রূপকথার মত
সমরনাথ চট্টোপাধ্যায়
মহালয়া এলেই মন উসখুস শুরু হয়ে যায়। দু-একটা ছোটখাটো ঘটনাও যে এত স্পষ্ট হয়ে গেঁথে থাকে তা এই 'মন উসখুস'-মনে ঠাহর হয় মাঝে মধ্যে। সেসব মনে এলে দুঃখ বা হতাশা নয়, বেশ উপভোগ্য মনে হয় আমার। আয়েস করে এই সব চর্বিতচর্বন আস্বাদনে বিভোর হয়ে পড়ি।
সে সময়টা আমাদের মত ছেলেছোকরেদের কাছে মহালয়া মানেই আলোআঁধারি ভোর। বছরে একটা দিন। আমরা দল বেঁধে মহালয়া শোনার নামে পাড়া বেড়াতে বেরতাম। এরমই একটা দিনের জাবর কাটা নির্যাসঃ
তখন সবার বাড়িতে রেডিও ছিল না। যাদের বাড়িতে রেডিও ছিল তারা উচ্চ ভল্যুমে রেডিও চালিয়ে দিত। এরমই দু-একটা বাড়ি থেকে "আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে …" শুনতে শুনতে আমারা পাড়া বেড়াতাম। মহালয়া শোনার চেয়েও অন্যের বাড়ির ফুল ফলের গাছের দিকে মনোযোগ বেশি। সামনেই শুক্লাদের বাংলো। শুক্লা আমার ক্লাশমেট। ওর বাবা রেলের ডাক্তার। সরকারী বাংলো। বেশ বড় ঘেরা বাগান। চাদ্দিকে অনেক গাছ। তারই মধ্যে একটা বেল গাছে কয়েকটা বেল ঝুলে আছে। আমি ছিলাম গাছপটু। বন্ধুরা বলল, 'সুমু, বেলগুলো দেখেছিস? আঃ, খুব লোভ হচ্ছে। যা না, উঠে যা। 'মুহূর্তে তরতর করে উঠে পড়লাম। কয়েকটা বেল পেড়ে নীচে বন্ধুদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নেমে আসব এমন সময় প্যাঁট করে ডান পায়ের মাঝখানটায় কী একটা ফুটল। 'উফ্', বলে পা-টা তুলে দেখি একটা বেল কাঁটা। আড়াআড়ি সিঁধিয়ে আছে পায়ের চেটোতে। সেটা টেনে উপড়ে ফেলতেই গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। ভয়ে ধপাস করে নীচে পড়ে গেলাম। ঠিক তখনই 'খুটুস খুট' করে বাংলোর দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠলাম। ভয়কাতর চোখে তাকিয়ে রইলাম ওই দিকে। দেখলাম আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বেরিয়ে এল শুক্লা। ধরা পড়ে যাব এই ভয়ে গাছের নীচে ঘাপটি মেরে বসে আছি। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গীরা সব পোঁ পাঁ। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে কীভাবে যেন শুক্লা আমাকে দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমার কাছে এসে, "কীরে সুমু, তুই?", বলে আমার পাশে হাঁটুমুড়ে বসে পড়তেই আমার হাতে পা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে, "এমা! কী করে হল? ইস্!" বলেই বাড়ির দিকে দৌড় দিল। ভয়ে আমি, "এই, এই শুক্লা, কাউকে কিছু বলিস না।" বলে কাতর মিনতি করলাম। ও কোন কথাই কানে নিল না। আমিভয়ে আরও সিটিঁয়ে গেলাম। বোধহয় ওর বাবাকে ডেকে আনতে গেল। ভয়ে জড়োসড় হয়ে বসে রইলাম। একটু পরেই দেখি হাতে কীসব নিয়ে একলাই প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এল শুক্লা। আমার কাছে থেবড়ে বসে আমার পায়ের কাটা জয়গাটা পাকা সেবিকার মমতায় তুলো দিয়ে মুছে পরিস্কার করে, টিঙচার আইডিন লাগিয়ে অপটু হাতে যতটা সম্ভব শক্ত পোক্ত করে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল। বলল, 'উঠে দাঁড়া। দেখতো হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?' বললাম,'না, না। একদম ফিট। যাই, মহালয়া শেষহয়ে এলো।' বলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে যাবার উদ্যোগ নিতেই ও শক্ত করে আমার ডান হাতটা ধরে গেটের বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিল। আমি প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। একটু দূরে গিয়ে একবার শুক্লার দিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম ও তখনও ওদের বাগানের গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে। ফ্রেমে বাঁধান ছবির মত ওকে দেখে তখন আমার মনে হয়েছিল, ও, ও শুক্লা নয়। ও, ও কোন এক রূপকথার রাজকন্যা। আর আমি...
তখনও কোথায় যেন মহালয়ার শেষ বাক্যগুলো চড়া সুরে বেজে চলেছে, "দেবীর আবির্ভাবে সুখবার্তা প্রচারিত হল..."
সমরনাথ চট্টোপাধ্যায়
৬২, আর. এন. গুহ রোড,
দমদম, কলকাতা – ৭০০০২৮
চলভাষঃ ৮০১৭৯২৪৫০৪ (কথা ও হোয়াটস অ্যাপ নম্বর)
৯৪৭৭৮১৫৩৬৫
email: etcsamar@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন