শীতের নলেন গুড়
শীতের হালকা চাদর গায়ে মেখে বাঙালি নলেন গুড় খাবে না তাই কখনো হয় নাকি !আহা, ভাবলেই জিভে কেমন জল চলে আসে |নলেন গুরের পায়েস, সন্দেশ, পিঠে, পুলির সাথে সাথে, শীত পড়তেই রসনা প্রিয় বাঙালি নলেন গুরের রসগোল্লায় মজে যায় |
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়ে যায় |একটা খেজুর গাছ তিন বার কাটার পরে তাতে বাঁশের নলি লাগানো হয় |রস সংগ্রহ করার জন্য বাঁধা হয় হাঁড়ি |একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দুই বার রস পাওয়া যায় |ভোর বেলা ও বিকাল বেলা | খেজুর গাছ থেকে টানা তিন দিন রস সংগ্রহ করার পরে বন্ধ রাখা হয় রস সংগ্রহ |একে বলে গাছের জিরান বা জিরেন |তিন দিন বাদে যে রস পাওয়া যায় তার স্বাদ খুব সুন্দর সুস্বাদু হয় | এই রসকে বলা হয় জিরেনকাটের রস |
ডিসেম্বর মাস পরে গেলো, তবুও শীতের দেখা নেই |ফলে যে গুড়ের জন্য বাঙালি সারা বছর বসে থাকে সে গুড়ের দেখা পাওয়া যাবে কিনা, তাই ভেবেই মনের কোনে এক পাষাণসম বরফ জমতে থাকে |শীতের মরশুম শুরু হতেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে ওঠে গাছিরা |খেজুর গাছের ডগা ছাটছে তাঁরা |এর পরে চাঁচা জায়গায় বাঁশের তৈরি বিশেষ নল লাগিয়ে সংগ্রহ করা হবে রস |দেড় থেকে দুই হাঁড়ি রস জমলে তবে এক কিলোগ্রাম খাঁটি পাটালি তৈরি করা যাবে |
হাঁড়িতে থাকা রস গুলোকে একটা বড় পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয় |জ্বাল দিতে দিতে রস আরো ঘন হয় |এই ঘন মধুর মত রঙের গুড়ই আসলে নলেন গুড় |এই নলেন গুড়কে যদি আরো জ্বাল দেওয়া যায় তবে তা কালচে রঙের হয়ে যায় |আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে এই কালচে অল্প তেতো নলেন গুড় শরীরের পক্ষে সবচেয়ে উপকারী |এই গুড়ের যদি পুষ্টির পরিমাপ করতে যাই তবে দেখা যাবে চল্লিশ গ্রাম নলেন গুড়ে ভিটামিন B-6এর পরিমান 14%, ক্যালসিয়াম 8%, পটাসিয়াম 15%, কপার 10%, আয়রন 10%, ম্যাগনেসিয়াম 24%, ম্যাঙ্গানিজ 30%এবং সেলসিয়াম 10%থাকে |
খুব উপকারী এই নলেন গুড় |পিরিয়ডের সমস্যা মেটাতে এই সুস্বাদু খাদ্যের জুড়ি মেলা ভার |হরমোনের সমতা রক্ষা ছাড়াও এই গুড় এন্ডোরফিন বা হ্যাপি হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় |নলেন গুড় শীতকালে শরীরকে গরম রাখতেও সাহায্য করে |হাড় মজবুত করতে এটি সত্যিই অদ্বিতীয় |এই গুড়ের মধ্যে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয় |একই সঙ্গে এর মধ্যে থাকা পটাসিয়াম রক্ত চাপ স্বাভাবিক রাখে |ফলে হৃদরোগের পরিমান কমে |মধুর থেকেও কালচে নলেন গুড়ে আন্টি অক্সিডেন্টের পরিমান বেশি থাকে, যা অবসাদ কমায় এবং ক্যান্সারকে দূরে রাখে |
টানা ঠান্ডা না পড়লে যে ভালো গুড় পাওয়া যাবেনা তা খেজুর রস সংগ্রহকারী বা শিউলিরা ভালোই জানে |তাই তাঁরা গভীর আশা নিয়ে বসে থাকে,কবে জাঁকিয়ে শীত পড়বে |টানা তিন -চার দিন শীত পড়লে রসে টইটম্বুর হবে খেজুর গাছে বাঁধা কলসি |ভালো রস পাবার আশায় বুকবেঁধে শীতের শুরুতে শিউলিরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে খেজুর গাছের মালিকদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করে গাছ সংগ্রহ করে |চুক্তির শর্ত থাকে গাছ পিছু তিন কিলোগ্রাম করে গুড় অথবা সমান অংকের টাকা গাছের মালিককে দিতে হবে |এক এক জন শিউলি এই শর্তে 300-400 গাছ জমা নেন অর্থাৎ ওই গাছ গুলো থেকে সারা শীতকাল জুড়ে খেজুর রস সংগ্রহের অধিকার পান |একটা গাছ থেকে চার -পাঁচ দিন রস পাড়ার পরে অন্তত পক্ষে তিন -চার দিন জিরেন বা গাছের বিশ্রাম দিতে হয় |গাছের বিশ্রামের পর প্রথম দিনের রস থেকে তৈরী হয় নলেন গুড় |এর চাহিদা বাজারে সবচেয়ে বেশি |তাছাড়া অন্য সময়ে যে রস সংগ্রহ করা হয় তার থেকে তৈরী হয় ঝোলা গুড়, দানা গুড় এবং পাটালি |
শীতের নলেন গুড়ের এত গুন থাকা সত্ত্বেও বর্তমান প্রজন্ম খেজুর গাছ কাটার দক্ষতা ও উৎসাহ হারাচ্ছে |নতুন করে দক্ষ লোকের অভাবে গুড়ের জোগান পর্যাপ্ত স্তরে পৌঁছাতে পারছে না |ফলে আগামীদিনে ভালো নলেন গুড় পেতে সমস্যা হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না |তাছাড়া খেজুর গাছ সাধারণত পুকুর, খাল, বিলের ধারে অযত্নে বড় হয় |চারিদিকে এত গাছ লাগানোর প্রকল্প হয় কিন্তু খেজুর গাছ লাগানো হয় না |তাই বাঙালি হয়তো ভবিষ্যতে এই রসের রসিক হতে পারবে না |
জিজ্ঞাসু মন জানতে চাইতেই পারে, নলেন গুরের নামটা হলো কি করে | এর উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, এই শব্দের সঙ্গে দ্রাবিড় সভ্যতার যোগ আছে | শীত শুরুর আগেই খেজুরের ডাল কেটে গাছ পরিষ্কার করা হয়ে যাবার পরে, গাছের গা চেঁচে নরুন দিয়ে ফুটো করে সেখানে আঙুলের মতো সরু একটা বাঁশের ছিলা লাগিয়ে দেওয়া হয় হাঁড়ি পর্যন্ত, সে কথা তো আগেই বলেছি |এবারে ওই নল দিয়ে খেজুর গাছের রস চুইয়ে পড়ে হাড়িতে |সেখান থেকে নলেন গুড়ের উদ্ভব হতে পারে বলে অনেকে মনে করে |তবে সংসদ বাংলা অভিধান মতে, গুড় একটি বিশেষ্য পদ, এর অর্থ তাল, খেজুর, আখ ইত্যাদির রস থেকে প্রস্তুত সুমিষ্ট খাদ্য বিশেষ |আর নলেন হল গুড়ের একটা বিশেষণ, যার অর্থ খেজুরের নতুন রসে প্রস্তুত -নলেন গুড় !
===============
সুদর্শন মণ্ডল
মদনপুর, নদিয়া
ফোন :8293195177