Featured Post
গল্প ।। বামপন্থী ।। চন্দন মিত্র
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
তীব্র কর্তব্য সচেতন, অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন না। আপদে বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু ওই এক দোষ, মালটা গোঁড়া বামপন্থী। মাঝেমধ্যে এমন বিলো দ্য বেল্ট হিট করেন যে, মনে হয় এক ঘুষিতে ওঁর নাকটা ফাটিয়ে দিই। কিন্তু কী করব কলিগ শুধু নয়, পাশাপাশি চেয়ারে বসি। সম্পর্কটা অম্লমধুর। সেদিন একটা নতুন আংটি পরে গেছি। দেখে বলেন কিনা — ঘোষবাবু, এই নতুন সংযোজনটা কী করোনা-প্রতিষেধক! মৈনাকবাবুর অনুমান ক্ষমতা দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যায় । আমি ছাড়া সহকর্মীদের সকলেই করোনা-ভ্যাকসিন নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভ্যাকসিন সম্পর্কিত নানা বিরূপ মন্তব্য দেখে আমি ঠিক ভরসা পাইনি।
অনেক ভাবনাচিন্তা করে জ্যোতিষার্ণব সমর শাস্ত্রীর শরণাপন্ন হলাম। তিনি আমাকে আগেও বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। কেবল আমাদের এলাকায় নয় বিভিন্ন জেলায় তাঁর চেম্বার আছে। প্রথম শ্রেণির দৈনিকে তাঁর বিজ্ঞাপন বেরোয়। আমার আগের চারটি আংটি তাঁরই দেওয়া। আমাকে দেখেই অন্তর্যামী মনের কথা বুঝে গেলেন।
— কিরে ব্যাটা ভোটের ডিউটিতে যেতে হবে বলে ভয় পেয়েছিস ! করোনার ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাই তো ! আয় বোস। ডান হাতটা দে। আতস কাচের ভিতর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চালিয়ে বললেন — করোনা যোগ আছে, তবে কেটে যাবে।
পাশে রাখা বাক্স থেকে একটা সবুজ পাথর দেওয়া আংটি বের করে আমার ডান হাতের তালুতে রেখে বললেন — করোনা-যোগ-মুক্তি-অঙ্গুরীয়, বাম হাতের তর্জনীতে পরে নে।
ডানহাতে বুড়ো আঙুল ছাড়া আর জায়গা নেই। আশ্চর্য ! বাম হাতের তর্জনীতে বেশ মানিয়েও গেল। আমি জানি সমর শাস্ত্রী বাকসিদ্ধ মানুষ, মুখে যা বলবেন তার অন্যথা হবে না।
— হাজার একান্ন টাকা দে। তোর জন্য টেন পারসেন্ট ডিসকাউন্ট। ভ্যাকসিন-ফ্যাকসিন নিয়ে মাথা ঘামাস না। দেখছিস না, ভ্যাকসিন নিয়েও কেউ পার পাচ্ছে না।
সমর শাস্ত্রীর দেওয়া সেই আংটিটা দেখেই এমন মন্তব্য করেছেন মৈনাকবাবু। আমিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই।
— শুনুন, যেসব বিষয় বোঝেন না, তা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।
— বুঝি না মানে। ভালোই বুঝি। ওসব বিষয়ে আমার যথেষ্ট পড়াশোনা আছে। দাঁড়ান আপনাকে একটি জ্যোতিষ-বিরোধী ঘোষণাপত্র দেখাচ্ছি।
— ওসব আমার অনেক দেখা আছে, আপনাদের মতো আর্টস-পড়া স্বঘোষিত বিজ্ঞানীদের ঘোষণাপত্র পড়া আর না-পড়া সমান।
— আরে না না, আমি যে ঘোষণাপত্রের কথা বলছি তা ১৮৬ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীর স্বাক্ষরিত, যাঁদের মধ্যে ১৮ জন নোবেল লরিয়েটও আছেন। বেরিয়েছিল আমেরিকার হিউম্যানিস্ট ম্যাগাজিনে; দেখিয়ে দিচ্ছি,...
মৈনাকবাবু মোবাইল ঘেঁটে সেই ঘোষণাপত্র বের করে আমাকে দেখাতে চান।
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি — পড়েছেন তো ইতিহাস নিয়ে ,আবার বিজ্ঞান বিজ্ঞান বলে এত হাঁক পাড়ছেন কেন ?
— বুঝলেন ঘোষবাবু, এটাই আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। আমি ইতিহাস পড়ে বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে লড়ি। আর আপনি বিজ্ঞান পড়ে কুশিক্ষার ফেরি করে বেড়ান। পাঁচ আঙুলে পাঁচটি রংবেরঙের আংটি পরে ক্লাসে আপনি কী কেমিস্ট্রি পড়াবেন বলুন তো ! আর ছাত্রছাত্রীরা আপনার কাছ থেকে কতটা বিজ্ঞান শিখতে পারবে তাতে একটা সন্দেহ থেকে যায়। আপনি বিজ্ঞান পড়ান অথচ আপনিই বিজ্ঞান মানেন না। সত্য সেলুকাস ...
— থামুন, থামুন। আপনার মতো বামপন্থী আমার অনেক দেখা আছে। আপনারা দেশীয় ঐতিহ্যের শত্রু, বিদেশি ভাবধারার দাসত্ব করেন। নিজের বাবাকে ছেড়ে অন্যের বাবাকে বাবা বলেন। আপনার কাছে আমার বিজ্ঞানমনস্কতা না-শিখলেও চলবে।
ইতিমধ্যে থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়ে গেছে। তর্ক ভেঙে দুজনেই চললাম ক্লাসে।
ভোটের ডিউটি থেকে ফিরে আসার পর মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। মৈনাকবাবু খোঁটা দেওয়ার পর থেকে মনটা কেমন যেন কু গাইছিল। গিন্নিও ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে সমানে ঘ্যানর ঘ্যানর চালিয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম দেখি তো ১৮৬ জন বিজ্ঞানী জ্যোতিষ-বিরোধী ঘোষণাপত্রে কী বলেছেন। গুগল সার্চ করে পেয়েও গেলাম। ফার্স্ট প্যারাটা পড়ে ফেললাম —Scientists in a variety of fields have become concerned about the increased acceptance of astrology in many parts of the world. We, the undersigned — astronomers, astrophysicists, and scientists in other fields —wish to caution the public against the unquestioning acceptance of the predictions and advice given privately and publicly by astrologers. Those who wish to believe in astrology should realize that there is no scientific foundation for its tenets ।
ভোরবেলা গিয়ে লাইন দিলাম তাও সিরিয়াল হল ১৪১। বহুজন সারারাত লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। নটার সময় টোকেন হাতে পেলাম। টোকেন দেখে তবে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলে কথা, ভিতরে বসার ব্যবস্থা ভালোই; শ-দুয়েক লোক যাতে দূরত্ব বজায় রেখে বসতে পারে তেমনভাবে চেয়ারগুলো সেট করা। ফার্স্ট ডোজ আর সেকেন্ড ডোজ-এর জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা। সকাল ১০টার সময় চেয়ারে বসার সুযোগ পেলাম। জানি না কতক্ষণ পরে ভ্যাকসিন নেওয়ার সুযোগ হবে! এন নাইনটি ফাইভ মাস্কটা এমন কামড় বসাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে খুলে ছুড়ে ফেলি; দমও বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। আরও একটা সমস্যা হল, মুখ ঢাকা থাকায় চেনা লোককে অচেনা, আর অচেনা লোককে চেনা বলে ভ্রম হয়। এদিকে অনেকক্ষণ থেকে দেখছি সেকেন্ড ডোজের লাইনে বসা একজন লোক আমার দিকে মাঝেমধ্যে কেমন যেন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। আবার আমি যখন তাঁর দিকে তাকাচ্ছি, তখন তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। লোকটিকে খুব চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি। মুখে এন নাইনটি ফাইভ মাস্ক থাকায় মুখের আদলটা ঠিক ধরা না-গেলেও ওই লেস লাগানো গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা, ওই বাবরি চুল, যেন আমার আগে দেখা ! কোথায় দেখেছি ! কোথায় দেখেছি ! হ্যাঁ মনে পড়েছে। আর মনে পড়তেই রাগে-দুঃখে-হতাশায়-আনন্দে আমার ভিতরে এক অভূতপূর্ব ভাব জেগে ওঠে। চেয়ার ছেড়ে আমি তার সামনে গিয়ে সটান দাঁড়াই। লোকটি আমাকে দেখে থতমত খেয়ে যান, ভূত দেখার মতো আঁতকে ওঠেন। আমি খুব তীক্ষ্ণ অথচ নীচু গলায় ক্রোধ প্রকাশ করি —
ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে একেবারে প্যান্টশার্ট পরে চলে এসেছেন, ভেবেছিলেন কেউ চিনতে পারবে না !
— না, মানে সেকেন্ড ডোজটা বাকি থেকে যাবে তাই আর কী!
— শুনুন আপনি বিমল ঘোষকে ঠকাতে পারেন। কিন্তু এই বামপন্থী বিমল ঘোষকে আর ঠকাতে পারবেন না। এই নিন এই আংটিটা আপনি রাখুন। আমি তাঁর গ্লাভস পরা হাতে আংটিটা গুঁজে দিই।
তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে নিঃশব্দে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেন। আমি তাঁকে বিরত করে বিনয়ের সঙ্গে জানাই, না না টাকা লাগবে না।
---------------------------
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন