নিরঞ্জন মণ্ডল
চলতে পথে বাঁক পেরিয়ে যখন ফিরে চাই
পেরিয়ে আসা পথের রেখার আধেক টুকুই নাই!
হারিয়েছে তার গাছগাছালির চিকন সবুজ মায়া
ফসল খেতে রোদের চুমা গেরস্থালীর কায়া।
হারিয়ে গেছে পুকুর জলে ডুব-সাঁতারের সুখ,
বট পাকুড়ের ছায়ায় ভেজা হাজার চেনা মুখ।
ধূপছায়া রোদ নিঝুম দুপুর আকাশ মুখো ঘুড়ি
ঘাস ফড়িঙের ঘাড় বাঁকানো,আলতো ওড়াউড়ি।
আল পথে রোজ কলকলিয়ে শ্লেট পেনসিল বই
ঝোলায় ভরে স্কুল-মুখো ছুট ফুটিয়ে মুখে খই
যেতেম যারা কোথায় তারা হারিয়ে গেছে আজ
ভূবনডাঙার সৃজন-স্রোতে থামিয়ে সকল কাজ!
ধু-ধু মাঠের কপাল ছোঁয়া বাবলা হলুদ ফুল
টলটলে জল মাঠ-পুকুরে শাপলা দোদুল দুল
পানকৌড়ির ডুব-সাঁতারে লাফিয়ে ওঠা মাছ
বাবলা ডালে মাছরাঙাদের অলোক চপল নাচ ;
স্মৃতির মাঝে আজও এদের আবছায়া রূপ ভাসে
রাতের ঘুমে সজনে সোঁদাল ফুলরা অমল হাসে।
তেঁতুল ডালের চোখ না ফোটা দুইটা শালিক ছানা
স্বপ্নে সাকার হলেও তাদের ছুঁইতে আছে মানা!
শালুক ফুলের সফেদ ডানার নাগাল পাওয়াই দায়
টুকটুকে লাল ছাঁচি কুলের গন্ধ এ মন চায়।
তাল খেজুরের নিটোল কায়ায় বিভোর চোখের তারা ;
বাবলা ডালের ধঁদুল-ফুলে হই যে আপন হারা।
কবির লড়াই তর্জা গানের সুর-ঝুরঝুর দিন
আঁধার বুকে জমিয়ে গেছে অনেক অনেক ঋণ।
পোষ-পাবনে মনসা পুজোয় টুসু ভাদুর গানে
পয়লা বোশেখ গোষ্ঠপুজোয় ছুটছি গোপন টানে।
যাত্রাপালা রথের মেলা ঘোড়দৌড়ের মাঠ
টেমির আলোয় খলবলানো গাঁয়ের ভরাট হাট
বিকিকিনির মাঝেও নিপাট কুশল বিনিময়
ঝর্ণা-ধারার মতোই বুকে কলকলিয়ে বয়।
খেত ভরানো ধানের চারায় নরম রোদের খেলা
বুক চিরে তার মাটির পথে ঘাসফুলেদের মেলা
মাটির দাওয়ার কপাল ছোঁয়া উঠোন পুকুর-ঘাট
চুপ-পায়েতে হারিয়েছে সব চুকিয়ে মুখর পাঠ।
বাউনি পুজোর ধানের মরাই,তুলসি তলার সাঁঝ
প্রদীপ শিখায় মগ্ন নিথর আলতা শাড়ির সাজ
ধুনোর ধোঁয়া গন্ধ-ধূপের চনমনানো হাওয়া
উতল হলেও সবটা ফাঁকি--যায় না আজ আর চাওয়া!
আকাশ-গাঙের গহিন মেঘের ঝমঝমানো স্বর
জড়ায় না আর কাদায় জলে সকাল দুপুর ভর!
নৌকো হয়ে দুলছে না আর উঠোন পুকুর-জলে
খাতার ছেঁড়া পাতারা সব উধাও স্মৃতির তলে।
চোত-গাজনের ঠমক নাচে ঘুঙুরী ঝুমঝুম
ঢোল কাঁসরের চকিত বোলে দুপুর বেলার ঘুম
ভাঙছে না আর নাড়িয়ে চেতন গাজন-গানের মায়া
সবটুকু তার অলিক এখন সাহারা-ধূপছায়া!
বাবার শাসন, মায়ের আদর,ঠাকুর-তলার মাঠ
পাতার বাঁশি,লাঠির খেলায় প্রথম জীবন-পাঠ
রামধনু রঙ ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার ভয়
মা-র আঁচলে লুকিয়ে যাওয়া--ফিরে পাওয়ার নয়।
নেই রাজ্যের নৈরাজ্যেও একটা কেবল সুখ
চোখ-নাগালে পাচ্ছি আজও কয়টা চেনা মুখ।
সেই মুখেতে ছড়িয়ে আজও অলোক অমল হাসি;
সব সয়ে তাই পথ হেঁটে যাই,জীবন-ডিঙায় ভাসি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন