Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। সন্তান ।। প্রণব কুমার চক্রবর্তী

সন্তান

প্রণব কুমার চক্রবর্তী


          আলেয়া ? অ আলেয়া ?
          ঘরে বসে টিভি দেখতে দেখতে হঠাৎ মহিউদ্দিন সাহেব পাগলের মতো চিৎকার করে  উঠলেন । স্ত্রীর নাম ধরে হাঁক দিয়ে বলে উঠলেন - কোথায় গেলেগো ? একবার চটজলদি এদিকে এসো । দ্যাখো একটা দারুন খবর ! আমাকে এক্ষুনি ওইসব পোশাকগুলো পরতে হবে । মোটেই দেরি করা যাবে না ।
          আগে বসতেন না । ইদানিং কিছুদিন হলো টিভির খবরের আগে টুক টুক করে এসে ঘরে একটা টেনে নিয়ে চেয়ারে বসেন । খবর দেখেই আবার উঠে নিজের ঘরে চলে যান । কারো সাথে কথা বলেন না । মনে হবে যেন কথা বলাটাই উনি ভুলে গেছেন । 
          ভদ্রলোক  কিন্ত এমনটা ছিলেন না । সেনা বাহিনীতে চাকরি করতেন । ভেতরে এবং বাইরে উনি ইস্পাতের মতো শক্ত ছিলেন । চাকরির সূত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন । বাড়িতে খুব কমই থাকতেন । তবে , যতক্ষণ থাকতেন বাড়ি এবং এলাকার লোকজনের হৈ চৈ করেই সময় কাটাতেন । কখনো সখনো স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটিং করতে বেরুতেন , আবার ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা থাকলে ছেলেদের সঙ্গে - বিশেষ করে ছোটটার সঙ্গে ঘরে বসে টিভিতে খেলা দেখতেন, আর মাঝে মধ্যেই স্ত্রীকে ডেকে বলতেন - কি গো বাড়ি থেকে কি চা অর কফির পাট উঠে গেছে ? এতক্ষণ খালিমুখে বসে আছি । ওগুলো না হলে কি খেলা দ্যাখার কোনোও আনন্দ পাওয়া যায় ?
          ছোট ছেলে সমিউদ্দিন বাবার কথায় সায় দিয়ে মাকে বললেই , মায়ের কাছে বকুনি আর গালি শুনতে হতো । মা আর ছেলের ঝগড়া শুনে মহিউদ্দিন সাহেব মুখ টিপে হাসতেন আর গোটা ব্যাপারটাকে চুটিয়ে উপভোগ করতেন । আলেয়াও শেষ পর্যন্ত চা কিংবা কফি বানিয়ে এনে দিয়ে বলতেন - লাই আর আসকারা দিয়ে ছেলেটাকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছ ।  তোমাদের দেখে তো বুঝার উপায় নাই যে , তোমরা দুই বাপ আর ব্যাটা ! মনে হয় একদম সমবয়সী বন্ধু । কই একবারও তো দেখিনা ওকে লেখা পড়ার কথা বলছো ? ওর ভবিষ্যতটার কথা কি একবারও চিন্তা করেছো ?
          মহিউদ্দিনবাবু বরাবরের স্পোর্টস ম্যান , তার উপরে সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন, সব সময় জীবনটাকে একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে অভ্যস্ত । স্ত্রীর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলতেন - ভেবোনা গিন্নী । দেখো , ছোটটাই তোমার বড় ছেলের থেকে ভালো হবে । নাম করবে । তোমার মুখ উজ্জ্বল করবে ।
          আসলে মহিউদ্দিনবাবু ভালোই জানতেন যে  , বড় ছেলে সুজাউদ্দিন ছোটছেলে সমিউদ্দিনের থেকে সব কিছুতেই ভালো । মায়ের কথামতো সে কনভেন্ট ইস্কুলে ইংরেজীতে পড়াশুনা করেছে । অনর্গল ইংরেজীতে কথা বলতে পারে । দারুন স্মার্ট । ইচ্ছে আছে , এখানে পড়া শেষ করে ও ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় গিয়ে পড়াশুনা করবে এবং সেটেল্ড হবে । মোদ্দা কথা , একজন উঠতি বাংরেজ সাহেব হয়ে উঠেছে ! ছোটটার ওসব হবার কোনোও ইচ্ছে বা মনোবৃত্তিই নেই । ওকে মাকে ম্যাম আর বাবাকে কোনদিনই ড্যাডি বলে ডাকতে পারবে না ।
          দাদার সাথে তুলনা করলেই সামিউদ্দিন রেগে উঠতো । বলতো - ছাড়না ওসব আলোচনা ।কারোও সাথে তুলনা করাটা ওর ভীষন অপছন্দ । ওর বিশ্বাস একজনের সাথে অন্য আর একজনের তুলনা করাটা মোটেই উচিৎ নয় । এটা সবাই মন থেকে মেনে নিতে পারে না । বিশেষ করে এক ভাইয়ের সাথে অন্য ভাইয়ের তুলনা । ওতে একজনের মনে অন্য জন সম্পর্কে ঘৃণা , বিদ্বেষ এবং শত্রুতার সৃষ্টি হয় । বিভেদের বেড়া তৈরি হয় । কথাগুলো বলে সামিউদ্দীন ভাবতো মা বুঝি কষ্ট পাচ্ছে । তাই , পরক্ষনেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠতো - মা ? তোমার তো দুটো ছেলে । তুমি তো দারুন ভাগ্যবতী । দাদা বিলেতে গেলে আমাকে তো এখানে থাকতেই হবে -  তোমাদের দুটো বুড়ো বুড়িকে দেখভাল করার জন্য । তাছাড়া , এই দেশ , এই ঘর বাড়ি , বংশ পরম্পরার স্মৃতি , সবকিছুকে একজনকে তো বহন করতেই হবে ! সেটা না হয় করার জন্য আমিই এখানে থেকে যাবো , কি বলো ? দাদা , দাদার মতো চলুক । আমাকে আমার মত চলতে এবং থাকতে দাও ।

                               ( দুই )

          মহিউদ্দিন বরাবরই একটু অন্য ধরনের মানুষ । বহিঃকেন্দ্রিক । একসট্রোভার্ট টাইপের !
          সারাক্ষণ শুধু দেশ অর দশের জন্যই তার চিন্তা । নিজের ভাষা , নিজের গ্রামের ছেলেমেয়ে , লোকজন , তাদের শিক্ষা , সামাজিকতা , সভ্যতা এবং সংস্কৃতির উপরে তিনি সবথেকে বেশী শ্রধ্যাশিল । সব সময় মনে করেন - যে সমাজে তিনি বসবাস করছেন , দিন গুজরান করছেন , সেই সমাজের উপরে তার একটা আত্মিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং কর্তব্য রয়েছে । সেই কারনেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করবার পরে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও উনি যাননি । পশ্চিমী দেশগুলোর এই ভারতীয়দের ব্রেন ড্রেন করে নিয়ে যাওয়াটাকে ভদ্রলোক ভয়ংকর ঘৃণার চোখে দেখতেন । সেই কারনেই দেশে থেকে গিয়েছিলেন । 
          ভিয়েতনামের যুধ্যে সেই দেশের মানুষের দেশপ্রেম , ওর মনে একটা স্বদেশ প্রেমের চেতনা এবং দেশের জন্য কিছু একটা করার চিন্তা এবং ইচ্ছে জাগিয়ে তুলেছিলো । নিজেকে আর সরিয়ে রাখতে পারেনি । সেনাবাহিনীতে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন । বড় ছেলে সুজাউদ্দিনকেও সেইমতো বুঝিয়েছিলেন । কিন্তু , ওর ওই কথাকে কোনো রকম মূল্যই দেয়নি । দেশী হয়ে বিদেশীনাটাকেই সে বেশী পছন্দ করে ।
          ছোট ছেলে সমিউদ্দীন তাই মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে বেশি প্রিয় । বুঝেছিলেন , বড়টা নয় ছোটটাই সুখে দুঃখে বাবা মায়ের পাশে থাকবে । সেইমতো স্ত্রীকে নিজের ধারণাটা জোর দিয়ে জানিয়ে বলতেন - আমার কথাটা ভবিষ্যতে মিলিয়ে নিও । কিন্তু , স্ত্রী ওর বক্তব্যকে মোটেই পাত্তা দিতেন না । 
          সুজাউদ্দিন যেদিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ওকে আমেরিকায় পাড়ি দেবার কথা বলতে এসছিলো , সেদিন  ভদ্রলোক একটু মনক্ষুন্নই হয়েছিলেন । রাগ আর মনের দুঃখটা চেপে রাখতে নাপেরে একটু কটু কথাও ছেলেকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন । রাত্রে খাবার টেবিলে বসে বাড়ির উত্তাপটাকে পরিমাপ করে , সমিউদ্দিন একটা প্রলেপ দেবার উদ্দেশ্যে দাদাকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলো । কিন্তু , তাতে কোনও লাভ হয়নি । সুজাউদ্দিন বিরক্তির সুরে বলেছিলো - থাম তুই । তোকে বাবার হয়ে আর উমেদারি করতে হবে না । তুই কি বাবার মাউথ পিস হয়েছিস ? তুই চুপ কর , নাহলে আমি বাধ্য হবো খাওয়া ছেড়ে উঠে যেতে ।
          শুরু হয়ে গিয়েছিলো দুই ভাইয়ের মধ্যে ভয়ংকর তর্ক বিতর্ক ! মহিউদ্দিন আর আলেয়া কারোরই ব্যাপারটা ভালো লাগেনি । খাবারের টেবিলের পরিবেশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে , ওরা স্বামী এবং স্ত্রী দুজনেই একটা অস্বস্তি বোধ করা শুরু করেছিলেন । মহিউদ্দিন বড় ছেলেকে কিছু না বলে ছোটো ছেলের দিকে ঈষৎ অসন্তুষ্টির চোখে তাকাতেই , ও বলে উঠেছিলো - বাবা ? তুমি যেন রিটায়ার করার পরে কেমন যেন পাল্টে গিয়েছ । শারীরিক তো বটেই , মানসিক ভাবেও কেমন যেন দুর্বল হয়ে পরেছো । একটা টিপিকাল ফাদার হয়ে উঠেছে । আমরা যে বয়সের দিক থেকে বড় হয়েছি , আমাদের যে একটা নিজস্ব অভিমত আছে , সেটা মানতেই চাইছো না ! তুমি কতদিন আর আমাদের কোলে আগলিয়ে নিয়ে বসে থাকবে ? আজ না হোক আগামী কাল তো আমাদের বাইরে কাজে যেতেই হবে । সেদিন তুমি কি করবে ? যেতে দেবে না ? বাড়িতেই বেঁধে রাখবে !
          মা এবং বাবা সেদিন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো ।
          - দাদা বিলেতে গেলে তো তোমাদেরই ভালো হবে । সমিউদ্দিন ঠোঁটের ফাঁকে একটা ছোট্ট হাসির ঝলক তুলে বলেছিলো - মাঝে মাঝে তোমরা ওই দেশে গিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে । তুমি কত প্যান্ট এবং হয়ত আর মা গাউন এবং হয় - হিল জুতো পরে বিলেতের রাস্তায় হা ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াবে ! ভাগ্যে থাকলে , আমারও হয়তো দাদার দৌলতে বিদেশটা দ্যাখা হবে । দাদা চলে গেলে , আমিতো এখানে থাকছি । তোমাদের মৃত্যুর পরে দাফনের কবলা পরানো আর মাটি দেয়ার জন্য । ছেলে হিসেবে একজনের তো ওই কাজটা করতেই হবে ।
          ওনারা আর সুজাউদ্দিনকে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেননি ।

                              ( তিন )

          যতো দিন যাচ্ছিল মহিউদ্দিনবাবু কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছিলো ।
          একদিকে সুজাউদ্দিনের চিন্তা যেমন ওকে কুরে কুরে খাওয়া শুরু করেছিল , অন্য দিকে এন অর সির ভীতি ! জীবনটা ক্রমশ যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে !  প্রত্যেকটা মানুষকে প্রমাণ করতে হবে যে , সে ভারতীয় নাগরিক ! না হলে , এই দেশের নাগরিকত্ব থেকে নাম কেটে "ডি ভোটার" করে  "ডিটেনশন ক্যাম্পে" বন্দী করে রেখে দেবে !  ঝামেলা ! লাখ লাখ মানুষ যারা একশ দেড়শ বছর ধরে অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে বসবাস করছে , যে জায়গাগুলো আগে অবিভক্ত ভারতের অংশ ছিল এখন ভারত স্বাধীন হবার পরে সেই দেশটা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে , সেখানকার সব্বাই বর্তমানে ভারতের নাগরিক । অথচ , ওইসব মানুষজনকে বলা হচ্ছে - হয় তাদের নিজেদের না হয় তাদের বাপ , ঠাকুরদা প্রমুখর জন্মের কাগজ , ঘরবাড়ি এবং জমি জমার কাগজ , দলিলপত্র , ইত্যাদি দ্যাখাতে হবে । অন্যথায়  তাদের "ডি ভোটার" করে "ডিটেনশন ক্যাম্পে" নিয়ে গিয়ে বন্দী করবে ! এ কি এক উঠকো ঝামেলা !
          মহিউদ্দিন সাহেবের বাবা , ঠাকুরদা , বৃদ্ধ ঠাকুরদা , সব্বাই আসামের এই ধুবুরি জেলাতেই নিজের বাড়িতে জন্মেছিলেন ।  বাপ , ঠাকুরদা এবং বৃদ্ধ ঠাকুরদা তো দূরের কথা , তাদের কারোর নিজেদেরই জন্মের কাগজ পত্র নেই । কারণ , সেই সময় কেউই হাসপাতালে বা " নার্সিং হোমে " জন্মাত না । বাড়িতে ধাইয়ের হাতে জন্মাত। তাই , জন্মের কাগজ পত্র তারা কোথা থেকে পাবে ? এখন সেগুলো কিছু দেখাতে  পারছে না বলেই , প্রশাসনের লোকজন মানতে চাইছে না যে , তারা বংশ পরম্পরায় একশ বছরেরও বেশী ভারতের নাগরিক ।  প্রশাসনের লোকজনকে নিজের অবিভক্ত ভারতবর্ষের সেনা বাহিনীতে কাজ করার উপযুক্ত কাগজ পত্র দেখিয়ে বুঝবার যে চেষ্টা করবেন , সেটাও সম্ভব হচ্ছে না ! কারণ , গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদীর বার কয়েক বন্যায়  সেসব ধুয়ে মুছে কোথায় যে চলে গেছে , তার পাত্তাই পাওয়া যায়নি । আসলে , সেই সময় তেমন ভাবে কেউ আর ওগুলো জোগাড় করার চেষ্টা I করেনি । ভাবেইনি যে ওগুলো ভবিষ্যতে কোনোও কাজে লাগবে !
          যেদিন ভারত স্বাধীন হয়েছিল , দিল্লীর লালকেল্লায় ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী তেরঙ্গা জাতীয় পতাকাকে উত্তোলন করেছিলেন , কর্নেল মহিউদ্দিন সাহেব তখন সেইখানে হাজির থেকে সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু , সেটাও এখন ওর কাছে নেই । বাড়ির দেয়ালে ফটো ফ্রেম বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখেছিল । সেটাও বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে !  ওইসব ঘটনার গল্প এখন আসামের বর্তমান প্রশাসনের কাছে বলতো যেন সবটাই কাকস্য পরিবেদনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ! সরকারি তরফ থেকে মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে চিঠি এসেছে - অবিলম্বে ভারতবর্ষের মাটিতে তিনি যে জন্মেছেন তার সেই জন্মের কাগজ পত্র বা বাপ ঠাকুরদার বাড়ির এবং জমি জমার দলিল ও কাগজ পত্র না দ্যাখাতে পারলে , ভোটার লিস্টে ""ডি ভোটার"" করে দেওয়া হবে এবং ""ডিটেনশন ক্যাম্পে" নিয়ে আটকে রাখা হবে !
          কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! প্রায় এক শতাব্দী কালেরও অধিক সময় ধরে আসামের এই ধুবুরিতে বসবাস করছে এবং নিজে প্রায় পঞ্চান্ন বছরের মতো প্রথমে ব্রিটিশ ভারতীয় পরে স্বাধীন ভারতের মিলিটারিতে  চাকরি করে উনিশশ বাহাত্তর সালে রিটায়ার করেছেন । তাকেও আজ প্রমাণ করতে হবে যে , সে কি সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিক !
         ব্যাপারটা মহিউদ্দিন সাহেবকে কুরে কুরে খাওয়া শুরু করেছে । মাঝে মাঝে ভাবেন চিৎকার  করে কেঁদে আল্লাহকে বলবেন , এই অপমান এবং যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না ।  দয়া করে উপরে নিয়ে যাও । এই রকম ভারতবর্ষ তো আমরা দেখতে চাইনি ! জীবনে ভাবতেও পারিনি যে , জন্মসূত্রে এই ভারতের নাগরিক হয়েও আমাদের আবার নতুন করে প্রমাণ দিতে যে আমরা অনুপ্রবেশকারী নই । সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিক !
          মাঝে মাঝে বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে  একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতেন - কিছুটা দূরে বিরাট এলাকা জুড়ে চলছে - এন আর সীর শিকার হওয়া "ডি ভোটারদের" জন্য "ডিটেনশন ক্যাম্প" তৈরির কাজ । যারা ওই ক্যাম্প তৈরির কাজ করছে , সবথেকে দুঃখের বিষয় তারা নিজেরাই জানেনা যে , ওই ক্যাম্পেই হয়তো তাদের নিজেদের মা , বাবা কিংবা ভাই বোনকে বন্দী থাকতে হবে । এ যেন হিটলারের সেই ইহুদিদের " কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প" ! বন্দী শিবির !
          এইভাবে কি বাঁচা যায় ! ক দিন এইভাবে মনের সাথে লড়াই করে , সে দিন কাটবে ? একদিন তো ওইসব কাগজ পত্র দ্যাখাতে হবে ! না দ্যাখাতে পারলে ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবেই । সেদিন কি হবে ?  কথাগুলো ভাবলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে ।  একটা চিন চিন ব্যথা অনুভূত হতে থাকে ।
          ময়দানে দাঁড়িয়ে লড়াই করার লোক হয়েও রিটায়ার্ড সেনা আধিকারিক মহিউদ্দিন মোল্লা উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শুধু আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকেন ।

                                ( চার )

          সেদিন মহিউদ্দিন সাহেব ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন ।
          হটাৎ আলেয়া হাতে চায়ের কাপটা নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে - কি গো ? তুমি কি ঠিক করেছো যে , বাড়ির টেলিফোনটা আর ঠিক করবে না ? আজ প্রায় আট না হয়ে গ্যালো লাইনটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে । আমি সুজার কোনোও খবরই পাচ্ছি না । আগে তবু তুমি বাইরে যেতে , বুথ থেকে ফোন করে খবর নিয়ে এসে আমাকে জানাতে । এখন তো সেটাও বন্ধ করে দিয়েছো ।  বলতে পারো, আমি কি নিয়ে থাকবো ?
          আসলে , বড় ছেলে ভিনদেশী বিদেশিনীকে বিয়ে করার খবর শোনার পর থেকেই মহিউদ্দিন সাহেব নিজের ভারতীয় জাত্যাভিমানে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন । কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না । ব্যাপারটা শুনলে আলেয়া ভীষন কষ্ট পাবে । তাই , বাড়ি ফিরে ভদ্রলোক নিজেই ইচ্ছে করেই টেলিফোনের আই এস ডির লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন । ভেবেছিলেন , ব্যাপারটা সময় করে ছোটছেলে সমিউদ্দিনকে বলে রাখবেন । কিন্তু , এইসব এন আর সি , ডি ভোটার এবং ডি ক্যাম্পের  চিন্তা আর ঝামেলায় সবটাই উনি ভুলে গিয়েছেন । বলা আর হয়ে উঠেনি ।
          ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন টেলিফোনের ব্যাপারটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো , তখনই  কোথা থেকে সমিউদ্দন ঝড়ের মতো উড়ে এসে হাজির হয়েই দুম করে বলা শুরু করলো - বাবা ? তুমি কেনো বাড়ির টেলিফোনের লাইনটা ঠিক করাচ্ছো না ? কতদিন ওটা অকেজো হয়ে পড়ে আছে ? মা দাদার সাথে কথা বলতে পারছে না । ঘরেবসে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে । হয় ওটা ঠিক করাও , না হয় মাঝে মাঝে মাকে নিয়ে বাইরে গিয়ে রাজুর টেলিফোন বুথ থেকে দাদার সাথে মাকে কথা বলাও , এবং নিজেও বলো ।
          মহিউদ্দিন ছেলের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন । কেন যেন ওর মনে হচ্ছিলো - এ তো সেই সমিউদ্দিণ নয় !  যাকে সে চেনে এবং জন্য !  যাকে নিয়ে ওর অনেক উঁচু ধারণা ! ...
          সমিউদ্দিন আরোও কিছু বলতে চাইছিলো , কিন্তু আলেয়াই ওকে থামিয়ে দেয় ।
          হঠাৎ যেন মহিউদ্দিন সাহেবের ধর্য্যর  বাঁধ ভেঙে পড়ে ! চিৎকার করে বলে উঠলেন - ইডিয়েট একটা ? তুমি পারো না টেলিফোন অফিসে গিয়ে লাইনটা ঠিক করাতে ? পারো না সেটেলমেন্ট অফিসে গিয়ে  আমাদের এই শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি , জমি - জমার সব পুরাতন রেকর্ড , কাগজ - পত্রগুলো জোগাড় করে আনতে ? এন আর সির এনকোয়ারিতে তো ওগুলো না দ্যাখাতে পারলে আমাকে আর তোর মাকে "ডি ভোটার" করে দেবে ! "ডিটেনশন ক্যাম্পে" নিয়ে গিয়ে আপাতত ঢোকাবে ! পরে অনুপ্রবেশকারী বলে এই দেশ থেকে বের করে দেবে ! আমি বুড়ো মানুষ , এই শরীর নিয়ে কোথায় , কর কাছে দৌড়াবো ? আমি যে সেনা অফিসার ছিলাম , সেটা কেউ শুনতেই চাইছে না ।  চাকরি বাকরির তো চিন্তা নেই । দিব্যি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তারাচ্ছ । এগুলো তো করতেই পারো ?
          আলেয়া আর বসে থাকতে পারেনি । উঠে ধমক দিয়ে ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে স্বামীকে বলেছিলো - দেখলে তো তোমার আস্কারাতেই সমিউদ্দীনের  বারোটা বেজেছে ! এখন আর ওকে দোষ দিয়ে লাভ কি ? ওতো জানেই না - কাকে কখন কি কথা বলতে হয় !

                               ( পাঁচ )    

          পরের দিন সকাল থেকেই সমিউদ্দিনকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি ।
          থানা পুলিশ থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে খোঁজ খবর করে ওর কোনোও খোঁজ পাওয়া যায়নি । মহিউদ্দিন সাহেবের বাড়ি এখন যেন একটা মৃত পাষাণ পুরি হয়ে উঠেছে !
          বৃদ্ধ মহিউদ্দিন সাহেবের এখন প্রতিদিন সন্ধ্যেয় টিভিতে খবর শোনাটা একটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে । চুপ চাপ খবরটা শুনেই উঠে নিজের ঘরে চলে যান । বছর তিনেকের মতো ওদের দুই ছেলের কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই । এন আর সিতে জমা দেওয়া বা দ্যাখনোর মতো কোনোও কাগজ পত্র এখনও তিনি জোগাড় করে উঠতে পারেননি । যে কোনোদিন "ডি ভোটার" ডিক্লেয়ার হয়ে যাবেন এবং পুলিশের লোক এসে বাড়ি থেকে ধরে "ডিটেনশন ক্যাম্পে" নিয়ে যাবে ! আলেয়ার সেই সময় কি হবে ! ও তো জীবনে কোনদিন একা একা থাকেনি ! কে ওকে দেখবে ! ....
          সেদিনও সন্ধ্যে বেলায় মহিউদ্দিন সাহেব ঘরে বসে টিভির সংবাদ শুনছিলেন । হঠাৎ , খবরের মাঝে একটা "স্ক্রলিং নিউজের ক্যাপশন" ভেসে উঠলো ।  কাশ্মীরে পাক হানায়  ভারতীয় সেনা হত ।  ঘোষক বলে চলেছেন -  "কাশ্মীরের কুপোওয়রের রাস্তায় ভারতীয় সেনা বাহিনীর কনভয়ের উপরে পাক সন্ত্রাসবাদীদের একটা সংগঠিত হামলাকে , বীর সেনা জওয়ান সমিউদ্দিন মোল্লা একাই প্রাণ দিয়ে রুখে দিয়েছেন সমিউদ্দিন আসামের ধুবুরির ছেলে । ওনার বাবা মহিউদ্দিন মোল্লাও একসময় ভারতীয় সেনার অফিসার কর্নেল ছিলেন । বছর তিনেক হলো সমিউদ্দিন সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ।  সেনা বাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে , সমিউদ্দীন মোল্লার ইউনিফর্মের বুক পকেট থেকে একটা সেনা বাহিনীর সিল মারা কাগজ পাওয়া গিয়েছে , তাতে প্রাক্তন সেনা অধকারিক মহিউদ্দিন মোল্লার চাকরি জীবনে ঢোকার প্রথম "পুলিশ ভেরিফিকেশনের সার্টিফাইড কপিটা" রয়েছে । ওটাতে লেখা রয়েছে - মহিউদ্দিন মোল্লা জন্মসূত্রে অবিভক্ত ভারতবর্ষের নাগরিক । আসাম প্রদেশের ধুবুরিতে উনিশ শ এগারো সালের পাঁচই অক্টোবর জন্মেছেন । নিহত সামসুদ্দিন মোল্লার মৃতদেহটা নিয়ে ইস্টার্ন কম্যান্ডের গুয়াহাটির কোনও বড় অফিসার ধুবুরীতে গিয়ে সামসুদ্দিন মোল্লার বাবা মহিউদ্দিন সাহেবের সাথে দ্যখা করবেন এবং ওনার হাতে  টেনে নিহত বীর সন্তান সমিউদ্দীণ মোল্লার দেহ এবং উদ্ধারকৃত কাগজটিও হস্তান্তর করবেন ।
          বীর সামসুদ্দিন মোল্লা ! আসামের ধুবুরীর বাসিন্দা ! মাই ইয়াঙ্গেস্ট সন ! আমি ওকে বকাবকি করে অপদার্থ বলে বাড়ি থেকে একরকম বের করে দিয়েছিলাম । তার বডি নিয়েই গুয়াহাটির হায়ার মিলিটারি অফিসাররা এখানে আসছেন । বুঝলে আলেয়া , তোমার সামসুদ্দিনের জন্যই হয়তো আমাকে আর "ডিটেনশন ক্যাম্পে" যেতে হবে না ।           
          মহিউদ্দিন সাহেব আর ভাবতে পারছিলেন না । পাগলের মত চিৎকার করে বললেন - আলেয়া ? অ আলেয়া , কোথায় তুমি ? এদিকে একবার এসো । আলমারি থেকে আমার পোশাকগুলো সব বের করে দাও । আমাকে এক্ষুনি পরতে হবে । এটা আজ আমার কাছে দারুন খবর । তোমার ছোট ছেলে নিজের জান কুরবানি করে আমাকে আর তোমাকে এই বাপ - ঠাকুরদার বাড়িঘর ছাড়া হতে দেয়নি । আমাকে বেআইনী অনুপ্রবেশকারী বলে অপমানিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে গেলো !
          আলেয়া ছুটে এসে দেখে - দেয়ালে টাঙ্গানো ছোটছেলে সামসুদ্দিনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ প্রাক্তন সেনা আধিকারিক কর্নেল মহিউদ্দিন মোল্লা স্যালুট করে ভারাক্রান্ত গলায় বলে চলেছেন - ব্রাভো মাই বয় ! সামসুদ্দিন , আজ আমি তোমার জন্য প্রাউড ফাইল করছি । টেন্ডার মাই হার্টিয়েস্ট রেসপেক্ট নট অনলি ফ্রম অ্যান এক্সমিলিটারি অফিসার , বাট আলসো ফ্রম অ্যান ওল্ড এজেড ফাদার ! .... সামু , আজ তুমি যে অমরত্ব লাভ করে বেহেশ্তের পথে এগিয়ে যাচ্ছো । যাও । আমি আর তোমাকে পিছন থেকে ডেকে সেই যাত্রায় বাধা দেবো না । .... তবে, সামু জেনে রেখো , ইউয়োর ফাদার ইজ অলসো গোয়িং টু মিট উইথ ইউ ভেরি শুন । ... বেহেশতে আমার জন্য অপেক্ষা করো কিন্তু । পারলে আমার জন্য একটা সিট বুক করে রেখো । .... ডোন্ট আফ্রড , সামসুদ্দিন কাশ্মীর থেকে তোমার মৃতদেহটা  আমাদের এখানে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত - আই উইল ওয়েট ফর ইউ । ..... তোমাকে তো এই ব্রহ্মপুত্রের পারেই তোমার পিতামহ , প্রপিতামহ এবং বৃদ্ধ পিতামহের সাথে রেখে যেতে হবে । .....
          কথাগুলো কানে যেতেই আলেয়া শঙ্কিত হয়ে  উঠলেন । এতো সাংঘাতিক কথা ! উনি এসব কি বলছেন .....



=============================

               প্রণব কুমার চক্রবর্তী
            বানীদিপ ভবন ( দ্বিতীয় তল )
            এইচ এন রোড , গোলবাগান ,
            কুচবিহার
            পিন - ৭০৬১০১



      
   














          


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩