দু'পাশে তার চাকা ...
আর মধ্যিখানে ফাঁকা
সুদীপ পাঠক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ । চতুর্দিকে ধ্বংসের চিহ্ন ছড়ানো । অর্থনৈতিক মন্দা , বেকারত্ব , হাহাকার । এর মধ্যে চলছে জীবন সংগ্রাম । দাঁতে দাঁত চেপে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করে চলেছে মানুষ । সে এক অসম প্রতিযোগিতা । ইতালিতে এমনই একজন মানুষ সম্পূর্ণ কর্মহীন হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে । স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? কি করবে এখন ? এই সমস্ত অমীমাংসিত প্রশ্নের কোনো জবাব নেই । হঠাৎ মেঘ না চাইতে জল পাওয়া মতন করে জুটে যায় রোজগারের উপায় । শহরের দেওয়াল গুলিতে তাকে পোষ্টার সাঁটাতে হবে । ঘাড়ে করে মই পোষ্টারের বান্ডিল আর হাতে আঠার বালতি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেই কাজ করতে হবে তাকে । তবে শর্ত একটাই তার একটি নিজস্ব বাই সাইকেল থাকা আবশ্যিক । নিরুপায় হয়ে শেষ সম্বল টুকু পর্যন্ত বাজী রেখে সে সাইকেল জোগাড় করে । শুরু হয় কাজ । একদিন হঠাৎ তার চোখের সামনে একজন লোক সেই সাইকেল চুরি করে পালায় । শুরু হলো নতুন লড়াই । সাইকেল পুনরুদ্ধার তাকে করতেই হবে । সে পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয় । আইনের দরজায় কড়া নাড়ে । এহেন জায়গা নেই যেখানে সে সুবিচারের আশায় বুক বেঁধে হাজির হয় নি । কোনো ফল হলো না । প্রাপ্তি শুধু হতাশা আর নৈরাশ্য । একদিন অনন্যোপায় হয়ে অতর্কিতে একটি সাইকেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সেই নিরপরাধ মানুষটি । তারপর ? ছবিটি যারা দেখেছেন শেষ দৃশ্যের কথা একবার স্মরণ করুন । হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন । আমি সিনেমার কথা বলছি ! ১৯৪৮ সালে নির্মিত ভিত্তোরিও ডি সিকা পরিচালিত ইতালীয় চলচ্চিত্র দ্যা বাই সাইকেল থিবস । জগৎ বিখ্যাত কিম্বা দুনিয়া কাঁপানো এই সমস্ত বিশেষণ সার্থক হয়ে ওঠে এক্ষেত্রে । এই সেই ছবি যা দেখে সত্যজিৎ রায় অপনুপ্রনিত হন ও বিলেত থেকে দেশে ফিরে ফিল্ম মেকিং করবেন বলে মনস্থির করেন । ক্লাসে পড়াতে গিয়ে সঞ্জয়দা (JU , Film Studies) বলেছিলেন প্রভু যীশু স্বয়ং যেভাবে নিজের ক্রুশ কাঁধে বয়ে নিয়ে গেছেন সেই ভাবেই যেন রাজপথে নায়ক চলেছে দুই বাহু প্রসারিত করে । চার্চের চূড়া থেকে তার ওপর এসে পড়ে ক্রশের দীর্ঘায়িত ছায়া যেটি তার নিজের প্রলম্বিত উপচ্ছায়ার ছায়ার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
তবে এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় সিনেমা নয় । বরং সিনেমায় সাইকেল কিভাবে প্রত্যক্ষ ভাবে কিম্বা অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে তাই । অন্ততঃ গোড়ার দিকে সেই সম্পর্কে গুটি কয়েক কথা বলার খুব সাধ হচ্ছে । কিন্তু হঠাৎ সাইকেল কেনো ? কারণ আগামী ৩রা জুন হল বিশ্ব বাই সাইকেল দিবস । বিগত তিন বছর তাই পালিত হচ্ছে । ২০১৮ সালে সন্মিলিত জাতী পুঞ্জের সাধারণ এ্যাসেম্বলিতে সেটি মান্যতা প্রাপ্তি পেয়েছে । দূষণ মুক্ত , পরিবেশ বান্ধব এই দ্বীচক্র যানের আজও কোনো বিকল্প নেই । সাইকেল চালানো স্বাস্থের পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক । কারণ এতে ভালো ব্যায়াম করা হয় । সেই সঙ্গে আছে মনের স্ফূর্তি আনন্দ আর এক ধরনের রোম্যান্টিসিজম । সব চাইতে বড় কথা সাইকেল হলো এমন একটি বাহন যা আজো সাধারণ মানুষ বলা ভালো নিম্নবিত্ত (প্রকৃত অর্থে দরিদ্র) মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে পড়ে এবং মেন্টেনেন্সও সহজ সাধ্য।
নয়ের দশকের শেষে তৈরী হলিউডি ছবি লেক প্রাসিড যেমন । ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে মিট সসেজ চুরি করে আনে বাচ্ছা ছেলেটি । কেনো ? তার বাড়ী থেকে অনতি দূরে অবস্থিত আপাত নিরীহ নিস্তরঙ্গ সরোবরে ডেরা বেঁধেছে কিছু ভয়ঙ্কর দানবাকৃতি কুমীর । সেই প্রাণীগুলি তার আবার খুব প্রিয় । তাদের খিদে মেটাতে সে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে । সে নিয়মিত লুকিয়ে সবার নজর এড়িয়ে লেকের ধারে আসে সাইকেলে চড়ে । হঠাৎ একদিন যখন কুমীরগুলি তাকে আক্রমণ করে তখন দ্রুত পালাতে সহায়ক ভূমিকা নেয় সাইকেল । আর সেই সাইকেল বেশ স্টাইলাইজড । মোটা চাকা , বাহারি হ্যান্ডেল যুক্ত ।
কার্টুন নেটওয়ার্ক থেকে জ্বলজ্যান্ত রক্ত মাংসের চরিত্র সর্বত্র জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা মিঃবিন একবার কি করেছিল মনে আছে তো ? রাস্তায় সাইকেল রেস হচ্ছে । দলে দলে প্রতিযোগীরা চলেছে । মিঃবিনও চলেছেন সাইকেল আরোহনে তবে তিনি ঐ দলভুক্ত নন । তিনি বিশিষ্ঠ এবং বুদ্ধিমান মানুষ । তাঁর সব কাজে সে প্রমাণ পাওয়া যায় । এখানেই বা বাদ যায় কেনো ? একটি দ্রুতগতি সম্পন্ন গাড়ীর লেজ ধরে সবাইকে টেক্কা দিয়ে চলে গেলেন হাত নাড়তে নাড়তে । মুখে লেগে আছে বিখ্যাত মুচকি হাসি ।
এছাড়াও দ্যা ক্যারেট কিড অথবা লিটিল মিস সান সাইন এই সব ছবিতে সাইকেল উনি ঝুঁকি দিয়েছে যৎকিঞ্চিৎ ।
এবার ভারতীয় চলচ্চিত্রের উপমা দেওয়া যাক । গোড়াতেই নারী শক্তির জয়জয়কার ও মহিমা প্রচারকারী পড়শন ছবির সেই বিখ্যাত গানের দৃশ্যের কথা স্মরণ করা যাক । ১৯৬৮ সালে নির্মিত বিপুল জনপ্রিয় এই হিন্দি ছবির তারকা সমাবেশ অভিনব ! সুনীল দত্ত , সায়রা বানু , কিশোর কুমার ও মেহেমুদ । নায়িকা সায়রা বানু এক ডজন সখি সমাহারে শহরের সুরম্য পথ ধরে চলেছেন সাইকেল চালিয়ে । মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি আর শোনাচ্ছেন ততোধিক মিষ্টি গান "ম্যায় চলি ম্যায় চলি দেখো প্যায়ার কি গলি" । এই গানের চিত্রায়ণ যথেষ্ঠ চিত্তাকর্ষক এবং সেই সঙ্গে কঠিনও বটে । পুরোটাই আউট ডোর লোকেশনে শ্যুট করা , কোনো ব্যাক প্রজেকশন শট নেই । ৫২ বছর আগে তৈরী এই সিনেমা । সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভাবলে সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জিং তা নিঃসন্দেহে বলা যায় । অতি নয়নাভিরাম এই গানের দৃশ্য আজও দর্শক হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে ।
১৯৮০ সালের সুপার হিট হিন্দি সিনেমা শান । দুই হিরো অমিতাভ বচ্চন ও শশী কাপুর নিজ নিজ প্রেমিকার মান ভঞ্জনের উদ্যেশ্যে সাইকেল চালাতে চালাতে গান গাইছেন ।
জানু মেরি জান
ম্যায় তুঝপে কুরবান ...
তবে সেটি সাধারণ সাইকেল নয় । তাতে দুটি হ্যান্ডেল ও দুটি প্যাডেলের ব্যবস্থা আছে । অর্থাৎ দুইজন আরোহীকেই সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করতে হবে । কত রকমের কসরৎ যে করেছেন দু'জন সাইকেলে চড়ে ! আহা বেচারাগণ ।
নয়ের দশকের গোড়াতেই (১৯৯২) দর্শক হৃদয় জয় করে রীতিমত সাড়া ফেলে দেয় আমির খান অভিনীত ছবি যো জিতা ওহী সিকান্দার । সাইকেল রেস সেই ছবির মুখ্য উপজীব্য বিষয় । বলা বাহুল্য এখানে ব্যাবহৃত সাইকেল গুলিও সাধারণ নয় ; অসাধারণ । অর্থাৎ রেসিং বাইক । বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের উত্থান ও অত্যাচারী অহংকারীর পতন আবহমানের প্রিয় বিষয় । তার সঙ্গে সাইকেল দৌড় জুড়ে দেওয়া ফলে তারুণ্যের উচ্ছাস যেন বাঁধ ভাঙা রূপ পায় । ফাইট করার স্পিরিট প্রতীক হয়ে ওঠে ।
সব শেষে বাংলা ছবির কথা বলি । ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায় তৈরী করলেন নায়ক । শুধু বাংলা ছবি নয় , সমগ্র ভারতীয় সিনেমার নিরিখে এটি আজো মাইলস্টোন । এক এবং অদ্বিতীয় । উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনের টার্নিং পয়েন্ট । এই ছবির দৌলতে তিনি বিশ্বচলচ্চিত্রের দরবারে সসন্মানে স্থান করে নিয়েছেন । পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ।
সেই দৃশ্য যেখানে ট্রেনের কামরায় নায়িকা মিস সেনগুপ্তার মুখোমুখি বসে নায়ক অরিন্দম পুরোনো কথা মনে করতে গিয়ে বলছে
- বীরেশ আর আমি দশ বছর এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছি । এক স্কুল এক কলেজ । ও করতো রাজনীতি আর আমি বেকার । কাজেই আমি যেতুম ওর সঙ্গে ।
সাউন্ড ট্রাকে শুনি এই সংলাপ আর পর্দায় দেখি দুই বন্ধু খোশ গল্প করতে করতে চলেছে সাইকেল চালিয়ে । খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও ভালোলাগা তৈরী হয় । সে যেনো এক অন্য আমেজ ।
এর ঠিক দু'বছর পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখা যায় দুই বন্ধু সহযোগে চওড়া ফাঁকা পথ ধরে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে চলেছেন ।
ও আকাশ সোনা সোনা
ও মাটি সবুজ সবুজ ।
ছবির নাম অজানা শপথ ।
আটের দশকের মাঝামাঝি তরুণ মজুমদার পরিচালিত ছবি পথভোলার কথা ভুললে চলবে কেনো ? প্রসেনজিতের সঙ্গে নয়নার সাইকেল প্রেম সেই সময়ের বাঙালী দর্শক যথেষ্ট উপভোগ করেছিল বৈকি !
সিনেমার পর্দা থেকে এবার অন্য দিকে নজর ঘোরানো যাক । প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত কয়েক বছর আগে আনন্দ বাজার পত্রিকায় ছেলেবেলার স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে বলেছেন কি ভাবে তিনি সাইকেলে চেপে হুড়মুড়িয়ে চলে আসেন শ্যাম বাজার পাঁচ মাথার মোড়ে । কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না তাঁর যানটিকে ! সে এক সাংঘাতিক পরিস্থিতি । এদিকে ট্রাফিক পুলিশের তো চক্ষু ছানবড়া । সুস্বাদু সেই রচনার যোগ্য সঙ্গতকারি ছিল প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট দেবাশীষ দেবের মজার ছবি ।
যাঁরা জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি : কলকাতা মহানগরীর রাজপথে সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ ।
অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজধানী শহরে শুধু মাত্র সাইকেলের জন্য আলাদা ওয়ে করা আছে । তারা এটিকে অবহেলা করে না গুরুত্ব দেয় । সাইকেলে অসমুদ্র হিমাচল ভ্রমণের খবর অনেকেই কাগজে পড়েছেন নিশ্চই । এমন কি সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হওয়ার উল্লেখও পাওয়া যায় মাঝে মধ্যে । বিশেষ কোনো বার্তা বহন করে আরোহী বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে । এসব ক্ষেত্রে অবশ্য বিধি নিষেধ শিথিল যোগ্য হয়ে থাকে ।
আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে মামার বাড়ীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হবে । কারণ সাইকেল চালানোর হাতে খড়ি সেখানেই । একাধিক সাইকেল ছিল । দাদামশাইয়ের ছিল গ্রীন রেলে । ২২ ইঞ্চি তো নয়ই এমনকি ২৪ ইঞ্চির চাইতেও যদি উঁচু বা বড় কিছু থেকে থাকে তো তাই । এছাড়াও হারকিউলিস ছিল । সে সব যেমন মজবুত তেমনই টেকসই । অনেক পরে হিরো সাইকেলের উদ্ভব ঘটে । প্রথমে হাফ প্যাডেল , তাইতে লেংচে লেংচে চলা । তারপর বেশ কিছুটা দুমদাম পড়ে যাওয়া , কাটাছড়া এসবের পালা সাঙ্গ করে পুরোপুরি সিটে বসে চালানোর আনন্দ লাভ । তবে প্রথমেই হাত স্টেডি হয়নি , ল্যাগব্যাগ সিং অবস্থায় চলেছি অনেক দিন । প্রথম প্রথম সাইকেল চালানো শিখলে জোরে চালাতে মন চায় । তাতে ব্যালেন্স রাখা সহজ হয় । আস্তে প্যাডেল করতে গেলে নড়বর করে । যাই হোক সে ভাবেই মামার বাড়ি থেকে বেশ কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চলে যেতাম মাসী পিসীর বাড়ী । আর গিয়ে পৌঁছনো মাত্র বাড়ীর লোক আমায় দেখে হাঁ হাঁ করে উঠতো ।
- তুই বড় রাস্তা দিয়ে এই এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে এলি ? কি দুঃসাহসিক কাণ্ড বলো দেখি ? হু হু করে বাস যাচ্ছে লরি যাচ্ছে । যদি কোন অঘটন ঘটে তবে ?
না কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি । ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল । তবে কলকাতায় আমার বিশেষ সাইকেল চালানো হয় নি । প্রয়োজন হয় নি বলেই হয় নি । বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে চেয়ে চিনতে অল্প স্বল্প চালিয়েছি বটে । মনে আছে তখন ঘন্টা পিছু ভাড়ায় সাইকেল পাওয়া যেতো । এখন সে ব্যবস্থা আছে কি না জানি না । বি এস এ কোম্পানি এক সময় হাল্ক ফুলকা কেতা দুরস্ত সাইকেল বাজারে আনে । ফ্যাশনেবল্ লেডিস সাইকেল লেডিবার্ড তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ।
মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হবার পর একদিন হঠাৎ মনে হলো এবার স্বাবলম্বী হতে হবে । কিছু লোক গ্যাস খাওয়ালো এবং আমিও অম্লান বদনে সেটা খেলাম । সকাল বেলা বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ সরবরাহ করবো বলে মনস্থ করলাম । একটা ল্যাঝঝেড়ে সাইকেলও জোগাড় করা গেলো । এবার দুগ্গা বলে নেমে পড়লেই হয় । ঠিক সময়ে বাবার কানে সে কথা উঠলো । বাবা প্রথমে যথা সম্ভব ধীরস্থির ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন ।
- শীত গ্রীষ্ম বর্ষা প্রতিদিন নিয়ম করে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে ।
"ছোড় দো বেটা তুমসে না হো পায়গা" ।
কিন্তু আমি এঁড়ে বাছুরের মতো একবগ্গা । কে কার কথা শোনে ! অবশেষে বাবা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করতে বাধ্য হলেন ।
- যদি এই কাজই করতে হয় তবে নিজেকে আমার ছেলে বলে পরিচয় দেবে না । আর আমাকেও বাবা বলে ডাকবে না । মনে থেকে যেনো ।
কি সব্বনাশ ! পিতৃ পরিচয়হীন হয়ে যাবো কোথায় ? খবরের কাগজ বিলি করে যা আয় হবে তাইতে তো আর জীবন চলবে না । সুতরাং বাসনা বৃক্ষ মূলে কুঠারাঘাত । আসলে আমার কাছে প্রধান আকর্ষণ ছিল সকালবেলা ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে গোটা অঞ্চল চষে বেড়ানোর দুর্লভ সুযোগ পাওয়া । কিন্তু সে গুড়ে বালি । ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যথা ।
এক সময় বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে অন্নপ্রাশনে ছোট তিন চাকার সাইকেল উপহার দেওয়ার প্রচলন ছিল । প্রায় সব বাড়িতেই এরকম একটা না একটা নমুনা পাওয়া যেতো । আমারও ছিল । উপনয়নে যদি কেউ স্ট্যান্ডার্ড সাইকেল (২০ ইঞ্চি ও তদুর্দ্ধ) উপহার পেতো তবে সেটা এভারেস্ট জয়ের মতন এ্যাচিভমেন্ট বলে গণ্য করা হতো । ন্যাড়া মাথায় গেরুয়া বসনে হাসি মুখে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখা হতো । এখন সে সবের পাঠ উঠে গেছে । শহুরে সমাজে বাচ্ছারা এখন সময় ও স্থানাভাবে সব ধরনের খেলা ও শরীরচর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । তাদের যাবতীয় বিনোদন এখন স্কোয়ার ফুটের মাপে বন্দী । মফঃস্বল ও গ্রামে কিন্তু চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত । সেখানে আজও সাইকেল ব্যতীত জনজীবন অচল ।
আমাদের ছেলেবেলায় আরো একটা ব্যাপার সেনসেশন সৃষ্টি করতো । তা হলো নন স্টপ সাইকেল চালানোর কম্পিটিশন । অর্থাৎ লাগাতার ২৪ , ৪৮ কিম্বা তার চাইতেও বেশী সময়ের সাইকেল চালানোর চ্যালেঞ্জ । অনেকে সেটা এ্যাকসেপ্টও করতো , লক্ষ্য অবশ্যই নগদ আর্থিক পুরস্কার । শুরুটা হতো বেশ ঘটা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে । এমনকি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নেতা মন্ত্রীদের আগমন ঘটতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে । একটি নির্দিষ্ট ফাঁকা জায়গায় গোল করে সাইকেল চালানোর ক্লান্তিকর প্রয়াস । ধীরে ধীরে প্রতিযোগীর সংখ্যা কমতে থাকতো আর দর্শক বন্ধুরাও কেটে পড়তো গুটিগুটি পায়ে । শেষ পর্যন্ত যে টিকে থাকতে পারতো সে রাতারাতি এলাকার হিরো হয়ে উঠতো । দূরদর্শনের জামানায় এই বিষয় নিয়ে বেশ ভ্যাদভ্যাদে আবেগ জর্জর টেলিফিল্মও নির্মিত হয়েছে । সেখানে দেখা যায় নিঝুম রাতে জনমানব শূন্য ফাঁকা মাঠে নায়ক একা মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । মায়ের চিকিৎসার জন্য সে টাকার জোগাড় করতে বদ্ধ পরিকর । দু' চার জন আধা ঘুমে ঢুলুঢুলু কর্মকর্তার নজর এড়িয়ে প্রেমিকা অতি সংগোপনে তাকে লেবুর শরবত খাওয়াতে এসেছে ।
মধ্যবিত্ত বাঙালী চিরকাল এই সেন্টিমেন্ট কপকপ করে গিলেছে । তবেই যতই ঠাট্টা করা হোক না কেনো এর মধ্যে পুরাতন মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার একটা জেদ বা ইচ্ছে ছিল । যেমন সাহস ছিল নিরন্ন সহায় সম্বল হীন উদ্বাস্তু বানজারা পরিবার গুলির মধ্যে । আগাম কোনো বার্তা না দিয়ে তারা হঠাৎ করেই চলে আসতো আমাদের ভদ্র পল্লী গুলিতে । দু' দিকে বাঁশের তেকাঠি খাঁটিয়ে তার ওপর বাঁধা হতো দড়ি । সাইকেলের চাকার টিউব ও টায়ার খুলে ফেলে শুধু মাত্র রিম নিয়ে ভেল্কি দেখাতো বাচ্ছারা । দুধের দাঁত পড়েনি এমন শিশুকে নির্দ্বিধায় ওপরে তুলে দিয়ে তার বাপ নিচে দাঁড়িয়ে ছড়া কাটতো আর মা বাজাতো ঢোলক ডুম ডুম শব্দ করে । সেই বাচ্ছা দু' হাতে লাঠি ধরে মাথায় ঘটি বাটি নিয়ে নিখুঁত ব্যালান্স বজায় রেখে সাইকেলের রিমের মাঝে পা ফেলে ফেলে খুঁটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যেতো অকুতোভয়ে । আমরা যারা বারান্দায় বুক পেতে এই দৃশ্য দেখতাম তারা আতঙ্কে শিউরে উঠতাম । অসামান্য সেই ট্রাপিজের খেলা যখন শেষ হতো তখন তারা সকলের সামনে বাটি পেতে পারিশ্রমিক চাইতো ! চারানা আটানা ছুঁড়ে দেওয়া হতো তাদের উদ্যেশ্যে । এক প্রকার ভিক্ষাই বলা যায় , তারাও হাসি মুখে মাটি থেকে পয়সা কুড়িয়ে নিতো । কোনো গ্লানি নেই তার জন্য । এই তাদের পরম প্রাপ্তি , এর বেশী কিছু তারা প্রত্যাশাও করে না । কারণ ওদের কেউ কখনো বলে নি ওরা আর্টিষ্ট , ভিখারী নয় । সাইকেলের চাকায় ওদের জীবন চক্র বাঁধা পড়ে গেছে যে । সেটাই যতোই গড়ায় ততই মঙ্গল ।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে একাধিকবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছি । বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সাইকেল চালানো ব্যাপারটিকে ষ্টাইল স্টেটমেন্টে পরিণত করেছে তা অনস্বীকার্য । ছাত্রছাত্রী অধ্যাপক টোকা মাথায় সবাই (কেউ কেউ) চলেছে সাইকেলে । এতো বড় চত্বরের জন্য আদর্শ পরিবহন । পশ্চিমবঙ্গে অন্যত্র কোথাও এই ভাবনা কেনো অগ্রাধিকার পেলো না ? হলে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো । এখনো সময় আছে ।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি গল্পের চরিত্র আড্ডা দিতে দিতে তার বয়স্যকে বলছে সে নাকি বিয়ের জন্য কিনে রাখা টোপর মাথায় দিয়ে বাজার করে ! শুনে তো সে লোকের মুখে মাছি ঢুকে যাবার জোগাড় ! এ বলে কি ? তখন হিরোর উত্তর
- আজ্ঞে না , সব সময় নয় । টোপরটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল তাই চোত বোশেখের রোদ থেকে মাথা বাঁচাতে পরে থাকি আর কি । সাইকেল চালানোর সময় ছাতা খুলতে খুব অসুবিধা হয় কিনা তাই ।
বোঝো ঠ্যালা !
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিবাহের যৌতুক স্বরূপ সাইকেল প্রদান গ্রামাঞ্চলে এক সময় বাঁধাধরা প্রচলিত রীতি ছিল ।
গপ্পো হলেও সত্যি এরকম একটা উদাহরণ দিয়ে ইতি টানি কেমন ? আমার এক নিকট আত্মীয় যে কিনা পেশায় হীরের ব্যবসায়ী । একাধিকবার ইউরোপ আমেরিকা ও আফ্রিকা সফরে গেছে কর্মসূত্রে । একের বেশী বাড়ী এবং গাড়ী আছে । বিবাহের অব্যবহিত পরে তার মোবাইলের রিং টোন কি ছিল আন্দাজ করতে পারেন ?
" আয় সজনী
চড়বি আমার
প্রেমের সাইকেলে " ।
কি গোড়াতেই বলেছিলাম না সাইকেলের সঙ্গে রোমান্স মাখামাখি হয়ে আছে ! আমার কথা মিলল তো ?
সমাপ্ত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন