।। ইন্দুদের কথা ।।
মিঠুন মুখার্জী
ইন্দুর অসাধারণ রূপ লাবণ্য শংকরকে মুগ্ধ করেছিল। ত্রিশটি সম্বন্ধ দেখার পর অবশেষে ইন্দুকে পছন্দ হয়েছিল তার। কারো দাঁত উঁচু, কারো চোখ টেরা, কারো উচ্চতা কম, কারো গায়ের রং কালো, কেউ পড়াশোনায় কম, কারো বয়স বেশি---এভাবে একের পর এক পাত্রীকে প্রত্যাখ্যান করে অবশেষে ইন্দুকে পছন্দ হয়েছিল শংকর ও তার বাবা-মার। তারা যেন একেবারে লক্ষ্মী প্রতিমা খোঁজ করছিলেন। কিন্তু নিখুঁত মানুষ পাওয়া সম্ভব না। তবে ইন্দু আগের গুলো থেকে অনেক ভালো।
ইন্দুর বাবা একজন ফুল চাষী। খুব কষ্ট করে তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে বড় করেছেন। রূপসী ও বিরাজের বিয়ে হয়ে গেছে। ইন্দু তার ছোট মেয়ে। ইন্দুর মুখখানা গোলগাল, গায়ের রঙ ফর্সা। শংকর কলকাতার এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে। ত্রিশ বছর বয়স তার। ইন্দুর বয়স আঠারো বছর। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য আর পড়তে পারেনি ইন্দু। শংকর বারো বছরের বড় হওয়ায় ইন্দুর প্রথমে আপত্তি ছিল। কিন্তু বাবা-মার পছন্দ হওয়ায় সে আর বিশেষ কিছু বলেনি।
পাকা দেখার দিন শংকর ইন্দুর সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চায়। সে ইন্দুকে বলে--- "কিছু মনে করো না। তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে মন চাইছে। বলছিলাম, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? না মানে, বলছিলাম, অন্য কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে? না মানে, কিছু না ভাবলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। প্রথমেই মারপিট করা ভালো, নতুবা সারা জীবন দুজনকে পস্তাতে হবে।" শঙ্করের এই কথার উত্তরে ইন্দু বলেছিল--- "আমার বাবার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ওনার জহুরীর চোখ। মানুষ উনি ভালোই চেনেন। আমার কোনো মেয়ে বান্ধবী নেই, বন্ধু তো দূরের কথা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।" ইন্দুর কাছে এই আশ্বাস পেয়ে খুশি হয়েছিল শংকর। একটা ভালো লগ্ন দেখে তাদের বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই ইন্দু শ্বশুরবাড়ির কে কেমন,হ তা বুঝে নিয়েছিল। শ্বশুর তার মাটির মানুষ। শাশুড়ির কথায় এবাড়িতে সকলে উঠবোস করে। শাশুড়ি বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এলে তাদের স্বর্ণ ব্যবসা ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তাই এই বাড়ির সকলে রাজলক্ষ্মী দেবীকে লক্ষ্মী দেবীর মতো মানে। ইন্দুর কাছে শাশুড়ির একটাই দাবী ছিল। এ বংশের প্রদীপ চান তিনি। মেয়ে হলেও তার আপত্তি নেই। তবে একটা ছেলে চাই-ই চাই। বছর পাঁচেকের মধ্যে ইন্দুর তিনটি মেয়ে সন্তান হয়। পরপর মেয়ে হওয়ায় রাজলক্ষ্মী দেবী ইন্দুর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। শংকর ও ইন্দু আর সন্তান না নেওয়ার কথা বললে শাশুড়ি তাদের বলেন--- "ছেলে সন্তান আমাকে দিতেই হবে। নতুবা মেয়েগুলোকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবো।" শংকর তার মাকে খুবই ভয় পেত। পত্নী ও মার মধ্যে পড়ে তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। শ্বশুর নিশিকান্ত কর্মকার পত্নীকে বলেন---"থাক না, মেয়েরা কি মানুষ নয়। ছেলে নাইবা হলো। কি হবে বংশ রক্ষা করে? এভাবে মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।" শ্বশুরের কথা শাশুড়ি শোনেননি। তিনি বলেন--- "তুমি চুপ করো। যা বোঝ না তাই নিয়ে একদম কথা বলো না। এসব বিষয়ে ছেলেদের কথা বলা আমি পছন্দ করি না।"
বেশ কিছুদিন পর ইন্দু চতুর্থ সন্তান সম্ভবা হয়। চতুর্থ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ইন্দু মারা যায়। কিন্তু শিশুটি বেঁচে যায়। এবার আর ইন্দু শাশুড়িকে হতাশ করে নি। রাজপুত্রের মতো পুত্র সন্তান হয়েছে তার। নার্সিংহোমে যখন শংকর মৃত ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল, তখন শাশুড়ি নাতিকে আদর করতে ব্যস্ত। মেয়ের মতো মৃত বৌমার দিকে একবারও নজর দেওয়ার সময় ছিল না তার । নিজে মেয়ে হয়ে মেয়েদের উপর এমন আচরণ কেন? নিজের মেয়ে নয় বলে? নিজের মেয়ে হলে এমনটা পারতেন?
শংকরকে তার মা বলেছিলেন--- "অত ন্যাকামি করিস না। তোকে আমরা আবার বিয়ে দেব। সে এসে তোর এই ছেলে এবং মেয়েদের মানুষ করবে।" শংকর শুধু তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। মনে মনে বলেছিল---"তিনিও তো একজন নারী। নারী হয়ে কিভাবে আর এক নারীর প্রতি এভাবে অন্যায় করতে পারেন!! তার মেয়ের যদি এরকম হত, তাহলে তিনি পারতেন এ সকল কথা বলতে!!" শংকরের দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা বেয়ে পড়েছিল। ইন্দুকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড কান্না করেছিল সে। ইন্দুর উদ্দেশ্যে বলেছিল--- "তুমি আমাদের রেখে চলে গেলে, আমরা কি করে বাঁচবো? তোমার সন্তানদের কিভাবে মানুষ করব আমি?" দিনটি ছিল একাদশীর। যেভাবে ইন্দু চিরনিদ্রায় পড়েছিল, দেখে মনে হচ্ছিল, সে প্রসন্ন চিত্তে ইহলোক ছেড়ে গোলকে পাড়ি দিয়েছে। সেই মুহূর্তে শংকরের মনে আরো কিছু প্রশ্ন জেগে ওঠে---শাশুড়িরা কেন মায়ের মত হতে পারেন না? বৌমাকে তারা কেন মেয়ে ভাবতে পারেন না? যে মানুষটি শশুর-শাশুড়ি, স্বামী ও সন্তানদের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেয়, তাদের কথা সংসারের কেউ ভাবে না কেন? ইন্দুর মতো মেয়েরা সংসারের জন্য শুধু দিয়েই যাবে, পাবে না কিছু?
ইন্দুর কাজ মিটে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে শ্বশুর বাড়ি থেকে শংকরের বড়শালা জীবন ঘোষাল মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন। শংকরের ইচ্ছা ছিল না মেয়েদের ছেড়ে থাকার। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে অস্বীকার করায় তার মা মেয়েদেরকে পাঠিয়ে দেন। ছেলেটিকে নিজেই মানুষ করার সংকল্প গ্রহণ করেন।
এদিকে দিন দিন শংকরের অবস্থা ইন্দুর শোকে খারাপ হয়ে ওঠে। স্ত্রীকে অকালে হারানোর জ্বালা যেমন সে ভুলতে পারে না, তেমনি মেয়েদের থেকে বঞ্চিত হয়ে আরও ভেঙে পরে সে। জীবনটা ক্রমশ অর্থহীন হয়ে যায়। ইন্দুকে অকালে হারানোর জন্য মায়ের পাশাপাশি নিজেকেও দোষী মনে করে। মায়ের অন্যায় যদি সে মুখবুজে সহ্য না করত,যদি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করত সে, তবে অকালে আজ ইন্দুকে চলে যেতে হত না। ইন্দুর কথা চিন্তা করে তার দুচোখে জল ঝরে। কোনো কিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। ইহলোকে না হলেও পরলোকে সমস্ত অশান্তির বাইরে ইন্দুর সাথে মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। যাওয়ার আগে মাকে একটি পত্র লেখে--- " মা, তুমি যখন এ পত্রখানি পাবে, তখন আমি আর এইলোকে থাকব না। সবাই বার বার বিয়ে করে না। বাবা - মার প্রতি ভালোবাসা তো থাকেই। পত্নীর প্রতিও কম থাকে না। তোমার ইন্দুর প্রতি অন্যায় আমি মেনে নিতে পারলাম না। তাই ওর কাছে চললাম। ছেলেকে তোমরা মানুষ করো। নিজে মেয়ে হয়ে মেয়েদের সঙ্গে এরকম আচরন কেন? বৌমারা কী কারো সন্তান নয়? নিজের সন্তানকে হারিয়ে তোমার বিবেক জাগ্রত হবে আশা করি। বাংলার ঘরে ঘরে এ অন্যায় বন্ধ হোক। ইতি- তোমার খোকা।"
==================
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা
পিন -- ৭৪৩২৫২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন