অনুসন্ধানলব্ধ গল্প ও আমাদের কথা:
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে বিশেষ করে আফ্রিকা ভারত পাকিস্তান ও অন্যান্য শতদরিদ্র্য দেশগুলো থেকে গৃহীত অনুসন্ধান ভিত্তিক পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে তাঁদের গবেষণায়। দারিদ্র্যের পেছনে নানা কারণ আছে বলে তাতে দেখা যায়। দারিদ্র্যের ফাঁদ একটা বা দুটো কারণে দেখা যায় না। এর পেছনে বহু বিচিত্র কারণ দেখা যায়। যেমন কোথাও আয়ের অভাবে পুষ্টির অভাবে গরিব মানুষের কর্মক্ষমতা থাকে না ফলে সে নিজেকে আগামীদিনে আয় বাড়াবার উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। ফলে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে আটকে থাকে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদনের প্রযুক্তি বদলের জন্য বা নতুন উপকরণের ব্যবহারের মুখে বেকারির উদ্ভব ঘটে। তার শিকার হওয়ায় আয় বাড়াতে সক্ষম হয় না। এক্ষেত্রে খাবার জোটে না বা পুষ্টি জোটে না তাই দারিদ্র্য তা নয়। কর্মচ্যুতি বেকারি এক্ষেত্রে সমস্যা। সে দিক থেকে পুষ্টি অভাব জনিত দারিদ্র্য ফাঁদ দেখা যায় না। সে কাজ হারিয়ে নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে, হতাশা তাকে গ্রাস করে। তাই দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র দেখা দেয়। আবার যেখানে দেখা যায় শিশুরা পুষ্টি পায় তারা উপার্জনক্ষম হিসেবে বেড়ে ওঠে সেখানে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে তাদের আয় বাড়াতে পারে। তারা দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আবার কোথাও শিক্ষার অভাব থাকায় নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে গরিব মানুষ নিজেকে গড়ে তুলতে পারে না তাই দারিদ্র্যের ফাঁদে তাকে পড়ে থাকতে হয়। ভোগের ধরন কোথাও কোথাও একটা বড় সমস্যা। আবার কোথাও বড় পরিবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমরা দেখব যে সমস্যাগুলোকে অনুসন্ধান সাপেক্ষে ব্যষ্টি স্তরে তুলে আনলেও সমষ্টিগত স্তরে একটা ব্যবস্থায় সেগুলো আশ্রয় পায় যাকে অবহেলা করে সমাধানের স্থায়ী পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর অভিজিৎবাবুদের ব্যাখ্যায় এই সামগ্রিক দিকটা অবহেলিত হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়। আর এটা আদর্শগত দিক যেটাকে অভিজিৎবাবুরা শুধু উপেক্ষা করেন নি কটাক্ষ করেছেন। এতে এই ব্যবস্থার কর্তারা সন্তুষ্ট হন। কারণ আপাতভাবে অনেক সত্যের আড়ালে একটা ব্যবস্থার আসল চরিত্রটা চাপা পড়ে যায়। ব্যষ্টি স্তরে কিছু মানুষের কিছু উপকার করার মধ্যে ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এখানে আমাদের আপত্তি। উনারা আদর্শের বিষয়টা কিভাবে কটাক্ষ করেছেন সেটা নিয়ে কিছু কথা আমরা বলতে পারি। এখানে স্বীকার করে নিতে হয় যে অমর্ত্যবাবু এ বিষয়টা মাথায় রেখেছিলেন। তাই মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকারটা, তাঁর আলোচনায় স্বাধিকার সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টা এত গুরুত্ব পেয়েছিল। লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে তিনি এত মাথা ঘামিয়েছিলেন। শুধু দারিদ্র্য ও তার সমাধানের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখেন নি । মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার প্রশ্নটা বড় করে দেখা দিয়েছিল। অধিকারের দাবিটা দারিদ্র্য আলোচনা প্রসঙ্গে এসেছিল। মানবতাবাদের প্রশ্নটা উঠে এসেছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির বিভিন্ন দিকগুলো উদ্ঘাটিত হয়েছিল। ওগুলো আনলে দারিদ্র্য উপশমের বিষয়টা তত্ত্বের চশমায় দেখা হবে বলে অভিজিৎবাবুরা এড়িয়ে যান। তাঁরা মানুষের ব্যক্তিজীবনের নানা অভিজ্ঞতার আড়ালে একটা ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত সমস্যার এই মৌলিক দিকটাকে এড়িয়ে যান। আমরা এই বিষয়টায় আবার আসব অভিজিৎ বাবুদের অনুসন্ধান থেকে পাওয়া দুচারটে গল্প শোনার পর। অভিজিৎ বাবুদের বই কি বার্তা বহন করে? তাঁদের ভাষায় :
''The message of the book, however, goes well beyond poverty traps. As we will see , ideology, ignorance and inertia ----- the three Is----- of the part of the expert , the aid worker, or the local policy maker , often explain why the policies fail and why aid does not have the effect it should. It is possible to make world a better place --- probably not tomorrow , but in some future that is within our reach ------ but we cannot get there with lazy thinking."( Page23)
অর্থাৎ শুরুতেই এই গবেষকরা আক্রমণ করেন আদর্শ ভিত্তিক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে। তাঁরা শিকার করতে চান না যে অনেক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উঠে আসে প্রজন্মকাল ধরে সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য ধরে। সেখান থেকে তৈরি হওয়া তত্ত্ব বর্তমানকে ব্যাখ্যা করতে কাজে লাগে। একে তাঁদের আই ( I ) তিন বলে কটাক্ষ করাটা ঔদ্ধত্য ছাড়া কিছুই নয় যদিও এটা ঠিক যে বেশ কিছু এমন তত্ত্বও উঠে আসে যা বিভ্রান্তের সৃষ্টি করে। আদর্শ অজ্ঞতা আর জড়তাকে একই পঙক্তিভূক্ত করতে দ্বিধা করেন নি তাঁরা। তবে এই বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্বগুলোকে এই ব্যবস্থার কর্ণধাররাই মদত করে। এর বাইরে মানুষের অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে অনেক তত্ত্ব উঠে আসে যেগুলো এই ব্যবস্থা অনুমোদন করে না। বরং তাদের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, তাকে দেশবিরোধী তকমা দিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থিত করা হয়। এ বিষয়টা নিয়ে আমরা পরে আবার আসব। এখন অভিজিৎবাবুদের অনুসন্ধানলব্ধ দুচারটে গল্প শুনে নিতে পারি।
অভিজিৎবাবুরা দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা ধারণা দুটিকে পশ্চিমি জগতে অভিন্ন বলে দেখবার প্রবণতার কথা বলেন। বিষয়টা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না কারণ তাদের অনুসন্ধানে সাক্ষাৎকারী অনেকের সঙ্গে কথা বলে এটা মনে হয়েছে। তবে সবসময় দেশে খাদ্যের অভাবে ভূখা মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে বাঁধা পড়ে তা নয়। ২০০৯ সালে UNO Food and Agriculture Organisation ( FAO) ভূখা জনিত দারিদ্র্যের কথা বলে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব মত তখন পৃথিবীতে বুভুক্ষু গরিব মানুষের সংখ্যা ছিল ১০ কোটির ওপরে। সম্মিলিত জাতি সংঘের প্রথম শত বর্ষের উন্নয়ন লক্ষ্যে ( Millennium Development Goal) দারিদ্র্য ও তার সাথে ভূখা নিবৃত্তির কথা বলা হয়। বুভুক্ষ ও দারিদ্র্য যেন হাত ধরাধরি করে চলে। সেইজন্য দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসূচিকে সরকার মূলত গরিবের মধ্যে বিনা খরচায় বা কম দামে খাদ্য বিতরণের কর্মসূচি বলে গ্রহণ করে। গরিব মানুষ নিজের আয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি করতে পারে না বলে দারিদ্র্যের ফাঁদের উদ্ভব হয় বলে মনে করা হয়। কিন্তু গরিব মানুষের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে সব সময় দেশে খাদ্যাভাব থেকে সেটা ঘটে না। এই প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন অনেকদিন আগেই দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ গ্রন্থে বলে গিয়েছিলেন যে খাদ্যের উৎপাদনের অভাবে সব সময় দুর্ভিক্ষ দেখা যায় না। আয় বৈষম্য ও তার ফলে খাদ্য বন্টনে অসমতার দরুন দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। একই কথা খাদ্যের যোগান ও দারিদ্র্যের সম্পর্ক সম্পর্কে বলা যায়। অভিজিৎবাবুদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে আজ শুধু আয় স্বল্পতা নয় আয় কিভাবে ব্যয় করা হয়, সেই আয়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যয় হয় কিনা পরিবারের গঠন কেমন উন্নত প্রযুক্তির সুযোগ গরিব মানুষ গ্রহণ করতে পারে কি না তার ওপর নির্ভর করে গরিব মানুষ দারিদ্র্যের কোন স্তরে আছে সে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা। এই প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারীদের থেকে শোনা দুএকটা গল্প শুনে নিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জানা একটা আধটা গল্প তুলে ধরব। দেখব অভিজ্ঞতা কাছাকাছি। অভিজিৎবাবুদের বিরোধিতা করার কারণ নেই। কিন্তু আমরা দেখব কি ব্যবস্থার মধ্যে এরকম বহু বিচিত্র ঘটনা ঘটে যা নিয়ে আমরা উচ্চবিত্তরা হাসি তামাশা করি। গরিব মানুষদের অদ্ভুত কার্টুন চরিত্র বলে মনে করি। এই ব্যবস্থার মধ্যেকার সমস্যা দূর না করে ব্যক্তি স্তরে সকলকে দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্ত করা যায় কি না। না কি এই ব্যবস্থা টিকে থাকলে দারিদ্র্য থাকবেই যদিও দারিদ্র্যের মাত্রা পরিবর্তিত হয়। ইতিহাস বলে প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিরকালই দারিদ্র্যের মাত্রা কমেছে । যখন প্রগতি বিপথগামী হয়েছে তখন ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে নতুন ব্যবস্থ্যা গড়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গটা আমরা আলোচনায় বিশদভাবে আনব। সেখানেই আমরা আমাদের প্রশ্ন রাখব। অভিজিৎ বাবুরা কি বলেন জানতে চাইব।
ধরে নেওয়া হয় যে গরিব মানুষরা নিজেদের আয়ে নিজেদের ভরণ পোষণ করতে পারে না। প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না বলে আগামীদিন নিজের আয় বাড়াতে পারে না । নিজেদের অতিরিক্ত যায় অর্জনে উপযুক্ত করে তুলতে পারে না। তাই তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বা দারিদ্র্যের ফাঁদে বাঁধা পড়ে। সেখান থেকে বেরোতে পারে না। ইন্দোনেশিয়ার বানদং নামে ছোট্ট একটি গ্রামের এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তার নাম পাক সহলিন। তাদের যা জমি ছিল তাতে বড় পরিবারের সবার বাড়ি তৈরিতে কাজে লেগে যায়। সে একজন কৃষি শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করত। গরিব হলেও যা রোজগার করত তা দিয়ে চলত। কিন্তু সার ও বীজের দাম বাড়ায় জমির মালিক খরচ কমিয়ে নিজের লাভজনকতা বজায় রাখতে তাকে ছাঁটাই করে দেয়। সেখান থেকে চলে গিয়ে অন্যত্র কাজে তার যা আয় হত তা তার পরিবার চালাবার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তার খাদ্যের অভাব হয় যা তাকে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে নিক্ষেপ করে। সে যখন মোটামুটি ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য পেত তখন পুষ্টির তেমন অভাব হত না। সে মাছ ধরে বিকল্প কাজ করেও কিছু রোজগার করত যা তাকে অবস্থা উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কৃষিতে কাজ চলে যাওয়ায় উত্তরোত্তর তার অবস্থার অবনতি হয়। সে নিজের কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র তাকে গ্রাস করে। সে জানায় খাদ্যাভাব তার এই দারিদ্র্যের জন্য দায়ী যা ঘটে তার চাকরি চলে যাওয়ায়, নিজের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায়। তার থেকেই জানা যায় খুব গরিব মানুষরা ন্যূনতম পুষ্টিকর খাদ্য পায় না বলে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে পাক খায়। অভিজিৎ বাবুদের S আকৃতির দারিদ্র্য রেখার e বিন্দুর বা দিকে স্থান হয় তার। আর যে যথেষ্ট যায় অর্জন করতে পারে, e বিন্দুর ডানদিকে অবস্থান করে সে কালক্রমে আরো আয় বাড়াতে সক্ষম হয়। প্রথম দিকে রেখাটির e বিন্দুর ডানদিক ধরে দ্রুত হারে আয় বাড়ে তারপর বৃদ্ধির হার কমে ও শেষ পর্যন্ত আজ ও কালের আয়ের মধ্যে সমতা বজায় থেকে একটা স্থিতিতে পৌঁছয়। এটাই হলো সহলিনের দারিদ্র ফাঁদের গল্প যা তার জীবনের ইতিবৃত্ত। চাকরি চলে যাওয়ায় আয় কমে যাওয়ায় আর পুষ্টির অভাব হওয়ায় তাকে দারিদ্রের ফাঁদে পড়তে হয় যেখান থেকে সে আর বেরোতে পারে না।
অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাচস ও অভিনেত্রী এঞ্জেলিনা একটি ভিডিওতে কেনিয়ার শতবর্ষ পুরোনো এক গ্রামের কৃষকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দারিদ্র্যের ফাঁদ কোন অবস্থায় কিভাবে উদ্ভব ঘটে আর কোন অবস্থায় এর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব সেটা আলোচনা করেন। সেটা তুলে ধরেন অভিজিৎবাবুরা তাঁদের বইতে। এও জীবনের এক চলমান গল্প। এই গরিব কৃষককে দারিদ্র্য ফাঁদ থেকে তুলে আনতে কিছু অনুদান দেওয়া হলো। সে তা দিয়ে সার কিনে চাষ করলো। ফলে তার কুঁড়িগুন ফসল বাড়ল। সে পরের বছর এর থেকে কিছু বীজ হিসেবে ব্যবহার করল তাতে আবার তার ফসল বাড়লো যা তাকে কিছুদিনের মধ্যে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বার করে আনে। সে e বিন্দুর ডানদিকে বেরিয়ে আসে। কালক্রমে তার আয় বাড়ার গতি বজায় থাকে। এ ব্যাপারে সন্দেহভাজনরা বলেন তাই যদি হয় সে যদি জানে অল্প সার ব্যবহার করে আয় বাড়ানো যায় তবে আয়ের থেকে অল্প অল্প বাঁচিয়ে সার ব্যবহারের পথ ধরে সাহায্য পাবার আগে এগিয়ে এলো না কেন। অভিজিৎবাবুরা দেখান যে আয় ছাড়াও এ পথে প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে যা কৃষককে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আস্তে দেয় না। যেমন সারের বাজারটাই এমন যে একসঙ্গে বেশি সার কিনতে হয়। যার জন্য বড় সঞ্চয় দরকার। কিন্তু কৃষক সেটা পারে না। এই প্রসঙ্গে অভিজিৎবাবুরা বইয়ের পরবর্তী একটা পরিচ্ছেদে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা আনেন যেখানে ক্ষুদে সঞ্চয় তথা micro finance এর আলোচনা হয়। কিভাবে এর মাধ্যমে দারিদ্রের দুষ্টচক্র ভাঙা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে তারা তিল তিল করে সঞ্চয় কর কিভাবে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা যায় তা আলোচনা করেন। ছোট ছোট প্রচেষ্টা একটু সহায়তা কিভাবে দারিদ্র্য দূর করে গরিব মানুষকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় সেই আলোচনা এই গবেষণায় জায়গা পায়।
ভারতের শহরে গরিব জনসাধারণের ওপর সমীক্ষায় দেখা গেছে শহরে খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে। আজের তুলনায় মানুষ কম খায়। খাবার ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষ সুগারের মত রোগে ভোগে। ফলে শরীর ক্যালরি পায় না। প্রয়োজনীয় পুষ্ট পায় না । এতে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।গৃহস্থের বাড়িতে চারজনের মধ্যে তিনজনের শহরে গড় ক্যালরি জোটে ২১০০ আর গ্রামে ২৪০০। এটা ন্যুনতম প্রয়োজনের মাত্রা। সব স্তরের মানুষের মধ্যে মোট খরচে খাদ্যের ওপর খরচের মাত্রা কমে গেছে। এমন কি খাদ্যের মধ্যে কম খরচে যে খাদ্যশস্য বেশি পুষ্টি দিতে পারে তার ওপর খরচ তেমন না করে দামি খাদ্য যাতে ক্যালরি বেশি তার ওপর বেশি খরচ করার প্রবণতা বেড়েছে। গরীবের আঁয় কম বলে তারা সেটা কিনতে পারে না। তাই অভ্যাসের এই বদল তাদের পুষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর। অভিজিতবাবুরা মনে করেন গরিব মানুষদের খাদ্যাভাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত কারণ তাদের মেহনত করে খেতে হয় যার জন্য পুষ্টি দরকার। এই পুষ্টির অভাব তাদের দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে রাখে। কিন্তু এর জন্য সব সময় খাদ্যাভাব নয় খাদ্যাভ্যাসও দায়ী। কম খরচে কিভাবে বেশি পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে মানুষের আরও উৎসাহিত হওয়া দরকার।
এবার আসা যাক শিক্ষা প্রসঙ্গে। বইটাতে আলোচনা হোয়েছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা যার ছাপ থাকলে কাউকে বেশি রোজগারের জন্য বেশি যোগ্য বলে মনে করা হয় চলতি বাজারে। এখনও এই শিক্ষা প্রসারে ব্যবস্থাটা গুরুত্বপূর্ণ যার আধারে শিশু শিক্ষা অর্জন করে।যেটা অবহেলিত হয়েছে বইটাতে। সেই প্রসঙ্গে পরে আমরা আসব। সেটা ধরে বইটার মূল্যায়ণ করব। শিক্ষার সঙ্গে দারিদ্রের সম্পর্ক ব্যাখ্যা যে সব সাক্ষাৎকার ধরে বোঝার চেষ্টা হয় তার একটা দুটো আমরা তুলে ধরব। শিক্ষার অভাব কেন ঘটে সে সম্পর্কে চলতি ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো সব ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য নয় সেটা বলা হয়েছে। যেমন পরিকাঠামোর অভাব শিক্ষকের যোগ্যতার অভাব শিক্ষকের অভাব। এর জন্য এই সমস্যা সমাধানে কোন সাধারণ সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কোন ক্ষেত্রে হয়ত পরিবারের দারিদ্রের দরুন সন্তানকে রোজগারে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাই সে শিক্ষা পেয়ে নিজেকে যথেষ্ট রোজগারের উপযুক্ত করে তুলেতে পারে না। দারিদ্রের ফাঁদে আটকে থাকে। আবার বাবা মায়ের ইচ্ছে থাকলেও ছেলেমেয়ে কোন কারণে পড়াশুনায় উৎসাহ পায় না। স্কুল ফাঁকি দেয়। তাই তার স্কুল ছুট। আবার সরকারী স্কুলের অভাব বেসরকারি স্কুল খরচ সাপেক্ষ হওয়ায় শিক্ষা জোটে না গরিব মানুষের। এসব নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি স্কুল ব্যবস্থা ও বেসকারী ব্যবস্থার প্রয়োজন তার ত্রুটি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন লেখকদ্বয়।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে শান্তারামা নামে এক মহিলার থেকে জানা যায় তাঁর স্বামী অল্পবয়সে ছয় সন্তান রেখে মারা গেলে তাদের আর্থিক সংকট বাড়ে। মহিলা নিজে কাজ করে সংসারের সংকটের মোকাবেলার চেষ্টা করেন তাও বাচ্চাদের স্কুলে পড়া বন্ধ করেন নি। সুতরাং এক্ষেত্রে চলতি অনুমানটি যে সংসারের অভাবের দরুন শিক্ষা না পাওয়ায় সন্তানদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে না বলে দারিদ্রের ফাঁদে আটকে থাকে গরিব মানুষ তা সবসময় সত্যি নয় বলে দেখা যায় । তবে তাঁর কোন কোন বাচ্চা স্কুল যেতে তাগিদ বোধ করত না বলে তাদের পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যায়। যেমন ছোট মেয়েটি পড়া ছেড়ে দেওয়ায় তাকে বেকার বসিয়ে না রেখে কাজে পাঠান মা।অন্যেরা যারা যেমন চেয়েছে পেরেছে তেমন পড়াশোনা করেছে। এক্ষেত্রে যে পড়াশোনা করেনি স্কুল ছুট তার ক্ষত্রে অন্যত্র কারণ খুঁজতে হয়। হতে পারে স্কুলে শিক্ষার পরিবেশের অভাব বাচ্চাদের বিরাগের কারণ। সুতরাং মনে করার কারণ নেই যে গরিব মানুষরা শিক্ষা চায় না। স্কুল ছুটের পরিসংখ্যান দেখিয়ে বা স্কুল থাকলেও স্কুলে পাঠানোর বা যাবার তাগিদের অভাব দেখিয়ে অনেকে বলেন যে প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানোর প্রচেষ্টা একটা অর্থহীন ও বিরাট পরিহাস যদি না শিক্ষার চাহিদা থাকে। যদি চাহিদা থাকে তবে তার টানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব হয় না। অর্থাৎ শিক্ষায় বাজার অর্থনীতি না নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি কোনটা বেশি কার্যকরী সেই বিতর্কটা চলে আসে। এই প্রসঙ্গে অভিজিতবাবুরা বলেন:
'' Though the specific reasons invoked are different, the fault line divides the field essentially in the same place it divides of the subject of aid, with the aid optimists being generally education interventionists, and aid pessimists being in favor of Laissez-faire.'' (109-110)
অভিজিৎবাবুরা নানা কারণে শিক্ষার যোগানের দিকটার অসম্পূর্ণতার পরিচয় পান বিভিন্ন অনুসন্ধানে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি, শিক্ষকদের অনীহা, অনুপযুক্ত পাঠ্যসূচি সবকিছুর কথা বলেন। সেসব দেখে মনে হতে পারে শিক্ষার ওপর খরচ অপচয়। শিক্ষার যথাযথ চাহিদা থাকলে যোগান আপনা থেকেই আসে। এটাই যথার্থ শিক্ষার প্রসার বলে শিক্ষার জগতের চাহিদাওয়ালাদের বক্তব্য। এই চাহিদা ওয়ালাদের যুক্তিতে শিক্ষাকে বিনিয়োগের দিক থেকে দেখা দরকার। কিন্তু লেখকদের গবেষণায় দেখা যায় সবসময় যে চাহিদার অভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা যোগানের দিক থেকে কাজ করে না তা নয়। যোগান এলে এবং তার সঙ্গে কিছু উৎসাহ ব্যঞ্জক উপাদান থাকলে বা স্কুলে পাঠানোকে বাধ্যতামূলক করলে বা স্কুলে গেলে নগদ টাকা পউরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে স্কুল প্রকল্প স্বার্থক হয় বলে তারা দেখান। তারা বলেন ইন্দোনেশিয়ায় একনায়কতন্ত্রী শাসক সৌহার্তের স্কুল যোগানের কর্মসূচি কাজ করেছে বলে দেখা যায়। তাইওয়ানে বাধ্যতামূলক শিক্ষা কর্মসূচী ফলদায়ক হয়েছে। এ ছাড়াও Pratham নামে NGO সংগঠন ভারতে শিক্ষা নিয়ে যে কাজ করেছে তার বিশদ আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল আপাতদৃষ্টিতে বেশি ভালো হলেও তার সুযোগ গরিবরা পায় না বলে তাঁরা দেখান। তাছাড়া এসব স্কুলের মূল কিছু ত্রুটির কথা বলা হয়। যেমন যে স্কুলে অভিজিৎবাবু পড়তেন সে স্কুলে ছেঁকে ভালো ছাত্রদের রেখে দেওয়া হতো আর বাকিদের বাদ দেওয়া হত। এই বাছাই করা ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তাদের স্কুলের সুনাম বজায় থাকত। গরিবদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে এই সব বেসরকারি স্কুলের কোন ভূমিকা থাকত না। এই সব সম্ভ্রান্ত স্কুলের অসম্পূর্ণতার কথাও আলোচনা করা হয়েছে বইটাতে।
দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রশ্নে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপুর। স্বাস্থ্য ভালো রেখে মানুষকে কর্মতৎপর কর্মক্ষম রাখা যায়। ফলে তারা বেশি আয় অর্জনে সক্ষম হয়। শিশুরা সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠলে দারিদ্রের সমস্যা অর্ধেক মিটে যায়। কিন্তু সাবসাহারা দক্ষিণ এশিয়ার মত দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া ডায়রিয়া যক্ষার মত রোগ মানুষকে একধরনের মহামারীর মধ্যে ফেলে রাখে। শিশু মৃত্যুর হার ভয়ংকর।
এ ছাড়াও বিভিন্ন পরিচ্ছেদে পরিবারের বড় সংসার প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষমতা বা অনীহা শিক্ষার সুযোগের অভাব দারিদ্রের ফাঁদ সৃষ্টিতে সাহায্য করে বলে দেখানো হয়। এ সব প্রশ্নের সঙ্গে শুধু অর্থ নয় মানুষের জীবন যাপনের অভ্যেস রুচি সবই যুক্ত বলে মনে করা হয়। বিচ্ছিন্ন ভাবে এক একটা গল্প সুন্দর মনে হতে পারে। গরিব মানুষের ব্যক্তিজীবনে সত্যিই মর্মস্পর্শী। ব্যক্তিস্তরে সামান্য সাহায্য বাইরের থেকে ধাক্কা সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দিতে পারে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সাহায্য সরকারের সাহায্য আঞ্চলিক স্বশাসন বা বৈদেশিক সাহায্য এ ব্যাপারে বিরাট সহায়ক হতে পারে। এর জন্য আদর্শ অর্থনৈতিক তত্ত্ব আলোচনার তেমন দরকার নেই বলে অভিজিৎবাবুরা মনে করেন। বিষয়টা ব্যষ্টিস্তরে ভুক্তভোগী মানুষকে সাহায্যের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার। তাদের জীবন ধারণ আচার আচরণকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার। এটা করতে গেলে তাদের জীবনের মধ্যেই এর সমাধানের সূত্র খোঁজা দরকার। আমরা এখানে আমাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারি। দেখতে পারি পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বা সরকার অনুদিত স্কুলে বছর চল্লিশ আগে ইংরেজি প্রাথমিক বিভাগ থেকে তুলে দেওয়ার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা আমাদের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক।
সাতাত্তর সালে বামফ্রন্ট সরকারে আসার পর ১৯৮০ সাল নাগাদ প্রাথমিক বিভাগ থেকে ইংরেজি তুলে দেয়। তাদের যুক্তি ছিল মাতৃভাষা শিক্ষার উপযুক্ত বাহন। কথাটাকে অস্বীকার করা যায় না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যার যার নিজের ভাষায় বিভিন্ন ভাষাভাষীরা নিজেদের দেশের অর্থনীতি গড়ে তুলেছে, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে। চীন উপনিবেশের কাঠামো ভেঙে নিজেদের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে ভাষাটাকে প্রশাসনিক কাজ থেকে ব্যবসা সর্বত্র চালু করেছে। ভাবলে অবাক লাগে তারা তাদের ভাষায় কম্পিউটার প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভর হয়েছে। কিন্তু ভারতে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজির প্রয়োজন বাড়িয়ে তুলেছে।বর্ণমালার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা হলেও চীন খুব অল্প সময়ে গুগলকে দেশ থেকে বিদায় করে নিজেদের ভাষায় আত্মনির্ভর হয়ে কম্পিউটার শিল্পে বিরাট উন্নতি করেছে।কিন্তু ভারতের মত দেশে দু শতক ধরে ইংরেজ শাসনে যে উপনিবেশিক ধাঁচ গড়ে উঠেছে সেটা আজও বজায় আছে। কার্যত বেড়ে চলেছে। ব্যবসা থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এমনকি শিক্ষিত সমাজের আচার ব্যবহার গড়ে উঠেছে ইংরেজিকে কেন্দ্র করে সাহেবি কায়দায়। স্বাধীনতার পর দেশের একটা জাতীয় ভাষাকে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয় নি বা যায় নি। চাকুরী ও প্রশাসনের কাজে প্রধানত ইংরেজি ভাষার চল থেকে গেছে। কর্পোরেট দুনিয়ায় ইংরেজি দাপিয়ে বেড়িয়েছে ও বেড়াচ্ছে।এই অবস্থায় আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হলে যে ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো দরকার সেটা এখনও নেই। এমনকি গরিব মানুষের মধ্যেও এই ইংরেজি নির্ভরতার মনন গেড়ে বসেছে । এই আর্থ-সামাজিক অবস্থায় মাতৃভাষার ওপর আকর্ষণ না বেড়ে গত চল্লিশ বছরে কমেছে। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে নিজেকে ভালো রোজগারের তাগিদে গড়ে তোলা যায় বলে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে।সেটার কারণ নিহিত আছে সমাজের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে। ব্যষ্টি স্তরের ব্যাখ্যা দিয়ে একে বোঝা যাবে না। আর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পরিসংখ্যান নিয়ে হদিস পাওয়া যাবে না কারণ সাক্ষাৎকারে অসংখ্য মানুষ মুখে অন্তত বলবে মাতৃভাষার প্রয়োজনের কথা। এটা আজ আমাদের জীবনের স্ববিরোধিতা যার উদ্ভব ঘটেছে একটা ব্যবস্থার ফলে যার ওপর আমার এই বই আলোকপাত করতে চায়, যেটা অভিজিৎ বাবুদের বইতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তাত্ত্বিক বিতর্ক উঠবে বলে। পরিবারগুলোতে ইংরেজি শিক্ষার ওপর আনুগত্য আজ এমন বেড়েছে যে মাতৃভাষাকে অহেতুক দায় বলে সাধারণ মানুষ মনে করছে।একটা সমাজে এই গোষ্ঠীগত দিকটা যে কত শক্তিশালী তা উপলব্ধির বিষয়। এই বিষয়টা আজ গরিব মানুষকে যে এক ধরনের নতুন দারিদ্র্যের ফাঁদে ফেলছে সেটা আমরা তুলে ধরছি।
দেখা যাচ্ছে ভোটের চাহিদার তাগিদে অফুরন্ত অর্থ ব্যয় করে সরকার সরকারি ও আধাসরকারি স্কুলগুলোকে চালিয়ে যাচ্ছে।করপোরেশন ও বিভিন্ন সরকারি আধা সরকারি স্কুলগুলো সরকারি ও বিভিন্ন এনজিওর অনুদানে ধুঁকতে ধুঁকতে হলেও টিকে আছে। বিশেষ করে কলকাতা ও বড় বড় মফস্বল শহরের স্কুলে। এদের যোগান থাকলেও চাহিদা নেই। অভিজিৎবাবুরা শিক্ষার চাহিদা যোগানের দিকটা তুলে ধরলেও এই বাস্তব অবস্থাটার কথা বলেন নি।অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর চাহিদা বেড়ে চলেছে লাভের তাগিদে। বেসরকারি উদ্যোগে যোগান এর পিছু ধাওয়া করে চলেছে। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। টাকার থলি নিয়ে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েকে ভর্তি করবে বলে ছুটছে। শহরে নামজাদা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তো কথাই নেই। এখানে দেখা যাচ্ছে দুধরনের স্কুলকে কেন্দ্র করে অভিজিৎবাবুদের তোলা অনুদানের অর্থনীতি ও বাজারের মুক্ত অর্থনীতির বিতর্কটা ভিন্ন প্রেক্ষিতে হলেও এসে পড়ে।
আমরা আমাদের আলোচিত দারিদ্র্য ফাঁদ ধারণার প্রেক্ষাপটে দেখব শিক্ষার এই অবস্থাটা যেটা প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দেওয়া এবং তার সঙ্গে শিক্ষার বেসরকারিকরণের সঙ্গে সৃষ্ট হোয়েছ। আজ বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার খরচ আকাশ ছোঁয়া। তাও গরিব মানুষরাও ভালো রোজগারের উপযুক্ত করে গড়ে উঠবে আশায় সন্তানদের সর্বস্ব খরচ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করছে। নামী স্কুলে দিতে যারা তেমন খরচ করতে পারছে না তারা অঞ্চলের কোন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দিচ্ছে। সেখানে তুলনামূলকভাবে খরচ কম হলেও গরিব মানুষটার পক্ষে কম নয়। এসব স্কুলে পরিকাঠামো নেই বললেই চলে। উপযুক্ত শিক্ষকও নেই। শিক্ষকের মাইনে যৎসামান্য। তাও তারা সন্তানদের বাংলা মাধ্যম স্কুলে দিচ্ছে না। বিড়লা স্কুল বা সাউথ পয়েন্টে দেবার ক্ষমতা এদের নেই। ইংরেজি মাধ্যম বলে এদের বাড়িতে কেউ দেখার নেই। কোচিনে দিতে হয় আরও টাকা খরচ করে। স্কুলের মান ভালো নয় বলে বা তেমন ভালো কোন ঘরের শিক্ষক নেই বলে এরা তেমন ভালো করতে পারে না এক আধটা ব্যতিক্রম ছাড়া। ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও ইংরেজি তেমন শেখে না। বাংলা বা অন্য কোন আঞ্চলিক ভাষা তো নয়ই। না হয় ঘরকা না ঘাটকা। এর মধ্যে থেকেই যারা একটু ভালো করে তাদের এবার ইঞ্জিনিয়ার হতে হয়।সেটাই সমাজের মানে সমাজ শক্তির বিধান। তার জন্য আছে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। টাকা লাগে দেবে গৌড়ি সেন। ব্যাংক থেকে না পেলে মহাজন আছে। ফলে ঋণের ফাঁস লাগে।সেটা থেকে বেরোবার উপায় কি?। আছে। বেশি রোজগারের উপযুক্ত হলে সন্তান শোধ করবে। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট চাকরি নেই। চাকরি থাকলেও আয় তেমন নয় যা দিয়ে শোধ করা যায়। এরই মধ্যে কেউ কেউ টিকে যায় বাকিরা হারিয়ে যায়। দারিদ্র্যের ফাঁস আরও শক্ত হয়। এই অবস্থার মধ্যে আজ দেখা যাচ্ছে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্র থাকছে না। ইংরেজি মাধ্যমে যোগান থেকে চাহিদা বেশি আর বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্র কম কিন্তু স্কুল বেশি। অর্থাৎ যোগান বেশি।
উপরোক্ত আলোচনা প্রসঙ্গে আমি আমার জীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ধরে নিতে পারেন এটাও অভিজিৎবাবুদের মত একটা সাক্ষাৎকারের গল্প।
আমার গাড়ী চালায় ছেলেটি একদিন আমায় জানায় ছেলে তথ্যপ্রযুক্তির একটা কোর্স করবে। সে জানতে পারে পড়া শেষে চাকরি নিশ্চিত। কোন একটি কলেজ বলেছে ১ লাখ টাকা ওরা ব্যাংক থেকে ব্যবস্থা করবে যদি ১ লাখ টাকা দিয়ে নিজেরা ভর্তি করে দেয় । আমার কাছ থেকে ও পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নেয়। আমি সংশয় প্রকাশ করি ব্যাংক কিছু বন্ধক না নিয়ে টাকা দেবে কি না।এতে ওর স্ত্রী মনঃক্ষুণ্ণ হয়। ভাবে বোধ হয় আমি টাকা দিতে চাইছি না। আমি কথা না বাড়িয়ে টাকাটা দিয়ে দিই। দুমাস না যেতেই কলেজ টাকার জন্য চাপ দেয়। ব্যাংক জানায় বিনা বন্ধকে টাকা দেবে না। ছেলের পড়ার সাধ চুকে যায়। এখানে বলতেই হয় আমার টাকাটা ও কষ্ট করে ফেরত দেয়। বুঝুন দারিদ্রের ফাঁদটা কি আর এ ধরণের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাটা কেমন।
আমরা আগেই বলেছি যে শিক্ষার সাথে সাথে স্বাস্থ্য দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কারণ সুস্বাস্থ্য মানুষকে আরও কর্মক্ষম ও আয় উপার্জনে সক্ষম করে তোলে। আর এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোতে মানুষ গরিব নিরক্ষর ভগ্নস্বাস্থ্য ।গরিব বলেই তারা একদিকে যেমন স্বাস্থের প্রতি যত্ন নিতে পারে না আবার শিক্ষার অভাব বলে স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষা রোগ প্রতিহতের সস্তা পথগুলো তাদের জানা থাকে না। জানা থাকলেও সেগুলো তেমন গ্রহণ করে না। সেইজন্য ভগ্ন স্বাস্থ্য তাদের দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ দারিদ্র্য যেমন ভগ্ন স্বাস্থের কারণ আবার তা ভগ্ন স্বাস্থ্যের ফল। স্বাস্থ্যের নৈরাজ্যজনক অবস্থাটা আমরা জানি যখন দেখি সাব সাহারা ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর নব্বই লক্ষ শিশু পাঁচ বছর না হতেই মারা যায় ডাইরিয়া ম্যালেরিয়ার মত রোগে। যদিও নুন চিনি ক্লোরাইনে ঘরে তৈরি করা পানিও সেবন বা মশারী টাঙিয়ে শোয়ার মত সস্তার ওষুধগুলো বা মশারি ব্যবহারের মত প্রতিরোধী ব্যবস্থা এই মৃত্যু হার কমাতে জাদুর মত কাজ করে কিন্তু মানুষের এদের ওপর তেমন আস্থা নেই। বরং তারা বেশি দামী অ্যান্টি বায়টিক এর ওপর আস্থাশীল। ফলে দারিদ্র্যের মুখে চিকিৎসা করানো বা রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নেওয়ায় রোগের আক্রমণ থেকে মুক্তি পায় না। আবার খরচ করে চিকিৎসা করাতে পারে না। ফলে তাদের কর্মক্ষমতা থাকে না। আয় বাড়িয়ে দারিদ্র্য ফাঁদ থেকে বেরোতে পারে না। এছাড়াও বিশুদ্ধ খাবার জলের ব্যবস্থা করে ডায়রিয়ার মত রোগ প্রতিহত করা যায় যা শিশুমৃত্যু কমাতে সাহায্য করে তাদের কর্মক্ষম রেখে আয় বাড়াতে সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গে সচসের The End of Poverty বইটির ওপর আলোচনা হয়। বিভিন্ন NGO যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করে সেগুলো তুলে ধরা হয়। সাচস মনে করেন যে এসব ক্ষেত্রে গরিবদের সাহায্য করা সরকারের কাজ। অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। যদিও বলা হয় যে গরিব মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর খরচের ব্যাপারে উদাসীন গবেষণায় দেখা যায় বাস্তবতা উল্টো। তারা তাদের আয়ের বেশ কিছুটা অংশ স্বাস্থ্যের ওপর খরচ করে। কিন্তু তাদের আয় কম বলে টাকাটা যথেষ্ট। সরকারের সাহায্য তদের স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করলে তার ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হয়। আমরা পশ্চিমবঙ্গেও দেখি সরকারি হাসপাতালে বা ক্লিনিকে গরিব মানুষের ভিড় উপচে পরে। গ্রাম গঞ্জ থেকে মানুষ আসে চিকিৎসা নেবার জন্য। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ব্যবস্থা কম বলে এখানে স্বাস্থ্য সেবার মান নেমে যায়। যতটা সেবা পাবার তারা সেটা পায় না। পরিকাঠামো দুর্বল বলে অবস্থাটা এক এক সময় ভয়ঙ্কর আকার নেয়। পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো অবাধে ব্যবসা করে। প্রচারের ঢক্কানিদাদে এদের দিকে গরিব মানুষ ঝোঁকে। খরচ এখানে অনেক। কিন্তু বাস্তবে এখানেও নানা দুর্নীতি দেখা যায়। এব্যাপারে আমার নিজের অভিজ্ঞতা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে আমি কলকাতার একটা নার্সিং হোমে ভর্তি হই। সেখানকার অব্যবস্থ্যা আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অবাধ বেসকারী ব্যবস্থা বড় বড় কর্পোরেট হসপতালের লুঠের ময়দান সেটা বলতে আমার দ্বিধা নেই। সরকারি ব্যবস্থাকে বাড়িয়ে সেখানে আরও সেবার সুযোগ সৃষ্টি করে গরিব মানুষকে সেবা দিতে পারলে তাদের উপকারে লাগে।তাদের কর্মক্ষমতা রক্ষিত হতে পারে। চূড়ান্ত দারিদ্র্য থেকে তারা মুক্তি পেতে পারে। এরই সঙ্গে গরিবদের জন্য সস্তা বীমা চালু করা দরকার। বীমা বেসরকারিকরণ করায় যে খরচ বেড়েছে তা গরিব মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সরকারের ব্যবস্থাও খুবই সীমিত। এই অবস্থায় গরিব মানুষকে দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা এই মুহূর্তে আকাশ কুসুম কল্পনা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আজ ভারতে সর্ববৃহৎ ব্যবসা হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে নির্মাণ শিল্প। নির্মাণ শিল্পে চাষের জমি নিয়ে যে আশ্রয়স্থল গড়ে উঠছে তা গরিব মানুষকে সাহায্য করছে না। বরং তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে ধনীদের বিলাস এপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে। কৃষিতে নিয়োগ কমছে।দিল্লি গুরগাঁও বোম্বে বেঙ্গালোর বা কলকাতার নিউ টাউনে যে সব এপার্টমেন্ট হচ্ছে তা তারাই কিনতে পারে যাদের যথেষ্ট অর্থ আছে, মোটা ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা আছে। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এদের বেশিরভাগের বিকল্প আশ্রয় আছে। এপার্টমেন্টগুলো খালি থাকে। এগুলো নিয়ে ফাটকা খেলা চলে। অথচ শিক্ষা স্বাস্থ্যের মত বাসস্থানও মানুষকে পরিষ্কার জীবন যাপনে সাহায্য করে যা তাকে আরো উপার্জনক্ষম করে তুলতে পারে। দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসূচির অঙ্গ হতে পারে।
দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যষ্টি বা ক্ষুদে অর্থসংস্থান ও বীমা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে বইটাতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যবসা আর লাভের স্বার্থে এগুলো পরিচালিত হয়। আজ ক্ষুদে অর্থসংস্থান নিয়ে যে লুঠের রাজত্ব চলছে আমরা পশ্চিমবঙ্গে সারদা রোজভ্যালি দেখে সেটা বুঝি। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় সারা ভারতে একই চিত্র। কিন্তু বইটাতে অনেক গল্প জায়গা পেলেও এগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা হয় নি। অথচ এদের কার্যকলাপ গরিব মানুষকে তো সাহায্য করছেই না সর্বশান্ত করে আবার দুষ্টচক্রকেই স্থিতি দিচ্ছে।
এবার আমরা আমাদের আলোচনায় প্রযুক্তির বিষয়টায় বিশদে আসব। আমরা এ ব্যাপারে প্রথমে প্রযুক্তি কিভাবে মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত দেখব। অভিজিৎবাবুদের আলোচনায় উন্নত সার ব্যবহার প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে বিষয়টা এসেছে। কিন্তু অর্থিনীতির উন্নয়নের ইতিহাসে প্রযুক্তির উন্নতি এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছে আজও করছে যেটা তার আলোচনায় তেমন জায়গা পায়নি। শুধু ব্যক্তিস্তরে প্রযুক্তির উন্নতি কিভাবে গরীব মানুষের দারিদ্রের দুষ্টচক্র ভাঙতে সাহায্য করতে পারে তা বলা হয়েছে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে যেটা আমরা ইতিমধ্যে এনেছি। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় একটা সমাজের কাঠামো বদলাতে প্রযুক্তির উন্নতি সাহায্য করেছে। নতুন প্রযুক্তিকে জায়গা করে দেওয়ার স্বার্থে একটা ব্যবস্থা ভেঙে আরেকটা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সমাজ জীবন ব্যক্তি জীবন তোলপাড় করে দিয়েছে। সুতরাং শুধু ব্যক্তি স্তরে নয় গোষ্ঠী স্তরেও বিষয়টা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রযুক্তি প্রয়োগের আধার। এর সঙ্গে আদর্শের প্রশ্নটা যুক্ত। কোন প্রযুক্তি কার স্বার্থে কিভাবে কাজে লাগবে কি ধরণের সাংস্কৃতিক আধার প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করবে সেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। এই সামগ্রীকতার দিক থেকে প্রযুক্তির প্রশ্নটাকে অভিজিৎবাবুদের আলোচনায় আসেনি বলে আমাদের মনে হয়েছে। আমরা এ বিষয়টা সংক্ষেপে অথচ সামগ্রীকতায় আলোচনা করব। এই প্রসঙ্গে ভোগবাদের বিষয়টাও আসবে যেটা দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। আমরা শ্রেণী বিভক্ত সমাজে প্রযুক্তির আগ্রাসনের মুখে আজ শুধু একটা শ্রেণীর মুনাফার স্বার্থে প্রযুক্তির ব্যবহার যে গরিব মানুষকে প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার দারিদ্র্যকে স্থায়িত্ব দিতে সাহায্য করে সেটা দেখব। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা লব্ধ সত্যটাকে বাদ দিয়ে কৃষকের প্রযুক্তি গ্রহণের পথে বাধা বিষয়টা আলোচনা করা যায় না।