Featured Post
ফিরেদেখা ।। আমার জন্মদিনযাপন ।। সুবীর ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আমার জন্মদিনযাপন
আমি একজন অকিঞ্চিৎকর মানুষ । কবে আমি জন্মেছি তা জেনে কার কী এসে যায় ! আমার জন্মদিনে উৎসব করবে এমন অফুরন্ত সময় হাতে থাকা মানুষই বা কোথায় ? রবীন্দ্রনাথ যে রবীন্দ্রনাথ তাঁরও জন্মদিন উৎসবের চেহারা নিতে নিতে কবির ২৬ বছর বয়স এসে গেছিল । তা-ও অত বড় পরিবারে কবির গুণমুগ্ধ মানুষের কিছু কমতি ছিল না । সরলা দেবীর উদ্যোগে সেই প্রথম কবির জন্মদিনের উৎসব পালিত হয় । জানি না তার আগে বিশ্বকবির মা তাঁকে তাঁর নিজের হাতে বানানো পায়স খাওয়াতেন কী-না । আর কারো কাছে না থাক্ , প্রতিটি মায়ের কাছে তাঁর সন্তানের কদর সবার আগে । আমার মা-ও আমার জন্মদিন মনে রেখে নীরবে তৈরি করে ফেলতেন জন্মদিনের পায়েস । সবাই খেত সেটা । তবে এক চামচ হলেও সবার আগে সেটার স্বাদ নিতে হত আমাকেই ।
খুব ছোটবেলায় মা-বাবার কাছ থেকে আমি একটা তিন চাকার সাইকেল উপহার পেয়েছিলাম । সেটা পাওয়ার সময়কার স্মৃতি আমার নেই , তবে একটু বড় হয়ে সাইকেলটা আমি দেখেছি এবং এত বেশি সেটা চালিয়েছি , যতদিন না সেটা ভেঙে পড়ে । আমি যে সময় ছোটবেলা কাটিয়েছি তখন পৃথিবী মানুষের জীবনের এত কাছে চলে আসেনি । তখন গ্রাম-শহরের বিস্তর ফারাক ছিল । সাধারণ মধ্যবিত্তদের জীবনযাপন এখনকার মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তদের কাছাকাছি চলে আসেনি । গরিব – মধ্যবিত্ত ও ধনী এদের মধ্যে যে বিপুল তফাত সেটা খোলা চোখেই বেশ দেখতে পাওয়া যেত । আমরা সেই শ্রেণিবিভাজনযুক্ত যুগের ছেলেমেয়ে । আমাদের জন্যে জন্মদিনের পার্টি ছিল না , কেক কাটার সুযোগও ছিল না । ছিল তখনকার অসামান্য সুরভিত গোবিন্দভোগ চালের সুমিষ্ট পায়েস । এই পায়েস মাতৃভক্তি জাগায় , শরীরে বল জোগায় , যেমনটি হয়েছিল সুজাতার হাতে পায়েস খেয়ে বুদ্ধদেবের ।
আমাদের ছেলেবেলা কঠোর গ্রীষ্ম আর মুষলধারা বর্ষার ভেতর কেটে গিয়েছিল । তখন বিয়েবাড়িতে ক্যাটারারের বুফে নয় , ভোজবাড়ির খাওয়া । বিয়ের পদ্য লেখার যুগ সেটা । বিয়েতে বই উপহার পাওয়ার সময় সেটা । এখনকার বিনোদনগুলো তখন দেখা দেয়নি যেমন ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপ , টিভি , স্মার্টফোন , কম্পিউটার । তখন বিনোদন বলতে এক রেডিও নয় গল্পের বই । জন্মদিনেও গল্পের বই দেওয়ার চল ছিল । আমি কবিতা লিখতাম বলে কবিতার বই-ই বেশি পেতাম ।
তখন কলেজে পড়ি । একবার আমার ক্লাসের সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে এক রেস্তোঁরায় খাওয়াতে নিয়ে গেলাম । সে রেস্তোঁরায় নানা রকম নোনতা খাবার পাওয়া গেলেও সব মিষ্টির স্টক শেষ হয়ে গিয়েছিল । অনেকেরই সে জন্য মন খারাপ হয়ে গেল । কিছুটা দূরে অন্য রেস্তোঁরায় যাওয়া যেত । কিন্তু গুছিয়ে বসে যাওয়ার পর অনেকেই আর সেখান থেকে নড়তে চাইছিল না । আর একবারের কথা । তখনও কলেজে । চেতন ভগত যেমন একটা বই লিখেছিলেন 'হাফ গার্লফ্রেন্ড' নামে সেরকম তখন আমার মধুপা নামে এক 'হাফ গার্লফ্রেন্ড' ছিল । ভীষণ অভিমানী ছিল সেই মেয়ে । আমার জন্মদিনের আগের দিন তার সঙ্গে জন্মদিন মানানোর নানা পরিকল্পনা করতে করতে কী নিয়ে যেন এক দুঃসহ অভিমানের মেঘ জমে ওঠে । আমি রাতে ঘুমোতে না পেরে খুব কষ্ট পাই । তখনই ঠিক করে ফেলি আগামীকাল আর কলেজেই থাকব না । সকালে উঠে মায়ের কাছে বাড়ি চলে যাই । মা তো অভাবিতভাবে আমাকে পেয়ে দারুণ খুশি । দুদিন মায়ের কাছে কাটিয়ে হস্টেলে ফিরে যাই । পা দেওয়া মাত্র যাদের যাদের মুখোমুখি হই সবাই বলে আমাকে মধুপা খুঁজছে । সেদিন বিকেলে তার সঙ্গে আমার দেখা হল । দু' তরফের অভিমানই তখন অনেকটা ফিকে । বিস্তর কটূকথা শুনিয়ে সেই মেয়ে আমাকে বের করে দিল একটা উপহার । একটা কবিতার বই , তার সুন্দর হাতের লেখায় লিখে দেওয়া । বইটির নাম—হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য । কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত বই ।
কলেজ ছেড়ে এসে কর্মজীবনে প্রবেশ করায় সেভাবে ছুটির আবহে জন্মদিনকে খুব বেশি আর পাইনি । বড়জোর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও একটা খেতে যাওয়া । ততদিনে মা চলে গেছেন । কেকস্ কিংবা মনজিনিস-এর কেক কেনা হচ্ছে । স্ত্রী-পুত্রর কাছ থেকে শুভেচ্ছা-সংবলিত কার্ড পাচ্ছি । এই কয়েক বছর আগে এক জন্মদিনের দিন সপরিবারে ঘুরতে গেছিলাম গড় পঞ্চকোট । কী চমৎকার জঙ্গলের ভেতর ভেতর রাস্তা । কাশীপুরের রাজাদের এককালের আধিপত্যের নমুনা । এক সময় এখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিছুকাল কাটিয়ে গেছিলেন । অনেককিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে । কিছু কিছু সংস্কারও করা হয়েছে । বিশেষ করে একটি মন্দির । একটি অতিথিশালা রয়েছে । আমরা দুপুরে সেখানেই খেলাম । ভাত ডাল মাছের ঝোল আর দারুণ একটি বড় পোস্তর বড়া ।
আমার জন্ম বর্ধমান জেলার শিল্পশহর কুলটিতে । কিন্তু সেখানে মাত্র পাঁচ বছর কাটিয়ে আমার পিতৃভূমি বীরভূম জেলার খয়রাশোলে চলে যাই । সেখানেই প্রকৃতির মাঝে শৈশব কৈশোর কেটে যায় ।
আমার জন্মদিন ১৭ ভাদ্র । আমার বড়দার ৩১ ভাদ্র । শরৎচন্দ্রেরও তা-ই । ১৭ ভাদ্র , ইংরেজির ৩ সেপ্টেম্বর । ঐ দিন উত্তমকুমারেরও জন্মদিন । ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বড়দা আর শরৎচন্দ্র এবং আমি ও উত্তমকুমার এক দিনে জন্মেছি বলে । কখনও কখনও জন্মদিনকে মনে রেখে কবিতা লিখেছি -- দু'একটা , তার বেশি নয় । এমনই দুটি কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরছি ---
১
ভাদ্রের সতেরো এলে উত্তপ্ত দর্পণ
দর্পণে জল পড়ে বদ্ধ মায়াকাল
কাল কী পাথর ছিল বিপদ বিগ্রহ
বিগ্রহ ও যুদ্ধের মাঝে শান্তি-সূত্রধর
২
তবু এই দাদনের দেশগাঁয়ে ভাদ্রের সতেরো আসে ঠিক,
আমি তার এক ফাঁকে জন্মকুক্ষিগুহামুখ থেকে
উঁকি মেরে দেখে নিই এ-সংসার কতখানি বাসযোগ্য হল ,
আস্ফালনের পৃথিবীতে কেঁচোর মতন জীব মানুষের শিক্ষণীয় তারা ।
সুবীর ঘোষ
৩০১ আশ্রয় এ্যাপার্টমেন্ট
গ্রুপ হাউসিং, বিধাননগর
দুর্গাপুর—৭১৩২১২ / পশ্চিম বঙ্গ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন