বাংলার নদী নালা ও ধীবর সম্প্রদায়
বারিদ বরন গুপ্ত
বাংলার ধীবর সম্প্রদায় সেই প্রাচীন কাল থেকেই নদীকে বুকে করে বেঁচে রয়েছে, নদী এদের কাছে মায়ের মত! মা যেমন তার সন্তানদের লালন পালন করে নদী ও ঠিক সেভাবেই এদেরকে লালন পালন করে আগলে রেখেছে! বংশ কৌলিন্যের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এই অবহেলিত শ্রেণী দীর্ঘকাল ধরে বাংলার মানুষকে মাছে ভাতে করে রেখেছে, পুষ্টির যোগান দিয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে পেয়েছে কতখানি? তা অবশ্যই আজ ভাববার বিষয়!
জলের উপর নির্ভর করে এদের জীবন ও জীবিকা, সাধারণত জল থেকে জাল দিয়ে এরা মৎস্য সংগ্রহ করে, সেই হিসেবে মনে করা যেতে পারে যে এই জাল থেকে জেলে কথাটি এসেছে। এক সময় এরা খাল বিল নদী নালা ইত্যাদি থেকে মৎস্য সংগ্রহ করত, মূলত খাবারের জন্য। পরবর্তীকালে তারা এই মৎস্য আহরনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে! এই জেলে সম্প্রদায় কৈবর্ত, ধীবর বা কেওট নামেও পরিচিত! পরবর্তীকালে বাগদি দুলে রাজবংশী মালো প্রভৃতি সম্প্রদায় এদের পেশায় ভাগ বসায়, কিন্তু জেলে বা ধীবর হিসেবে মর্যাদা পায় না! মুসলিম সমাজের নিকারী, ধাওয়াল, আবদাল প্রভৃতি সম্প্রদায় মৎস আহরনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত! উল্লেখ করা যায় যে নিকারি সম্প্রদায় দীর্ঘকাল মৎসাহারণ এবং মৎস্য ব্যবসা, বা আমবাগান আগলদার পেশার সাথে ও যুক্ত রয়েছে! সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের ধীবর রা সমুদ্রে নৌকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মৎস্য সংগ্রহ সংরক্ষণ এবং বিপননের সাথে যুক্ত আছেন।
বাংলার জেলে বা ধীবরদের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস! এরা চিরকাল নদী নালা খাল বিল থেকে মাছ সংগ্রহ করে জীবন অতিবাহিত করেছে, রাত বিরেতে কখনো সাপের মুখে কখনো বাঘের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে! বড়ই সংগ্রামী, অবহেলা এবং বঞ্চনার জীবন এদের। সেই রাজ রাজাদের আমল থেকেই এরা নানাভাবে শোষিত হয়ে আসছে ! সমাজের আধিপত্যকারী শ্রেণী নানা সময়ে এদের খাবারে ভাগ বসিয়েছে, নানাভাবে পেশায় বাধা সৃষ্টি করেছে। পাল যুগ ছিল কৈবর্ত দের ইতিহাসে সুবর্ণ যুগ। এই সময়কালে কৈবর্ত সম্প্রদায় যথেষ্ট শক্তিশালী হইয়া ওঠে! শুধু মৎস্য আহরণ নয়, পাল রাজাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এমনকি সেনাবাহিনীতেও তাদের দেখা গেছে। পাল যুগে সামন্ত হিসেবেও তাদের নিয়োগ করা হতো । পাল যুগে বর্ধমান ভুক্তিতে মন্ডল গ্রামে জনৈক রানা নামের এক ধীবর সামন্তের কথা জানতে পারা যায়! এই মন্ডল সংলগ্ন বিষয় গুলিতে একসময় ধীবরদের আধিপত্য ছিল, রানা ছিল সেই ধীবর বা কৈবর্তদের নেতা! এই জনপদে বেশ কয়েকটা পুকুর ছিল যা ধীবরদের দখলে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রানা এবং একা দিঘি এখনো এই দুই দিঘী কৈবত্তাদের সেই সুদিনের কথা স্মরণ করাচ্ছে। উত্তর রাঢ ছিল পালদের আধিপত্যের অন্যতম কেন্দ্র, উত্তর রাঢ অর্থাৎ বরেন্দ্রভূমিতে কৈবর্তরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল! দিব্য সহ বেশ কিছু কৈবর্ত নেতা পাল রাজাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল । কিন্তু পাল যুগের শেষ অর্ধে তাদের পেশা সামাজিক সংকটের মুখে পড়েছিল, অনেক সামাজিক বিধি নিষেধ তাদের ওপর চেপেছিল, তাই জীবন ও জীবিকার তাগিদে এরা পাল সম্রাট মহীপালের আমলে দিব্যর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল যা ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত হয়ে আছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে এই বিদ্রোহের কথা লিপিবদ্ধ আছে!পাল সেন সুলতানি মোগল হয়ে ব্রিটিশ কোন যুগেই এরা সুস্থির হয়ে বেঁচে থাকতে পারেনি, রাজ অনুগ্রহ বিশেষ একটা পেয়েছে বলে মনে হয় না, সামাজিক মর্যাদা এবং অবস্থানের ভিত্তিতে এদের জীবনটা সেই খাল বিলেই পড়ে থেকেছে!
ব্রিটিশ শাসন আদবে ছিল জমিদারি শাসন! সেই সামন্ততান্ত্রিক শাসনে এদের অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে পড়ে! সেই জমিদার সামন্ত প্রভুরা এদের খারুই থেকে সেরা সেরা মাছগুলো তুলে নিতো! বাংলার বিভিন্ন নদী-নালা ঘাট কোন না কোন জমিদারের অধীনে ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবে এরা নানা ভাবেই জমিদার এবং তাদের পেয়াদাদের শোষণের শিকার হয়েছিল। জমিদারদের দাবি মত মাছ বা অর্থ না দিতে পারার জন্য নানাভাবে রোষানলের চাবুক এদের উপর পড়েছিল! রানী রাসমনি জেলে সমাজের দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা করে দক্ষিণেশ্বর সংলগ্ন হুগলি নদীতে জেলেদের বিনা খাজনায় মাছ ধরার অধিকার দিয়েছিলেন! যাই হোক বাংলার জেলে সমাজের জীবন সংগ্রাম বা দুঃখ দুর্দশার সব কথা হয়তো ইতিহাসে লেখা হয়নি! হয়তো তা আজও বাংলার নদীনালা খাল বিলেই ঘুরপাক খাচ্ছে!
ভারত স্বাধীন হলো, জমিদারি নাগপাশ থেকে কৃষক সমাজ মুক্তি পেল, কিন্তু এদের মুক্তি আজও ঘটেনি! যান্ত্রিক সভ্যতার করাল গ্রাসে এরা মৃত প্রায় হয়ে বেঁচে আছে, নগর সভ্যতা এবংশিল্প কারখানার বিকাশের দৌলতে নদী যেমন নানাভাবে দূষিত হয়ে মৃত প্রায় হচ্ছে এদের ও অবস্থা তাই! আসলে সভ্যতার বিকাশের দৌলতে এক শ্রেণীর মানুষের যেমন অতিরিক্ত মুনাফা এসেছে, তা অবশ্যই আরেক শ্রেণীর মানুষদের অধিকার কে খর্ব করে! যেমন নদী দূষিত হওয়ার কারণে নদীতে মাছের যোগান কমে আসছে, তেমনি জেলে সম্প্রদায় তাদের বাঁচার অধিকার ধীরে ধীরে হারাচ্ছে! ধীবরদের এই অধিকার বেঁচে থাকার অধিকার, নুন ভাতের জোগাড়, সমাজের কাছে ন্যূনতম দাবি! যা আর্তনাদ! এদের সেই আর্তনাদ এবং দাবিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে, তাহাদের কথা আমার আর্তনাদ!
সভ্যতার বিকাশে বাংলার নদ নদী গুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল! নদীকেই কেন্দ্র করে এক সময় গড়ে উঠেছিল জনসমাজ, ধীরে ধীরে তা জনপদে রূপ নেয়, নদী নালা খাল বিলের জল কে কেন্দ্র করে বাঁচার রসদ খুঁজে ছিল সেই আদিম মানুষ, কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলেছিল, দুর্গম অঞ্চলে পাড়ি দেবার জন্য এক সময় পথ খুঁজে ছিল! প্রথমে নদীর জলে শুকনো কাঠ ভাসতে দেখে খুঁজে পেয়েছিল পারাপারের ইতিহাস, ধীরে ধীরে বাঁচার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে উন্নত মস্তিষ্কে দৌলতে শুকনো কাঠ খোদাই করে আবিষ্কার করেছিল পানসি, ধীরে ধীরে তা নৌকায় রূপ নেয়! সহজ ও নিরাপদ হয়ে ওঠে প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। পরবর্তীকালে এই জল- পরিবহন ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছিল বাংলার ধীবর ও বণিক সমাজ। বাংলার বুকে বেশ কয়েকটি বন্দর গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সপ্তগ্রাম, তাম্রলিপ্ত , সোনারগাঁও, উজানী, কর্জনা প্রভৃতি । এই সমস্ত প্রাচীন বন্দর হয়ে ধনপতি সওদাগর, চাঁদ সওদাগর, শ্রীমন্ত সওদাগর প্রমুখরা বাণিজ্য তরী ভাসিয়েছিল দেশ বিদেশে। সেই প্রাচীন বন্দর গুলো ধ্বংস চিহ্ন নিয়ে এখনো বেঁচে আছে, আর বেঁচে আছে প্রাচীন নাবিকদের, সওদাগরদের সেই কাহিনী বাংলার বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যে।
সে যুগ ছিল জল পরিবহনের যুগ, এরপর সমাজের আয়তন বেড়েছে, জীবন জীবিকার খোঁজে মানুষ পাড়ি দিয়েছিল নতুন আবাসস্থলের খোঁজে, হয়তো চোখে পড়েছিল সমতল ভূমি, সেখানেই গড়ে তুলেছিল বাসস্থান, বলতে গেলে পশু পালক গোষ্ঠী ধীরে ধীরে যখন কৃষি কেন্দ্রিক সভ্যতায় এসে হাজির হয়, তখন এভাবেই নতুন নতুন সমতল ভূমি আবিষ্কার করে, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনসমাজ ও জনপদ, তাহলে একটা কথা পরিষ্কার যে সভ্যতা বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নদী এ বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়!
প্রথমে যান্ত্রিক সংহতির যুগে কোন শ্রম বিভাজন তৈরি হয়নি, তখন সমাজে কোন জাতি বিভাজন ও তৈরি হয়নি, বুদ্ধি বিকাশের সাথে সাথে সমাজ ধীরে ধীরে উন্নত পর্যায়ে এসে যায়, সমাজে কাজের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে শ্রম বিভাজন ও এসে যায় , জাতিভিত্তিক পেশা স্পষ্ট হতে থাকে, বংশ পরস্পয় লোকজন একই পেশায় যুক্ত হতে থাকে! পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ জৌব সংহতির প্রথম পর্যায়ে কর্মের ভিত্তিতে জাতবিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, উৎকৃষ্ট নিকৃষ্ট পেশার সূত্রপাত ঘটে, সমাজের আয়তন বাড়ার সাথে সাথে সমাজের আইন-শৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটতে থাকে, যা রাষ্ট্র গঠনের প্রথম ধাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়!
আধুনিক সভ্যতার ক্ষুধা, জীবনধারা বর্তমান বাংলার খাল বিল নদী নালা কে গ্রাস করছে। আধুনিক শিল্প এবং কৃষি সভ্যতার গরল বাংলার নদী নালা কে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ফলে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী মৎস্যজীবী সম্প্রদায় জাল গুটিয়ে প্রায় গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে! বাংলার অনেক শ্রেণীর মাছ আজকে বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছে, যার ফলে ধীবরদের পেশা চরম সংকটের মুখোমুখি, অনেকখানি অনিশ্চয়তা গ্রাস করছে! ফলে বাংলার এই ধীবর বা মৎস্যজীবী শ্রেণী জল সম্পদ হারিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে! যার ফলে দিন দিন সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে!
====================
তথ্য:: খড়িনদীর তীরে বিভিন্ন মাঝি মাল্লা ও ধীবর সম্প্রদায়।
লেখক পরিচিতি:: বারিদ বরন গুপ্ত মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, কবি লেখক প্রাবন্ধিক, সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন