রিতা বেশ কয়েকদিন ধরেই ভাবছে অনিমেষকে বাবুর ল্যাপটপের কথাটা বলবে কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না। জানে এই কথা নিয়ে বাড়ি মাথায় করবে ওর ঘরের লোকটা। আবার বাবুর দুঃখী দুঃখী মুখটাও মনে ভাসছে। আজ অনিমেষ অফিস যাওয়ার সময় সাহস করে বলেই ফেললো "শোনো তোমাকে ক' দিন ধরেই ভাবছি একটা কথা বলবো"। অনিমেষ চশমার ফাঁক দিয়ে রিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে "এত ভূমিকার দরকার নেই মোদ্দা কথাটা তাড়াতাড়ি বলো, আমার দেরি হয়ে যাবে বেরোতে"। অনিমেষের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুঁয়ে থাকে রিতার মুখ। রিতা টিফিন বক্স ব্যাগে ভরতে ভরতে বলে "আসলে বাবুর একটা ল্যাপটপ খুব দরকার, এখনকার পড়াশুনা ল্যাপটপ ছাড়া খুব......" অনিমেষ কথাটা শেষ করতে দেয় না। "হ্যাঁ তাতো বটেই, তোমার লায়েক ছেলের আর কি কি লাগবে তার লিস্ট করে দাও, এখনো ওর মোবাইলের ই এম আই কাটা শেষ হলো না, আবার একটা বায়না, আমার দ্বারা ওইসব কেনা সম্ভব নয়, বলে দিও"। অফিসের ব্যাগ কাঁধে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অফিসের পথে পা বাড়ায় অনিমেষ। রিতা স্বামীর যাওয়ার দিকে হাত জোড় করে "দুগ্গা দুগ্গা" বলে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।
অনিমেষ ব্যানার্জি একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী। এক সময় ব্যবসা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনোটাই তাকে লাভের মুখ দ্যাখাতে সমর্থ হয়নি। ঘরের বেশ কিছু পুঁজি শেষ করে এখন দশটা ছটার চাকরিতেই স্থিতু হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকাকালীন তাকে কোনোদিন পয়সার কথা চিন্তা করতে হয়নি। সাধন ব্যানার্জি ছিলেন ওই অঞ্চলের বেশ নামকরা উকিল। বাংলাদেশ থেকে কর্পদক শূন্য হয়ে এসে শুধুমাত্র নিজের পরিশ্রম আর ইচ্ছার জোরে ওকালতি পাশ করেন। সকালে প্রিন্টিং প্রেসে কাজ আর রাতে পড়াশুনা। আসলে মানুষটার বুকে ছিল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবল ইচ্ছে। তাতেই সফলতা পেয়েছিলেন। অনিমেষ বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী উকিল হতে পারেনি। তার বরাবরই খেলার প্রতি ঝোঁক। একসময় জেলার হয়ে ফুটবল খেলে এসেছে। তার নিদর্শন এখনো সযত্নে আলমারিতে সাজিয়ে রাখা। কিন্তু গতানুগতিক পড়াশুনা তাকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত নিয়ে যেতে সমর্থ হয়নি। এই নিয়ে বাবার কাছে ভৎসনা যেনো গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল তখন। তবে একমাত্র সাধনবাবু ছাড়া অনিমেষ আর কারো কাছে কোনোদিন তিরস্কার পায়নি। সন্তানহীন কাকা কাকিমার কাছে অনিমেষ নিজের সন্তানের থেকেও বড় ছিল। যৌথ পরিবারে ওদের অর্থ বা শান্তি কোনোটিরই অভাব ছিল না। সেই কাকা কাকিমা কাশি যাওয়ার পথে যখন একটা অ্যাকসিডেন্টে ইহলোক ত্যাগ করেন অনিমেষ প্রায় সপ্তাহ খানেক ঘর থেকে বের হয়নি। গোটা পরিবার ভেঙে পড়েছিল শোকে। তবু সময়ের ঢেউ পেরিয়ে আবছা হয়েছে তাদের স্মৃতি। আসলে এখন যে বট গাছের নিচে বাস করে অনিমেষের পরিবার তার নাম প্রভাতী। প্রভাতী ব্যানার্জি। অনিমেষের মা। আশি ছুঁই ছুঁই বয়স যেনো তার কাছে একটা সংখ্যা মাত্র। এখনও মিক্সি নয় শিল নোড়া দিয়ে হাতে বেটে নাতির প্রিয় পোস্ত রান্না করেন। সংসারের যে কোনো বিষয়ে প্রভাতী ছাড়া যেনো অচল। রিতা প্রথমে ভেবেছিল ল্যাপটপের কথাটা শাশুড়ি মাকে দিয়েই বলাবে, কিন্তু কয়েকদিন আগের একটি ঘটনায় সে মত পাল্টায়। বাবু রাতে ঠাকুমার ঘরেই শোয়। যে কথা মাকে বলা যায় না তা সে নির্দ্বিধায় প্রভাতীকে বলে। একদিন বৌমাকে ডেকে প্রভাতী বলেছিল "ছেলের দিকে আগের থেকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে এবার, চোখ বুজে বসে থাকলে আর চলবে না, বিপথে যাওয়ার এই বয়স"। রিতা কম কথার মানুষ প্রভাতীর এতগুলো কথা হজম করতে একটু সময় লেগেছিল। আবার এটাও মনে হয়েছিল যে, বাবু ঠাকুমার কাছে হয়তো এমন কিছু বলেছে তার জন্য প্রভাতী তাকে সতর্ক করে দিলো। মনটা খারাপ হয়েছিল কথাটা শুনে। পরদিন বাবুকে না জিজ্ঞেস করে পারে নি "তোর পড়াশুনা সব ঠিক হচ্ছে তো? নাকি সারাদিন আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছিস ? বাবু তার স্বভাববশত উত্তর দিয়ছিল "আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না"। এখানেই শেষ হতে পারতো রিতার দুশ্চিন্তা, কিন্তু না, পরদিন যখন শুনল বাবুর মুখে "মা, বাবাকে বলে একটা ল্যাপটপ ব্যবস্থা করে দাও, না হলে খুব অসুবিধা হচ্ছে প্রজেক্ট করতে" রিতার শুরু হলো ধুকপুকানি। কি করে বলবে অনিমেষ কে, এই কয়েকমাস আগেই ছেলের স্মাট ফোন কেনা নিয়ে লঙ্কা কান্ড বেঁধেছিলো ঘরে। তবু ছেলেকে উত্তর দেয় "হ্যাঁ রে, তোর সব বন্ধুই কি বড়লোক, তারা সবাই ল্যাপটপ কিনে বসে আছে বলছিস?"। এর উত্তর এসেছিল "তুমি কি জানো, ল্যাপটপ এখন সব ঘরেই আছে, এমন কি বস্তি ঘরেও, আর আমরা তো...." কথাটা শেষ করতে দেয় নি রিতা, বলে উঠেছিল "নিজে রোজগার করে কিনে নিস, তোর বাবার পক্ষে আর সম্ভব নয়"। বাবু ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে উত্তর দিয়েছিলো "তাহলে আমার থেকে ভালো রেজাল্ট আশা কোরো না তোমরা, যেমন গুড় ঢালবে তেমনি মিষ্টি পাবে"।ররিতা কথাটা শুনে চুপ করে যায়। এ ছাড়া আর করবেই বা কি?
অনিমেষের শরীরটা বেশ কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না, কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে রয়েছে দিন কতক। প্রভাতীরও নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা। সে জানে অনিমেষের বুকে ঝড়ের তাণ্ডব কখনোই মুখে প্রকাশ পায় না। সে সবার কাছে তার ক্ষত সর্বদাই চাপা দিয়ে রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু প্রভাতী ঠিক বোঝে। তাই ছেলেকে না বলে পারলো না "অনি, কি হয়েছে তোর? আমাকে বলবি না?" মায়ের কথায় শুধু "কিছু না" বললেও তার চোখের কোণে চিক চিক করে ওঠা জল অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। রিতাও এসে দাঁড়ায় প্রভাতীর পাশে। প্রভাতীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আর রিতার মলিন মুখ এড়াতে পারে না অনিমেষ। "মা, বাবু একেবারে উচ্ছন্নে গেলো, আমি পারলাম না ওকে মানুষ করতে, ভালো বন্ধুর চেয়ে বখাটে বন্ধুর সংখ্যাই বেশি, যাদের মধ্যে আবার কয়েকজন জেল ফেরত দাগী আসামি"। রিতা মুখে আঁচল চাপা দিল কান্নার শব্দ কম করার জন্য। প্রভাতী বললো "তুই এত খারাপ চিন্তা করছিস কেনো, ওর যা বয়স, তাতে এই সময়টা মানছি খুব সাবধানে থাকা দরকার, কিন্তু অতিরিক্ত শাসনে ফল উল্টো হতে পারে"। অনিমেষ ইশারায় রিতাকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিতে বলে আবার শুরু করে "আরো একটা কথা শুনলাম, বাবু নাকি এক অবাঙালি মেয়ের সাথে মিশছে, তাকে বিয়ে করার কথাও ভাবছে"। এবার প্রভাতী বেশ প্রত্যয়ের সুরে বলে ওঠে "কি বলছিস, ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে? না না এসব মিথ্যে, বাবু এটা করবে না, আবার বলছিস অবাঙালি, এতটা মতিভ্রম হবে না ওর"। অনিমেষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে "তোমার কথাই যেনো সত্যি হয় মা, আমার তো রাতের ঘুম চলে গেছে শুনে অবধি"।
অনিচ্ছা সত্বেও ল্যাপটপ কিনে দিতে হলো ছেলেকে। রিতার কথায় "ল্যাপটপ পেলে, মনটা লেখা পড়াতেই ব্যস্ত থাকবে, বন্ধু বান্ধব আর আগের মত মাথাটি খেতে পারবে না"। অনিমেষ আর কি করে, কিনতেই হলো কষ্ট শিষ্ট করে। আগেকার দিন হলে সবাই বলত "স্বর্গে বাতি দেওয়ার লোক তো ওই একটাই, তার জন্য এটুকু তো করতেই হবে" কিন্তু অনিমেষ ভাবে স্বর্গে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওই বাতি যে কি ভাবে বাঁশে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে তা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
সেদিন অন্যদিনের থেকে বেশ অনেকটাই আগে ফিরলো বাবু। অনিমেষ তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। বাবু এসেই মাকে বললো "মা একবার ঠাকুমার ঘরে এসো তো, দরকারি কথা আছে"। রিতা চায়ের কাপ হাতে প্রভাতীর ঘরে ঢুকে দ্যাখে তখনও জামা কাপড় ছাড়েনি বাবু। ওকে দেখেই বলে উঠলো "মা এখানে বসো"। রিতা অবাক হলেও ছেলের কথামত চিয়ারে বসে পড়ে। প্রভাতী টিভির রিমোটটা টিপে বন্ধ করে নাতির দিকে চেয়ে জানতে চায় "কি হলো, এমন করছিস যেনো বিশ্বজয় করে এলি?" বাবু কিন্তু এই প্রশ্নে তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে হেসে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে বললো না "হ্যাঁ গো, তোমাকে নিয়ে এবার পঙ্খিরাজে উঠবো"। বরং একটু গম্ভীর সুরেই বললো "আমি একজনকে ভালোবাসি, তাকে এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে, ওর বাড়ি থেকে বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে, তাই আর দেরি করা যাবে না"। রিতা কথাটা শুনে চিয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু প্রভাতী ডান হাত তুলে তাকে বারণ করে নিজে বলে ওঠে "মেয়েটির বাড়ি কোথায়, বাবা কি করে, আমাদের পাল্টি ঘর তো?" বাবুর উদাস দৃষ্টি প্রভাতীর মুখ ছুঁয়ে যায়। "কোনোটাই নয়, সে বিহারী, বাঙালি নয়, আর পরিবার বিহারে থাকে, এখানে কাকার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে"। রিতা আঁতকে উঠলো যেনো "কি বলছিস তুই, এক খোট্টা মেয়ে বউ হবে এই ব্রাহ্মণ বাড়ির, না না আমি বেঁচে থাকতে সেটা তুই কখনোই পারবি না করতে"। শেষের কথাগুলোর সাথে বেরিয়ে এলো কান্নার ফোঁপানি। প্রভাতী এখনও একটাও কথা বলে নি। রিতার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো "কষ্ট পেও না, বৌমা, ভগবান দেখছেন ঠিক, এত কষ্ট করে ছেলে মানুষ করে তার এই ফল"। বাবু চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে মা আর ঠাকুমার সামনে বসে। মায়ের আঁচল দিয়েই মায়ের চোখ মুছিয়ে বলতে শুরু করে "তোমাদের আমি কষ্ট দিয়েছি, আমাকে পারলে দুটো চড় মারো, কিন্তু প্লিজ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকো না। আচ্ছা ঠাকুমা, তুমি তো অনেকদিন আগে দুটো বদ্যি পাখি পুষেছিলে, ছোট্ট খাঁচাতে, আমি ছোটবেলায় কত কথা বলতাম তাদের সাথে, একটা ছেলে পাখি, অন্যটা মেয়ে, পরে যখন ওরা সংখ্যায় বাড়লো তুমি ছাদে অনেক বড় একটা খাঁচায় অর্ধেক পাখি ভাগ করে রাখলে, মনে আছে?" প্রভাতী বলে উঠলো "এর সাথে পাখির কি সম্পর্ক তা তো বুঝতে পারছি না"। বাবু ঠাকুমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠলো "সম্পর্ক আছে গো, এখন ছাদে প্রায় পাঁচটি খাঁচায় যে পাখি গুলো আছে সেগুলো যে ওই ছোট্ট খাঁচা থেকেই এসেছিল সেই সত্যিটা শুধু আমরা জানি, পাখিগুলো নয়, এখন অন্য খাঁচা থেকে যদি অপর খাঁচায় পাখি রাখতে চাও, তো সেই খাঁচার পাখি বলবে এ তো আমাদের মত নয়, অন্য কোথাকার পাখি। একমাত্র সৃষ্টি কর্তাই জানেন আমরা কেউ কারো অপর নই, শিকড় এক। তাই বাঙ্গালী, বিহারী, মারোয়ারি বা অন্য সব ঘরের সন্তানরাও একই ভাবে মানুষ হয়।" এক নাগাড়ে কথা বলে একটু থামে বাবু। প্রভাতী বলে ওঠে "তোর বাবা শুনলে কি হবে বুঝতে পারছিস? সে তো বেঁচে থেকেই মরে যাবে"। বাবু কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দরজার কাছে বাবাকে দেখেই থেমে গেলো। রিতার বুক কেঁপে উঠলো আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিতে। কিন্তু না, সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনিমেষ বলে উঠলো "আমি সব শুনেছি, মা, তুমি অমত কোরো না, আমার ছেলের যুক্তি ভুল নয়"। রিতা চমকে উঠে তাকায় স্বামীর দিকে। অনিমেষ রিতাকে বলে ওঠে "ছেলে আর ছেলেমানুষ নেই, এখন অনেক ম্যাচিওর"। বাবু প্রণাম করতে গেলে অনিমেশ বুকে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। সেই বুকের মাঝে কষ্টটা যেনো এক নিমেষেই মিলিয়ে যায় অনিমেষের।
গোপা ঘোষ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন