মৌন ভালোবাসা
শীত বেশ ভালোই পড়ে গেছে এদিকে।বছর শেষে সবারই চলছে পরীক্ষার মরসুম।বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না।কিন্তু তবু পরীক্ষা তো, উঠতেই হয়। আর এছাড়াও আজ সকাল থেকেই রামুয়া খুব সমস্যায় পড়েছে।যত সময় এগিয়ে আসছে ততই ওর টেনশন বেড়ে চলেছে। আসলে আজ নয়, সমস্যাটার শুরু গতকাল স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পর থেকে।যখন স্কুলের হেডস্যার ওকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন যে আজ স্কুলে কিসের যেন একটা ফর্ম ভরা না কি ফিলাপ হবে, রামুয়াও সেটা করতে পারবে,কিন্তু তা করার জন্য রামুয়াকে ওর বাবার নাম বলতে হবে,না হলে সেই ফর্ম ভরা যাবে না।আর সাথে সাথে হেডস্যার এটাও বললেন যে এতে নাকি বছর বছর বেশ খানিক টাকা পাওয়া যাবে, যাতে রামুয়া ভালোমতো পড়াশুনা চালাতে পারবে।
আসলে রামুয়ার বাবা কথা বলতে পারে না, তাই সব লোক ওর বাবাকে বোবা বলেই ডাকে।রামুয়ার খুব খারাপ লাগে, কিন্তু সব লোককে তো আর ডেকে ডেকে না বলা যায় না।আর রামুয়া পড়ে মাত্র ক্লাস সিক্সে,ওর পক্ষে ওদের দেশে দিয়ে খোঁজ নিয়ে বাবার আসল নাম বের করাও মুশকিল। এদিকে রামুয়া বাবাকে এটা বোঝাতে পারছে না। কিন্তু হেডস্যার বলেছেন যে বাবার আসল নাম না বলতে পারলে এই ফর্ম ভরা যাবে না আর ফর্ম ভরা না গেলে টাকাও পাওয়া যাবে না। রামুয়া জানে যে ওর স্কুলের সব স্যাররা ওকে আর ওর বাবাকে খুব ভালোবাসে। তাই ওর এই স্কুলে ভর্তির সময় বাবার ঐ নামেই ভর্তি হতে পেরেছে। কিন্তু এখন এটা নাকি একটা সরকারী ব্যাপার, তাই এবার বাবার আসল নাম চাইই-চাই।
মা-র কথা মনে পড়ে না রামুয়ার। ওর বাবাই প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্না বসান। রান্না হয়ে গেলে তারপর নিজে স্নান করে আগের দিনের রাতের দুটো রুটি খেয়ে কাজে চলে যান। রামুয়ার জন্য তরকারী ভাত এইসব খাবার ঢাকা দেওয়া থাকে। রামুয়া দশটা নাগাদ পড়ে এসে স্নান করে ঢাকা দেওয়া খাবার থেকে খেয়ে স্কুলে চলে যায়। রামুয়া অনেকদিন ওর বাবাকে বলেছে খেয়ে কাজে যেতে। কিন্তু বাবা কিছুতেই ওর কথা শুনবে না। তবু আগে যখন রামুয়া ছোট ছিলো-প্রাইমারী স্কুলে পড়তো, তখন দুজনে মিলে রান্না হয়ে গেলে সকালেই একবার খেয়ে নিতো। কিন্তু এখন তো রামুয়া বড় হয়ে গেছে,বড় স্কুলে পড়ে, সকালে পড়তে যেতে হয়। বাবা তাই রামুয়ার খাওয়া না হলে খাবে না কিছুতেই। একবারে দুপুরে এসে বাবা ভাত খায়, বাকিটা রামুয়া স্কুল থেকে এসে খায় আর রাতে ওরা খায় রুটি।
সন্ধেবেলা রামুয়া যখন পড়তে বসে, বাবা বসে থাকে একটু দূরে। একটা লোহার কড়াইতে কাঠকয়লার আগুন জ্বালিয়ে পায়ের সামনে রাখে ওর,নিজে হাত সেঁকে তাতে। একটু রাত হলে বাবা রুটি বানায়।বারে বারে রাতে লেপ দিয়ে ওকে ঢেকে দেয় বাবা। রামুয়া কখোনো টের পায়, কখোনো পায় না।ছুটির দিনে বাবা সকাল সকাল ওর স্কুলের জামা কাপড় কেঁচে দেন। তাই পরদিন যখন রামুয়া পরিষ্কার ঝকঝকে স্কুলড্রেস পড়ে স্কুলে যায়, বন্ধুরা অবাক হয়ে থাকে। ওদের অনেকেরই জামা কাপড় এত পরিষ্কার থাকে না। রামুয়া জানে না ওর বাবা কি কাজ করে। শুধু জানে যে বাবা বাজারে কিছু একটা কাজ করে। সেখানে সকালে যায়-দুপুরে আসে,আবার বিকেলে যায়-সন্ধ্যারাতে চলে আসে।
জানে হবে না, তবু কাল রাতে বাবার কাছ থেকে বারদুয়েক মরিয়া হয়ে নাম জানতে চেয়েছে রামুয়া। কিন্তু বোঝাতেই পারেনি বাবাকে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও। তারপর আজ সকালে উঠে পড়তে যেতে হয়েছে ওকে আর বাবা রান্না করে চলে গেছে কাজে।পড়ার ওখানেও রামুয়া শুধু ভেবেই গেছে কিভাবে জানা যায় বাবার আসল নাম। পড়ে এসে স্নান করে খেতে খেতে রামুয়া ভাবলো যেহেতু ও জানে যে বাবা বাজারে কাজ করে আর বাজারের বেশীর ভাগ লোকেরাই ওর বাবাকে চেনে বা জানে তাই বাজারে চলে গেলেই যেখানে বাবা কাজ করে সেখান থেকে বাবার আসল নাম জানা যাবে। সেখান থেকে ও স্কুলে চলে যাবে। এই ভেবে সাইকেলে বাজারের পথ ধরলো রামুয়া। সাইকেলটা বাবাই গতবছর ওকে কিনে দিয়েছে অনেকটা রাস্তা স্কুলে হেঁটে যেতে হয় বলে।
বাজারে ঢুকতেই একটা ব্রীজ পড়ে। ভিড় বাজার তাই লোকে সাইকেল বা মোটরসাইকেল সব এই ব্রীজের ওপরেই রেখে বাজারে ঢোকে। এখান থেকে বাজারের মুখটা দেখা যায়, সেখানে রিক্সাগুলি সব পরপর দাঁড়িয়ে থাকে। লোকে নামে ওঠে রিক্সা থেকে।ব্রীজে সাইকেলটা রেখে তালা দিতে দিতে ঐদিকেই তাকিয়ে ছিলো রামুয়া। ভাবছিলো কোথায় গিয়ে ও জিজ্ঞেস করবে বাবার নাম। এরমধ্যেই ওর মনে হল বাবাকে যেন একবার দেখলো ও। বাবার মাথায় আর হাতে দুটো ব্যাগ,একজনের রিক্সায় তুলে দিলো, সে বাবাকে টাকা দিলো হাতে।রিক্সা ছেড়ে দিলো, বাবা চলে গেলো বাজারের ভেতরে। খুব অবাক হল ও। এবারে ছোট্ট রামুয়া ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো বাজারের দিকে। দু পা এগিয়ে ও আবার দাঁড়িয়ে পড়লো, আড়াল নিলো একটা মোটর সাইকেলের আড়ালে। মনটা খচখচ করছে।আগেরবার বাবাকে ঠিক দেখেছে তো নাকি কোন অন্য লোক? ভাবতে ভাবতেই বাবাকে আবার দেখলো ও। আর এবারে কাছ থেকে দেখে নিশ্চিত হল রামুয়া যে ওটা বাবাই।বাজারের ব্যাগ তুলে দিচ্ছে রিক্সায়, পয়সা নিচ্ছে।তার মানে বাবা বাজারে এত কষ্টের কাজ করে, এত কষ্ট করে নিজে রামুয়াকে ভালো রাখার চেষ্টা করে? সব কিছু কিনে দেয়? ভাবতেই রামুয়ার চোখে জল চলে এলো।তাহলে এখানে তো বাবা ওকে দেখলে লজ্জা বা কষ্ট পেতে পারে।মোটরসাইকেলটার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই রামুয়া ঠিক করলো বাজারে ও আর যাবে না বাবার আসল নাম জানতে।স্কুলে কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবে, তাতে ফর্ম ভরা গেলে যাবে বা যাবে না, টাকাও পাওয়া গেলে যাবে বা যাবে না। কিন্তু বাজারে বাবার সামনে গিয়ে বাবাকে লজ্জা বা কষ্ট দিতে পারবে না ও। সাইকেল ঘুরিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিলো রামুয়া।
============
সত্যম ভট্টাচার্য, আস্থা এপার্টমেন্ট ৩য় তল, রায়কতপাড়া, জলপাইগুড়ি। মুঠোফোন-৯৪৭৫৮৯৩৪৩৩