বিশ্ব সাহিত্যের প্রতীক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এস এম মঈনুল হক
বর্তমানে ইন্টারনেটের জগতে এসে আমরা সাহিত্য চর্চাকে একেবারে ভুলতে বসেছি। এর একটা বড় কারণ হল মোবাইল বিনোদন। আমরা এন্টারটেনমেন্ট- এ ব্যস্ত আছি। তাই সাহিত্য চর্চার দিকে মনোনিবেশ করতে পারছিনা। বিশ্ব বরেণ্য কবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যতটা অল্প বয়সে সাহিত্য চর্চা করেছিলেন বাস্তবে আর একটা উদাহরণ পাওয়া চরম কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমি কয়েকটা কথা সাহিত্যে প্রেমিকদের কাছে তুলে দিলাম। এটা চর্চিত হোক। তাহলে এই লেখনি আমার স্বার্থক হবে।
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি......
২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সঙ্গিনী সারদা সুন্দরী দেবীর গর্ভে জন্ম নিলেন এক ছোট্ট শিশু। তাঁর নাম দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কে জানত এই ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ একদিন বিশ্ব বরেণ্য হবে। হতে পারে সেদিন তাঁর প্রসুতি গৃহের হাসি মুখটি হয়তো বলে দিয়েছিল যে আমি রবীন্দ্রনাথ। আমি বিশ্ব বরেণ্য হব। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন। শৈশবে তিনি কিছুদিন কোলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নরম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। স্কুলের এই বাধা ধরা নিয়ম ও আবহাওয়া তার একদমই ভালো লাগেনি। তাই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে গৃহ শিক্ষকের দ্বারা পড়াশোনাই ব্রতী করলেন। শুরু হল তাঁর পড়াশোনার জীবন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সারদা দেবীর অষ্টম পুত্র। জানা যায় উনিশ শতকের সাহিত্য সংস্কৃতির পিঠস্থান ছিল এই জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্মণ ঠাকুর পরিবার। অনেক সাহিত্যিক এখান থেকে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রননাথ ছিলেন অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল কেউ বলে সময় বয়ে যায়, কেউ বলে সময় হয়নি। এটা মন্দিরের ঘন্টা ও অমল দই ওয়ালা র কথা। ঘেরাটোপের মধ্যে জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে তিনি প্রকৃতির শোভা অবলোকন করতেন। শুরু করলেন তিনি সাহিত্য জীবন। তিনি ছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার সঙ্গীতজ্ঞ ও গল্পকার। ভানুসিংহ ছদ্মনামে তিনি লেখালেখি করতেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম বই ' কবি কাহিনী' প্রকাশিত হয়। তারপর একে একে সন্ধ্যা সংগীত, প্রভাত সঙ্গীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কমল, মানসী, সোনার তরী কাব্যসমূহ তিনি রচনা করেন। তারপর রচনা করেছিলেন চিত্রা, চৈতালি, কনিকা, কল্পনা, কথা ও কাহিনী, নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতালি ইত্যাদি। বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেরণায় কবির প্রাণে গানের জোয়ার আসে। তখন তিনি রচনা করেন তার অনবদ্য গীতিনাট্য 'বাল্মিকী প্রতিভা'। ১৯১৩ সালে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলির জন্য তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। ১৯১২ সালে এই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে। আইরিস কবি ডব্লুউ. বি. ইয়েস ইংরেজিতে গীতাঞ্জলির ভূমিকা লেখেন । নোবেল প্রাইজ আনতে গিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। নোবেল প্রাইজ আনতে গিয়ে ওখানে বিমানবন্দরে কবি ও কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের ব্যাগটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরে অবশ্য পেয়েও গেছিলেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ রাজ কবিগুরুকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালা বাদে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করলে তার প্রতিবাদে তিনি "নাইট" উপাধি পরিত্যাগ করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা আজ হেরিটেজে পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশী বহু জ্ঞানীগুণী এখানে শিক্ষকতা করতেন। আজ তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত। রচিত দুটি সংগীত জনগনো মনো-অধিনায়ক এবং আমার সোনার বাংলা যথাক্রমে ভারতের ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রূপে গৃহীত ও সমাদৃত। জমিদারির সামলানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝে মাঝে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ যেতেন এবং সেখানে রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই "সোনার তরী" ও বহু ছোট গল্প। তার মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ৫২টি, গান দুই হাজার, উপন্যাস ১৩ টি, ছোটগল্প ৯৫ টি, প্রবন্ধ ও গদ্য গ্রন্থ ৩৬ টি, নাটক ৩৮টি। তাঁর সমস্ত রচনাবলী ৩২ টি খন্ডে প্রকাশিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রহ্মবাদী কবি। তিনি বলেছিলেন পথ ভাবে আমি দেব/ রথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব/ হাসে অন্তর্যামী। কবি মনে ঈশ্বরের আন্তরিক বিশ্বাস ছিল।
তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁর অন্তরে ঈশ্বর কিভাবে বিকশিত এবং প্রকাশিত হয়েছে। তাই তিনি বলেছিলেন- সীমার মাঝে অসীম তুমি/ বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/ তাই এত মধুর। কবির মনে অগাধ প্রেম ছিল। তিনি বহু প্রেমের গান লিখে গেছেন। তার মধ্যে তিনি বলেছিলেন- এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে/ বাহির হয়ে এসো/ বাহির হয়ে এসো তুমি/ যে আছো অন্তরে। ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে/আমারও পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শেখো তোমার চরণ মঞ্জিরে। যেছিল আমার স্বপ্নচারিনী/তারে বুঝিতে পারিনি তারে বুঝিতে পারিনি। সখি ভাবনা কাহারে বলে/ সখি যাতনা কারে বলে। ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করে খেলা/আনমনা যেন দিক বালিকার ভাসানো মেঘের ভ্যালা। এ ধরনের অনেক প্রেমের গান তিনি রচনা করেছিলেন। কবি জানতেন তাঁর জীবনেও একদিন বার্ধক্য আসবে। তাই তিনি লিখেছিলেন- ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু/ পথেই যদি পিছিয়ে পড়ি কভু। রবীন্দ্রনাথ জানতেন বার্ধক্য জীবনে ঈশ্বরের সেবা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। তাই তো তিনি এই ধরনের গানগুলিও রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কিছু বলা মানে মহাসমুদ্র থেকে পাখির চঞ্চুতে যে পরিমাণ জল উঠে ততটুকুই বলা হবে। কেননা তিনি মহাসমুদ্র। কেননা আমি একটা ছোট্ট ডোবা হয়ে এই মহা সমুদ্রের বর্ণনা কেমন করে দিই।
আমাদের সমাজে রবীন্দ্র ভাবনা প্রায় দিন দিন ক্ষীন হয়ে আসছে। সাহিত্য কবিতা নাট্য গল্প নিয়ে আমরা আর অত মাতামাতি করি না। আমাদের মাঝে সাহিত্যের স্পৃহা অনেকটাই কমে গেছে। আর একটা রবীন্দ্রনাথকে কি আমরা কোনদিনই পাবো না? আর কি কোনদিনই শুনতে পাবো না- দখিনা হাওয়া জাগো জাগো/ জাগাও জাগাও /জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ। আর কে শোনাবে-কি গাবো আমি কি শোনাবো আজই আনন্দধামে। আর কোনদিনও শুনতে পাবো না- আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ সুরেরও বাঁধনে। তিনি কোন পুরনোকে ভুলতে চাননি। বলেছিলেন-পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়। তিনি বলেছিলেন-আমার রাত পোহালো শারোদ প্রাতে/বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে। তিনি হৃদয় খুলে দিতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। বলেছিলেন-কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/তোমারও চরণে দেব হৃদয় খুলিয়া।
বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মূল্যবান একটা উক্তি রেখে গেছেন। বলেছিলেন-মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়/ এই হোক শেষ পরিচয়/। এই মহান কবি দীর্ঘ চার বছর রোগ ভোগের পর ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে ইহ জগতের লীলা শেষ করেন।
=== (সমাপ্ত) ===
এস এম মঈনুল হক
গ্রাম- ফুলসহরী
পোস্ট- রমনা শেখদিঘি
জেলা- মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন