Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

পুস্তক আলোচনা ।। অরবিন্দ পুরকাইত (পুস্তক : সুন্দরবনের আঞ্চলিক শব্দকোষ ।। সংকলক : নিরঞ্জন মণ্ডল)



'সুন্দরবনের আঞ্চলিক শব্দকোষ' পাঠে যেমন মনে হল

অরবিন্দ পুরকাইত

শব্দকোশ নানা রকম প্রচলিত আছে। তার মধ্যে যে-কোনো ভাষায় প্রচলিত সাধারণ থেকে বিষয়ভিত্তিক শব্দসংগ্রহ, পারিভাষিক শব্দকোশ, বানান অভিধান ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় মান্য চলিত বাংলা শব্দকোশের সঙ্গে সঙ্গে— তুলনায় কম হলেও— স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষায় শব্দকোশ বা বিচ্ছিন্ন সংগ্রহ দুর্লক্ষ্য নয়।
       ভাল মানের শব্দকোশ বা অভিধান রচনা সে বড় অধ্যবসায় ও শ্রমসাপেক্ষ। বিশেষ করে পথিকৃৎদের ক্ষেত্রে তার জন্য হয়তো 'একটি জীবন'ই উৎসর্গ করতে হয়। পরবর্তী অভিধানকারদের তবু একইসঙ্গে বেশ খানিক দিশা ও সংগ্রহ হাতের কাছে মেলে, তাতে কাজটা তুলনায় সহজসাধ্য হয়। কিন্তু তাও কাজটা নেহাত কম সময়, শ্রম, অধ্যবসায় ইত্যাদি দাবি করে না। কেন-না একটি ভাল মানের অভিধান রচনা— আমাদের স্মরণীয় উত্তরাধিকার সত্ত্বেও— আজও খুব সহজ কাজ নয়। একই অভিধানের মাধ্যমে সবরকম পাঠকের দাবি বা সমস্ত ক্ষেত্রের প্রয়োজন মেটানো তো প্রায় অসম্ভবই, কোনও ভাষার একটি অভিধানকে বহুমান্য হয়ে উঠতে গেলে তা নানারকম দিকে আলোকপাত দাবি করে। সে ভাষায় প্রচলিত সমস্ত শব্দের (অন্য ভাষা থেকে আগতও) উৎস, ইতিহাস, উচ্চারণ, অর্থ, প্রয়োগ, এমনকি প্রয়োজনে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা— শব্দ ও শব্দানুষঙ্গের যাবতীয় দিক। এটাও ঠিক যে সে যোগ্যতাও থাকে না সবার, বা সেই সুদীর্ঘ নিবেদিতপ্রাণতাও সম্ভব হয় না সবার পক্ষে। বলতে দ্বিধা নেই যে বর্তমান আলোচকেরও সে যোগ্যতা নেই। এটা নিছক বিনয় নয়, বাস্তব। শব্দ সংগ্রহ এক আর তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ আর এক। বিচার-বিশ্লেষণ তথা উৎস বা ব্যাকরণগত দিক ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখার যোগ্যতা নেই বলেই এ আলোচনাও উপর উপর শব্দের সংকলন বা সংগ্রহ, সজ্জা, অর্থ ইত্যাদির সাধারণ বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ বলা যায় খানিক অগোছালোভাবে ব্যক্তি-পাঠকের ভাল লাগা-মন্দ লাগার গুটিকয়েক কথা।
       অনেক পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে অভিধান না হয় তৈরি হল, কিন্তু তা প্রকাশ করবে কে! তা তো অনেক ব্যয়সাপেক্ষও। আর সেই তুলনায় আজকের দিনে অভিধান ক'জন ব্যবহার করছে— কে কিনবে এখন অভিধান! হাতের কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ক্লিক করলে মুহূর্তে চলে আসছে অর্থ, বিপরীত শব্দ, প্রয়োগ ইত্যাদি অনেককিছুই। অযথা লোকে অভিধান কিনতে যাবে কেন, সবই তো ধরে দিচ্ছে হাতের মুঠোর ফোন! যদিও এখনও তা মূলত মান্য চলিত বাংলার ক্ষেত্রে, স্থানভেদে বিপুল বৈচিত্র্যময় স্থানীয় বা আঞ্চলিক শব্দ তার আয়ত্তে আসেনি সেইভাবে। যাই হোক, প্রতিষ্ঠানগতভাবে প্রকাশ তবু খানিক আসানের, ব্যক্তির ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের সঙ্গে বহুত শ্রম, সময় ইত্যাদি ব্যয় করার পরেও অর্থব্যয়— সে বড় বিড়ম্বনা ও চাপের হয়ে পড়ে। তাও বাজার থাকলে আলাদা কথা। সেখানে আঞ্চলিক শব্দকোশের তো আরওই বাজার মন্দা। 
       মানুষ তো অভিধান অনুসরণ করে কথা বলে না, মানুষের সভ্যতার নিরিখে অর্বাচীন অভিধান বরং মানুষকে অনুসরণ করে। অভিধানে না থেকে থাকলে, দীর্ঘ প্রচল শব্দেরা অভিধানে অন্তর্ভুক্তি দাবি করে। মান্য চলিত বাংলায় সচরাচর যারা কথা বলে, অভিধান অনুসারী না হলে তাদের তবু সংকোচ হতে পারে বা হতে পারে তাদের সমালোচনা, আঞ্চলিক বা স্থানীয় শব্দে যারা কথা বলে তাদের ক্ষেত্রে অভিধান তেমন পাত্তা পায় না। সেই পাত্তা না পাওয়ার মধ্যে, অন্যের বোধগম্য করে তোলার স্বতঃস্ফূর্ততায় এমন কিছু কিছু শব্দ পাত্তা পেয়ে থাকে, প্রচল দীর্ঘ হলে স্বয়ং অভিধান তাদের পাত্তা না দিয়ে পারে না। 'পাতে' স্থান দেয় বা তুলে নেয়।
       আমাদের আজন্মের ভাষা— ছোটবেলা থেকে দীর্ঘদিন যা আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ছিল— আজ নিজেদেরই তা মাঝে মাঝে আবিষ্কার করতে হয়! কোথাও শুনে, কোথাও পড়ে, কোনও কোনও প্রসঙ্গে নিজেদেরই হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায়। আমাদের নিয়ত শহর-সংশ্রবের ফলে— তা সে শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে হোক বা বইপত্র থেকে দৃশ্য-শ্রাব্য সমস্ত মাধ্যমের মাধ্যমেই হোক, মান্য চলিত বাংলার নিত্য সান্নিধ্যে আমাদের সেই মায়ের-পেট-থেকে-পড়া ভাষা থেকে আমরা নেহাত কম দূরে সরে আসিনি। নিয়ত চর্চা নেই, বলা নেই, লেখা তো নেই-ই প্রায়— খুবই অল্প পরিমাণে— তাহলে আমাদের মতো যারা একটু লেখাপড়া শিখে, আবার বিশেষ করে শহর বা শহরতলিতে অস্থায়ী বা স্থায়ী বাসা নিয়েছি/বেঁধেছি, তাদের কাছে আদত সেই শৈশব-কৈশোরের ভাষা সেই রূপে, সেই ব্যঞ্জনায়— সেই মহিমায় অধিষ্ঠিত থাকা কতখানি সম্ভব! সপ্তাহ-অন্তে একদিন গ্রামে যাওয়া বা মাসে একদিন, কিংবা ষাণ্মাসিক বা বাৎসরিক দুই-একদিন ফেলে-আসা-গ্রাম-সংশ্রবে সত্যিই কি তার ধাত যথাযথ অনুসরণ বা সবকিছু উদ্ধার সম্ভব— যে গ্রামও প্রতিদিন সচেষ্ট মান্য চলিত বাংলায় নিজেকে প্রকাশ করে মান্য পঙ্্ক্তিতে স্থান লাভ করতে! সত্যি বলতে, অন্তত আজ থেকে মাত্র চার-পাঁচ দশকের ভাষা এখনও পর্যন্ত গ্রামে যতটা প্রচলিত আছে তা তো মূলত ততটা-লেখাপড়া-না-জানা বা একেবারেই না-জানা মানুষদের লবজে, যারা এখনো গ্রামেই রয়ে গেছে। পাঁচজনের সামনে স্থানীয় কথ্য উচ্চারণে কিছু বলে ফেললে আমরা কি আড়ালে শুধরে দিইনি আমাদের সন্তানদের!
       নিরঞ্জন মণ্ডল সুন্দরবনেরই ভূমিপুত্র। কেবল ভূমিপত্র হলেই সব কিছু ভূমিরূপ হবে এমন কথা নয়, ভূমি-সংশ্রব দরকার এবং সেটা কালেভদ্র হলেও চলে না। কারণ আরও অনেক কিছুর মতো ভাষাও তো নিত্য প্রবহমান, তা সে গ্রামীণ ভাষা হলেও। কেউ একজন কোনও এক গ্রামে জন্মাল, তারপর একটা সময়ে আর গ্রামের সঙ্গে কোনো সংযোগ রইল না— তার পক্ষে সেইভাবে গ্রাম-রূপকে তুলে ধরতে পারা কি সম্ভব! দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার গোসাবা-সংলগ্ন কচুখালির জাতক (১৯৫৫) নিরঞ্জনবাবু কেবল সুন্দরবনের ভূমিপুত্র নন দীর্ঘদিনের ভূমিপুত্র এবং পরবর্তীকালে সোনারপুরবাসী হওয়ায় সে ভূমিসংশ্রব নিরন্তর উপস্থিতির সংশ্রব না হলেও, তাঁর চর্চার সংশ্রব বটে। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক— সবচেয়ে বড় কথা, কথাকার। তিনি গল্প-উপন্যাসে তাঁর আজন্মের ভাষা সংস্কৃতি চারিয়ে দেন। 
       গ্রামের পাঠশালার পর বড় মোল্লাখালির তারানগরের স্কুল, তারপর হিঙ্গলগঞ্জ এলাকার গোবিন্দকাটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল হয়ে গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ তাঁর পড়াশোনার ক্ষেত্র। কর্মজীবনে সরকারি ব্যাঙ্কের আধিকারিক-তিনি সুন্দরবনের নানান দিক নিয়ে দীর্ঘদিন লিখে চলেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সংকলন গ্রন্থে। তাঁর নিজের গ্রন্থতালিকার দিকে একটু তাকিয়ে নিতে পারি আমরা। কবিতাগ্রন্থ 'অফুরান নীল', 'বিষণ্ণ ক্যানভাস'। গল্পের বই 'বাদাবনের পদাবলি', 'সুন্দরবনের দলিত গল্প'। উপন্যাস 'উজানভাটির কথকতা', 'ভাটির দেশের উপাখ্যান'। কিশোর উপন্যাস 'ঠাকুর ঠাকুর ডয়রা কলা' (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত অনুবাদ 'Oh priest, give me the seeded banana')। লোকসাংস্কৃতিক প্রবন্ধগ্রন্থ 'সুন্দরবনের বালাকি বালাই শ্লোক, বালাগান গাজন'। তাছাড়া 'বাদাবনের কমলেকামিনী', 'কামিনীশাল ধানের গন্ধ'; প্রকাশ পেয়েছে 'হেতালবনের বাঘ', 'ভরতগড়ের গুপ্তধন'। 'কবিকল্প' পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত তিনি।
       তাঁর মতো একাধারে ভূমিপুত্র এবং নিত্য চর্চাকারী হিসাবে যখন কেউ কোনও শব্দকোশ সংকলনে হাত দেন আমাদের প্রত্যাশা স্বভাবতই থাকে অনেকটা বেশি।
       এই সংকলন গ্রন্থ থেকে আমরা এমন অনেক শব্দ পেয়েছি যাদের আজ আর ততটা চল নেই বা তুলনায় কম প্রচল, তা সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গে এখনও রীতিমতো সুন্দরবনে চলিত যে শব্দ সে শব্দভাণ্ডারের বহু শব্দই তিনি এখানে ধরে দিয়েছেন। বর্তমান আলোচকের এমন কিছু কিছু শব্দ মনে পড়ে গেছে এই বইটি থেকে যা হয়তো আপাতভাবে ভুলেই ছিল সে। তার বাইরেও সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এমন কিছু কিছু পরিভাষা এখানে পাওয়া যাবে যা আমরা একদা বৃহত্তর সুন্দরবনের বাসিন্দা তো বটেই, সুন্দরবনের বাইরের মানুষ বিশেষ করে শহর বা শহরতলির মানুষ সেইভাবে ওয়াকিবহাল নয় সেসব শব্দ বা শব্দানুষঙ্গের সঙ্গে। সুন্দরবনের সমাজজীবনে প্রচলিত অনেক পরিভাষা মেলে এই বইয়ে।
       তাঁর সংকলিত বা সংগৃহীত শব্দসমূহ এইরূপ সূচিতে পরিবেশিত হয়েছে : গৃহস্থালি, জীবনযাত্রা ও অন্যান্য; কৃষিজীবী ও কৃষি সরঞ্জাম; মৎস্যজীবী ও মাছ ধরার সরঞ্জাম; বিভিন্ন পেশা ও বৃত্তিমূলক শব্দ; কুম্ভকার; শোলাশিল্প; উৎসব, আমোদপ্রমোদ, পালা-পার্বণ ও লৌকিক দেবতা; গ্রামীণ খেলাধুলো সংক্রান্ত; শিল্প সংক্রান্ত; নৌকা বিষয়ক; জেলে, মৌলে, কাঠুরেদের জঙ্গলে ব্যবহৃত ভাষা; পেশাগত শব্দ। শেষে আছে তথ্যঋণ। ১৯১ পৃষ্ঠার বই। সূচিটি সাজানোর ঠিকঠাক লাগল না। বিভিন্ন পেশা ও বৃত্তিমূলক শব্দের পরে অনুচ্ছেদ করে ছোট অক্ষরে পরপর এল কুম্ভকার ও শোলাশিল্প, একইভাবে তারপরে কীভাবে আসে বাকিগুলো, যার একদম শেষে আবার আলাদা করে পেশাগত শব্দ!

       সুন্দরবন এবং বৃহত্তরভাবে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কথ্য ভাষা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে নেহাত কম সংগ্রহ নেই। বিশ্লেষণও। স্বতন্ত্র সংগ্রহ ছাড়াও, আমাদের সাহিত্য এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে ভাণ্ডার ইতিমধ্যেই রচিত হয়েছে সেগুলোকে যদি একত্র করা যায় তো কথ্য ভাষা এবং তার নানান দিকদর্শন সমৃদ্ধ একটা জায়গায় পৌঁছাবে। দীর্ঘস্থায়িত্ব লাভ করবে হারিয়ে-যেতে-বসা বহু শব্দ, শব্দানুষঙ্গ, সূক্ষ্ম ও স্বতন্ত্রপ্রকাশ শব্দ-চিত্র। নিজেদের সাহিত্য, সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে সাধন চন্দ্র নস্কর, কালীপদ মণি, ধূর্জটি নস্কর, পঞ্চানন দাস, মদনমোহন মাহাতা, অক্ষয় বৈদ্য, পূর্ণেন্দু ঘোষ, প্রদীপ বর্মণ, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, বিনোদ বেরা, অমিয় দাস,  অপরেশ মণ্ডল, উত্থানপদ বিজলী, বিমলেন্দু হালদার, সুভাষ মিস্ত্রি, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, পুরঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ হালদার, দিলীপকুমার নাহা, সনৎকুমার নস্কর প্রমুখ এবং আরও বহু লেখক  তাঁদের লেখায় বিপুল শব্দসম্ভার, বিশ্লেষণ ইত্যাদি ধরে রেখেছেন। সেই বড় মাপের কাজের জন্যে বড় রকমের উদ্যোগের প্রয়োজন এবং সেটি সম্মিলিতভাবে হলেই সব দিক থেকে সুবিধা।
       
       বইটিতে ধরা হয়েছে অনেক কিছুই, কিন্তু বইটি দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার মনে না হয়ে পারে না যে এমন একটি উদ্যোগের মধ্যে এত অযত্ন কেন, পরিকল্পনাহীনতা কেন! সংক্ষেপে কয়েকটি দিক তুলে ধরি।
       প্রথমত একটা ধন্দ লাগে, বইটি সংকলিত না সংগৃহীত! প্রচ্ছদে যিনি লেখক, ভিতরে তিনি সংকলক! ব্লার্বে বলা হল সংগ্রহের কথা, বলা হল 'সংগৃহীত আকাড়া (?) বিপুল শব্দভাণ্ডার'। ভূমিকাতে বলা হয়েছে, 'সংকলনের শব্দ সংগ্রহে আমার বন্ধু কবি সুশীল মণ্ডল কবি প্রবীর রঞ্জন মণ্ডল সহযোগিতা করেছেন। সুন্দরবনের কথ্যভাষার গবেষক বিমলেন্দু হালদার, প্রাবন্ধিক সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন অধ্যাপক সুভাষ মিস্ত্রির রচনা থেকে মূল্যবান তথ্য পেয়েছি। এই সব বিদগ্ধ গবেষকদের কাছে আমি ঋণী। সুলেখক সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। সামান্য জ্ঞানে যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তুলে দিলাম তা। জানি, তবু ত্রুটি রয়ে গেল অনেক। পাঠকদের কাছে আগাম ক্ষমাপ্রার্থী।' আসলে নিজস্ব সংগ্রহ কিছু থেকে থাকলেও— অর্থাৎ বইটির চরিত্র মিশ্র হলেও— সংকলনধর্মিতারই প্রাধান্য।
       বইটির ভূমিকা দায়সারা বলতে গেলে, একটি অভিধানের সামগ্রিক পরিকল্পনা দর্শন ইত্যাদি তাতে পরিস্ফুট নয়।
       শব্দকোশের সাধারণ লক্ষণ অনুযায়ী এখানে শব্দগুলো বর্ণানুক্রমিকভাবে পুরোপুরি আসেনি, অনেক জায়গাতেই যচ্ছেতাইভাবে বিঘ্নিত হয়েছে তা। তাঁর শব্দসজ্জায় ক-এ চন্দ্রবিন্দুযুক্ত সব শব্দ এল পরপর!
       একই শব্দজাত একাধিক শব্দ সেই শব্দের অধীনেই তাদের অর্থ তথা প্রয়োগভিন্নতা নিয়ে আসার কথা। তার বদলে পরপর বসে সংখ্যা বাড়িয়েছে। যেমন, কতা-র পরে তা দিয়ে পরপর আরও আঠারোটি শব্দ এসেছে! তারপর কথা দিয়েও পাঁচটি, সে ক'টি কেন কতা-র অধীন আসতে পারল না বোঝা গেল না। গা-র পরে নানারকম আঠারোটি শব্দ পেরিয়ে গার (অর্থ প্রথমটির দেহ ও পরেরটির গায়ের)! একই শব্দ উচ্চারণের ইতরবিশেষে সংখ্যা বাড়িয়েছে। আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে কী চমৎকার স্থানানুগ উচ্চারণবৈচিত্র্য দেখিয়েছেন কামিনীকুমার রায় একই শব্দের অধীনে রেখে! এখানে হুবহু একই শব্দ স্থানভেদে একাধিকবার এসেও বাড়িয়েছে সংখ্যা। যেমন, আড়িয়ে যাওয়া (পৃ. ২৮, ২৯), শাশি (পৃ. ১৩৩, ১৩৫), হানশেল (পৃ. ১২৩, ১২৪), মালেন (পৃ. ১৪২, ১৪৩), তাড়া সন্ন্যাস (পৃ. ৮৪, ১৫৩), জল-সন্ন্যাস (পৃ. ৭৩, ১৫৩)। কোনও কোনও শব্দ একাধিক পরিভাষা সংকলনে এসেছে এখানে অর্থাৎ একাধিকবার। কাঁইমাই সামান্য বানানভেদে তিনবার রয়েছে আলাদা করে! একই অর্থবোধক ভগা-যুক্ত চারটি শব্দ আলাদা আলাদা! এমন তো অনেক হতে পারে তবে। এটা কি অভিধানের ধারা!
       প্রচুর মান্য চলিত বাংলা শব্দ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মাচবা শব্দ গৃহীত হতে পারে অন্তত তা যদি সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট হয়, অন্যথায় ঠিক নয়; যেহেতু বইটিকে সেখানকার আঞ্চলিক শব্দকোশ বলা হচ্ছে। বস্তুত, আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহের পর অন্তত একবার দেখে নেওয়া দরকার মান্য চলিত বাংলা অভিধানে তা আগে থেকেই রয়েছে কি না। থাকলে, অর্থভিন্নতা না থাকলে বা তার সঙ্গে আঞ্চলিক অনুষঙ্গ না থাকলে সেগুলো না নেওয়াই শ্রেয়। অক্কা পাওয়া, অতটা, অনামুখো (এখানে অনামুকো হওয়ার কথা), অন্যায্য, অযশ, আইবুড়ো, আকাট, আগবাড়িয়ে (আগবেইড়ে হতে পারত), আঘাটা, আঙটা, আছাড় খাওয়া (আচাড় উচ্চারণই বাস্তবের বেশি কাছাকাছি), আছাড় মারা, আটপৌরে, আকছার, উদোম এমনই দু-একটি এখানে তুলে দেওয়া হল। কোনও কোনও শব্দের সুন্দরবনকেন্দ্রিক অন্য অর্থ বা প্রয়োগ থাকলেও তা দেখানো হয়নি— শব্দ সেখানে সীমায়িত অর্থে এসেছে।
       উচ্চারণ প্রাধান্য পায়নি পরিবেশনে। কাছাখোলা, কাছায় হাগা ইত্যাদিতে কাচা হওয়ার কথা নয় কি? সুন্দরবনের শব্দকোষে এ কাদের উচ্চারণ! এর ফলে অনেক শব্দ মান্য চলিত বাংলা-র দিকে চলে যায়। একটি আঞ্চলিক ভাষার শব্দকোশে বিশেষত দৃষ্টান্ত আঞ্চলিক হওয়ায়ই বাঞ্ছনীয়। নিতান্ত প্রয়োজনবোধে মাচবা। তাঁর অল্প দৃষ্টান্তে পুরোপুরি স্থানীয় উচ্চারণ আরও অল্প, তাও সে উচ্চারণে স্থানীয় ধারা রক্ষিত হয়নি সবসময়। উচ্চারণ কোনও কোনও জায়গায় মিশ্র। হ্যাঁ, এখন নানান কারণে গ্রামীণ জীবনের উচ্চারণও মিশ্র নিশ্চয়ই, কিন্তু একটি অভিধানের শব্দচয়ন ও শব্দার্থের প্রয়োগে উচ্চারণের একটা নির্দিষ্ট ধারাই গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করি। তিনি কখনও হয়েছে, কখনও হুয়েছে লিখেছেন দৃষ্টান্ত-বাক্যে, অর্থাৎ মাচবা এবং স্থানীয়। কিন্তু হুয়েচে বা হয়চে-ই কি বেশি কাছাকাছি নয় সুন্দরবনের দেহাতি মানুষজনের? এমনকি হুয়েচ বা হোয়েচ উচ্চারণও বরং চলিত আছে, বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে। দৃষ্টান্ত বা খণ্ড সংলাপে এমন মাচবা-র উপস্থিতি কেন? অভিধানকার যখন অর্থ বা বর্ণনা দিচ্ছেন তখন মাচবা ঠিক আছে, কিন্তু যেসব দৃষ্টান্তে বোঝা যাচ্ছে বাদাবনের পাত্র-পাত্রী কথা বলছে সেখানে মাচবা মানায় না, যেহেতু এটা সুন্দরবনের আঞ্চলিক শব্দকোশ। কোথাও কোথাও দৃষ্টান্ত হিসেবে মুখের ভাষায় স্থানীয় উচ্চারণের প্রয়াস আছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে শেষরক্ষা হয়নি, অর্থাৎ মাচবা এসে গেছে; আর অনেক স্থানে মাচবা-ই প্রধান হয়ে উঠেছে। ছেদ্দ শব্দের অর্থ ফুটো বলে উল্লেখ করে দৃষ্টান্ত হিসাবে দিয়েছেন তিনি— নৌকাটার ছেদ্দ দিয়ে জল ঢুকছে। ছিদ্র-কে যারা ছেদ্ধ উচ্চারণ করে তারা কি ওইরকম উচ্চারণ করবে? অন্তত দে এবং ঢুকচে বা ঢুকতেচে উচ্চারণ করবে না কি? এমনটি বেশি দেখি বিশেষত মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন শহর বা শহরতলির কথাসাহিত্যিকদের গ্রামীণ চরিত্রদের মুখে বসানো সংলাপে। সামঞ্জস্যহীন কিছু গ্রামীণ উচ্চারণ সংলাপের মধ্যে পুরে দিয়ে বাহবা পেতে কম দেখা যায় না। সুন্দরবনের মানুষের মুখে বসানো অধিকাংশ দৃষ্টান্ত যদি মাচবা-তে হয় তবে আঞ্চলিক অভিধান তুলনায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
       ঐ-কার দিয়ে যে দশটি শব্দ এসেছে, ও-কারেই আসতে পারত।
       ব্যক্তিবিশেষের ব্যতিক্রমী উচ্চারণ সেই স্থানের সাধারণ উচ্চারণ হিসাবে স্থান পেয়ে যায়নি তো কোনও কোনওটি! ধরুন অ্যাপিরিলি, অ্যাণ্ডাশোন বা অ্যাসিটিরি বললে উদ্দিষ্ট অংশের সাধারণ মানুষজন এপ্রিল মাস, ইনজেকশন বা রেজিস্টারি করা-ই বুঝবে তো? কোনও কোনওটি— মনে হয়েছে— বিচ্ছিন্ন প্রয়োগ থেকে নেওয়া, না বলে দিলে সেখানকার মানুষই অনেকসময় ধরতে পারবে বলে মনে হয় না। 
       অভিধানে বানান যথাযথ হওয়া একান্ত দরকার এবং সে কারণে প্রুফ দেখায় অধিক যত্নশীলতা দাবি করে। এ বইয়ে বানানভুল/ছাপার ভুল নেহাত কম নয়। ছাঁদ বা বাঁধা ছাদ বা বাধা হয়ে গেলে চলে কী করে! ফাড়া/ফালা/ফাঁসা-র বিমলেন্দু হালদারকৃত অর্থ ছিঁড়ে যাওয়া/ছিঁড়ে ফেলা ছাপার ভুলে এখানে ছেঁড়ে যাওয়া/ছুড়ে ফেলা, ফেরেঙ্গা-র বিমলেন্দুকৃত ডাল এখানে ভাল। বিমলেন্দুবাবু ফেরেঙ্গার সুন্দর বর্ণনা দিলেন, নিরঞ্জনবাবু তাতে নিবৃত্ত হলেন। ফলে অর্থ বা ছবিটা স্পষ্ট হল না। অসম্মতি অর্থ করা হল 'আপিও' শব্দের!  
       এক বর্ণ দিয়ে তৈরি শব্দগুলো যেখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারপরেই একটু বাড়তি ফাঁক রেখে পরবর্তী বর্ণ দিয়ে তৈরি শব্দ শুরু হয়ে যেতে পারত, খানিক বা অনেকখানি পৃষ্ঠা ফেলে রাখার দরকার ছিল না।
       জলদাভাত শব্দ দিয়ে তিনি অর্থ করেছেন— জল দেওয়া ভাত। পান্তা ভাত। জল-দেওয়া ভাত ও পান্তাভাত একই প্রতিপন্ন হওয়ার ভয় রয়ে যেতে পারে এক্ষেত্রে। যেমন পান্তা আর পষ্টি-র স্পষ্টতই তফাত আমাদের এদিকে। জাউ শব্দের অর্থ করেছেন— খুদের রান্না করা খাবার। চালের ছোট কণাকে 'খুদ' বলে। এখানে খুদ আর মোল্কো-র তফাৎ বোঝানো দরকার ছিল। 'খুদের টানে মোল্কো চোঙে' প্রবাদ রয়েছে। জাউ মোল্কোরও হতে পারে। আদতে জাউ পায়েস জাতীয় খাদ্য। মোল্কো ছিল বিশেষত আতপ চালের সেই অংশ, ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করে চালতে চালতে (যেমন পৌষ সংক্রান্তিতে চালের গুঁড়ি করার সময়) শেষ যে অংশটি আর গড়ে দেওয়ার মতো পরিমাণে থাকত না।
       ছবিটি পরিষ্কার না করে কেবল সরঞ্জাম বা একপ্রকার বলে অনেক শব্দের অর্থ এড়িয়ে যাওয়া শব্দকোশের ক্ষেত্রে এক দুর্বলতাই, এখানে যেটি ঘটেছে নেহাত কম নয়। ভূমিপুত্ররা যদি যথাসম্ভব স্পষ্ট ছবি তুলে না ধরেন তবে কার কাছে তা আশা করব আমরা! ডাকক্ষৌরি বলতে বিমলেন্দুবাবুর 'এক ধরনের পাখি'কে নিরঞ্জনবাবু করলেন 'এক রকমের পাখি'। 
       কোনও কোনও শব্দের অর্থের এক-একটি পর্যায় যতিচিহ্নের ভিন্নতায় না বুঝিয়ে প্রায় সমস্ত জায়গায় অর্ধবিরতি চিহ্ন (কমা) দিয়ে দেওয়া হয়েছে। শব্দকোষে এটা ঠিক নয় একেবারেই।
       বোঝানো বা অর্থের বাক্য ঠিকঠাক গঠিত নয় সব সময়। যতিচিহ্ন ঠিকঠাক বসেনি সব জায়গায়।
       অর্থভিন্নতার উল্লেখ কোথাও কোথাও প্রয়োজন ছিল। আড়া-র অর্থ করা হয়েছে, খড়ের ঘরে দুই খুঁটির ওপর সমান্তরাল লম্বা বাঁশ। খড়ার বড়কেও আড়া বলা হয়। আর দিত অর্থে অসম্পূর্ণতা রয়েছে। খড়ের ঘর, খুঁটি বা বাঁশ এর অর্থকে সীমায়িত করে। অ্যাক গইলির গরু মানে কি কেবল একদলের সমর্থক! 
       ভুল অর্থও প্রাধান্য পেয়েছে নেহাত কম নয়। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র হয়ে তিনি অজ শব্দের অন্যতম অর্থ করলেন 'নিকৃষ্ট, হীন', আড় ভাঙা-র একমাত্র অর্থ করলেন 'কথা বলার মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার টান না থাকা'! আড়িমুড়ি খাওয়া কি 'শরীরটা খারাপ হওয়া' (পরে দু-এক পাতার ব্যবধানে আড়মোড়া ভাঙা বা আনমুড়ি ভাঙা-য় অর্থ মোটামুটি ঠিক আছে)! আধসিরে ঘটি কি 'এক সের ধরে এমন ঘটি'! আদুরির অর্থ কি 'মেয়েদের ডাক নাম'! দুটি শব্দকে মাঝে রেখে দু-বার আপাতক শব্দের অর্থ করা হল কেবল 'অন্তত'! আলগোচ মানে কি উঁচুতে রাখা! আলটাগরা বা আলতাবলা কি কেবল যথাক্রমে গলার ভিতর ও অস্পষ্ট বোঝায়! আংরা বা আকাড়া (?) বলতে যথাক্রমে জ্বলন্ত আগুন ও চাষ নয় এমন জমি বললে ঠিকঠাক বলা হয় কি? ছাওন গাবা বলতে বিমলেন্দুবাবুর বয়ান প্রায় হুবহু রেখে তিনি লিখলেন, "গাদাতে ধান বিচালি সাজাবার পর শেষে বিচালি দিয়ে ছেয়ে দেওয়া হয়। একে 'ছাওনগাবা' বলে।" অর্থাৎ যাচাই না করে প্রায় হুবহু নিতে গিয়ে তিনিও ভুল করলেন। কারণ, ধানের গাদায় ছাওনগাবা হল ছাওন বা ছাওয়ার ঠিক আগের পর্যায়— যে পর্যায়ে গাবা গাবা বিচুলি (অর্থাৎ অনেকগুলো করে বিচুলি একসঙ্গে নিয়ে) পরিপাটি করে সাজিয়ে পেতে পেতে অনেকটা উঁচু করে নেওয়া হয় যাতে ছাওন ঢালু হয়। ছাওনগাবা কখনোই ছেয়ে দেওয়া নয়। ধানের গাদা তো পাটা (একটার গায়ে আর একটা— এইভাবে পেতে পেতে) এবং গাবার সংযোগেই পরপর গড়ে ওঠে, অর্থাৎ বেশ কয়েকটি পাটার পর গাবা, তারপর আবার কয়েক পাটা, তারপর গাবা দেওয়া— এইভাবে। এতেই গাদা ঠিকমতো পরস্পর বাঁধনে গড়ে ওঠে। "এমন আশিটির 'তড়পা' বিচালি হলে এক কাহন বিচালি হবে।"— ঠিক বলা হল কি? দৃষ্টান্তে আর এগোচ্ছি না।
       ঐ শব্দকোশে উচ্চারণের সূত্র ধরিয়া দেওয়া হয়নি বেশির ভাগ সময়, উচ্চারণানুগ শব্দসংগ্রহ হলেও কোথাও কোথাও উচ্চারণের দিশা আবশ্যক ছিল।
       পরিভাষা সংগ্রহ পরিবেশনে শিরোনামকে মনে রাখা হয়নি। যেমন 'জেলে, মৌলে কাঠুরেদের জঙ্গলে ব্যবহৃত ভাষা'য় জ দিয়ে— জবান, জো-সো করে, জাড়, জো। পরিভাষার ক্ষেত্রে বিভাগ অনুযায়ী শব্দ বাছাই নিখুঁত নয়। 'পেশাগত শব্দ' পর্যায়ে অধিকাংশ শব্দই মাচবা আভিধানিক এবং কেবল সুন্দরবনকেন্দ্রিকও নয়। ব্লার্বের দাবিমতো এগুলো কি 'আকাড়া'? মৎস্যজীবী ও মাছ ধরার সরঞ্জাম অধ্যায় ঝ বর্ণের অধীন ঝাঁপি শব্দের পর কী হল! ট থেকে হ পর্যন্ত আর কি কোনো শব্দ নেই দেওয়ার মতো এই বিভাগে? এর পর-পরই 'জাল তৈরির উপকরণ', 'মাছধরার বঁড়শির প্রকারভেদ'-এর পর এসে গেল 'নৌকার সরঞ্জাম' এবং আশ্চর্যজনকভাবে তার অধীনে নৌকা মলম-এর পরে-পরেই পোলো, পাটা, পাশ ফেলা, পাই, পোনা ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধ শুরু হয়ে গেল! এমন ফাঁক রয়ে গেল প্রুফ দেখায়!

       তাঁর এ শব্দকোশে, যথার্থ তৃণমূল স্তরে শব্দ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মান্য ব্যক্তিত্ব বিমলেন্দু হালদারের প্রলম্বিত ছায়া। এমন শব্দ নেহাত কম নয় যেখানে তিনি সরাসরি শ্রী হালদার-দিত অর্থই নিয়েছেন অথবা একটু-আধটু নিজের মতো করে। শব্দকোশের চরিত্র যখন সংকলনগোত্রীয় তখন সেটা অসম্ভব নয়, কিন্তু সুনির্দিষ্ট ও সঙ্গতভাবে তা হতে গেলে হুবহু নেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বীকৃতি দরকার। শব্দ কারও নিজস্ব নয় নিশ্চয়ই— যদিও প্রয়োগে স্বাতন্ত্র্য সম্ভব— কিন্তু ভাষা বা ব্যাখ্যা যে-যার নিজস্ব। সেই নিজস্বতার যথাযথ স্বীকৃতি না থাকলে পাঠকের পক্ষে সবসময় বোঝা সম্ভব নয় যে সে ভাষা বা ব্যাখ্যাদি একাধারে সংগ্রাহক-সংকলকের নিজের না অন্য কারও। যেখানে সহায়ক হিসাবে একাধিক গ্রন্থ বা লেখকের নাম রয়েছে। কেবল পুস্তকের শেষে ঋণস্বীকার-রূপ স্বীকৃতি বা ভূমিকায় সশ্রদ্ধ উল্লেখ ইত্যাদিতে সে কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। হুবহু বা প্রায়-হুবহু নেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধনীর মধ্যে বি.হা., সু.চ., সু.ম. ইত্যাদি দেওয়া যেত ভূমিকা বা অন্যত্র এগুলো কাকে বোঝাচ্ছে তা উল্লেখ করে। হ্যাঁ, বিমলেন্দুবাবুর বইয়ের উল্লেখ করেছেন শ্রী মণ্ডল, ভূমিকায় তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন— সর্বোপরি বইটি উৎসর্গই করেছেন তাঁকে, তার পরেও বলছি, উক্ত যথাযথ স্বীকৃতির দায় এড়ানোর নয়। প্রশ্নটা যেহেতু নিজস্বতা তথা মৌলিকতার। দু-একটি দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন পেশা ও বৃত্তিমূলক শব্দ বিভাগের কুম্ভকার পর্যায়ে বিমলেন্দুবাবু তাঁর 'দক্ষিণ ২৪ পরগনার কথ্য ভাষা ও লোকসংস্কৃতির উপকরণ' (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে ৩৫টি শব্দ চয়ন করেছিলেন নিরঞ্জনবাবু করলেন ৩২টি, যার অধিকাংশই বিমলেন্দুবাবুর বইয়ে রয়েছে। শ্রী মণ্ডলের এখানে বড়জোর একটু আধটু পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। নিরঞ্জনবাবু কৃষিজীবী ও কৃষি সরঞ্জাম অধ্যায়ে 'সুন্দরবন এলাকায় চাষ করা আমন ধানের নাম' শিরোনামে ৫৬টি ধানের নাম রাখলেন, বিমলেন্দুবাবু তাঁর বইয়ে রেখেছেন ৫৮টি। নিরঞ্জনবাবুর নামগুলির অধিকাংশই বিমলেন্দুবাবুর তালিকায় রয়েছে, এখানে একটু সাজানো আকারে এই যা।

       ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "১৯৬৮ সালে কামিনীকুমার রায়ের 'বাংলা ভাষার অভিধান' সে সময়ের চাহিদা কিছু পূরণ করেছিল।" উক্ত সালে কামিনীকুমার রায়ের 'লৌকিক শব্দকোষ' নামে অসাধারণ বইটি প্রকাশিত হয়েছে বলেই জানি, 'বাংলা ভাষার অভিধান' বলে তাঁর কোনও গ্রন্থ আছে কি না বর্তমান আলোচকের জানা নেই। নিরঞ্জনবাবু বলেছেন, 'কথ্যভাষা গ্রাম্য ভাষা'; কামিনীকুমার তাঁর ভূমিকায় 'গ্রাম্য' শব্দটি একাধিকবার ব্যবহার করলেও, শব্দটি সম্মানার্থে ব্যবহার করা হয় না বিবেচনা করে তার বদলে 'লৌকিক' শব্দ ব্যবহার করে নিজের বইয়ের নাম দিয়েছেন 'লৌকিক শব্দকোষ'। শ্রী মণ্ডল যেখানে অঞ্চলভেদে ভাষার বা উচ্চারণের রূপভেদের কথা বলেছেন অথচ বইয়ে কোথাও প্রায় তা নির্দেশ করেননি, কামিনীকুমার সেখানে প্রতিটি শব্দের পাশে কোন অঞ্চলে কী উচ্চারণে প্রচলিত তাও নির্দেশ করেছেন এক দীর্ঘ বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে। নিরঞ্জনবাবু যেখানে মান্য চলিত বাংলা শব্দ হামেশাই গ্রহণ করেছেন সেখানে কামিনীকুমার ঘোষিতভাবেই মান্য চলিত বাংলাকে তাঁর শব্দকোশে ঠাঁই দেননি। 

       শ্রী মণ্ডল তাঁর ভূমিকায় স্বচ্ছন্দে একাধিকবার 'নিম্নবর্ণের' শব্দটি বসিয়েছেন, এটি সচেতন প্রয়োগ কি?

       ছেউনি লক্ষীকান্তপুর এলাকার আঞ্চলিক শব্দ বলেছেন তিনি আমাদের মগরাহাট থানাতেও এই শব্দটি সমধিক প্রচলিত, আগে জল সেচের এই সরঞ্জাম ছেউনি ছিল বেতের তৈরি। আদতে ছোট খড়ার গায়ে দড়ি বেঁধে দু-দিকে দুটি করে বাড়তি দড়ি থাকত দু-জন লোক দু-হাতে করে ধরে জল ছেঁচার জন্যে। একে তাই জল ছেঁচার খড়াও বলা হত। পরে অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ইত্যাদিতে এইভাবে জল ছেঁচা শুরু হয়।

       পিছনে তথ্যঋণ-এ সুজিত কুমার মণ্ডল সম্পাদিত 'বনবিবির পালা' পুস্তক থেকে একটি উদ্ধৃতি দেখা যাক। ধুয়া শব্দ প্রসঙ্গে সুজিতবাবু লিখেছেন, 'পালা গানে মূল-গায়েনের গাওয়া যে অংশটি দোহারের কণ্ঠে একাধিকবার পুনর্গীত হয় তাকে বলা হয় ধুয়া বা ধুয়ো।' শ্রী মণ্ডল ধুয়া/ধুয়ো শব্দে লিখেছেন, 'পালাগানে মূল গায়েনের গাওয়া যে অংশটি দোহারের কণ্ঠে একাধিকবার গাওয়া হয় তাকে বলা হয় ধুয়ো।' বর্তমান আলোচকের বিশ্বাস, কেবলমাত্র সংকলন গ্রন্থ হিসাবে দেখতে গেলেও, এমন উল্লেখের ক্ষেত্রে কার থেকে সংকলিত তা স্পষ্ট হওয়া উচিত বইয়ে।

       শ্রী মণ্ডলের তোলা আলোকচিত্রে জাল ফেলার মানুষটির ছবি এসেছে অনবদ্যভাবে, কিন্তু একটি সুচারুভাবে-পড়া-জালের ছবি হলে ভাল হত।

       আলোচনায় আর বেশি কিছু বলছি না আমরা। শ্রী মণ্ডল একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তার জন্যে তিনি অবশ্যই ধন্যবাদার্হ, কিন্তু আরও খানিক সুষ্ঠুভাবে কাজটি হতে পারবে এই আশা করব আমরা। বিশেষত আরও অজস্র শব্দ যেখানে এমন কোষগ্রন্থে আশ্রয়প্রত্যাশী। আমরা আশা রাখি এ বইয়ের দ্রুত সংস্করণ হবে এবং সযত্ন সেই পরবর্তী সংস্করণে তা আরও সমৃদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে সকলের কাছে। অনেক শুভেচ্ছা।


পুস্তক : সুন্দরবনের আঞ্চলিক শব্দকোষ

সংকলক : নিরঞ্জন মণ্ডল

প্রকাশনী : গাঙচিল

প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০২১

মূল্য : তিনশো টাকা 

       



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক