গুড়
সন্তু চ্যাটার্জি
বাজারের থলেটা নামিয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজে চোখ রেখেছে বাতান ...
অমনি,
শুনছো !! বলছি, খেজুরগুড়ের ওখানে যাও না গো একবার। খানিকটা গুড় লাগতো।
রোজকার সকালের এই এক ফিরিস্তি । একবারে কিছুতেই বলবে না বাজার -দোকান থেকে ঠিক কি কি আনতে হবে। ফলে দৌড়াও চোদ্দবার । জিনিসপত্র আনতে দেওয়ার ব্যাপারে কেন যে এমন চূড়ান্ত গোপনীয়তা, না নিছকই স্মৃতিভ্রম ?
বাতানের কাছে তা আজও রহস্যই রয়ে গেলো।
যাইহোক , কাগজের পাতা উল্টোতে উল্টোতে খানিক বিরক্তির সুরে বাতান জবাব দেয় "না, না, আজকে আর হবে না। কাল সকালে দেখবো "।
ব্যাস, ক্যাসেট শুরু " তুমি কি ভাবলে আমি খাব বলে আনতে বলছি? কখনোই না। কোনোদিন কি বলেছি? কালকে মা বলছিল অনেকদিন পাটিসাপটা খায়নি , তাই ভাবলাম...যতই হোক বয়স্ক মানুষ তো, মুখের উপর না বলি কিভাবে?
নিত্যদিনের পাঁচালী পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিকই ছিল, কিন্তু শেষের কথাগুলো বাতান কে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতে বাধ্য করলো ।
।। দুই ।।
ধুর ,ধুর এইভাবে হয় নাকি ? ওনার গুড়ের যা ডিমান্ড ! প্রায় প্রতিদিন তৈরি হতে না হতেই সব শেষ হয়ে যায়। প্রয়োজন আগের দিন না জানালে দিনের দিন পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। এখন এইসব কে বোঝাবে? তাও দেখে আসি , যদি দৈবাৎ এক-আধটা সোনালি ঢেলার দেখা মেলে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাতান গুড়ের দোকানের সামনে এসে দেখে, দোকানি ও তার হেলপার খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার বাসনপত্র ,মাটির কলসি ইত্যাদি ধোয়াধুয়ি শুরু করে দিয়েছে। বাইক থেকে নেমে দোকানের সামনে এগিয়ে যেতেই ,,
দোকানি সংকোচের সাথে জানায়, "দাদা আজকে যে একদমই হবে না গো । এই অসময়ের বৃষ্টিতে রস অনেক কমে গিয়েছে , তার ওপর অর্ডার ও বেশকিছু বাকি ছিল। আপনি বরং কাল সকাল-সকাল আসুন অবশ্যই ব্যবস্থা করে দেব"।
সব কথা মন দিয়ে শুনে বাতান বেশ নরম গলায় বলে " আসলে মা হঠাৎ পাটিসাপটা খেতে চাইলো কিনা, তাই একবার খোঁজ করতে এসেছিলাম আর কি । আচ্ছা দাদা, ঠিক আছে।
কথা কটা বলে বাতান বাইকের দিকে মুখ ঘোরাতেই পেছন হতে দোকানি তাকে দাঁড় করায়। অবাক চোখে বাতান দেখে, দোকানি তার খেজুর পাতা, প্লাস্টিক ও বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের ভেতর হতে, হাতে একটা কাগজে মোড়া প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে আসছেন।
"দেখুনতো এই কেজি খানেক এ হবে কিনা? আসলে এইটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলাম ছেলেটার জন্য। কাল ওর জন্মদিন কিনা"।
দোকানির মুখে কথাগুলো শুনে বাতান এর বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। প্রায় সাথে সাথে বলে ওঠে ,
"না, না দাদা এটা তো আমি নিতে পারবো না"। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দোকানি প্রায় জোর করে তার হাতে প্যাকেটটা গুঁজে দেয়। একগাল হেসে বলেন, "আপনারা হলেন আমার লক্ষী, আপনাদের ভোগ না দিলে আমার ও আমার পরিবারের যে ভারি অকল্যাণ হবে"।
।। তিন।।
বাতানের কেমন যেন সব ওলট-পালট হয়ে যায়।
তীক্ষ্ণ এক অপরাধ বোধ তাকে বিদ্ধ করতে থাকে । তবে শান্তি আসে বাড়ির মানুষটার কথায়।
"গুড়টা নিয়ে তুমি মোটেই ঠিক কাজ করোনি , তবে যখন নিয়েই নিয়েছো তখন আর কষ্ট পেয়ো না ।আমি আজ রাতেই ওই গুড়ের কিছুটা দিয়ে ছেলেটার জন্য পায়েস বানিয়ে দিচ্ছি, তুমি কাল সকাল সকাল গিয়ে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে এসো"।
সাব্বাশ!! এই না হলে বেটার হাফ। জিতে রাহো darling .
।। চার ।।
সকল সকল স্টিলের টিফিন বাটিতে পায়েস নিয়ে বাতান রওনা দেয় । মনটা তার আজ এক দারুণ আমেজে ভরে আছে। পায়েসটা হাতে পাওয়ার পর দোকানি ভদ্রলোকের ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা দেখতে তার যেন আর তর সইছে না। শীতের সকালের কাঁচা মিঠে রোদ মেখে , গুনগুন করতে করতে, বাইকের এক্সেলেটর এ চাপ দিয়ে বাতান হাওয়ার বেগে এগিয়ে চলে।
ছন্দপতন ঘটল দোকানের সামনে এসে ।
একি !!! দোকান যে পুড়ে ছাই !! ইতি উতি ছড়িয়ে থাকা ভাঙ্গা কলসি, ভাঙ্গা বাসনপত্র, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া উনুন এক বিধ্বংসী ঝড়ের জানান দিচ্ছে । ভাঙ্গা পোড়া দোকানের এক পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা হেলপার ভদ্রলোকের দিকে বাতান ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।
কি হয়েছে জানতে চাইলে ভদ্রলোক ফুঁপিয়ে ওঠে,বলেন ,
"কাল আপনি চলে যাওয়ার পর বাইক নিয়ে পাঁচ ছয়টা ছেলে এসে দাদাকে গুড় দেওয়ার জন্য জেদাজিদি করতে থাকে। দাদা ও আমি তাদের অনেক বুঝিয়ে বললেও তারা কিছুই শুনতে চাইনি। নিমেষের মধ্যে আমাকে ও দাদাকে মারধর করতে শুরু করে। আমি কোন রকমে পালিয়ে যাই কিন্তু দাদা পালায়নি। দাদার খুব লেগেছে, হসপিটালে ভর্তি । গুড় না পেয়ে ওরা সব ভেঙে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো গো দাদা বাবু। আমাদের যে আর কিছুই রইল না"। বলেই ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে, দরিদ্র মানুষগুলোর উপর মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা শুনতে শুনতে বাতানের গা গুলিয়ে উঠছিল । গভীর শোকে মুহ্যমান বাতান যেন হঠাৎ করে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাতানের চোখের সামনের জগত ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে অন্ধকার হয়ে আসছে। তবে এরই মাঝে বাতান অবাক বিস্ময়ে অনুভব করে , এখনও তার হাতে ধরা ছোট্ট স্টিলের টিফিন বাটি থেকে গুড়ের গন্ধ যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।।
============
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন