Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

স্মৃতিকথা ।। দাইমা, দাইমা গো... ।। অরবিন্দ পুরকাইত



দাইমা, দাইমা গো...

অরবিন্দ পুরকাইত 


'সুস্থ নারী সুস্থ সমাজ' জানিয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতাল সকল নারীকে আন্তর্জাতিক নারীদিবসে অভিনন্দন জানিয়েছে। তার পরে আছে আসল ব্যাপারটা। সেটি আদতে সে হাসপাতালে শিশুজন্মের বিজ্ঞাপন। লেখা হয়েছে, সেখানে কোনও শিশুর জন্মের খরচ ঊনসত্তর হাজার ন'শো নিরানব্বই টাকা থেকে শুরু। মহানগরের চৌমাথায় কয়েক দিন ধরে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ছিল। ইতোমধ্যে মেয়ে একদিন পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করলে, বাবা, 'দাই' মানে কী? তার দু-একদিনের মধ্যে 'নবপ্রভাত' ঘোষণা করল নববর্ষে স্মৃতিচারণমূলক লেখার কথা। তো এগুলো কোথায় একটা মিলে গেল। মনে হল দু-চার কথা লেখা তো যায়। ধাত্রী বা ধাই, চলতি উচ্চারণে দাই-কে নিয়ে। অর্থাৎ ধাত্রীমাতা, ধাইমা বা দাইমাকে নিয়ে। আরও সোজা করে বললে, ধরুনীদের নিয়ে।
     ধরুনী পুরোপুরি স্ত্রীলিঙ্গ, পুংলিঙ্গে ধরুনে-র চল ছিল, এখনও আছে। ধরুনী অর্থাৎ যে মহিলারা ধরেন। কী ধরেন? বাচ্চা হওয়ার সময় ধরেন। মানুষের বাচ্চা। গরুর বাচ্চা বা ছাগল-ভেড়ার বাচ্চা ধরায় বেশির ভাগ ছিলেন ধরুনেরা। অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রেই, নির্বিঘ্নে যাঁরা প্রসব করাতেন। হ্যাঁ, করাতেন। এখন আর তাঁদের দিন নেই। সরকারি নিয়মই হয়ে গেছে প্রতিটি বাচ্চা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্মাবে। কিন্তু মাত্র এই তিন-চার দশক আগে পর্যন্ত গ্রামসমাজে প্রসবের বলতে গেলে একমাত্র ভরসা ছিলেন এই ধরুনীরা। গবাদির ক্ষেত্রে অবশ্য, পাস-করা বা পাস-না-করা পশুচিকিৎসকের এই দিনেও, ধরুনে বা কোথাও কোথাও ধরুনী আজও আছে। কিন্তু তাঁরা তো আর ধাত্রীমা, ধাইমা বা দাইমা নয়। আমাদের কালে বেশির ভাগেরই নিজের মায়ের উপরে বাড়তি এক মা থাকত। দাইমা। তিনি বহুজনের দাইমা। প্রসব করিয়ে, নাড়ি কেটে, বাচ্চা ও তার জননীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দু-চারটি পরামর্শ দিয়ে, নিজের প্রাপ্যটুকু নিয়ে চলে যান এঁরা। আসার আগে প্রসব হয়ে গেলে, কেবল নাড়ি কেটে, পরামর্শটর্স দিয়ে চলে যান প্রাপ্যটুকু নিয়ে।
       আবার জন্মদাত্রী মা অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে সন্তান লালনপালনে অক্ষম হলে অনেকসময় দীর্ঘস্থায়ী ধাত্রীমাতার শরণাপন্ন হতে হয়। কোনও কোনও অভিজাত বংশে, বিশেষত রাজা বা জমিদারের ঘরে ধাত্রীমাতার কাছে সন্তান লালনপালনের রেওয়াজ ছিল। সে যাই হোক, যিনি প্রসব করিয়ে, নাড়ি কেটে সিধে এবং চাল-কাপড়-টাকাপয়সা নিয়ে চলে গেলেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তখখনই পুরোপুরি চুকেবুকে যেত না, সে সম্পর্ক ধাত্রী বা যাকে ধরা হয়েছে— উভয়ের কোনও একজনের মৃত্যু অবধি বজায় থাকত, নামমাত্র হলেও। বৎসরের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের সময় তাঁরা চালপয়সা তুলতে আসতেন প্রতি বাড়িতে। বিশেষত পৌষসংক্রান্তি বা রান্নাপুজোর (অরন্ধন) সময়। বাড়িতে বাড়িতে তাঁর কণ্ঠ ধ্বনিত হত, এই, তোর আমি ধরিছিলুম, জানিস! বা, বাপের বাড়ি-আসা-মেয়েকে— বাবা, এই সিদিন তুই আমার হাতে হলি/তোর নাড় কাটলুম, আর তুই এর মদ্যি দুই ছাবালের মা হয়ে গেলি! আশ্চর্য হয়ে ভাবি আজ, কত পরিবারের খবর থাকত তাঁদের নখদর্পণে! গল্পগাছা তো আর কম হত না। আর তাঁদের যাওয়া এবং আসার পথে আশপাশের পাড়া বা গ্রামের কতজন যে জেনে যেত কাদের বাড়িতে নতুন প্রাণের আগমন ঘটল! বিপরীতে, দাইকে আসতে দেখলে, পাড়ার বা পাশের পাড়ার কত জন যে বুঝে যেত কাদের বাড়ি আসছে! বলেও দিত, কী, অমুকদের বাড়িই যাচ্চ তো?
     ধাইমার বউমা বা মেয়েও সচরাচর ধাইমা হত, অর্থাৎ মহিলানুক্রমিক। এবং বলতে গেলে বংশানুক্রমিক। সচরাচর এঁরা প্রান্তিক মানুষ, তথাকথিত নিম্নবর্ণ বা নিম্নবর্গের, অত্যন্ত দরিদ্র। বয়স হতে থাকলে তথা চলাফেরার সামর্থ্য কমে আসতে শুরু করলে, সময় থাকতে তাঁরা মেয়ে বা বউমাকে সঙ্গে করে এনে এনে ক্রমশ কাজটা শেখানো ও পরিচয় করানোর পালাটা সেরে রাখতেন। ধাইয়ের মেয়ের আশপাশে বিয়ে হলে অনেকসময় একই এলাকা থাকত প্রসব করানোর, যে এলাকায় মায়ের সঙ্গে অনেক দিন সেও হয়তো এসেছে ছোটবেলা থেকে। অন্যত্র বিয়ে হলে অবশ্য অন্য কথা। সেখানে আগে-থেকে-থাকা দাইয়ের সঙ্গে তাঁর নাও মিলতে পারে, অথবা ইনিও সেখানে শুরু করতে পারেন ধাইয়ের কাজ। বিশেষত রাতবিরেতে বা ঝড়বাদলের দিনে, কাছাকাছি এমন মহিলা থাকলে তাঁর ডাক পড়াটাই স্বাভাবিক। এঁরাও চুপচাপ থাকতে পারতেন না সেসব দিনে। এভাবেও ডাক বা নামডাক বাড়তে পারে। হ্যাঁ, রাতবিরেত, ঝড়ঝাপটা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপদ-আপদের দিনেও খবরটি কানে গেলে এঁরা চুপচাপ থাকতে পারতেন না সচরাচর। আমাদের পাঁচালি-কীর্তন, গল্প-উপন্যাস, যাত্রা-নাটক-চলচ্চিত্রে এমন চরিত্র দুর্লক্ষ্য নয়।
     ঘটনা হল, বাড়িতে এখন বাচ্চা না জন্মালেও, কোথাও কোথাও অবস্থিত দাইরা উৎসব-অনুষ্ঠানের সময় আজও বাড়ি বাড়ি আসেন, গৃহস্থরা তাঁদের একেবারে বঞ্চিতও করেন না। এমনিতে, তাঁদের হাতে জন্মানো মানুষজন আজও ফুরিয়ে যায়নি যে পুরোপুরি! যেমন গোকর্ণী গ্রামের আমাদের পুরকাইতপাড়ায় পার্শ্ববর্তী রায়নগর গ্রামের দাই আজও আসেন, অন্তত অবশ্যই ওই পৌষসংক্রান্তি ও রান্নাপুজোর সময়। তিনি তাঁর শাশুড়ির স্থলাভিসিক্তা।
     সবাই কি সত্যিই জন্মাত তাঁদের হাতে? তা তো নয়। মনুষ্যশাবক-জন্মদান তখন অন্যান্য অনেক প্রাণীর মতোই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল। অনেকেরই দু-এক গণ্ডা সন্তানের জন্ম হত কিন্তু তার জন্য আলাদা করে আজকের দিনের মতো খুব বেশি বিশ্রাম বা আরামে থাকার চল তখন ছিল না। সংসারে প্রায় যাবতীয় কাজকর্ম করতে করতে চলতে হত। বড়জোর ভারী কাজকর্ম একটু কমিয়ে দেওয়া হত, পরিবারের অন্যেরা করে নিত। বাপের বাড়িতে থাকলে একটু আরাম। কিন্তু বাপের বাড়ি বড়জোর প্রথম দু-এক সন্তানজন্মের সময় থাকা, তার বেশি তেমন নয়। বলার কথা যেটা সেটা হল, কাজকর্মের মধ্যে থাকতে থাকতেই কোনও একসময় প্রসবটিও হয়ে যেত। আমরা দেখেছি সারাদিন প্রায়-স্বাভাবিক কাজকর্ম করে রাতের বেলা পোয়াতি বাচ্চার জন্ম দিলেন। বা দিনের বেলায় যে-কোনো সময়। প্রসবে তো আর ধরাবাঁধা সময় ছিল না। আজকের দিনের মতো অমুক দিন অমুক সময়ে তমুক ডাক্তারবাবু এতগুলো গর্ভবতীর পেট কাটবেন, ছিল না এমনও। কোনও বিশেষ দিনে (এমনকি বিশেষ মুহূর্তেও) আমার বাচ্চা জন্মাবে সুতরাং সেইমতো জন্মের তারিখ এগিয়ে আনা (বা এমনকি টেনেটুনে যদি দু-একদিন একটু পিছিয়ে দেওয়া যায! বেশ এগিয়ে আনা সম্ভব, পেছানোটা নয়— এবং সেটা বাচ্চা ও জননীর পক্ষে ক্ষতিকরও, কিন্তু ওই যে, বিশেষ দিনে বিশেষ গুণসম্পন্ন সন্তানের আকাঙ্ক্ষা!), ছিল না তো এসবও। এখন বলতে গেলে, জন্মের পর জন্মমুহূর্ত ধরে কোষ্ঠী তৈরি নয়, কোষ্ঠী তৈরি করে জন্মটা এগিয়ে আনা অসম্ভব নয়। তো আমাদের এইসব প্রসব বেশির ভাগ আপনিই হয়ে যেত। কিংবা দাইকে ডাকতে যাওয়া হয়েছে, দাই আসতে আসতে প্রসব হয়তো সম্পন্ন! আপনিই হয়ে গেল বা পরিবার কি পাড়ার বয়স্ক কেউ একটু ধরলেন বা তত্ত্বাবধান করলেন। বিশেষত এই ডাকতে যাওয়া এবং দাইয়ের আসা উভয়ই যখন ছিল মূলত পদব্রজেই। শেষের দিকে বড়জোর ছিল সাইকেলে, তাও তা সাধারণত ডাকতে যাওয়াটা— দাইদের আসাটা পদব্রজেই, কেন-না আজকের মহিলাদের মতো সেদিন মহিলারা এত সাইকেল চড়তে জানতেন না আর ছিল নাও এত সাইকেল (অন্যান্য যানবাহনের কথা বাদই দিলাম)। তবে অনেক সময় প্রসব করাতে যথেষ্ট কালক্ষেপ করতে হত, কেন-না তখনও হয়তো ভাল করে ব্যতা ওটেনে (ব্যথা ওঠেনি)। অথবা প্রসবে জটিলতা। যাই হোক, দাইকে ডাকার আগে বা দাই এসে পৌঁছানোর আগেই বাচ্চা হয়ে গেলেও, নাড়িকাটার ভূমিকা থাকত দাইয়ের। তাঁরা এসে বাঁশ বা কঞ্চির চেটি দিয়ে নাড়ি কেটে দিতেন এবং  তাঁর প্রাপ্য তাঁকে দেওয়া হত। বলা বাহুল্য, সে প্রাপ্য আজকের দিনের নিরিখে নগন্যই।
     তখন বলতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই মাটিতে জন্ম! বারান্দার একধারে বা ঘরে একটা ঝেঁদলা বা মাদুর পেতে দেওয়া হল, তার উপর একটি কাঁথা বা কাপড়; আর বিশেষত বারান্দায় হলে চারিদিকে ঝেঁদলা-মাদুর বা কাপড়চোপড় দিয়ে তড়িঘড়ি ঘিরে দেওয়া হত। এটাই আঁতুড়ঘর বা আঁতুড়। ঝেঁদলা-মাদুরের নিচে লোহার কিছু-একটা— কাস্তে, নিড়ুনি ইত্যাদি রাখা হত। ভূতপেত্নী-অপদেবতাদের নাকি লোহা দেখলে ভয়, ধারেকাছে ঘেঁষে না আর। বাচ্চা প্রসবের পরে, অন্তত পাঁচের কামান না যাওয়া পর্যন্ত পোয়াতি বাড়ির বাইরে গেলে সঙ্গে লোহার একটা কিছু রাখবেনই— সাধারণত কোমরে শাড়ির কষিতে  কাস্তে বা নিড়ানি গুঁজে রাখা হত। পাঁচের কামান বলতে পাঁচ জনের কামানদাগার কথা বলা হচ্ছে না, পাঁচ দিনের-দিন কামানোর কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ বাচ্চা ও তার জননীর সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সকলের, এমনকি কোথাও কোথাও জ্ঞাতিগোষ্ঠীর নোক-ছানা (নোক নখ) এবং পুরুষদের দাড়ি-গোঁফ কামানো। ছুঁচু যাওয়া। আঁতুড়ের কাছে বা ভিতরে দূরত্ব রক্ষা করে একটি আগুনের মালসা রাখা হত, পোয়াতি বাইরে গেলে হাত-পা সেঁকে আঁতুড়ে ঢোকার জন্যে বা বাচ্চাকে সেঁক দেওয়ার জন্যে। এটার সুফল কী, এটা জীবানুমুক্তির কাজ করে। একুশ দিনে হয় একুশের কামান— পুরোপুরি ছুঁচুমুক্তি (জন্ম শুভ হিসাবে শুভ-অশৌচ যাওয়া)। একুশ দিনে বা মাসের শেষে আছে ষষ্ঠীপুজো। বলা হয় বাচ্চাকাচ্চার মঙ্গল-অমঙ্গলের ব্যাপারটা ষষ্ঠীঠাকুরের দপ্তরেরই, তাই পূজায় সন্তুষ্ট করে আশীর্বাদ প্রার্থনা তথা মঙ্গলকামনা। ষষ্ঠীপুজোর পরে মা তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে পুরোপুরি আঁতুড়ের বাইরে আসতে পারতেন। শুরু হয়ে যেত সংসারের প্রায়-স্বাভাবিক কাজকর্ম। এখন সেই অর্থে আঁতুড়ঘর বিরল। তবে টুকটাক আছে, আর শব্দটি বেঁচে আছে অন্যভাবেও। যেমন, লিট্্ল ম্যাগাজিন কবি-সাহিত্যিকদের আঁতুড়ঘর।
     এমন প্রসব নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যকর ছিল না, প্রকৃতির সন্তান প্রায় প্রকৃতির মধ্যেই জন্মাত; কেবল একটু আড়াল-সহ সামান্য বিশেষ ব্যবস্থা। নাড়িকাটাও বলতে গেলে আদৌ স্বাস্থ্যকর ছিল না। কিন্তু তখন সচরাচর ওরকমই ছিল স্বাভাবিক। চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতার সেই দিনে প্রসূতিমৃত্যুও স্বাভাবিক কারণেই ছিল অধিক। এই লোহা কাছে রাখা বা নালতেপাতা খাওয়া (তেতো পাটের পাতা শুকিয়ে রাখা হয়, বছরের যে-কোনো সময় হালকা ভেজে গুঁড়ো করে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া), নাড় (নাড়ি) শুকানোর জন্য বেশি ভাত না খাওয়া বা দিনে কেবল দুপুরে একবার কম করে খাওয়া, পান্তা-পষ্টি না খাওয়া, চিড়েভাজা বা কাচকলাভাজা ইত্যাদি খাওয়া, বেশি টক-ঝাল-মিষ্টি না খাওয়া প্রভৃতি কথা দাইরা বলে দিতেন। তবে তাঁদের বলতে লাগত না বেশির ভাগ সময়— বংশপরম্পরায় শাশুড়ি বা পাড়ার বয়স্কারাই  বাতলে দিতেন এগুলো। পরে কোনোদিন এলে, বিশেষত ষষ্ঠীপুজোর সময় ইত্যাদিতে, দাইমা বাচ্চাকে তেল মাখিয়ে দিতেন।
       
       আমি কানা দাই, পত ঠাউরে ঠাউরে যাই/
পালকি আনো, রিকশা আনো, ট্যাক্সি আনো চড়ে যাই।। — কতদিন শুনেছি আমরা বিবিমার গানে! কোন কাল থেকে চলে আসছে, নতুন নতুন যানবাহন এলে, সংযোজিত হয়ে যায় তারা আসরে লোকশিল্পীর কণ্ঠে।
       ছোট মুখে বড় কথা শুনলে আজও অনেকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, হ্যারে, নাই কেটে ধাই ঘরে যেতি পাল্লুনি...! অর্থাৎ এই সেদিন জন্মালি, এর মধ্যে এরকম কথা!

       দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার লোকসংস্কৃতি চর্চার বিশিষ্ট এক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত কালিচরণ কর্মকার লিখেছেন, 'গর্ভবতী মায়ের প্রসববেদনা ভালো করে ওঠানোর জন্য দাইমা-রা বিশেষ লোকাচার পালন করেন। তাঁরা গর্ভবতী মায়ের মাথায় সাদা আকন্দের আঠা লাগিয়ে দেন। সন্তান জন্মের দশ মিনিট পরও ফুল বের না হলে দাইমা লাউয়ের সাদা ফুল মাকে চিবিয়ে খেতে বলেন। অথবা কাকমাড়ানো কুলোর সামনে একটু সরষের তেল লেপে দিয়ে নবজাতকের মাকে তা চেটে খেতে বলেন আর সঙ্গে চুলের ডগা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন, এতে মায়ের বমিভাব আসে আর তাতেই ফুল বেরিয়ে আসে। শেষে নবজাতকের মাকে উল্টো করে শায়িত করে দাইমা তাকে তিনবার লাথি মারেন। নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে গেলে তখন দাইমা নবজাতকের নাড়ি দুইতে শুরু করেন এবং আর একজনকে ফুলটা সেঁকতে নির্দেশ দেন। এর ফলে নবজাতকের জ্ঞান ফিরবে বলে দাইমা বিশ্বাস করেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়ের তলপেটে দাইমা জারিপাতায় সরষের তেল মাখিয়ে আগুনের সেঁক দেন যাতে মা সুস্থ হয়ে ওঠেন। সন্তান জন্মের পর একুশ দিন পর্যন্ত কাঁচা আম, তেঁতুল, পান্তাভাত, গুড়, মদ জাতীয় কিছু খাওয়া মায়ের পক্ষে নিষিদ্ধ বলে দাইমা বিধান দেন। আঁতুড়ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। বাইরে থেকে কেউ আঁতুড়ঘরে ঢুকলে কিংবা প্রসূতি কোনো কারণে বাইরে বের হওয়ার পর পুনরায় আঁতুড়ঘরে ঢোকার সময় ওই আগুনে হাত, পা কিংবা শরীরের কোনো অংশ ভালো করে সেঁকে নিতে হয়। সদ্যোজাত শিশুটিকেও পাঁচ দিন অথবা তারও বেশি দিন আগুনের উত্তাপ দেওয়া হয়। এই লোকাচারের পিছনে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিহত করার প্রচেষ্টা রয়েছে।' ('জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হিন্দুসমাজের লোকাচার '— কালিচরণ কর্মকার, 'জেলা লোকসংস্কৃতি পরিচয় গ্রন্থ : দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা', লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, জানুয়ারি ২০২৩)

     শুরু তো সত্তর হাজারে নয়, ঊনসত্তর হাজার ন'শো নিরানব্বই-এ। আপনি তো বলতে পারবেন না সত্তর হাজার! ব্যবসায়ী ব্যবস্থাপনায় এক টাকা কম রাখার কী মাহাত্ম্য! প্যাকেজের শুরুটা বলা থাকে, জানতে চাইলে শেষেরও একটা আন্দাজ পাবেন, কিন্তু প্রকৃত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। এসব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক খরচ একটা থাকেই। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যাবে। বোঝা যায়, আজকের বিরল বাছা বা বাচ্ছারা অর্থাৎ আমাদের সোনা-মানিকরা কত মূল্যবান। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয়রহিত অর্থাৎ এই একমেবাদ্বিতীয়মরা জন্ম হইতেই মহার্ঘ। ভাগ্যিস, আজও সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা বেসরকারি ছোটখাটো নার্সিং হোম আছে, সাধারণ লোকের পক্ষে তাই খানিক সুবিধে।
       গল্প নয়, একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। পাড়ায় আমাদের অনুজ মিলন বৈরাগীর ছেলে হয়েছে ডায়মন্ড হারবারে এক নার্সিং হোমে। ঘটনাটা তারই কাছে শোনা, হুবহু বর্ণনা আমার সাধ্যাতীত। তফাৎও হতে পারে একটু-আধটু, তবে মূল ঘটনায় কোনো ভেজাল নেই। তা মিলনের স্ত্রীকে দেখাশোনা করার জন্যে গেছে আমাদের জ্ঞাতি ঠাকুমা গীতা পুরকাইত। এমন দায়িত্ব হামেশাই নিয়ে থাকে ঠাগ্্মা, এখন আরও বয়সের কারণে বন্ধ হয়েছে, তাও আঁকুপাঁকু করে। সাংসারিক অনেক বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। তা মিলন নার্সিংহোমে গেছে সেদিন। একের পর এক সিজার করছেন এক ডাক্তারবাবু। এক পোয়াতির প্রসববেদনা উঠেছে খুবই। কিন্তু একটা সিজার করা শেষ হলে নিয়ে যাওয়া হল আর-এক জনকে। এঁর সিজার করার পালা নাকি তাঁর পরে। কিন্তু মহিলাটি আর সহ্য করতে পারছেন না। গীতা ঠাগ্্মার দেখেশুনে মনে হল, এর বাচ্চা তো প্রায় হয়ে গেল বলে! পোয়াতির সঙ্গে-আসা তাঁর মা আর বোধহয় এক ছোট ভাই বেশ অসহায় বোধ করে। ঠাগ্্মা আর থাকতে পারল না। মহিলাটির মাকে ডেকে বলল, কাপড়চোপড় কী এনোচো নে এসোদেন, ধরে ওই ঘরটায় নে যাই— এ তো এক্ষুনি হয়ে পড়ল পেরায়! অদূরের ঘরটিতে জন-তিনেক পুরুষ গুলতানি করছিল। নার্সিং হোমেরই লোক বোধহয়। ঠাগ্্মা বলল, তোমরা ঘর থেকে এট্টু বেরোও দেকি। তারা থতমত খেয়ে, বাইরে বেরিয়ে গেল। সেখানে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চা হয়ে গেল! ঠাগ্্মার তেমন কিছুই করতে হল না। এমনিতে ঠাগ্্মা ধরুনী নয়, কিন্তু পাড়ায় নানা বিষয়ে তালেবেতালে ঠেকা দিতে তার ডাক পড়ে। যাই হোক, খানিক পরেই চলতে-থাকা সিজার করার কাজটি সারা হলে, সে পোয়াতিকে নিয়ে যেতে এসে তো আর খুঁজে পান না নার্সিং হোমের কর্মীরা! দু-একজন দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই তাঁদের তো চক্ষু চড়কগাছ! এই কর্মকাণ্ডের নায়িকা গীতা ঠাগ্্মার উদ্দেশে কী হম্বিতম্বি তখন! ঠাগ্্মা বলে, দেকতি পাচ্চি ছাবাল পেরায় বেইরে আসতেচে— তা কী করব? ঝে কষ্ট পাচ্ছে, তোমরা ককন ছিজার করবে— ত্যাৎক্ষনে ঝেদি কিচু এট্টা হয়ে যায় পআতিটার! আমি তাই থাকতি পারিনি, ওর মা-র সোঙ্গে কতা বলে ওই ঘরে নিইগিচি— নে যাবার সোঙ্গে সোঙ্গে তো হয়ে গেল! আশেপাশের সবাইয়ের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে বেশি কিছু বলতেও পারেন না সে কর্মীরা! সবাই তো বেশ মজা পেয়েছে— সপ্রশংস দৃষ্টি ঠাগ্্মার দিকে। কিন্তু গজগজ করতে করতে তাঁরা যে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন ঠাগ্্মার দিকে! মহিলার মা কিন্তু কোনো আপত্তিই শোনেননি, মিষ্টি খাইয়েছিলেন ঠাগ্্মাকে।

___________________

* দু-একটি তথ্যসহায়তায় শান্তি পুরকাইত ও সরমা পুরকাইত।

===============

অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা,
ডাকসূচক — ৭৪৩ ৬০১।

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩