মরচে
ভুবনেশ্বর মন্ডল
ইদানিং সংসারে বিতৃষ্ণা এসে গেছে সমরেশের। বিশেষত স্ত্রী সোমাকে কেন্দ্র করে। সোমা এখন কট্টর বাস্তববাদী। ওর মধ্যে এখন আর কোন রোমান্স নেই। সম্পর্কে একটু রোমান্স না থাকলে ভালো লাগে না সমরেশের। সমরেশ চাই ওর বউ একটু সেজেগুজে থাকবে, মুচকি হাসবে ,কটাক্ষ করবে, গলা জড়িয়ে ধরবে, চুলে বিলি কেটে দেবে, পার্কে বেড়াতে যাবে,একসঙ্গে বাদাম , ফুচকা, পাপরি চাট খাবে। সোমার মধ্যে এসব আর কিচ্ছু নেই। একঘেয়ে সম্পর্কটাকে যে একটু নতুনত্ব দেবে সে সব কে বোঝায়! ঘরের বাইরে বেরোবার নাম নেই। বললে আবার জ্বলে ওঠে।দিনরাত কাজ আর কাজ ।ওকে কাজে কামড় দিচ্ছে। আর সমরেশকে চরকির মত ঘোরাচ্ছে। বাজার করো, ঝুল ঝাড়ো, জল তোলো, সবজি কাটো, দুধ আনো, ছেলেকে পড়াও কত কি। একটার পর একটা কাজ দিয়ে যাচ্ছে। হাঁফ ছাড়বার উপায় নেই। সমরেশ সময় সুযোগ পেলেই কবিতা ,গল্প এসব লেখে। আর লিখেই শ্রোতা হিসেবে বউকেই প্রথম শোনাতে যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সোমার ওসব শোনার সময় নেই। বলে "যাও তো, এখন দুনিয়ার কাজ পড়ে আছে। সময় নষ্ট করতে পারবনা। যত সব পাগলামি।" তবু সমরেশ নাছোড়বান্দার মত কবিতার ডাইরি নিয়ে ওর পেছন পেছন ঘোরে। আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে "প্লিজ একটু শোনো না। সেই কলেজ লাইফে তো কত শুনেছ। কিন্তু এখন সে সব কোথায় গেল?" সোমা বলে "এই ছাড়ো ,এখনই ছেলে চলে আসবে । তোমার বুড়ো বয়সে এই ভীমরতি দেখলে কি ভাববে বলতো? সত্যি তুমি বেহায়া বটো!" কথাগুলো শুনে সমরেশ কেমন যেন মুষড়ে পড়ে। ওর সব আবেগের বাষ্প কর্পূরের মত মুহূর্তে উবে যায়।
বিশ বছর আগের সোমা আর আজকের সোমাকে চিনতে পারেনা সমরেশ। তাদের প্রেম করে বিয়ে। সেই লুকিয়ে দেখা, হাত স্পর্শ করা, চোখের সম্মোহন, সিনেমা যাওয়া, পার্কে বসে গল্প করা , সে সব আজ কোথায় গেল ! সমরেশের এখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লিখেছিলেন "শেষের কবিতা"তে। যাকে প্রেম করবে ,তাকে বিয়ে করবেনা । আর করলেই ,দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনের আঁচে প্রেম বাষ্প হয়ে যাবে। সমরেশ সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এক একবার মনে হয় " দূর শালা, কে আর সংসার করে! সন্ন্যাস নিয়ে পালিয়ে যাওয়াই ভালো।অষ্টপ্রহর ঘ্যানঘ্যান, মুখ ঝামটা, কথার খোঁচা, অসহ্য।"
সমরেশের মনে হয় পাশের বাড়ির অভীক দা ভাগ্যবান। ওরা স্বামী-স্ত্রীতে বড় ভালো আছে। কখনো তো ওদের ঝামেলা ,ঝঞ্ঝাট ,ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় না। বরং ভোরবেলা মিতা বৌদির গানের সুরে তার ঘুম ভাঙে। মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মিতা বৌদি যেমন সুন্দরী ,তেমনি তার গানের গলা। বয়স কম করে বিয়াল্লিশ তো হবেই। কিন্তু দেখে মনে হয়, এখনও যেন পঁচিশ ছাব্বিশ ।একেবারে বিয়ের কনে। দেখা হলে মুচকি হাসেন। ইয়ার্কি করেন। চা খেতে ডাকেন। কখনো বলেন "একদিন আপনার কবিতা শুনবো, আপনি নাকি দারুণ লেখেন!ম্যাগাজিনেও বের হয়। একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি। জমিয়ে গল্প হবে।" সমরেশ মনে মনে ভাবে সোমার সঙ্গে মিতা বৌদির কত তফাৎ। সোমা জীবনটাকে উপভোগ করতেই এখন ভুলে যাচ্ছে। জীবনের রূপ, রস গন্ধ, স্পর্শ কিচ্ছু ওকে স্পর্শ করতে পারছে না। আরে বাবা! জীবনটা তো দুদিনের, তারপর তো সব শেষ। চিতার আগুনই যদি জীবনের শেষ পরিণতি হয় তবে জীবনের মাধুর্য টুকু কেন আঁকড়ে ধরবো না। রবীন্দ্রনাথ তো এজন্যই লিখেছিলেন -"মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।"কিন্তু সোমার মতো ওরকম বস্তুবাদী কেজোদের নিয়ে বড় মুশকিল। পৃথিবী সুন্দর, জীবন সুন্দর , এখানে রোজ ফুল ফোটে ,পাখি ডাকে, নদী বয়ে যায় ,ঝরনা ঝাঁপিয়ে পড়ে সমতলে, রাতের বুকে জ্যোৎস্না ঝরে কিন্তু কেন ?এটুকু বোঝার অনুভূতিও হারিয়ে ফেলেছে সোমা। আর সমরেশ যেন জীবন সমুদ্রের বিষটুকু পান করে হয়ে উঠছে নীলকন্ঠ। মানুষ তো শুধু দেহে বাঁচে না, মানুষ বাঁচে মনেও। এই মনটাই সমরেশের কাছে সর্বস্ব। এই দুঃখ যন্ত্রণা কেমন করে বোঝাবে সোমাকে, সমরেশ ভেবে পায়না। তাই তার মাঝে মাঝে মনে হয় ওদের সম্পর্কে বস্তু জগতের জল হাওয়ায় যেন মরচে ধরছে। এভাবে মরচে পড়লে সমরেশ বাঁচবে কি করে?
______________________________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাইথিয়া লেবু বাগান
পোস্ট -সাঁইথিয়া
জেলা -বীরভূম
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন