেমন দেখছিস - - - তুই ভালো আছিস তো?" " আমার আবার ভালো থাকা - - - আছি একরকম। " " তুই কি করে জানলি আমি এখানেই আসব? " " জানতাম না তো---তোকে বলেছিলাম না, পৃথিবীটা বড্ড ছোট - - - আর ভালোবাসা সত্যি হলে আমাদের দেখা হবেই।" " হুম্ - - - - বুঝলাম। শ্যামলের কাছে শুনেছিলাম তুই নাকি বিয়ে করিস নি আর গ্রামেও আসতিস না। কেন বলতো? " " একসাথে এত প্রশ্নের উত্তর দেব কী করে? একে একে বলি---তোর প্রথম প্রশ্নের উত্তর, তোকে পাইনি বলে। আর দ্বিতীয় উত্তর, তোকে ছাড়া ওখানে থাকতে পারতাম না তাই!" " তাহলে সেদিন ছেড়ে দিয়েছিলি কেন? " " সব প্রশ্নের উত্তর একদিনেই শুনে নিবি---তার চেয়ে আজকের এই সন্ধ্যেটা গল্পও তো করতে পারি আমরা? " " তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন রে? " " ভুলে যাচ্ছিস কেন - - - - আমি তোর থেকে একবছরের বড়ো - - - সময়টাতো খারাপ - - - তাই একটু ঠাণ্ডা লেগেছে রে। " একটু চুপ থেকে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় দীপন বলল" তুই এখনও একইরকম আছিস তিস্তা - - - একটুও বদলাস নি। " " তুইও একইরকম আছিস দীপ - - - "বিতস্তা আরও কিছু বলার উদ্যোগ করার আগেই দীপন বলে উঠল" আমি এখন আসি রে---অনেকটা দেরী হয়ে গেল। " " কিসের দেরী দীপ----এতদিন পরে এলি---এক্ষুণি চলে যাবি? আর একটু বোস না----তোকে ছাড়তে মন চাইছে না রে! " একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপন ওর হাতটা তিস্তার হাতে রাখতেই কেঁপে উঠল ও"তোর হাত এত ঠাণ্ডা কেন? তোর কী শীত করছে?" " হ্যাঁ রে, বৃষ্টিতে ভিজে গেছি---একটু তো শীত করছেই। আমি এখন আসি রে। " " তুই আর থাকবি না দীপ? " " নারে, এই অন্ধকারে কে কোথায় দেখবে---সেটা কী ঠিক হবে। কাল সকালে বরং তুই আমার কাছে আসিস।" "তুই কি এখানেই থাকিস? " "হ্যাঁ রে, ওই পিছন দিকের ঘরে - - - ম্যানেজারকে বললেই দেখিয়ে দেবে। " " সে না হয় যাব----কিন্তু সকালে তো বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, তুই রোজ রাত্তিরে আসবি তো? " দীপন আরও ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল" আসব রে, রোজ আসব---তোর কাছে আসার অপেক্ষাতেই তো আছি রে পাগলী। তুই রেস্ট নে - - - আমি আসছি। "কথাগুলো বলে দীপন ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই বিতস্তা বলে উঠল" সেদিনের মতো আর একবার তোকে জড়াতে দিবি দীপ? " ওর দিকে ঘুরে বিষণ্ণ গলায় দীপন বলল "আজ আমি ভিজে গেছি তিস্তা - - - আমাকে জড়ালে তুইও ভিজে যাবি---অন্য কোনদিন না হয় - - - " " বেশ তাই হবে" "আমি এখন আসি, কাল তোর অপেক্ষায় থাকব" কথাগুলো বলে পিছনে না তাকিয়ে খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকারে দীপন মিলিয়ে যেতেই মোমবাতিটা না জ্বালিয়ে দীপনের স্পর্শধন্য হাতটা বুকের কাছে জড়িয়ে চুপটি করে বসে রইল বিতস্তা।বেশ কিছুক্ষণ পর একটা টর্চের জোরালো আলোয় চমক ভেঙে তাকাতেই আবাসনের সর্বক্ষণের ছেলে সমীর বলল" কী হয়েছে মাসীমা, অন্ধকারে একা বসে আছেন যে? মোমবাতিটা নিভে গিয়েছিল - - - আমাদের ডাকবেন তো? এভাবে অন্ধকারে যদি পড়ে টড়ে যেতেন!" "না রে বাবা - - - - না! কিচ্ছু হবে না। অন্ধকারে কোনও অসুবিধে হয়নি আমার। তা কারেন্ট কী আসবে না আজ?" "না - - - - কারেন্ট আসবেনা - - - তবে সবাই শুয়ে পড়লে ইনভার্টারটা চালানো হবে। আপনার খাবার দিয়ে গেলাম আর মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেলাম। ও - - - হ্যাঁ - - - দেশলাইটা পাশেই রাখলাম। আর প্রয়োজনে ডাকবেন কিন্তু। " সমীরের সব কথা কানে ঢুকলেও মনে সবটা ঢুকল না ভাববিহ্বল বিতস্তার। দীপনের কথা ওকে জিজ্ঞেস করবে ভেবেও শেষ মুহূর্তে কিছু একটা ভেবে চুপ করে ওর কথায় মাথা নেড়ে বসে রইল বিতস্তা। সমীর চলে গেলে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে খাবারটা ঢাকা দিয়ে পাশে সরিয়ে রেখে জমাট বাঁধা অন্ধকারে বাইরের বারান্দায় চুপচাপ বসে দীপনের কথা ভাবতে লাগল ও। পরদিন সকালে প্রার্থনার পর অফিসে এসে ম্যানেজারবাবুর সাথে আলাপ পরিচয়ের পর বিতস্তা বলল "আমাকে একটু দীপন বসুর ঘরে নিয়ে যাবেন?" "আপনি দীপন বাবুকে চেনেন?" "হ্যাঁ, ও আমার বন্ধু। একটু নিয়ে চলুন না প্লিজ - - -" "কিন্তু উনি এখানে আছেন জানলেন কিভাবে - - - - না - - - মানে - - - উনি বলেছিলেন কাউকে না জানিয়েই এসেছেন এখানে। তাই - - - জানতে চাইছিলাম ।" একটু ইতস্তত করে বিতস্তা বলল "আসলে ওর সাথে দেখা হয়েছিল - - - তখনই বলল। একটু নিয়ে চলুন না প্লিজ। " ম্যানেজারবাবু অবাক হয়ে বললেন" উনি নিজে আপনাকে বলেছেন? না - - - মানে! " ওনাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বিতস্তা এগিয়ে গেল ঘরের দরজার দিকে। ম্যানেজারবাবুও আর কথা না বাড়িয়ে ওনাকে নিয়ে অফিসের পিছন দিকে পার্ক সংলগ্ন দোতলা বাড়ির একেবারে দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ পূবের বারান্দা ঘেরা ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াতেই দরজায় তালা দেখে বিতস্তা বলে উঠল "এই যাঃ! দরজাটা তো তালাবন্ধ দেখছি। জানিয়ে আসা উচিত ছিল আমার। আপনি বরং চলে যান----আমি ওর সাথে দেখা করে ঠিক চিনে চলে যাব" একটু ভ্রূ কুঁচকে ম্যানেজারবাবু বললেন "আমি চাবি খুলে দিচ্ছি - - - - আপনি ভিতরে যান।" ম্যানেজার বাবুর কথায় একটু অবাক হলেও এটা নিয়ম ভেবে চাবি খোলার সাথে সাথেই ঘরটায় ঢুকতে গিয়ে আবারো অবাক হল ও। ঘরটা খুলতেই একটা চাপা ধূলোর গন্ধ নাকে এসে লাগল ওর। গন্ধটা সয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল ভীষণই পরিপাটি করে সাজানো ঘরটা যেন ওরই অপেক্ষায় রয়েছে। টানটান করে পেতে রাখা অল্প কুঁচকে যাওয়া বিছানাটা দেখে মনে হচ্ছে, একটু আগেই কেউ উঠে গেছে বিছানা থেকে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ম্যানেজারবাবু কখন চলে গেছেন ওখান থেকে। দীপনের অপেক্ষায় চুপচাপ বসে না থেকে পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল ও। দেওয়ালজোড়া বিভিন্ন ছবি, একটা বুকসেল্ফে সাজানো বিভিন্ন বই, জানালায় রাখা দুটো মানিপ্ল্যান্ট গাছ একে অপরকে জড়িয়ে দেওয়াল বেয়ে বেশ উঠছে। টেবিলের ওপর বেশ কিছু বইয়ের মাঝে সেই নীল ডায়েরিটা - - - যা একদিন বিতস্তাকে ওর মনের মানুষের খবর এনে দিয়েছিল। এক বুক কৌতুহল নিয়ে ডায়েরির পাতা টা খুলতেই একটা চিঠি ওর হাতে পড়ল। একটু দোনামোনা করে চিঠিটা খুলতেই দেখল ওকেই লেখা হয়েছে চিঠিটা। দীপনের এমন কাজকে পাগলামী ভেবে নিজের মনে একটু হেসে পড়তে শুরু করল চিঠিটা---

Supta sent Today at 7:59 PM

তিস্তা,
 আমার মনে হয়েছিল তুই এখানে আসবি। তাই তোর জন্য এটা রাখলাম। ম্যানেজার সতীশবাবুকে বলাই আছে, তুই এলে তোকে এঘরে পৌঁছে দিতে। আসলে আর কিছুদিন আগে এলে আমি নিজেই তোকে নিয়ে আসতাম। ভীষণ অবাক হচ্ছিস তো এটা ভেবে যে, আমি কী করে জানলাম তোর আসার কথা! ভুলে যাস কেন, আমরা একসাথে বড়ো হয়েছি - - - - তাই সুন্দরী ভাগীরথী যে তোর প্রিয় নদী - - - এটা তোর মনে না থাকলেও আমি ভুলিনি রে। জানিস তিস্তা, তোকে আমি একটা দিনের জন্যেও ভুলিনি -----আমার নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গেই জড়িয়ে নিয়েছিলাম তোকে। তোর সব খবর আমি পেতাম শ্যামলের কাছ থেকে। তুই যেদিন অফ হোয়াইট আর কচি পাতা কম্বিনেশনের শাড়িটা পরে প্রথম স্কুলে গেছিলি - - - তোর অগোচরেই তোকে দুচোখ ভরে দেখে জড়িয়ে নিয়েছিলাম নিজের উষ্ণতায়। একই শহরে থেকেও ভিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে বেঁচেছি এতদিন।শরীরের টান তৈরী হওয়ার আগে থেকেই মনের টান তৈরী হয়ে গিয়েছিল আমাদের - - - তাই তোকে দূরে পাঠিয়েও নিজে দূরে যেতে পারলাম না রে। তোর না থাকা তুই-এর সাথেই সহবাস করেছি এতদিন - - - - এখানে এসে মনের টান মেটাতে তোর সাথে নতুন ভাবে বাঁচব ভেবেছিলাম - - - কিন্তু ওপারের ডাক যে অমোঘ - - - তাকে এড়াই কেমনে! জানিস তিস্তা, সবাই বলে নিশ্বাস বন্ধেই সব শেষ - - - - কিন্তু আমার কাছে তা আর এক শুরু। সতীশকে এই ঘরে অন্য কাউকে না রাখতে বলেছি তুই না আসা অব্দি। ভাবছিস তো জানলাম কীকরে! এটুকু বিশ্বাস না থাকলে বৃথাই এতদিন ভালোবাসলাম তোকে। এতদিন রণিতেশের সাথে সংসার করেও যে তুই ওর হতে পারিসনি - - - এটা আমি জানি। আর এখানেই তো আমার জিত রে। তুই আমার তিস্তা - - - শুধুই আমার - - - - কোনো বাধাই তোকে দূরে নিয়ে যেতে পারেনি আমার থেকে। আর তাই তো তুই ফিরে এসেছিস আমার কাছে। তুই থাকবি আমার এই ঘরে----আমার সাথে - - - আমার কাছে? আমার অশরীরের উষ্ণতায় জড়িয়ে রাখব তোকে - - - - তোকে বুকের মাঝে রাখার যে অপার শান্তি - - - - তা আমি উপভোগ করতে চাই তোকে বুকে জড়িয়ে। এক অশরীরের সাথে নতুন খেলার - - - - নতুন সংসার পাতবি? আমার এই ঘর তোর অপেক্ষায় - - - - আসবি তিস্তা? " চিঠিটা পড়তে পড়তেই চোখের জল বাঁধ মানছিল না বিতস্তার। চিঠি পড়া শেষ করে চিঠিটার গা থেকে দীপনের স্পর্শসুখ অনুভব করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে লাগল" তুই কাল কথা রাখতে এসেছিলি দীপ - - - - আমি এ ঘরেই থাকব - - - - তুই এখানেই আছিস আমি জানি - - - - সব শুনছিস তো----আমি তোর অশরীরের সাথেই বাকী দিনগুলো যাপন করব - - - - তুই খুশী তো!" বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠল দীপনের তিস্তা আর তখন ঠিক ওর পিছনে অবয়বহীন শরীরে এক নিশ্চিন্ত অবয়ব ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে।
 
  -----------------------------

You sent Today at 8:02 PM



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক