শংকর
কানাই দাস (আসাম)
১
শ্মশানের চিতাটা দাউ দাউ করে জ্বলছে ।অপেক্ষা করছে আর একটা লাশের ।কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটা হয়তো চলে আসবে। এভাবেই হয়তো জ্বলতে থাকবে একের পর এক লাশ ।এই লাশগুলোর দুঃখের কথা কেউ জানবে না। চিতার ছায়ভস্মের সাথে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা সব নিঃশেষ হয়ে যাবে ।হাতে একটা 'ওল্ড মঙ্ক 'এর বোতল নিয়ে ভাবতে থাকে শংকর। শঙ্করের কানে ভেসে আসে এটি একটি 22 বছরের তরুনীর লাশ।না -কোনো অসুখে নয় ,বিবাহিত পুরুষকে ভালোবেসে না পাওয়ার ব্যর্থ বেদনা নিয়ে হারিয়ে গেছে মেয়েটি। কয়েকজন শ্মশানের বাগানে বসে বিড়ি টানছে, আর বলছে- 'শালা বড়লোকদের দের মেয়ের পেছনটা বিড়ির পাছার মতই যতই চটকাবে ততোই একটা আলাদা গন্ধ বের হবে।' শংকর ভাবে -এই গন্ধের মধ্যেই তো রয়েছে ক্যান্সারের টান। হাতে বোতলটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায় তাদের কাছে। কিন্তু সাহস করে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। বোতলের মুখটাই একবার চুমু দিল। এদিকে বিড়িতে টান দিতে দিতে একজন বলে উঠল ,-
কে কে ওখানে ?
আমি, আমি শংকর । শংকর বাউরী।--
তা দাদা আপনার হাতে কি? শংকর নিমিষের মধ্যে উত্তর দেয়--গঙ্গাজল সেবন করছি। শংকর এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে তাদের পাশে বসল । একজনকে জিজ্ঞাসা করল---আচ্ছা দাদা আপনারা কী ওই লাশটার সাথেই এসেছেন! একথা শুনা মাত্র সকলেই চুপ। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিঃশব্দ ,নির্বাক স্রোতার মতো অবাক চোখে দেখতে থাকে শংকর কে। বোতলে এখনো অর্ধেকেরও বেশি মদ রয়েছে। ফটিক চাই-এর নজরটাও গিয়ে পড়েছে মদের বোতলের দিকে । মাতাল আর চাতালের মধ্যে কোনো লজ্জা ঘৃণা ভয় থাকতে নেই। মাতালের মাল আর চাতালের চা দেখলেই জিব টা এমনিতেই বেরিয়ে আসে। ফটিক বলে বসে ----দাদা এক চুমুক দেওয়া যাবে , উপর উপর মেরে দেবো ।বিড়ির কিছু আগুন ফটিকের তহবনে (লুঙ্গি )এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে,তহবনের মধ্যে পড়ে থাকা আগুন একজন দু আঙ্গুল দিয়ে নেভাতে থাকে। কিছুক্ষণ আগেই বাংলা 60 র বেশ কয়েক বোতল গলকেষ্টনম করেছে এই চারজনে। তবুও নেশা এখনো হয়নি। একজন ফেলে দেওয়া বিড়িটা আবার জ্বালাতে থাকে। ফুকফুক করে জ্বলতে থাকে বিড়িটা। কিছুক্ষণ নিরবতা থাকার পর -তৃতীয় ব্যক্তি বলে বসে ,----না দাদা ওটা একটা শহরের মালদারী মাল। ও কিছু নয়, সুসাইড কেস। দেখছেন না কতকগুলি সিভিক পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই মোটা পেটলা মালটা -ওটা পুলিশ অফিসার। বেশ কিছুদিন ধরে শঙ্করের একটা জুজু ধরেছে- এই রকম মোটা পেটলা মানুষ দেখলেই তার যেন ভেতরে ভেতরে ভয়ের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই ফটিক শঙ্করের হাতে থাকা মদের বোতলটা নিয়ে দু-তিন ঢোক গটগট করে গিলে ফেলেছে।
২
একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাগলা নদী। নদীর ওপাশে আমবাগান। বাগানটা ঘন অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছে। জল স্থির না স্রোত আছে তাও বোঝা যায় না। কচুরিপানা সমস্ত নদীটাকে দৈত্যের মতো গ্রাস করেছে। শ্মশান লাগোয়া নদীর পাশে পাশে কতকগুলি ফলক। যা কবর দেওয়ার পর বানানো হয়েছে। একটু আগেও ঘন অন্ধকারে এখানে মনে হচ্ছিল বসে কেউ যেন মদ খাচ্ছে। না। শংকর মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে প্রত্যক্ষ করে নিল ওটা একটা কবরের ফলক। কোন সাধুর। শঙ্করের নজর চলে যায়, সেই পেটওয়ালা মোটা মালটার দিকে। মনের মধ্যে বিড়বিড় করে বলতে থাকে মালটা কোথাও যেন দেখেছি। একটি শেয়াল তাদের পাশ দিয়ে সো করে বেড়িযে গেল। দুজন মাতাল নিজের নিজের লুঙ্গিটা শক্ত করে ধরে হো হো করে শেয়ালটার পিছু নিল । পড়ে থাকা অল্প মদের বোতলটা হাতে নিয়ে শংকর সেখান থেকে সরে পড়ল।
শ্মশানের গেটলাগোয়া কতকগুলি পান ,বিড়ি ,সিগারেটের দোকান। আর গেটের মধ্যেখানে লেখা ,'মদ্যপ অবস্থায় শ্মশানে প্রবেশ করবে.. ....।' 'ন' এবং' না' অক্ষর দুটির চিহ্ন ও সংকেত কিছুই নেই। তবু বুঝে নিতে হয়। শংকর বুঝে নেয এমত অবস্থায় তার ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। দুটো সিগারেট নিয়ে শংকর বেরিয়ে পড়ে শ্মশান লাগোয়া বাঁধের কাছে ল্যাম্পপোস্টের নিচে। সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে শুরু করে দুই সন্তানের পিতা শংকর কিভাবে সংসার থেকেও সংসারচু্্যত।
স্ত্রী সুকুমারী বাউড়ি। বালুচর গ্রাম। ভালোবেসে শংকর তাকে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়ে করার পড়ো আগে কখনোই সে সুকুমারী নাম ধরে ডাকেনি। ভালোবেসে ডাকতো শংকরী। বিয়ে 2010 এপ্রিল সংখ্যা। সংখ্যা বলার কারণ, কেননা শঙ্করের এরপরেও অনেক অলিখিত বিয়ে হয়েছে। সদ্য মাস্টার ডিগ্রী পাস করে বিয়ের ল্যাটা চুকিয়ে ফেলে । বাবার জমিজামার কাজ ,পার্টির কাজ কিংবা পয়সা দিয়ে চাকরি নেওয়ার ব্যবস্থা সব কাজ সমানভাবে চালাতে থাকে। একরকম সুখের সংসার। বাড়ি থেকে মাত্র 500 মিটার দূরে শশুর বাড়ি। দুই শ্যালক , তাদের বউ, শশুর ,শাশুড়ি ,গ্রামের আত্মীয়-পরিজন নিয়ে একরকম সুখের দিন ছিল তার। মজা তামাশা ,রঙ্গ ,হাসি ,সবই হত। কিন্তু গ্রাম্য পরিবেশে যখন কেউ কারো বাড়ি অতিরুক্ত ঘনঘন যায়, তখন সমাজের চোখে পড়তে শুরু করে। স্ত্রীর কানেও একথা আসতে থাকে। প্রথম প্রথম সুকুমারি ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে ব্যাপারটাকে, তিলকে তাল করে ফেলে। সুকুমারীর বৌদির প্রতি শঙ্করের দুর্বলতা প্রকাশ ক্রমশ বাড়তে থাকে। শুরু হয় স্বামী স্ত্রীর মল্লযুদ্ধ। শংকর প্রথমে আমল না দিলেও তার মাত্রা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ভালোবাসার সুতোর টান ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। সুকুমারীর হাত থেকে লাটাই টি হারিয়ে যেতে থাকে, গ্রাম্য অর্ধশিক্ষিত সুকুমারী তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনা। আজ বছর সাতেক হল , শঙ্করের শ্বশুরবাড়ি আর যাওয়া হয়নি।
মোবাইলটা অন করে সময় দেখে নেয় রাত্রি 8:45। পাসওয়ার্ড দিতেই নোটিফিকেশনে প্রায়ই হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। পঞ্চাশের উপরে মিসকলড। সবচেয়ে বেশি ফোন করেছে ছোটবোন রুমি। রুমিকে নিয়ম ও শঙ্করের চিন্তা---ধীরে ধীরে রুমির ও বযস বেড়ে যাচ্ছে। এ বছরের এপ্রিলে ঊনত্রিশে পা দেবে। ভালো একটা পাত্রের খোঁজ এখনও পাওয়া গেল না। মোবাইলের ওয়ালপেপারে নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে শঙ্করের ঘৃণা বোধ হয়। 2017 এসএসসিতে দুইভাই বোনের চাকরির জন্য প্রায় 16 লক্ষ টাকাএক দালালকে দেয়। কয়েকদিন আগে হাইকোর্ট তাতেও জল ঢেলে দিয়েছে। ওল্ড মঙ্ক টা শেষ হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য শংকর হাতের তালুতে বোতলের মুখ চেপে ধরে। মাত্র কয়েক ফোটা হাতের তালুতে এসে গড়াগড়ি খায়। দুই হাতের তালু এক জায়গা করে স্যানিটারাইজ করে নেয়। বাম হাতের তালু টা নাকের কাছে নিয়ে বেশ কয়েকবার সুগন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে। মোবাইল স্ক্রিনে আলোটা এখনো জ্বলছে। এইতো কদিন আগে যেখানে রিয়ান ও আয়ানের ছবিটা একে অপরকে চুমু দিচ্ছিল। শঙ্করের জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। শংকর ভাবতে থাকে ,জীবনের সমস্ত সঞ্চয়ের পরিমাণ কত। জীবন বীমায় অন্তত ত্রিশ লক্ষ টাকা পাবে। পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে আরও অন্তত পক্ষে কুড়ি লক্ষ টাকা । এসবের সমস্ত মালিক করে যাবে রিয়ান ও আয়ানকে। বাপটাও ক্যান্সারের ,'থার্ড স্টেজে' দাঁড়িয়ে রয়েছে--হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই " বল হরি হরিবোল "হয়ে যাবে। এসময় বোনটার বিয়ে দেওয়ার খুব দরকার ছিল। তাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার একমাত্র সাক্ষী রুমি। রুমি আবার তাকেই বেশি করে বকাঝকা করে। কখনো কখনো আবার প্রকৃত বন্ধুর মতো আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে রুমি। হতভাগী রুমি। পণের টাকাটাও দিয়ে দেয় চাকরির জন্য। ল্যাম্পপোস্ট থেকে 100 মিটার দূরে একটি শিমুল গাছ। একটি লক্ষ্মীপেঁচা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে শংকরের দিকে। ঠিক তার 70/ 80 মিটার দূরে শ্মশানের গেটটা। আবার একটি শবের প্রবেশের প্রস্তুতি চলছে। কতগুলি মানুষের হট্টগোল। রাম নাম সত্য হ্যায়,রাম নাম সত্য হ্যায় ,,বল হরি হরি বল, বল হরি হরি বল। শংকর এক-পা দু-পা করে এগিয়ে আসে শ্মশানের গেটের দিকে।
৩
এই ভিড়ের মধ্যে শংকর গেটের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে। পেছনের পকটে এ্ হাত দিয়ে পুরনো একটি মাস্ক বের করে। মাক্স টি মুখে পড়ে নেয়। তারপর ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু কোথায় গেল ওই মোটা পেটলা মানুষটা, পেছন দিক দিয়ে যাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছিল তার। জনা এক-দেড়শ মানুষের ভিড়। লড়ি থেকে লাশটা নামানোর চেষ্টা চলছে।নিচে কয়েকজন অতি সতর্কতার সাথে লাশের দোলনার হাতা দুটো জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। পাশে বছর 14 /15 এর একটি বালক ঠিমু ঠামু করে চিৎকার করছে। এক বুড়ো আরেক বুড়োকে ফিসফিস করে বলছে --বুড়ির একমাত্র সন্তান অনেকদিন আগেই মারা যায়। তারপর বৌমা বুড়ির ছেলের বন্ধুকে নিয়ে পালিয়ে যায় ।এই বুড়ি ছিল ছেলেটির মা বাবা। বাঁশের দোলনা নিয়ে এগিয়ে যায় চারজন মানুষ। গেটের সামনে আসতেই প্রায় 20/30 মিটার দূরে শবের বিশ্রামাগার ।ঘরটি মধ্যে পাঁচটি শব রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘন্টাখানেক আগে এখানে চারটি ছিল ।এখন কমে তিনটি। আবার চারটি শব ।শংকর এগিয়ে যেতে থাকে বাঁধানো শ্মশানের নদীর পাড়ে। পাড়ের ঠিক উপরে একটি স্মৃতিসৌধ। সৌজন্যে সৌগত শর্মা। কোটিপতির একমাত্র সন্তান। পুত্রের প্রতি পিতার একমাত্র উৎসর্গ স্বরূপ নবরূপে রুপায়ণ এই শ্মশানটি। শংকর ঘাটের বাঁধানো সিড়িতে পা দেয়। ঠামুর নতুন পুরাতন কাপড়গুলি বালকটি একটি ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার আগে বার কয়েক বুকে জড়িয়ে ওই কাপড়েই দুটি চোখ মুছতে থাকে। শঙ্করের দুচোখ দিয়ে জল বয়ে যেতে থাকে।
ঘাটের সিড়িতে বসে পড়ে শংকর। ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা কাপড়গুলো ধীক ধীক করে জ্বলছে ।একটা আলাদা ধরনের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কতগুলি ব্যাঙ ও ঝিঝি পোকা একসাথে ডাকছে আর ডাকছে। কিছু লোক বালকটির চার পাশে দাঁড়িয়ে সান্তনা পুরস্কারের পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করে চলেছে। রায়ান আর আয়ানের মুখদুটি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর কেন য়েন উবে যাচ্ছে। সাত জন লোক ঘাটের সিড়ি বেয়ে নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে ।সাথে একজন পুরোহিত কী কী করণীয় তা বলছে আর হাতদুটো নাড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ঘাটের নিচে পড়ে রয়েছে অসংখ্য ঘট ,মাটির তা ,প্রদীপ ছেঁড়া কাপড় পোড়াকাঠ আর ও কত কী ! এগুলি মাড়িয়ে সাত জন লোক এক হাঁটু জলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়জনের আত্মা শান্তির জন্য বিসর্জন দিতে। হঠাৎ কানের মধ্যে প্রবেশ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মোবাইলের রিংটোন ---মায়া নদী কেমনে যাবি বাইয়া //রঙ্গিলা দেশের নাইয়া //মায়া নদী কেমনে যাবি বাইয়া// বহুবার শংকর গানটা শুনেছে। কয়েকটা লাইন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল-- কত সাধু গুরু ভাইসা গেল রে-- এই না নদীর পিছল ঘাট// ছয় রমনি দেখায় ঠাট //তাদের রূপ দেখিয়া যাইওনা ভুলিয়া রে নাইয়া //রঙ্গিলা দেশের নাইয়া// স্ত্রীর সাথে ঝগরা করে শংকর দুপুর বারোটায় না খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। আসার আগে স্ত্রীকে কথা দিয়ে এসেছে ,এই মুখ আর সে তার স্ত্রীকে দেখাবেনা ।কিন্তু শঙ্করের মনের বল ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ।এ জীবন তার নিজের, রায়ান ,আয়ানের ,তার বাড়িতে থার্ড স্টেজ দাঁড়িয়ে থাকা পিতার, তার মা, রুমির আর কারো নয়। শংকর এ সময় বিদিতাকে বড্ড প্রয়োজন অনুভব করে। বিদিতা শঙ্করের বিবাহের পরবর্তী জীবনের পঞ্চমনারী ।বর্তমানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্রী।
এক পা দু পা করে শংকর এগিয়ে যেতে থাকে শ্মশানের ডানদিকে ।দুটি অশ্বত্থ গাছ পাশাপাশি অবস্থান করছে, নদীর ঠিক পাশে। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে চার পাঁচ হাতের বাঁধানো রাস্তা ।আর ঠিক ওই গাছের নিচেই রয়েছে একটি হরিবাসর। কতকগুলি সাধু ও কিছু শ্মশান যাত্রী যে যার উৎসাহ নিয়ে গান গেয়ে চলেছে--- হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে// অশ্বত্থ গাছটির পাশে রয়েছে একটি লোহার রেলিং-- শংকর হেলান দিয়ে লক্ষ করতে থাকে গাছের ঝুরি সহ গুড়িটাকে। অসংখ্য মানুষের নেমপ্লেট-- যাতে নামসহ- জন্ম-মৃত্যু -ঠিকানা গুলি ঝুলছে বাঁদুর ঝোলার মতো। কোথায়ও আবার লাল ওড়না জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাছের গুড়ির সাথে ।এভাবেই হয়তো অজস্র নক্ষত্র ঝড়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে ।যার সাক্ষী এই অশ্বত্থ গাছ। হঠাৎ নজরে পড়ে বছর ৭৯ এর শংকর মালাকারের নেমপ্লেটির উপর । বছর 38 শংকর ভাবতে থাকে এখনো তার অনেক আয়ু ।হাতের মুঠোফোনটা নিয়ে শংকর নাড়তে থাকে। আবার পাসওয়ার্ডটা দিয়ে দেখে এবারেও প্রায় একশর উপরে মিসকলড্। সময় বারোটা পাঁচ ,তারিখ 12/01/2021। আর একটা নতুন দিনের সূচনা হয়ে গেছে। সেখান থেকে ২০/২৫ মিটার দূরে কতকগুলো সাধু যজ্ঞের জায়গায় কাঠ পুড়িয়ে হাত দুটো বারবার প্রসারিত করে তাপ নিচ্ছে। শংকরও শরীরটা গরম করার জন্য এগিয়ে গেল তাদের কাছে।
৪
রাত্রি বারোটার পরই ফোন করত বিদিতা ।বিদিতার ও কোন ফোন বা মেসেজ পাইনি আজ। বেশ কয়েকদিন ধরে বিদিতার সাথে তার দর কষাকষি চলছে ।বিদিতা তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সংসার করতে চায়। বিদিতা গুহ ,যার পিতা রমেন গুহ, একজন দুদে পুলিশ অফিসার। মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর থানার ওসি।বড়দা সায়ন কোচবিহারের দিনহাটা কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ।একরকম হাইপ্রোফাইল ঘরের মেয়ে বিদিতা। বিদিতার সাথে তার পরিচয় কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় এক রেস্টুরেন্টে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয় শংকর ।তারপর তাদের দুজনের মধ্যে চলতে থাকে ফোনপকথন। শংকর ভালোবেসে নাম দেয় বিন্দি।
কয়েকজন সাধু শংকরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন কথা না বলে বসে পড়ে ছেড়া পাটের বস্তার উপর। আগুনের আঁচ নেওয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে ।পাশেই রয়েছে কতকগুলি মন্দির। শংকর সূর্য মন্দিরের দিকে চলে আসে। আবার বুক পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করে। না আর কোন মিসকলড্ এলার্ট নেই ।স্কিনে থাকা ফেসবুকে বুড়ো আঙুলটা দাবায়।লক্ষ করতে থাকে , গত এক-দেড় মাস ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টগুলি। কত গান ,জীবনমুখী কথা, বাস্তবতার কত ক্ষতচিহ্ন। গতকাল তিন চারটি গান পোস্ট করে --ও চাঁদ আমার কি অপরাধ তুমি বলে দাও /ভালোবাসো আর নাইবা বাসো আমি তোমায় ভালোবেসে যাবো /আজ থেকে আর ভালবাসার নাম নেব না আমি।/ এইতো জীবন, হিংসা বিবাদ , লোভ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ,_---- চিতাতেই সব শেষ /হায় চিতাতেই সব শেষ ।চার্জ না থাকার জন্য মোবাইল ফোনটা অফ হয়ে যায়। সূর্যদেবের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে --বিদিতা তুমি আমার কর্ণকে ভালো রেখো,--- তুমি আমার কর্ণকে ভালো রেখো।
বিদিতা জানতো শংকর বিবাহিত। তবুও কেন যেন তাকে ভালো লেগে যায়। বিদিতার জীবনে শংকর হয়ে ওঠে মস্তরাম। 2019 এর আগস্ট প্রথম পরিচয় হয় তাদের। তারপর পুজোয় যখন বিদিতা বাড়ি আসে তখন দুজনে হাতে হাত রেখে শহরের মণ্ডপগুলো ঘুরে ছিল। প্রথম প্রথম শংকর বিদিতার ভালোবাসা গ্রহণ করেনি। কিন্তু বিদিতায় যখন বলে-- এই ভালোবাসার কথা তার বাড়ির কেউ কোনদিন জানতেপারবে না। বাড়তে থাকে তাদের ভালোবাসার রসায়ন। শুরু হয় পূর্বরাগ , অনুরাগ, অভিসারও মাথুর এসবই চলতে থাকে মুঠাফোনের মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় ফোনবাৎসায়ন। বিদিতা অডিও সেক্স করলেও ভিডিও সেক্স কোনদিন করেনি শংকরের সাথে। ভিডিও সেক্সে ইতঃস্তত বোধ করত বিদিতা। শংকর কে প্রায়ই ডেকে নিতো কলকাতার ফ্ল্যাটে। ওটা বিদিতার ই ফ্লাট। দুজনে বসে এখানেই প্রথম তারা মস্তরাম ওয়েব সিরিজ টা পুরো দেখে এবং এক একটা আসন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্র্যাকটিক্যালি করতে থাকে । প্রথম দুদিন কনডমেশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি দেখালেও পরে য়েন কেমন কেমন মনে হয়। তৃপ্তি পায় না বিদিতা। শঙ্করের ওয়ালেটে রাখা কনডম্ গুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। তারপর মার্চ মাসে পুরো লকডাউন।বিদিতা আটকে পড়ে কলকাতায়। শংকর মালদায়। শুরু হয় বিরহ ।কেননা মস্তরামের নেশা তখনও কাটেনি তাদের ।তার উপরে হঠাৎ লকডাউন। প্রতিদিন সময় করে শংকর ফোন করে খোঁজখবর নিত। প্রেমের গাঢ়ত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে । শুরু হয় আনলক ওয়ান /টু ।এরই মধ্যে আবার শংকর কলকাতায় যায় ।এবারে প্রায় 12 দিন থাকে। সময়টা সেপ্টেম্বরের প্রথম । 'কভিদ' ১৯ এর প্রকোপ, ফ্ল্যাটের বাইরে যেতে পারিনি শংকর। কোনরকম প্রটেকশন ছাড়াই বাৎসায়নের কামসূত্র অধ্যায়ণ করতে থাকে দুইজনেই। অক্টোবরে বিন্দির সাথে শেষ দেখা হয় তার। সেইবার পুজোয় কয়েক দিনের জন্য সে মালদায় আসে। এখানেও বেশ কয়েকবার শারীরিক মিলন হয় দুজনের। তারপর চলে যায় কলকাতায় ।ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার আসে বিন্দি মালদায় ।ধরা পড়ে মায়ের হাতে ।প্রেগনেন্ট।
সূর্য মন্দির থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। কোথায় গেল সেই মোটা পেটলা মানুষটা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে হরিবাসরের দিকে ।কয়েকজন সিভিক পুলিশ একজনকে ঘিরে ধরে বসে আছে ।সকলেই চুপচাপ। মধ্যে বসে থাকা রমেন বাবু গম্ভীর স্বরে একজন সিভিক পুলিশের নাম ধরে ডাকছে আর বলছে, আরে ও হাবলা, কোথায় গেলিরে ,,দেখ না ব্যাটাদের হয়েছে কিনা। প্রথম দিন জয়েন করে ও শালা শান্তি পেলাম না। বাড়া জঙ্গিপুরই ভালো ছিল ।এই সৌমেন দেখে আইতো কি হলো? শঙ্করের গালভরা দাড়ি ,তার উপরে মুখে মাক্স। শংকর চিনতে পারল মোটা পাতলা মালটা বিদিতার বাবা ।বিদিতা অনেকদিন আগেই বলেছে বাবার ট্রানস্ফার টা 2019 এর শেষে না হলে 2020 শুরুতে হয়ে যাবে। তারপর তো চলে আসে একটা পেন্টানিক সিচুয়েশন গোটা বিশ্বে শুরু হয় লকডাউন ।তবে কি গতকালই তিনি জয়েন করেছেন! হবে হয়তো !তার উপরে পশ্চিমবঙ্গে যা চলছে প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে ভুড়ি ভুড়ি মানুষ ট্রানস্ফার নিয়ে বাড়ির কাছে চলে আসছে । লাল টুপি যতদিন ছিল শঙ্করের কদরও ছিল ব্লকে সবার আগে। তারা কয়েকজন মিলে সমস্ত কিছু সিদ্ধান্ত নিত এবং তা জেলা কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিত। সেই সময়টা বড্ড ভালো কেটেছে তার। নোকিয়া 1108 সেটটার কথা এখনো ভুলতে পারেনা শংকর। প্রথম মোবাইল, দিনে শ দুয়েক এরও বেশি ফোন আসতো তার কাছে। কত মানুষের কত রকম ভাবে সাহায্য করেছে, সে নিজেও জানে না। এসএফআইয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপ নেতা হয়ে উঠেছিল। তারপর জেলা কমিটি থেকে ধীরে ধীরে যুব তে প্রবেশ। একটা পরিচিতি নাম হয়ে উঠেছিল জেলার নেতাদের কাছে। 2011 পালাবদল। কিন্তু শঙ্কর নীতি এবং আদর্শ কোনটাই বিসর্জন দিতে পারেনি। বর্তমানে সবুজ এবং গেরুয়া পুরো পশ্চিমবঙ্গ ছেয়ে গেলেও শংকর এখনো লাল টুপি পরে বসে আছে। ব্যর্থ এক আশা নিয়ে-- হাত নাকি কাস্তে ধরেছে। সবুজের দাপটে প্রায় দু বছর হয়ে গেল রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছে। এতদিন লাল ঝান্ডা টা থাকলে হয়তো ভালো একটা জায়গা করে নিতে শংকর। না,রমেন বাবু তাকে চিনতে পারিনি। ভালো হয়েছে -চিনতে পারলে কোমরের রাখা পিস্তলটির একটি গুলি তার বুকের এপার ওপারে একটা সুরঙ্গ তৈরি করে চলে যেত। শঙ্করের সবচেয়ে বেশি ভয় হয় এই মানুষটাকে ।রাতের পর রাত ঘুমের মধ্যেও আসতে থাকে এই মানুষটা ।শংকর ডিপ্রেসড ।নিজেকে আলাদা জগতের মানুষ তৈরি করে ফেলে। দ্রুত আবার চলে যায় মন্দিরগুলোর দিকে ।মন্দিরের গায়ে লাগানো নেমপ্লেট গুলোর উপর লোকদেখানো চোখ বোলাতে থাকে ।একটি কে নিজের নেমপ্লেট ভাবতে থাকে। তার মদের নেশা টা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে।
৫
মাথাটা এখনো ধরে আছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করে। কেউ যেন মাথায় লোহার হাতুড়ি মেরে চলেছে ।প্রচন্ড শীত কুয়াশায়, অন্ধকারের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে। শীত শ্মশানের চারিদিকটা চক্রব্যূহ তৈরি করে ফেলেছে। নদীর এপাশ-ওপাশ করে চলেছে কতকগুলি নাম না জানা পাখি। শ্মশানের অস্পষ্ট আলো নদীতে পড়ছে ।পাখিরা কোন লৌকিক- অলৌকিক বার্তার অপরূপ স্পর্শ নিয়ে চলছে । অগ্রাহণের শেষ আর পৌষের শুরুর দিকে কিছু অতিথি পাখির আগমন ঘটে এই পাগলা নদীতে ।ঠান্ডা বাতাস, শক্ত মাটি আর মৃত্যুপ্রায় গাছগাছালিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে শ্মশানটা। ভীষণ ঠান্ডা অনুভব করতে থাকে ।মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের উপর বরফের আস্তরণ তৈরি করে ফেলেছে। না,, কিছু একটা শরীরে দিতে হবে।
সন্তর্পনে পা ফেলে শংকর এগিয়ে আসে শবের ছুড়ে ফেলা কাপড় গুলির ডাস্টবিন টার দিকে ।যদি একটা কম্বল পাওয়া যায় ।ডাস্টবিনটার পাশেই পড়ে রয়েছে কতগুলো কাপড়, তার মধ্যে রয়েছে একটি কম্বল। শরীরে ভীষণ ঠান্ডা লাগায় খপাৎ করে কম্বলটা উঠিয়ে নেয় এবং সারা শরীরে জড়িয়ে দেয়।শব বিশ্রামাগারের পাশে থাকা কয়েকজন লক্ষ করতে থাকে আর নিজেরা মাস্ক না পড়ায় অনুশোচনা করতে থাকে, শালা পাগলেও তার ভাল বুঝে। ধীরে ধীরে শংকর শ্মশানের গেটটা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। শ্মশানের বাঁধটা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। অল্প দূরেই শ্মশানের বাজারটা। শ্মশান যাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। গতকাল গঙ্গাজল আর কতগুলি আঙ্কেল চিপস, বিড়ি, সিগারেট ছাড়া কিছুই খাওয়া হয়নি তার ।পেটে ভীষণ খিদে ।।কিছু শ্মশান যাত্রী একটা দোকানে ভোজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুখাগ্নি করা মানুষটা কিছু লুচি,সবজি, মিষ্টি, বোঁদে শালপাতার থালায় নিয়ে সঙ্গে এক গ্লাস জল ,একটা নিরিবিলি স্থানে দিতে যাচ্ছে ।পেছনে পেছনে কতগুলি কুকুর , শংকর ও ওদের দলে এগিয়ে যেতে থাকে। খাওয়ার দেওয়ার পর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না, লোকটি খাওয়ার থালা টা রেখে হন হন করে দোকানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হাতে একটি ছোট লাঠি নিয়ে কুকুরগুলোকে তারা করে গ্লাস সহ থালা টা নিয়ে একটু দূরে খেতে থাকে। খেতে খেতে গরম অনুভব করে -- তরুণীর কম্বলটা শরীরে ফেভিকুইক আঠার মতো জড়িয়ে ধরেছে।
খাওয়া শেষ ।না --এখানে আর থাকা যাবে না, হাঁটতে হাঁটতে চলে ব্রিজ টার দিকে।
৬
শ্মশান থেকে বাবা ফিরে এসেছে ।মায়ের ঘরে ফিসফিস করে বলছে , মেয়েটা কিছু খেয়েছে, মেয়েটা না ওর শ্মশানের চিতাটা সাজিয়ে আসব। ভেবোনা মেয়েকে একা বিদায় দেব -_----সঙ্গে তোমারও রাম নাম সত্য করে দেব। সারা জীবন শুধু অর্থ সঞ্চয় করে গেলাম দুহাতে, কিন্তু তুই সামান্য একটা দায়িত্ব পালন করতে পারলি না। দরজাটা খোলা রেখেই মাকে বকছে -- আমার বিছানার পাশে জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, বাবা-মায়ের পাছায় রিভলভারটা লাগিয়ে পৃথিবীর সমস্ত অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে চলেছে। তারমধ্যে একটি বাক্য বেশ কয়েকবার বলতে থাকে রেগে রেগে --শালী তোর এই দিক দিয়ে ঢুকিয়ে এমন করে বের করবো যে তোর ফুটোটা কাউকে দেখাতে পারবিনা। কতবার বলেছি মাগী মেয়েটার কাছে থাক, শুনলি না। এখন বুঝ, তুইতো চার দেওয়ালের মধ্যে থাকবি, কিন্তু আমি-- বিদিতার চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। নিজেকে নিজেই এর জন্য দোষী মনে করে ।শঙ্করের সংসার ও তার নিজের পরিবার ,সব মিলিয়ে 12 জন মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছে। না ,,সুসাইড করতে পারবে না ।একা থাকলে সম্ভব ছিল ।কিন্তু সে অন্তঃসত্ত্বা। কোন এক আগন্তুকের মা ।তাকে বেঁচে থাকতেই হবে ।একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।মোবাইলটা বের করে এখনি একটা ফোন করবে শংকরকে ।বাবা-মায়ের ঝগড়ায় হৃদয়টা ভূকম্পনের মতো কেঁপে ওঠে ।নাড়ির স্পন্দন বেড়ে যায়। হাতে রাখা মোবাইলটাও কাঁপতে থাকে। এতদিন মাকেই দেখতো বাবাকে নানা বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছে,,কিন্তু কিছুদিন থেকে মা নির্বাক শ্রোতার মত বাবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে--- আর বাবা নিরহ বোবা জন্তুর মত মায়ের উপর অত্যাচার করে ।না ফোন নয়, একটা হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ ::
"আমি আমার সমস্ত জায়গা থেকে তোমাকে ব্লক করলাম --------
দাড়ি কমা হীন শূন্যস্থান যুক্ত একটি হৃদয় ভাঙ্গা বাক্য। ব্রিজের এক পাশে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। কম্বলটা মাথা পর্যন্ত মুড়ে দেয়। দুটো চোখ কম্বলের ফাঁকে বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। ব্রিজটার ওপাশে দুটি পাগল পাগলী-- পাগলটি পাগলীটির বুকের মাঝখানে নিজের মাথাটা রেখে দিয়েছে -,পাগলীটি দুই হাত দিয়ে তার মাথার চুলগুলো আঁচড়াতে থাকে ।একটা কম্বল দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। মাঝে মাঝে কপালে চুমু দিতে থাকে। লজ্জা রাঙ্গা টিয়ার মত মুখ সরিয়ে নেয় পাগল ।ভালোবাসার রাগ- অনুরাগ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। দুটি পারিজাত ফুল ব্রিজের উপর লুটোপুটি করতে থাকে। শংকর মুচকি হাসে আর হাসে-- নিয়তি আমার ভাগ্য নিয়ে এমন খেলা খেলছে বেদনার বালুচরে ।না, আর পারছে না ।চোখটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।বিড়বিড় করে বলতে থাকে বিদিতা, বিদিতা, বিদিতা, বিদিতা , বিন্দি ,বিন্দি ,বিন্দি, বিন্দি,হে কৃষ্ণ ,হে কৃষ্ণ ,হেকৃষ্ণ পৃথিবীর কত মানুষ পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে ,আমি কেন নয়? আমি কেন নয়?কাল বাদ পরশু পৌষপার্বণ ।গঙ্গাস্নানের মেলা। হাজার হাজার মানুষ এই ব্রিজ টায়ইআশ্রয় নেবে
। সকাল হলে কেউ জানবে না আজ রাতে শংকর এখানে ছিল। হালকা বাতাস গায়ে শিরশির করে এসে লাগছে।কম্বলের ভিতরে একটা আলাদা ধরনের সুগন্ধ বেরিয়ে আসতে থাকে। না কোন পারফিউমের সুগন্ধ নয়। পারফিউম আর মৃত দেহের গন্ধ একসাথে মিলেমিশে এক আলাদা কাম উত্তেজক সুগন্ধির মত হয়ে গেছে । তার স্পর্শ করা নারীদের শরীরের গন্ধ এক জায়গায় করলে যা দাঁড়ায় ।সে জড়িয়ে ধরে কম্বলটাকে। যতটা হাতের জোড় খাটাতে পারে। আবার উঠে পড়ে। সামনের দিকে এগোতে থাকে। কিছুদূর এগিয়েই রয়েছে বিরামপুর অনাদি চরণ মেমোরিয়াল ডি. ইএল .ই ডি. কলেজ। তার সামনে রয়েছে একটি প্রাচীন বটগাছ ।বহু পুরনো। পায়ে এক পাটি জুতো পড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই গাছটার নিচে ।কত মেলা আর লোকগানের আসর বসত এই গাছটার তলায়।নিচে একটি চায়ের দোকান ,এখানে কত নাম না জানা মানুষ, সাধুরা চা খেতে খেতে কত বিচিত্র ধরনের আলোচনা করত ।পাশেই একটি আমের আড়ত ।আমের সময় মালদহের সব রকমের আম এখানে পাওয়া যায় । কত ধরনের আম য়ে এখানে কেনাবেচা হয়, তা বলা খুব মুশকিল। সেই ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নেয়।সুরেলা ফজরের নামাজ শুরু হয়ে গেছে -- তিন চারটি মসজিদের আল্লাহ হুয়াকপার আল্লাহ ,/আল্লাহ হুয়কপার আল্লাহ---- শব্দগুলো একে অপরকে তীরের ফলার মতো বিধছে --কিছুটা উপরে যাচ্ছে আর কিছুটা নিচের মানুষের কানে প্রবেশ করছে। ফজরের আজান শুনতে শুনতে শংকর সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন