Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। উষ্ণতার সান্নিধ্যহীনতা ।। সৌমেন দেবনাথ

উষ্ণতার সান্নিধ্যহীনতা 

সৌমেন দেবনাথ 


দিন এসেছে দিন গিয়েছে। সব দিন যে সুখের জন্য এসেছে বা সুখ বয়ে নিয়ে এসেছে তা নয়, আবার সব দিন দুঃখও বয়ে আনেনি। স্বাচ্ছন্দ্য যে ছিলো বলবো না, আবার অস্বাচ্ছন্দ্যও ছিলো না। দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি, সমস্যা যত ছিলো তারচেয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতাও কম ছিলো না। মৃত্যুকে কখনো কামনা করিনি, বেঁচে থাকার আকুতি বেশী ছিলো বলে। আমার স্বামীর সাথে তার ভাইদের মতভেদ হয়েছে, আমার স্বামী তার মাকে বিশেষ কারণে বড় কথা বলেছে, প্রতিবেশীদের সাথে আমার স্বামী বাক-বিতণ্ডা করেছে, কিন্তু আমাকে কোনদিনও আঘাত দিয়ে কথা বলেনি, আঘাত করেনি। আমার স্বামী বলতো, তোমাকে দুঃখ কী বুঝতে দেয়নি, কষ্টের থাবার থেকে দূরে রেখেছি, দারিদ্র্যের চোখ রাঙানী তোমাকে পেতে দেয়নি, রোগ-ব্যাধি তোমাকে শাশানী দেয়নি, সমস্যাও তোমার জীবনে এসে দাপাদাপি করতে পারেনি। শত বিপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করেছি, নিজের শরীরকে প্রাচীর করে। বিনিময়ে তোমাকে কিছু দিতে হবে আমায়! আমি ভ্রূ কুঁচকে ভাবতাম, কি চায় ও আমার কাছে! ও এত উজাড় করে দিয়ে নিঃস্বকে ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিচ্ছে, নিঃস্বর কাছে সে কি চায়, নিঃস্বর কাছে এমন কি দেখলো যে, এত কিছুর বিনিময়ে সেটি সে পেতে চায়! অনেক পরে বুঝতে পারি। আসলে ওর হৃদয়কে বোঝার সে হৃদয় আমার ছিলো না। ওর হৃদয়ে আবেগের প্রাবল্য ছিলো, আমি ছিলাম ঠিক ঊষর জমির মত নীরস। ওর কারিশমাময় ব্যক্তিত্ব আমার বন্ধ হৃদয়ে বারবার টোকা মেরেছিলো, আমি বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম, তখন আর দেরী করিনি, ও যে জিনিসটি বিনিময়ে পেতে চেয়েছিলো, আমি সেটি ওকে বিনা বিনিময়ে দিয়ে দিয়েছি। ভাবি, নিঃস্বর ভেতরও এমন কিছু থাকে, যা অন্যের চোখে অনেক মূল্যবান। সেটি বিনিময় করলে নিঃস্ব আর নিঃস্ব থাকে না। নিঃস্ব হয়ে যায় মহাশ্চৈর্যের অধিকারী। আজ আমার হৃদয়ের সকল ভালোবাসা ওর জন্য, আমার একান্ত মনের ন্যূনতম সুখটুকুও ওর জন্য। আগামীর পথ চলাটাও ওর জন্য। বেঁচে থাকাও ওর বেঁচে থাকার উপর। ও আমার জীবনের আর এক অংশ, আমার জীবনের আর এক নাম, আমার সুখের আর এক নাম। আমার সুখ।
আমার ভাগ্যাহত কপালের এলোকেশগুলো সরিয়ে দিয়ে ও যখন আমায় উষ্ণ পরশ দিতো আমি ব্যাপক বিরক্তিবোধ করতাম। আমার স্বামীর এহেন কাণ্ডকে আমি উত্যক্ত জ্ঞান করতাম এবং নির্লজ্জ, বেহায়া বলে সম্বোধন করে বড় বড় কথা শুনিয়ে দিতাম। অথচ আমার স্বামী এক তিল কণাও রাগ প্রকাশ করতো না, আমার পাশ থেকে সরতো না, আমাকে একা থাকতে দিতো না, আমি ওর থেকে পালিয়ে থাকার চেষ্টা  করতাম। তখন ভাবতাম, ওর থেকে পালালেই বুঝি বাঁচা। এখন বুঝি, স্বামীর স্পর্শের মর্ম। আজ বুঝি, স্বামীর স্পর্শ স্ত্রীর জন্য কী! আজ বুঝি, স্বামীর আদর স্ত্রীর জন্য কত বড় প্রাপ্তি! আজ বুঝি, স্বামীর সান্নিধ্য কত বেশী সুখের! স্বামীর সান্নিধ্যে না থাকলে কোনো নারী কি বসন্তের মানে বোঝে! আসলে যে নারী বোঝে না ভালোবাসা, সে নারী বেঁচে থাকার স্বার্থকতা কিসে তা জানে না। যে নারীর জীবনে ভালোবাসার মানুষটি আজো আসেনি, সে নারী বোঝে না জীবনের সবচেয়ে রঙিন অংশ কি!
আজ বুঝতে পারি, আমার ছোট ছোট ভুলগুলো আমার সুখ নামক পাখিটিকে কত দূর বিতাড়িত করে দিচ্ছিলো। আজো যদি সেই ভুলকে আঁকড়ে থাকতাম, তবে হয়ত মাটির সাথে মিশে যেতাম। বুঝতে পারছি একটি ভুলের অনেক ক্ষমতা। সে নষ্ট করতে পারে একটি দিনকে, একটি মাসকে, এমনকি একটি জীবনকে। ভুল একটি হাজার বাকল বিশিষ্ট বৃক্ষ। সেই বাকলগুলো আরো পাঁচজনের মনের বিরুদ্ধে যেয়ে জীবনকে, জগৎকে বিষময় করে তোলে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই, একটি ভুলকে মহাভুলে রূপান্তর করার পূর্বেই আমি আমার লাগামকে ভালো ভাবেই টানতে পেরেছি। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছি, আর ভুল নয়। এবার ভুল হয়ে গেলে আর সহ্য করতে পারবো না। সব ভুল সব সময় সমান আঘাত দেয় না। পূর্বের ভুলে মজা পেতাম, এখন ভুল হলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে।
আমাদের জীবনের প্রথম রাতে আমার স্বামী যখন রুমে প্রবেশ করে তখন তার মোবাইলে একের পর এক কল আসতেই থাকে। কে কি বলছিলো আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। এবং বুঝতেও পাচ্ছিলাম। এক বন্ধু ওকে বললো, ঘরের লাইট যেন বন্ধ করিস না। জীবনের প্রকৃত মজাটা কিন্তু অন্ধকারে মাটি হবে।
আমার স্বামী তার বন্ধুটিকে ফাজিল বলে কলটা কেটে দিয়ে নিজের মনেই হাসতে থাকে। পরক্ষণে আবার কল আসে। সেই বন্ধুটি বললো, বেশী ভদ্র সাজতে গিয়ে নিজের আয়েশ না মিটিয়ে মনে মনে ইশপিশ করার দরকার নেই। যখন যে কাজটি করতে হয় তখনই সেটা করাই শ্রেয়। সময় গেলে কিন্তু ফোঁসফোঁস পাবি। বিষাক্ত সর্পকে বোঝার চেয়ে তাকে ধরেই নির্বিষ করতে হয়।
আমার স্বামী তাকে পাজী আর জ্ঞানী বলে কলটা কেটে দেয়। ভ্রূ কুঁচকে একটা মিনিট বসে থাকতেই আবার কল আসে। সেই বন্ধু বললো, এ রজনী জীবনে এক বারই আসে। কভু বৃথা যেতে দিবি না। যে কাজ হয় না বাসর রাত, সে কাজ হয় না আশ্বিন কার্তিক মাস।
আমার স্বামী যেন এক প্রকার বিপদে পড়ে গেলো। ও কলটা কেটে দিয়েছিলো রাগে। আমার শরীরে ঘাম দিতে শুরু করে আর গলা শুকাতে থাকে। এ রাত স্বামীর জন্য যত সুখের, যত সুখকর, স্ত্রীর জন্য তত নয়। স্ত্রীর জন্য ভয়ের যত, লজ্জারও তত। এ রাতের জন্য নরের মত নারীও অপেক্ষা করে, কিন্তু নরের তার পিছনে থাকে লোভ আর নারীর থাকে বিপদের, আশংকার। এ রাতে নারী তার সবচেয়ে আপন পুরুষের কাছে থেকে অমৃত ব্যবহার চায়, বোঝা পড়ার প্রারম্ভেই জীবন চলার চিত্রটা আঁকতে চায়, শিকারে থাকতে চায়, কিন্তু শিকার হতে চায় না। নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়, কিন্তু নিজেকে দিতে চায় না। বেশ পরে আমার স্বামীর সেটে আবারও কল আসে। সে বন্ধু বললেন, ব্যস্ত একটা দিন পার করলি, জানি এখনো ব্যস্ত আছিস। ব্যস্ত থাকিস থাক, ব্যস্ত রাখিস ঠোঁট, ব্যস্ত রাখিস হাত।
আমার স্বামীর রাগ হয়ে গেলো। ও সেট বন্ধ করে দিলো। ও আমার সামনে এসে বসলো, আমাকে এক মিনিট অপলকে দেখলো, কিন্তু কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না। হয়ত আমার রূপে ও মুগ্ধ হয়েছিল, নতুবা ক্রুদ্ধ। বেশক্ষণ পরে আমার নাম সম্বোধন করে বললো, রাজন্যা, আর দশটা পুরুষের মত আমি ধ্যান-ধারণা পোষণ করি না। আমি ভদ্রতার মাপকাটিতে পিছিয়ে ছিলাম না, তোমার চোখেও অভদ্র হতে চাই না। আমি কখনো কারো মতামত ভিন্ন কোনো কাজ একার সিদ্ধান্তে করিনি। এ কারণে আমি ঠকি কম। তোমার মতামত ভিন্ন তাই কোনো কাজও করবো না। জীবনে সুখী হতে হলে অনেক ধৈর্য ধারণ করতে হয়, যাকে নিয়ে পরবর্তী জীবনটা চলবো তাকে আমি আর যায় করতে পারি, নির্যাতন করতে পারি না। জীবন সাগরের আমরা দুই নব যাত্রী, আমাদের পথ এক মোহনায় মিলেছে। আজ সর্বোচ্চ আমি তোমার হাত ধরতে পারি, যার অর্থ আজ থেকে তুমি আমার চলার পথের সাথী, তাই-ই নয় আমিও তোমার চলার পথের সাথী। আমার জীবন নৌকায় তুলে নিলাম তোমায়, কভু এমন কাজ করো না, যাতে আমি অন্যের কাছে ছোট হই, পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হলে, সুখ আমাদের থেকে ছেড়ে যাবে না। কী হাতটি ধরতে দেবে? আমি জোর করে তোমার হাত ধরবো না।
আমি আমার হাতটি সভয়ে ওর হাতের উপর রাখি। ওর হাতে হাত রাখতেই আমার যে কি ভালো লেগেছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। আজো সে আমার হাতের থেকে হাত সরাইনি। একটি দিনও আমাকে কষ্ট দেইনি। আমার পাশ থেকে সরে যায়নি। আজ আমার পুরুষটি আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নিজের স্বামী বলে বলছি না, আমার স্বামীর মনে কোনো পাপ নেই। নির্ভেজাল একজন মানুষ ও। ওর কথা, আমার পাঁচটি ভালো বান্ধবী থাকতে পারে, তেমনি তোমার পাঁচটি ভালো বন্ধু থাকতে পারে। সবার সাথে মিশবে, সবাইকে সময় দেবে, কিন্তু শালীনতার পরিচয় দেবে৷ হাত তোমার, পা তোমার-কোনটিকেই আমি বাঁধতে পারি না। কিন্তু ঐ মস্তিষ্কে আছে তোমার নীতি। বিবেকবর্জিত কাজ করলে ঐ মস্তিষ্কে আমি নাড়া দিতে পারি, তাতে তোমার হাত যা ইচ্ছা তাই করবে না, পা বিপথে পা বাড়াবে না। স্নানের নামে তুমি শরীর ভাসিয়ে দিতে পারো না, আনন্দের নামে তুমি নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারো না। যা করবে নীতিকে আঁকড়ে করবে। জ্ঞানত অন্যায় করবে না।
আমি আমার স্বামীর কথা আজো মেনে চলছি, তাই আমার সুখের শেষ নেই, শত্রুরও।
অন্যের সুখে ঈর্ষান্বিত হওয়া মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। অনেকে অনেক কথা বলেন। সব আমার কানে না আসলেও অনেক কথায় কানে আসে। কেউ আবার শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন। কেউ বলেন, স্বামীর গুণেই স্ত্রী গুণান্বিত। স্ত্রী যদি উচ্চ শিক্ষিত হয় আর স্বামী যদি পাগল হয়, সবাই তাকে পাগলের বৌ-ই বলেন।
আর একজন বলেন, বোয়াল মাছের পেডি নরম, ভালো মানুষের বেডি নরম। স্বামীর দ্বারা স্ত্রী তো প্রভাবিত হবেই।
আবার কেউ আমার পূর্ব ইতিহাস তুলে বলেন, লোহা জব্দ কামার বাড়ি, মেয়ে জব্দ শ্বশুরবাড়ি।
আর একজন একই সুরে বলেন, মরিচ সড়ো শিলে, বৌ সড়ো কিলে।
যে যায় বলুক না কেনো আমার স্বামী আমাকে শাসন করে, প্রহার করে কিংবা অন্যায়শক্তি প্রদর্শন করে জয় করেনি। হৃদয়ের শক্তি প্রয়োগ করেই ও আমায় জয় করেছে। ওর হৃদয়ের শক্তি প্রবল। তা দিয়ে আমায় এমন কষে বেঁধেছে ছুটে গেলেও ফিরে আসতে হবে। অযাচিত ভাবেই জীবনের মহামূল্যবান জিনিসই পেয়েছি। এখন আমার মৌলিক চাহিদা তাই পাঁচটি নয়, ছয়টি।
একবার আমার স্বামী প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ যায়। পাড়ার লোকজন আমার শ্বাশুড়িকে ঘিরে ধরে হেসে হেসে বলতে লাগলেন, সুন্দরী বৌ ঘরে ফেলে বাইরে গেলে তা ফিরে পাওয়া যায় নাকি?
অন্যজন বললেন, দেবর সম্পর্কীয়দের সাথে দেখিস এবার বৌটির কথা-বার্তার মাত্রা বেড়ে যাবে।
আর একজন মহিলা নাক মুখ বাঁকিয়ে বললেন, বিয়ে করে বৌকে রেখে যাওয়া মানে বৌকে নরকে রাখা। নরকে কি সে নারী থাকে! এখন তো স্বামীর সাথে মোবাইলে কথা বলছে, দেখিস কিছু দিন পরে আর তেমন মিষ্টি করে কথায় বলবে না।
এক অল্প বয়স্কা নারী বললেন, দুরত্ব বাড়লে অনুভব বাড়ে। অনুরাগ না কমে বরং বাড়েই।
একজন বয়স্কা মহিলা তাকে গরম দিয়ে বললেন, দূর, তুই জানিস না কিছু। যৌবনের খাই বড় খাই। একবার যে নারী ঐ স্বাদ পেয়েছে, সে স্থির থাকতে পারে না। বিবেক তার লয় যায়। দেখিস ও বৌ রিক্সাওয়ালার হাত ধরে পালাবে।
আরো দুইজন মহিলা ঐ মহিলাটিকে সায় দিলেন। অন্যজন বললেন, লাজ-লজ্জার ঘাটতি আছে বৌটির। পর-পুরুষকে ঘরে জায়গা দেবেই দেবে।
এসব কথা ঘরে থেকে সব শুনলাম আমি। আমার শ্বাশুড়ি তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন, তার বৌমাকে নিয়ে এত বাজে বাজে কথা বলছে অথচ একটি কথাও না ধরে বরং আমার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এসব কথা স্বামীকে বললাম। স্বামী আমাকে বুঝিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। স্বামীর সান্ত্বনায় আমি সব ভুলে যাই।
এ রকম সমালোচনার সিংহভাগই আমার কপালে জোটে। নিন্দুকদের কথাগুলো আমাকে যেন উজ্জীবিত করে। আমি পথ চলি বুঝে শুনে। সকল কাঁটা ধন্য করে আমি হয়েছি জয়ী। আমার স্বামী আমায় বিশ্বাস করে, তার বিশ্বাসের কোনো অমর্যাদা আমি করতে পারি না। বিশ্বাস থেকে যে আশা জন্মায়, তার নাম ভালোবাসা। আর এ এমনি ভালোবাসা যা ঠুনকে নয় যে, একটু ঝড়ে ভাঙবে। স্বামী আমাকে আদর করে দিয়ে বলে, সমাজে এমন কীটের অভাব নেই। সব হয় ওদের, শান্তি হয় না। মনোভাব পরিবর্তন হয় না। সুন্দর পৃথিবী ওদের চায় না, সুন্দর পৃথিবী ওদের ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। সুখ থাকে না পথে পড়ে। আমরা বেঁচে রবো একে অপরের জন্য। সুখ তো তখন কেবল মামুলি। অনুভব দিয়ে ভালোবাসা হবে প্রগাঢ়তর। মেঘের থেকে কিছুটা জল চেয়ে আঙিনায় ভিজবো দুইজন। মধ্যরাতে জ্যোৎস্নাস্নানে একাকার হয়ে যাবো। তুমি এমন করে এঁকে দেবে ভালোবাসার চিহ্ন যেমনটা করলে মনটা শান্তি পাবে। হবে অভিমান, অভিমান কখনো জিতবে না, জিতবে ভালোবাসা।
আমার স্বামীর মুখের বাক্য আমার লাগে অমিয় সমান। ওর মুখের কথা আমার জীবনের সংলাপ। ওকে ছাড়া আজ এক পা এগুতে পারবো না। যা সকলে আশা করে আমি হাতে তাই পেয়েছি। সুনীল আকাশের একমুঠো নীল পেয়েছি। আজ সুখ-শান্তি কল্পিত নয়। জীবনের দৈনন্দিন লেনদেন সব জাবেদায় লিপিবদ্ধ করায় খতিয়ান করতে সমস্যা হয়নি। রেওয়ামিল মিলে যাওয়ায় আমাদের প্রেম আছে তেমনি। বৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে আমার স্বামী, যা আমাদের আর্থিক অবস্থাকে করেছে আচ্ছা, হিসাব বলে সব হিসাব রেখেছি। আমার স্বামী আমাকে পণ্যজ্ঞান করেনি, ভোগের সামগ্রী ভাবেনি। ও আমাকে ব্যালেন্স শীটের দায় পাশে রাখেনি, রেখেছে সম্পদ পাশে। সংসার নামক শিল্প প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত কাঁচামাল দিয়েছে। উৎপাদন তাই ব্যাহত  হয়নি। লজ্জায় আজো সরাসরি বলতে পারিনি, আমি তোমায় ভালোবাসি। এবার প্রশ্ন পেলে বলবো, প্রেমের নিক্তিতে মেপে দেখো আমি তোমায় কত কিলোগ্রাম ভালোবাসি!
আমি দেখেছি সাংসারিক কাজে কিছু থেকে কিছু হলেই আমার বাবা আমার মাকে বকতেন। শাসন করতেন। কিন্তু আমি সংসারে নিজের অগোচরে কত অনাকাঙ্ক্ষিত কাজই করে ফেলি। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে বকে না। শাসন করে না। বরং বুঝিয়ে বলে। শিখিয়ে দেয়। আমি হতবাক হই। দুটো পুরুষে আমি পার্থক্য দেখি। বলছি না আমার বাবা খারাপ। কোন বাবাই খারাপ না। কিন্তু স্বামী তো খারাপও হয়। বাবা শাসন করতেন, বকতেন, এগুলোও দরকার আছে। বাবা আমাকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন কিন্তু মায়ের উপর তো কষাঘাত করতেন। মায়ের কথার মূল্য ছিলো না, মা কথা বলার সাহসও করতেন না। কিন্তু আমার অভাগা মা বাবাকে অন্যের কাছে উপস্থাপন করতেন অনেক বড় করে, সুন্দরের চেয়েও সুন্দর করে। বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসার কমতি ছিলো না।
ছোটবেলা থেকেই আমার মিথ্যা বলার স্বভাব ছিলো। মিথ্যা বলে বলে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতাম। বাবাকেও মিথ্যা বলে বলে টাকা নিতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতাম। রেজাল্ট ভালো না হলেও বাড়ি এসে মা বাবাকে বলতাম রেজাল্ট ভালো হয়েছে। স্বামীর সাথেও মিথ্যা বলতাম। আমার স্বামী আমাকে অকপটে বিশ্বাস করতো। এক সময় জ্ঞান ফিরলো, এত মিথ্যা বলি, অথচ সে আমাকে বিশ্বস্ততায় রেখেছে। মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলাম। ভালো মানুষের সংস্পর্শে থাকলে খারাপও ভালো হয়ে যায়। আমার ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে গেলো ওর উজ্জ্বলতায়। কি দারুণ একটা মানুষ, কি দারুণ আচার আর কি দারুণ সুবিন্যস্ত চিন্তা! কখনো কোনদিন রেগে কথা বলেনি। কিভাবে রাগ করবো তার উপর! রাগ উঠার আগেই তার মহান ব্যক্তিত্ব আর দায়িত্বসুলভ ব্যবহারে রাগ কর্পূরের মত উড়ে যায়। সে আমাকে তার করে নেয়ার যে চেষ্টা করেছে আমি তার না হয়ে আর পারিনি। এখন সে যত ভালোবাসার চেষ্টা করে তারচেয়ে চেষ্টা বেশী করি আমি। যত সম্ভব ভালোবাসি, প্রকাশ করার চেয়ে কর্ম আর অনুভব দিয়ে বেশী বুঝিয়ে দিই।
এক মানুষের সুখ অন্য মানুষের সহ্য হয় না। আমাদের সুখও মানুষের সহ্যের বাইরে চলে গেলো। কেউ কেউ আমাদের উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছে, কেউ কেউ আমাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছে। কে বা কারোর বৌ আমাকে নিয়ে আমার স্বামীর কাছে নালিশ করেছে। আমি কিভাবে বুঝলাম? বাইরে থেকে এসেই আমার চোখে চেয়েই আমার স্বামী একটা অমলিন হাসি দেয়। যখন তার মুখে অমলিন হাসি দেখলাম না, বুঝলাম কেউ তার মুখে গরল দিয়েছে এবং গরলের পরিমাণ বেশ বেশীই। আমি কি হয়েছে বলতেও পারলাম না, আমাকে ও হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। আমি ওর এমন গম্ভীর মুখ কখনো দেখিনি। আর এমন শক্ত হতে কখনো দেখিনি। যার হৃদয় যত কোমল রেগে গেলে ঘটে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বাবা রেগে গেলে দেখতাম মাও রেগে যেত, ঘটে যেত ঘটনা দুর্ঘটনা পর্যন্ত । আমি মায়ের মত উচ্চবাক্য না করে চুপ থাকলাম। আমি জানি ওর রাগ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। ওর রাগ ও সংবরণ করে নেবে তাও জানি। কি করে না করে তাই অনুসরণ করছি। দেখলাম ও খুব অস্থির। এমন অস্থির ওকে মানাচ্ছে না। ওকে শান্ত করবো, তাও সাহসে কুলাচ্ছে না। ভুল বুঝতে পারলে ক্ষমা চেয়ে নেয়া যেত। কিন্তু কি ভুল করলাম যা মানুষের চোখে পড়লো, আমাকে ভুল ধরিয়ে দিলো না, স্বামীকে বলে তাকে বিষিয়ে দিলো! খুব খারাপ লাগছে। খেতে দিলাম। শান্ত ছেলের মত খেয়ে উঠে গেলো। এক গাল ভাত ও আজ গালে তুলেও দিলো না।
খেয়ে ও বিশ্রাম নিতে গেলো। আমি পিছন পিছন এলাম। ওর নিষ্প্রভতা আমাকে আরো নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে। মুখ ফুঁটে বলেই ফেললাম, আমার অজান্তে আমি যদি কোনো ভুল করি আমাকে ক্ষমা করো।
চুপ করে থাকলো সে। আমি বললাম, আমার ভুলটা কি আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না! 
কোনো কথা সে বলছে না। ওর চিবুক ধরে ঝাঁকিয়ে দিলে ও খুব খুশী হয়। ভাবলাম একবার চিবুক ধরে আচ্ছামত ঝাঁকিয়ে দিই। সাহসে বেড় পেলো না। ওর ঘুম আসছে না। আবার বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে, ভুল করেছিই। স্বীকার করলাম। আর গোমড়া মুখে থেকো না। 
ও ঘুমানোর জন্য খুব চেষ্টা করলো, কিন্তু ঘুম আসছে না। যাতে ঘুম আসে তাই চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ও আমার হাতটা সরিয়ে দিলো। আমি আজ আর বেশী অগ্রগামী হলাম না। ও ঘুমিয়ে গেলো। আমি ওর গাল, মুখ, চোখ, কপালে হাত বুলিয়ে অমৃত পরশ দিয়েও তৃপ্ত হচ্ছি না। মানুষটা আমাকে ভুল বুঝেছে। ফেঁটে যাচ্ছে বুকটা, চোখে জল এলো। জলচোখ দেখলে ও বাঁচতো না। ঘুম ভেঙে যদি দেখতো আমার চোখে জল, ওর সব রাগ চলে যেত। আমার সব ভুল ওর চোখে ফুল হয়ে ফুঁটতো।
সকালে অফিসে যাওয়ার আগে ও ওর মাকে ডেকে বললো, মা, তোমার বৌমা যেন বাইরে না যায়। 
মায়ের কেনো প্রশ্নের উত্তর না করে ও চলে গেলো। অফিসে যাওয়ার আগে কত বার ও ফিরে ফিরে দেখতো। আজ সে সব ভুলে গেছে। কে কানে বিষ দিলো, যে বিষে ওর মনের যত মাধুর্য নীল হয়ে গেছে! মা বললো, বাইরে যাও, কার কার বাসায় যাও? কী গল্প করো? সংসারকে কি ছোট করে উপস্থাপন করো?
আমি থমকে গেলাম। আমার সংসার আমার স্বর্গ। আমার সংসারকে মানুষের কাছে ছোট করবো কেনো? মা আবারো বললেন, আমাকে নিয়ে, আমার রবিনকে নিয়ে নিশ্চয় কারো কাছে বিষোদগার করেছো?
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না করে দিলাম। অপ্রত্যাশিত কিছু শুনলেই আমার চোখে জল আসে। একটু সুখের পরশ পেলেও চোখে জল আসে। বাবা যখন মাকে বকতো তখনও মা না কাদলেও আমার চোখে জল আসতো। আমার মা আমার বাবার আচরণে শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি তো আমার স্বামীর থেকে তেমন আচরণ পাইনি যে শক্ত হয়ে নীরস হয়ে পড়বো। নাকি আমার স্বামী এখন থেকে ওমন আচরণই করবে আর আমি শক্ত হয়ে উঠবো? আমার স্বামী কি আসলেই পরিবর্তন হয়ে যাবে! মাকে নির্ভয় দিয়ে বললাম, মা, আপনার অনুমতি ভিন্ন বাড়ির বাইরে আমি আর যাবো না।
মা বিড়বিড় করে বকতে বকতে চলে গেলেন। মা ছেলের মনে আমাকে নিয়ে সন্দেহ প্রবেশ করেছে। অথচ আমি কী ভুল বা কী অন্যায়টা করলাম বুঝতেও পারলাম না। আর কোন প্রতিবেশীর আমি ক্ষতি করেছি যে আমার প্রতিপক্ষ হলো! আমার বিরুদ্ধে আমার স্বামীকে বিষিয়ে দিলো কে! সারাদিন ভেবে ভেবে কূল কিনারা পেলাম না। একবার স্বামীকে ফোন দিলাম, ফোন ধরলো না। ধরলো না ভালোই হয়েছে, নতুবা কি বলতাম!
বাবা যেদিন যেদিন মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতো সেদিন সেদিন মা অভিমান করে চুপ থাকতো না। বাবার জামা কাপড় কেঁচে দিতো। বাবার পছন্দের খাবার রান্না করতো। আমাকে বেশী বেশী আদর করতো। ঘর, বাড়ি সুন্দর করে পরিষ্কার করতো। বাবা দেখে মাকে ধন্যবাদ না দিলেও রাগ থেকে বেরিয়ে আসতো। সব পুরুষ যদি এক চরিত্রের হয়, তবে আমার স্বামীও খুশী হবে। সারাদিন ঘরের কাজে মনোনিবেশ করলাম। প্রতিটি সংসারে স্বামীর মন জয়ের জন্য আমাদের মত স্ত্রীদের কত কিছুই না করতে হয়।
আমি খুব উৎকণ্ঠিত আর চিন্তিত। অফিস থেকে বাড়ি এসে আজ তার ভূমিকা কী হতে পারে ভেবে খুব ভেঙে পড়লাম। কেউ হয়ত তাকে বলেছে বৌ শাসনের কথা। সমাজে বৌ শাসন করা এক প্রকার পুরুষত্ব। হয়ত আমার স্বামীকে কেউ কাপুরুষ বলেছে বৌর সাথে মিলেমিশে মহব্বতে থাকে বলে। যে কোনো কাজে বৌর সাথে পরামর্শ করা, বৌর মতামত গ্রহণ করা আমাদের সমাজ কি ভালো চোখে দেখে?
মন খারাপ হলেও সংসারে মন খারপ করে থাকলে হবে না। বুকে ব্যথা নিয়ে তাই মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করলাম। এভাবে হেসে যাওয়ার গল্প কেউ বোঝে না, কেউ দেখেও দেখে না। ওর বাসায় চলে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে আছি। ও কি বলে না বলে, আর আমি প্রতিউত্তরে কি বলবো না বলবো, মেনে নেবো সব, না যথোচিত জবাব দেবো! বিশ্বাস করেছিলো যাকে তাকে এত ভুল বোঝাটা কতটুকু সমীচীন তার? অপরাধ না করেও যদি শাস্তি পেতে হয়, তবে সেই শাস্তি মাথা পেতে দেয়াও ঠিক না। প্রতিঘাত তো মানুষ তখনই করে যখন আঘাত পায়।
অফিস থেকে ফিরে ও প্রথমে ওর মায়ের কাছে গেলো। সচরাচর তা সে করে না। মায়ের সাথে কথা সেরে শুকনো মুখে আমার সামনে দিয়ে হেটে ঘরে চলে গেলো। চেয়েও দেখলো না। কি কারণে এক দিনেই এত অচেনা হয়ে গেলাম! ভালোবাসার মানুষটাকে সুন্দর করে কষ্ট দিতে একটুও ওর বুক কাঁপছে না। আমি ওর ধারে কাছে ঘেঁষলাম না। হয়ত তার রেগে থাকাতে আমার কোনো প্রশ্ন বিস্ফোরণের উদ্রেক করতে পারে।
শার্ট, প্যান্ট বদলে স্নানে গেলো ও। ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়া ওর শার্ট, প্যান্ট আমি যত্ন করে গুছিয়ে রাখলাম। কি রাগ, রাগ যেন বজ্রাস্ত্র! পুরুষ তো, রাগ তার মানায়, আমি নারী, আমার রাগতে মানা। পুরুষ রাগলে বাদশা, নারী রাগলে রগচটা।
ও স্নান করে এলো। ওকে খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে। শুধু মুখে হাসি নেই। মন চাচ্ছে ওর বুকে যেয়ে লুকাই। আজ কি এক দ্বিধার বেড়া দূর করে রেখেছে! নিরীহ হরিণীটিকে দেখেও কি ওর খুব ভাল লাগছে! খেতে দাও খেতে দাও করে অন্যদিন পাগল করে তুলতো, আজ কিছুই বলছে না। ওর পছন্দের খাবার রান্না করেছি। বললাম, চলো খাবে।
খেয়ে এসেছি কথাটি বলে ও ঘরে যেয়ে ঘুমিয়ে গেলো। বিয়ের পর ও কখনো এক সাঝ বাইরে খায়নি। আমার হাতের রান্না নাকি ওর অমৃত লাগে। মা রান্না করতে চাইলেও আমি মাকে রান্না করতে কখনো দিইনি। আপন মাধুরী মিশিয়ে রান্না করি, ও যে আমার রান্না খেতে মরিয়া। আজ সে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, শুনে এত খারাপ লাগলো বলে বোঝাতে পারবো না। সংসারে আজ আমি কত নেহাত একটা জীব হয়ে পড়েছি। সংসারের এ দুটো মানুষ আজ কত দূরের যেন। মনটা ছটফট করছে শুধু কথা বলবো বলে। কিন্তু কথা শোনার মানুষ নেই।
ও এড়িয়ে চলছে, ওকে অনুসরণ করা কতটুকু সমীচীন ভাবলাম। ওর পিছে লেগে না থাকলে ওর রাগ ভাঙবে না, আরো ভুল বুঝবে। আবার ওর পিছে লেগে থাকলে ও ভাববে অন্যায় করেছি। ক্ষমা পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। যাবো না ওর কাছে! দেখি একা থেকে কত আনন্দ পায়! ধারে থাকলে মূল্যবানকেও মূল্যহীন মনে হয়। নিজেকে মূল্যহীন করে তুলবো না। আমি ঘরে না যেয়ে বাইরে বসে থাকলাম। আজ ঘর আমার ঘর নেই, নিজের ঘরে ঢুকবো তবুও দ্বিধা জাগছে। নারীর ঘর কি খুব সহজপ্রাপ্য? আমার জন্য দরজাটা খোলা আছে, কত নারীর তো ঘরে প্রবেশের দরজাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সারারাত দরজা ঠুকেও পাষাণ স্বামীর মন গলাতে পারে না, এমন নারীও কি সমাজে নেই?
মা এসে বিরক্তির স্বরে বললেন, এত রাতে বাইরে কেনো?
মায়ের প্রশ্নের জবাব সহজ হলেও উচ্চারণ কঠিন৷ ঘরে গেলাম। ও ঘুমিয়ে গিয়েছে। কত আরামের ঘুম! ওর ঘুমন্ত মুখে চেয়ে থেকে ভাবছি, কঠিন তুমি কত কঠিন! তবে অত সহজ হয়ে ধরা দিয়েছিলে কেনো? স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন কেড়ে নিলে কেনো? প্রথম থেকেই নিরাশা দিলে নিরাশার মধ্যে তো আমি বাঁচতে শিখে যেতাম।
শুধু ভাবছি আর ভয় পাচ্ছি, কাকে চুল টেনে দিতাম, নাক টেনে দিতাম, কান টেনে দিতাম! কত ভয়ংকর একটা মানুষ। কথা বলতেও ভয় করছে। অথচ দুইদিন আগেও তার সাথে কত খুঁনসুটি, তর্কতর্কি করেছি। আমিও ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হলাম। যতক্ষণ ঘুম আসেনি, ততক্ষণই ভেবেছি, জীবনটা উলোট-পালোট হতে কত অল্প সময়ই না লাগে! গতবার যখন আমার জ্বর হয়, আমার স্বামী আমাকে কত যত্ন করে সুস্থ করে তুলেছিলো। সারাক্ষণ ভেবেছি আজ রাতেই আমার জ্বর আসুক। কাল সকালে তবে আমাকে সে শুশ্রূষা না দিয়ে থাকতে পারবে না। কাছে আসবে। কাছে থাকবে। কথা নাই বলুক কাছে তো থাকবে। কিন্তু অভাগার স্বপ্ন পূর্ণ হলো না। আমার জ্বর এলো না। ও কাছেও এলো না। প্রত্যাশিতকে কাছে পেতে মানুষ কত অপ্রত্যাশিতও কামনা করে, ভাবা যায়?
যখন ও অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবে, বাঁধা দিলাম, বললাম, তুমি আমাকে এত এড়িয়ে চলছো কেনো? 
ও উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। সামনে যেয়ে ওর চোখে মুখে চেয়ে বললাম, আমি কি এমন করেছি যে এত সন্দেহ করছো? তুমি আমাকে সন্দেহ করতে পারো?
ও খুব বিরক্ত। আমি তোয়াক্কা না করে বললাম, মানুষের কান কথায় কান দিয়ে নিজের স্ত্রীকে ভুল বোঝো? আর আমি কত বড় ভুল করেছি যে, এত শাস্তি দিচ্ছো? 
ও আমাকে শান্ত-শিষ্ট ভাবেই বললো, সরো, অফিসে যেতে দাও। দেরী হয়ে যাচ্ছে। 
আমি আজ ছাড়ার লোক না। বললাম, যাকে বিশ্বাস করো না, যার প্রতি অবিশ্বাস ভর করেছে সে এই জৌলুসে থাকবে না। প্রাণশূন্য ইমারতের মধ্যে সে থাকবে না। সে ভালোবাসা চায়, হয় ভালোবাসবে, না হয় ত্যাগ করবে।
ও দেখলাম একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এত শক্ত শক্ত কথা বলেও ওকে দমাতে পারলাম না। কাজে চলে গেলো। আমি খুব রাগ আর জেদে ঘরে যেয়ে জিনিস পত্র গুছিয়ে নিলাম। কিন্তু ঘর থেকে বের হতে পারলাম না। নারী ভালোবাসার নীড়ে থাকতে চায়, ভালোবাসায় বেঁধে রাখতে চায় সবাইকে। ভালোবাসার মধ্যে বাঁচতে চায়। ভালোবাসা না পেলে ঘর ছাড়তে চায়, কিন্তু ঘর থেকে বের হতে পারে না। অদৃশ্য কোনো এক বাঁধনে সে আটকা পড়ে যায়। ভালোবাসাহীনতায়ও তাই তাকে কত নিশীদিন যাপন করতে হয়। ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করে আবার ঘর সাজালাম। থাক সে তার মত, আমিও থাকবো আমার মত। ভালোবাসা তো আর চেয়ে পাওয়া যায় না। আমার মা তো ভালোবাসাহীনতায় একটা জনম পার করে দিলো। দুটো মানুষ এক ঘরে থাকা আর দুটো মানুষ এক হয়ে থাকা তো এক কথা না। তবুও জীবন চলে যায়। মনের যা দাবী মন না পেলে মনে যে হাহাকার থাকে তা তো বলে বোঝানো যাবে না। তবুও বেঁচে থাকতে হয়, বাঁচার মত না হলেও।
================
 
সৌমেন দেবনাথ
যশোর

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩