বৃহন্নলা
মিঠুন মুখার্জী
দুই হাতে জোরে জোরে তালি দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল দুজন বৃহন্নলা।
তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলল --- "দে বাবু, টাকা দে"। আমি মা-বাবা, মেয়ে
ও বউকে নিয়ে দীর্ঘ নয় বছর পর পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছিলাম। হাওড়া
থেকে সকাল নটা কুড়ি মিনিটের "ধৌলী এক্সপ্রেস"। যখন বৃহন্নলারা আমার কাছে
টাকা চাইলো, তখন আমরা খড়গপুর স্টেশনে। আমি মায়ের কাছে খুচরো পয়সা আছে
কিনা জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলল --- "হাসপাতালে প্রচুর পয়সা খরচ করিস
কিন্তু আমাদের দেবার বেলায় থাকে না?" এরপর তারা দুজনে চলে যায়। কথাটা
শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমি তো দিতে চাইছিলাম, তাহলে কেন এমন
ব্যবহার ! আমি আরো দেখলাম, একপ্রকার অভিশাপ দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জোর করে
যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে তারা। মনে মনে খুব রাগ হয় ওদের
প্রতি। কিন্তু আমিও ভয় পেয়েছিলাম, যদি অভিশাপ বর্ষণ করে। "বৃহন্নলারা
সমাজের সবকিছু থেকেই বঞ্চিত। তাদের আমরা যদি সহযোগিতা না করি, তাহলে তারা
বাঁচবে কি করে?" --- এমন নানান প্রশ্ন আমার মনে সেই মুহূর্তে জেগে
উঠেছিল। কিন্তু তাদের এহেন দুর্ব্যবহারে রাগেরও জন্ম হয়েছিল। কারো কারো
গায়ে হাত দিয়ে ও কাপড় তুলে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাতে
তাদের প্রতি মনের কোণে ঘৃণা জেগে উঠেছিল।
তবে সকলেই যে সমান তা নয়। কারও কারও ব্যবহার খুব নমনীয়। হাতের
পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়, তারাও সকলেই তেমনি একরকম নয়। উগ্র চরিত্রের
কিছু বৃহন্নলার জন্য পুরো জাতিটার বদনাম হচ্ছে। তাদের জীবনের কথা ভাবলে
আমারও খুব খারাপ লাগে। তাদের একাকিত্বের কথা সমাজ ভাবেনা। সারা জীবনে না
থাকে জীবনসঙ্গিনী, না থাকে ছেলে-মেয়ের সুখ। বাবা-মার ভালোবাসাও
সম্পূর্ণরূপে পাওয়া থেকে বঞ্চিত তারা। সমাজে অবহেলিত, ঘৃণিত। দলবদ্ধ
ছাড়া একাকী বেঁচে থাকা এদের খুবই কষ্টের। তাদের সংস্পর্শে যেতে চায় না
কেউ। অথচ তারাও আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষ !
আমরা যখন কটক স্টেশনে, তখনও বৃহন্নলাদের একটা দল ট্রেনে উঠেছিল। তবে
এদের মধ্যে তেমন উগ্রতা দেখলাম না। নিজের ইচ্ছা মতো যে যা দিচ্ছে তা
নিয়ে অন্য বগিতে চলে যাচ্ছে এরা। এদের দেখে বুঝলাম, সকলে একরকম নয়। আমি
দশ টাকা একজনকে ডেকে দিলাম। সে দুহাত তুলে আমায় আশীর্বাদ করল। সকলে
অভিশাপের ভয় পেয়ে এদের থেকে দূরে থাকে, কিন্তু এদের আশীর্বাদও যে জীবনে
কখনো কখনো অনেক বড় ভূমিকা নেয়, সেটা আমি বুঝেছিলাম। এদের মতো সবকিছু
থেকে বঞ্চিত একাকী জীবনের মানুষ এই সমাজে নেই। সকলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।
কাজও পর্যন্ত দেয়না। তাদের কথা চিন্তা করে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে
উঠেছিল। ভগবানের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম --- "হে ভগবান। তুমি ওদের মঙ্গল করো।
ওদের প্রতিটি পদক্ষেপে তুমি সহযোগিতা করো।"
---------------------
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন