Featured Post
অণুগল্প ।। তনুর চিঠি ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
তনুর চিঠি
বিশ্বনাথ
প্রামাণিক
আমি কর্মসূত্রে নিজের আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে অনেক দুরেই থাকি। সঙ্গে থাকে আমার স্ত্রী ও একরত্তি মেয়েটা। যখন সময়- সুযোগ হয় বাড়িতে যাই, কখনো বা উনারা আসেন। এখন এই ভয়ংকর অবস্থায় পড়ে অনেক দিন হল, বাড়ি যেতে পারি নি বা ওনারা ও আসতে পারেন নি।
সেদিন
সবে তখন সকাল হয়েছে । পাখির দল সব ঘুম ভেঙে উঠে চারিদিক কলকাকলিতে ভরিয়ে তুলেছে। অভ্যাস মতো আমার সাত
বছরের তনুও উঠে পড়েছে আমার সঙ্গে। ও অবশ্যি রোজ সকাল সকাল ঘুম থেকেই উঠে আমার সঙ্গে
প্রাতঃভ্রমনে বের হয়। এখন করোনার বাড়-বাড়ন্ত বলেই আমরা আমাদের পাঁচিল তোলা
বাগান বাড়িতেই হাঁটাহাঁটি করি। সকাল সকাল উঠার এ অভ্যাস তনু ওর দিদুনের
(ঠাকুমাকে ও দিদুন বলেই ডাকে) কাছ থেকেই শিখেছে। সেদিন দেখি আমার সঙ্গে না হেঁটে এই সাত সকালেই ও
আমাদের বাগানের সব চেয়ে বড় গাছটার নীচে
বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কি সব লিখে চলেছে!
আমি মর্নিং ওয়াক থামিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসি। আলতো করে মাথায় হাত রেখে বলি- এত মনোযোগ দিয়ে এই সাত
সকালে আমার তনু মা কি এত লেখা-লিখিতে ব্যস্ত, দেখি তো।
ও
রাগ করে চকিতে খাতার পাতাটা চাপা দিয়ে বলেউঠে - না না বাবা, তুমি এখন যাও । বুঝলাম ওর একান্ত সব প্রাইভেট ব্যাপার। আর কারো প্রাইভেট ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা ঠিক আমাদের সংসারের নিয়ম নয়। বিশেষত সে যদি না চায়। এ সবি আমার মায়ের শিক্ষা।
অগত্যা আমি
ওখান থেকে চলে গিয়ে আবার ব্যায়াম, প্রানায়াম... করতে শুরু করি। এখন গরম কাল
কিন্তু সকালের মনোরম স্নিগ্ধতায়
মন ভরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ব্যায়াম শেষে প্রানায়ামে ডুবে যাই। তনুর
লেখা-লিখির
কথা আর আমার বিশেষ মনে ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে,
দেখি ওর হোম টাস্কের খাতার একটা পেজ খুব যত্ন করে ভাঁজ করতে করতে আমার কাছে এসে বলে-
বাবা, আমার তো এবার ক্লাস শুরু হবে। তা তুমি কি এটা পোস্ট করে দিয়ে আসতে পারবে?
আমি প্রানায়াম বন্ধ করে বলি- ওটা কি? কোথায় পাঠাতে হবে মা?
- চিঠি, দিদুনকে পাঠাবে।
- আমি কি এটা খুলে পড়তে পারি?
-পারো, তবে মা কে বল না কিন্তু।
-বেশ।
তারপর দ্রুত ওটা আমার হাতে দিয়ে বলে- মা ডাকছে বাবা, আমি যাই। তুমি কিন্তু মাকে বলবে না। ছোট মেয়ে, সরল বিশ্বাসে আমার হাতে চিঠিখানা দিয়ে গেছে। খুলে দেখা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। তারপর কৌতূহল সামলাতে না পেরে ভাবলাম- কি আর লিখবে! ছেলেমানুষ। বড় হয়ে এই চিঠির কথা হয়ত ওর মনেও থাকবে না। তাছাড়া পারমিশন যখন পেয়ে গেছি পড়ে দেখলে ক্ষতি কি! এটি ওর ঠাকুমার কাছে লেখা ওর প্রথম চিঠি।
ধীরে ধীরে চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে থাকি। পেন্সিলে লেখা। তখনো ও কলম ধরেনি। কয়েক জায়গায় কাটাকুটি ও বানান ভুল থাকলেও বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকি চিঠিখানা।
দিদুন,
জানো? এখানে আকাশ থেকে নাকেশ্বরি শুধু হাঁচি ছড়াছে, আর তুমি তো বলেছিলে নাকেশ্বরির নিঃশ্বাসে নাকি বিষ আছে। সে বিষ চারদিকে এমন ভরে গিয়েছে যে আমরা কেউ বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। বের হলেই হপ করে আমাদের নাকে ঢুকে যাবে। বাবা বলেছে সব সময় নাক মুখ চাপা দিয়ে রাখবে। আচ্ছা দিদুন তুমি বলো, এভাবে সব সময় নাক-মুখ ঢেকে থাকলে, পারা যায়? আমার তো বাবা দম হাঁপিয়ে যায়! কিন্তু কি করব? নাকেশ্বরিটা ভারি পাজি না দিদুন?
খচ্চরটা কোথায় আছে তুমি জানো? ওটা তো এখন আর কঙ্কা দিদির লাগবে না, বল। ওর বরটাকে তো মেরেই ফেলল! এমন পাজি। খচ্চরটা একবার পেলে বেশ হতো। তুমি নিশ্চয় ভাবছ, ওটা নিয়ে আমি আবার কি করব?
কাউকে বলো না দিদুন, বাবাকে ও না, মাকে ও না। তোমাকে চুপি চুপি বলি- আমিও কঙ্কা দিদির মতো আকাশে গিয়ে ওই নাকেশরির নাক কেটে দিয়ে আসব। তাহলে ও আর এমন করে হাঁচতে পারবে না,আর বিষ ছড়াতেও পারবে না, না দিদুন? কিন্তু খচ্চরটাকে যে এখন কোথায় পাই!
আচ্ছা দিদুন,
তুমি বলেছিলে ওর নাকি বিয়ে হয়ে যাবে! তা বিয়ে হয়ে গেলে তো ও অনেক দূরে চলে যাবে! ওর
কি এখনো বিয়ে হয় নি দিদুন?
তুমি, দাদু ভাই, কাকাই, কাকিমনি, পুতু সবাই কিন্তু
মাস্ক পড়ে থাকবে। একদম বাড়ি থেকে বের হবে না। পুতুকে বলবে, ও তো খুব ছোট, বের হলেই
কিন্তু খপ…
আমি ভালো নেই দিদুন। একদম ভালো নেই। কতদিন স্কুলে
যাই না, বন্ধুদের দেখতে পাই না। তোমাদের দেখতে পাই না। বাবা বলে, ফোনে দেখো,
কথা বল যত খুশি। আচ্ছা দিদুন, বাবাটা কি বোকা, না!
ফোনে কি সত্যিকারের মতো দেখা যায়! ও তো কেমন যেন সিনেমা সিনেমা বলে মনে হয়।
আমার যা হাসি পায় না। কি বলব? কেমন যেন সব! আমি তোমাদের ছুতে পারি না, তোমাকে ধরতে
গিয়ে হাত বাড়ালেই মোবাইলের স্কিনে হাত পড়ে, আমার একদম
ভাল্লাগে না। তার উপর এই হয়েছে এক অনলাইন ক্লাস!
সকাল হলেই অ্যান্টিরা হোমটাস্ক নিয়ে চলে আসে। এ সব আমার বিচ্ছিরি লাগে, একদম ভালো লাগে না দিদুন।
সব হয়েছে ওই নাকেশরির জন্য, না দিদুন? তাই তো বলছি খচ্চরটা কোথায় আছে তুমি জানো? আমি ও কঙ্কা দিদির মতো আকাশে যাবো। পুতকে বলবে ও যেন মন খারাপ না করে । ওর জন্যে তারার ফুল এনে দেব। তুমি নিশ্চয় ভাবছ চাঁদের ওই তাল পাতার সেপাইটাকে আমি ভয় পাবো। হা হা হা......তাল পাতার সেপাই আমার কি করবে? আমার কাছে যে বীরবলের দেওয়া সেই তরবারিটা আছে।
তোমার আর দাদাইয়ের জন্য চাঁদের শিকড় আনব, ছাগলের দুধ দিয়ে বেটে হাঁটুতে লাগাবে। দেখো তোমার
বাতের ব্যথা সেরে যাবে। আর দাদাইয়ের তুলসিপাতার রস ও বেলের গুড়োর সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াবে,
পেট ভালো হয়ে যাবে। জানি না বাপু এত পেটের ব্যথা কেন হয়! এখন তো ডাক্তারখানা সব বন্ধ,
হাসপাতালে গেলেই এই পরীক্ষা, ওই পরীক্ষা করো। তারপর এখন তো করোনা পরীক্ষা না করে ডাক্তার
দেখবে না, বলো।
অমা, এতো
বেলা হয়ে গেছে? এখন তবে রাখি দিদুন, আমার আবার ক্লাস শুরু হবে। মা ডাকছে। তুমি কিন্তু
খচ্চরের কথাটা কাওকে বল না।
টা টা
………
তোমার তনু।
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কি বলব? এর আগে যখন প্রথম করোনার বাড়াবাড়ি হল, তখনো আমার মা- বাবা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর অবস্থা একটু ভালো হতেই ওনারা আবার দেশের বাড়িতেই ফিরে যান। ওর দিদা চিরকাল গল্প পড়তে ভীষণ ভালবাসেন। বুঝলাম এ সব আমার মায়ের কীর্তি। ছোট্ট তনু মাস্ক পড়তে চাইত না বলে মা ওকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ''কঙ্কাবতী''র গল্প শুনিয়েছিলেন।
মা -বাবা এখন দেশের বাড়িতেই থাকেন। আর আমরা এখানে। আবার করোনার সেকেন্ড ওয়েভ এসেছে। তাই বাড়তি সতর্কতা নিতে হয়েছে আমাদের সকলের।
কিন্তু তনুটা, এতখানি কষ্ট ওই ছোট বুকে লুকিয়ে রেখেছে ভাবতে আমার দু’চোখ জলে
ভরে এল। পায়ে পায়ে বাড়ি এসে দেখি, ও এখন পড়ার ঘরে ঘাটের উপর বসে আমার স্মাট
ফোনটায় চোখ রেখে চেয়ে আছে। আর দেখি, আমার পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে ওর বাম হাতের তর্জনীটি নিষেধের ভঙ্গিতেই দুই ঠোঁটের
উপর চেপে ধরে, মৃদু মৃদু হাসছে।
---------------------------
২৯/ ০৪/২০২১
সোনারপুর।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন