উত্তুরে হিমেল বাতাসে ...
রাত জাগা জানালার কাঁচে ভেজা শিশিরের জলছবি। ঘাসের ডগায় ডগায় হিরাকুচির স্বচ্ছতা দোলা খায় উত্তুরে ভোরের হিমেল বাতাসে। হলদে ফড়িং উড়ে যায় আনমনে কচি ঘাসের শরীর স্পর্শ করে। সবুজ প্রকৃতি জুড়ে সাদা কুয়াশার অস্পষ্ট দৃশ্যমানতা।রাতভর শিশিরে সর্বাঙ্গ ভিজে অনাঘ্রাতা প্রকৃতির আলসেমি যেন কিছুতেই কাটতে চায় না।
পাতায় পাতায় কুয়াশার ফিসফাস।কুয়াশা জড়ানো শীতের সকালে সূর্য বড় অভিমানী। ঝিম ধরা ধোঁয়াশা ঘনিয়েছে নদীর বুক জুড়ে। সেই কুয়াশার পরত পেরিয়ে হিলহিলে হাওয়া এসে নদীর অন্য পারের গল্প বলে।কত রকম পাখির ডাকে।দিগন্ত ভিজে ভারী হয়ে থাকে।
হিমঝরা খুব ভোরে, শুকতারার আলোয় পথ চিনে নিয়ে, বৃদ্ধ গোসাঁই সেই কখন খঞ্জনি বাজিয়ে গেয়ে গেছে গান, নরম সুরে। কলা পাতা থেকে টিনের চালে ক্রমাগত হিম পড়ে টুপ্ টাপ ,টুপ্ টাপ। মায়ের নরম বুকে ওম খোঁজে ছোট্ট শালিক। রসের ডাবরী হাতে খেজুর গাছ থেকে নেমে এসে আগুনের আতপে নিজেকে সেঁকে নেয় আজম মিঞা।
খোসা ছাড়ানো কমলালেবু রঙা মিয়ানো রৌদ্র এসে গড়িয়ে পড়ে গোবরে নিকানো মাটির উঠানে। হিমেল সকালের মিঠে রোদ গায়ে মেখে এক্কা দোক্কা খেলে পথ ভোলা একলা চড়াই। মাটির ভারে ধোঁয়া ওঠা চায়ের চুমুকে গা ঝাড়া দেয় প্রবল শৈত্য প্রবাহে ন্যুব্জ জনতা।
তারপর খেয়ালী বাতাস এসে আদিগন্ত সর্ষেক্ষেতে থিরিথিরি কাঁপন জাগায়। দিগন্ত জুড়ে হলুদ রঙের ঢেউ ওঠে। কালো ভ্রমর গুঞ্জন করে ফেরে।
চাষীর উঠানে চালের গুড়িতে আঁকা আলপনারা জেগে ওঠে, নতুন ফসল ঘরে তোলার পালা সাঙ্গ হলে নবান্নে মেতে ওঠে গ্রাম্য জীবন। বিন্নি ধানের খৈ নলেন গুড়ের সোনালী আদরে জড়িয়ে থাকে। মিঠে রোদে পিঠ করে দুলে দুলে সুর করে নামতা পড়ে কচিকাঁচা, অদূরে রোদের আলসেমিতে দুধের বাটি থেকে মুখ সরিয়ে দুই পা ছুড়ে আড়মোড়া ভাঙে ছোট্ট মিনি।উঠানে পড়ে থাকা ধানের কণা খুঁটে খায় অভিমানী মুরগির দল।
জীবনের সুরে ঝংকার ওঠে, থমকে থাকা জীবন, ধীরে ধীরে ফিরে পায় হারানো ছন্দ।পাতা ঝরিয়ে বেলা এগিয়ে চলে অবেলার প্রান্তে।
থরথরে দিন ভোর বাতাস বওয়া থেমে গেলে, মড়া বিকেলের আলো আরো খানিক মিইয়ে এলে, জাফরানি রং ছড়িয়ে পড়ে ঘোলাটে আকাশে ছাড়িয়ে গাছেদের পাতার ফাঁকে। শেষ বিকেলের সোনালী রং ডানায় মেখে বাসায় ফেরে গাঙ চিল। হাট থেকে ফেরে হাটুরের দল। মাথায় ভাট ফুল, সুর টেনে গান গাইতে গাইতে, দিনান্তের খাটুনি সেরে, দলবেঁধে বাড়ির পানে এগিয়ে চলে সাঁওতাল রমণীর দল।
সূর্য ডুবে গেলে বরফ কুচি ঠান্ডা বয়ে যায় বৃদ্ধ শিরায় শিরায়। কাশির দমক ওঠে। গৃহস্থের উঠানে জ্বলে ওঠে তেলের প্রদীপ খুব সরু হয়ে। সুর করে বেজে ওঠে মঙ্গল শঙ্খ জবুথবু শীতের কাঁপুনি নিয়ে। এক সমুদ্র নীলচে ঠান্ডা ক্রমে গ্রাস করে দীর্ঘ কালো রাত্রিকে।