Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

ছোটগল্প ।। লুকোচুরি খেলা ।। সৌমেন দেবনাথ 

লুকোচুরি খেলা 

সৌমেন দেবনাথ 


ভালো থাকতে হলে চুপ থাকতে হয়। চুপ থাকার মাহাত্ম্য প্রত্যেক স্বামীই জানে। আবার চুপ থাকলেও বাজে বাজে উপাধি পেতে হয়। চুপ থাকতে থাকতে রাগ চাপলেও চুপ থাকতে হবে। চুপ না থেকে উপায়ও নেই। যে যত বেশি চুপ থাকতে শিখে নিয়েছে, সে তত দ্রুত সংসার সামলানো শিখেছে। গর্জনশীল পুরুষও চুপ হয়ে যায় সংসারে ঢুকলে। কত কত বাঘা পুরুষ মেন্দামারা পুরুষ হয়ে গেছে তার হিসাব নেই। যে পুরুষই চেয়েছে পুরুষ হয়েই সংসারে রাজত্ব করবে, সেই সংসার অনলে জ্বলেছে। পুরুষ চায় না সংসারে অশান্তি, বিবাদ, ঝগড়া লেগে থাকুক, তাই চুপ হয়ে গেছে। সব কথাতেই চুপ, সব কথাতেই সহমত, সব কথাতেই হ্যাঁ-সূচক মাথা হেলুনি। ঘরণী যা-ই বলে মেনে নেয় কর্তা। ঘরে শান্তি থাক ঘরণী কতটুকু বোঝে কে জানে! কর্তা ঠিকই বোঝে, কারণ তার চুপ থাকার সদিচ্ছা। ঘরণী বাকওয়াজ করে শান্তি খোঁজে, কর্তা চুপ থেকে শান্তি খোঁজে। কিন্তু কেউ শান্তির খোঁজ পায় না। 
আব্বাস সারাদিন কাজ করে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরলেই তার স্ত্রী রজনী বলবে, বাজারে যাও। তরকারি নেই।
সবচেয়ে কাছের মানুষটি কাছের মানুষটির কষ্ট বোঝে না। সবচেয়ে কাছের মানুষটিই কাছের মানুষটির কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। আব্বাস স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থাকে। ঘামে ক্লিষ্ট মানুষটাকে দেখে যদি হৃদয়ে দরদটুকু না জাগে, তবে কিসের সহযাত্রী, সহধর্মিণী! সংসারের সুখের জন্য শ্রমক্লিষ্ট মানুষটা যদি একটু হাসি-খুশি থাকার রসদ না পায় সংসার থেকে, তবে কিসের জন্য এই সংসার বাঁধা! কষ্টের উপর কষ্ট চাপিয়ে দেওয়া সুস্থ বুদ্ধির কাজ না। ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের সাথে কেউ অবিবেচকের মতো আচরণ করে না। কাউকে ভালো না বোঝা, কাউকে শান্তি না দেওয়া কি শান্তির কাজ! বাজারে যাওয়ার পথে শামীমের সাথে দেখা। শামীম বললো, মাত্র মাঠ থেকে ফিরলি, বাজারে যাচ্ছিস এই দুপুরে?
আব্বাস প্রকৃত কথা লুকিয়ে বলে, বাজার করা একটা শখ। বাজার ঘুরে ঘুরে মানুষের বিকিকিনি দেখা এক প্রকার আনন্দ। সুকৌশলী না হলে বাজার করে ঠকতে হয়। দর-কষাকষি করা একটা শিল্প। বৌপাগলরা ঘরে থাকে। কাজপাগলরা কাজে থাকে, না সকাল, না দুপুর।
এই বলে সে বাজারের উদ্দেশ্যে চলতে লাগলো। সময়ে নিজেকেই নিজের ফাঁকি দিতে হয়। সময়ে কষ্ট দেওয়া মানুষটিকেও বড় করে উপস্থাপন করতে হয়। ঘরের মানুষের রূপ বাইরের মানুষের কাছে বললে মানুষ কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়। পর মানুষ পরই। পর মানুষের কাছে ঘরের মানুষের নিন্দা করতে নেই। সবার কাছে সব সময় মলম না থাকলেও, সবার কাছে সম্পর্ক তিক্ত করার লবণ থাকেই। কাটা ঘায়ে লবণ পর মানুষ ছিটাবেই। নিজেরা নিজেদের সীমা লঙ্ঘন করলে অন্য মানুষ আরো পেয়ে বসে।
অন্যকে প্রিয়জন করতে না জানলে কষ্টই বাড়ে, তাই নিজেকে নিজের প্রিয়জন করে নিতে হয়, হতাশা থাকে না। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। কেউ একজন ভালো রাখবে সে আশা করা ঠিকই না। অনিচ্ছার যে কাজটি করতেই হবে সে কাজটিকে তাই উপভোগের করে নিতে জানতে হয়। বাজার করে বাড়ি ফিরলেই স্ত্রী বলে, একই তরকারি কেনো, আর যে তরকারি খেতে ভালো লাগে না, তাই-ই কেনো! তুমি খুব হিসেবী।
ঘাম ঝরা রোজগার করা টাকায় ঘাম ঝরিয়ে বাজার করলেও ঘরণীর মন মেলে না। ঘরণীর তীর্যক কথায় শরীর ঘামে নতুন করে। মানুষকে আপন করতে চাওয়া মানুষগুলোই ঠকে বেশি। সকল সময় পাশে থাকার মানুষটাকে আঘাত না করলে স্বস্তি লাগে না। বলে না কিছু, নীরব কষ্টে দূরে সরে থাকে। রাগলে বা অস্থির হলে ভুল হবে, বিচ্যুতি হবে; তাই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। চেহারার যত্ন নেয়, ব্যবহারের যত্নটুকু নেয় না। কাছের মানুষটি কথা শুনবে, তা না কেবল কথা শোনায়। মানসিক যন্ত্রণায় থাকা মানুষই জানে বাস্তবতা কত কঠিন।
পরদিন ভালো আর দামি তরকারি কিনবে বলে বলে স্ত্রীকে সামলায়। কিছু খরচ কম করলে সংসারের সঞ্চয় বাড়ে সংসারের কর্ত্রী যদি না জানে ঐ সংসার তো ভবিষ্যতে বিপদে পড়বেই। ভালো চলার জন্য ভালো বুদ্ধিও যে প্রয়োজন অনেকেই জানে না। অভিজ্ঞ, অনভিজ্ঞ সব নারীরই একই কথা, নিজের স্বামী কিছুই বোঝে না। পাশের বাসার কুদ্দুসই সবচেয়ে ভালো আর সংসারী। অথচ কিছু না বোঝা ঐ গোবেচারা স্বামীর জন্যই মুখে ভাত উঠে, অঙ্গে পোশাক জোটে। এই ভালো চাওয়া মানুষটা ভালো ব্যবহারটুকু পায় না, হাসি মুখের দুটি কথা শুনতে পারে না। গোবেচারা মানুষটা যদি না থাকে কি হবে তার বেঁচে থেকে একটু সময় নিয়ে কোনদিনও ভাবে না সে। আপন মানুষটাকেই সবাই বকে, পর মানুষ পায় মিষ্টি ভাষা। আপন মানুষটাই নির্গুণ, আর সব মানুষ গুণধর। আপন মানুষটাই যেন বেবোধ, আর সব মানুষ বোধসম্পন্ন। আপন মানুষটাকেই আমরা আপন করে তুলতে জানি না। 
বিকালে শামীমের সাথে দেখা। সে বললো, কি বাজার করেছিলি?
আব্বাস রং মিশিয়ে বললো, পছন্দের যত বাজার সব করেছি। আমার বাজার-সদাই আমার স্ত্রী খুব পছন্দ করে। আমার পছন্দই তার পছন্দ। সত্যিই এমন বৌ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। 
শামিম আশ্চর্য হয় আব্বাসের কথা শুনে। সে জানতো, চোখের দেখায় সবকিছু বোঝা যায় না। মুখের কথায় সবকিছু প্রকাশ পায় না। কিন্তু আজ সে জানছে, মুখের কথায় সবকিছু বোঝা যায়। মন সন্তুষ্ট না থাকলে কারো মুখ দিয়ে বৌয়ের প্রশংসা বের হয় না।
বৌয়ের প্রকৃত আচরণ কাউকেই বুঝতে দেয় না আব্বাস। কাউকেই বলে না, অত আকাঙ্ক্ষী নারী নিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। অত বাজে কথার ধরণ যে নারীর তার সাথে পথ চলা যায় না। 
এরপর শামীম আর ও দুইজনে মিলে চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। দুটো বিস্কুট, একটা চা খেয়েই বাড়ির পথ ধরলো আব্বাস। বাইরে থাকলে দোষ। বাড়ি থাকলেও দোষ। গরম কড়াইয়ে থেকে সংসার করে চলেছে সে। স্ত্রীর চাওয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে পেরিয়ে যাচ্ছে জীবনের মূল্যবান সময়। তার ভাবনাগুলো প্রকাশের সুযোগ না পেয়ে হারিয়ে যায়, মনে জমে হাহাকার। সময়ে কঠিন হতে চায়, পারে না। মায়ার জাল গুটিয়ে রাখতে চায়, পারে না। বাড়ি আসতেই রজনী বললো, এত বাইরে থাকো কেন? চায়ের দোকানে আড্ডা দাও? এখনো ছেলেমি করলে হবে? তোমার না সংসার হয়েছে? বখাটেপনা করলে চলবে?
আব্বাস চুপ হয়ে শুনলো কথাগুলো। সাহসের অভাবে নয়, সম্পর্কের সুরক্ষায় নতজানু থাকে সে। একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না। একটি প্রশ্নের যদি উত্তর দেয় তো আরো দশটি প্রশ্ন করে বসবে। কথায় কথা বাড়ে, কথা বাড়াতে চায় না যারা তারা আর কথা বলে না। কথা জানা বড় গুণ। কথা বলতে সবাই জানে, বাগ্মী হতে কজন জানে! যে কথা মধুর তা দ্বারা মধুরতা বাড়ে। যে কথা কটু তা দ্বারা তিক্ততা বাড়ে। সংসারে নারীর আধিপত্য খারাপ ভাবে না আব্বাস। বহির্ঝগড়াটে থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। স্ত্রীর শক্তভাবাপন্নতায় স্বামীর অনেক বদাভ্যাস হ্রাস পায়। স্ত্রীর দৃঢ়তা না থাকলে স্বামীর অলসতা কাটে না। 
কিছুক্ষণ পরেই শামীম ফোন দিলো। প্রথম দুই বার না ধরলেও তৃতীয় বার রিং বাজলে আব্বাস ফোন ধরলো। শামীম বললো, ফোন ধরিস না কেন?
আব্বাস বললো, তোর ভাবীর সাথে গল্প করছি। কি মিষ্টি মিষ্টি করে গল্প বলে। হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যথা হয়ে যায়। তোর ভাবী খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। 
আব্বাসের মুখে তার স্ত্রীর প্রশংসা শামীমের বুকে তীরের মতো বিঁধে। কাজের কথা না বলেই সে ফোন রেখে দেয়। 
রজনী এসে আবার বলতে শুরু করে, ফোনে এত কথা না বলে কাজে যাও। বাচ্চাদের মতো ফোন ব্যবহার করলে হবে? বিয়ের পরও বিয়ের পূর্বের বাচ্চামি থাকলে হবে? কাজ করতে ভালো লাগে না? কাজ না করলে খাবো কি? 
ভালো কিছু যার চোখে পড়েই না, তার চোখ না থাকা ভালো। হৃদয়ে যার মায়া নেই, তার সংসারে প্রবেশ না করায় ভালো। কথায় যদি সুর না থাকে, সে কথা যতই কাজের হোক কাজে লাগে না। মাধুরী মিশিয়ে কথা বললে অনেক কঠিন কাজও মন দিয়ে করতে ইচ্ছে করে। মনে মনে ভাবে সে, এত পরিশ্রম করেও প্রিয়জনের জীবনে সৌভাগ্যবান পুরুষ হয়ে থাকতে পারলাম না। একটি বদাভ্যাসও নেই, তবুও প্রিয় পুরুষ হতে পারলাম না। যাদের মুখে নেশার গন্ধ তারা তাদের স্ত্রীদের প্রিয় পুরুষ কি করে হয়? যাদের চোখে আকুল করা নেশা তারা প্রিয় পুরুষ হয় না কেন?
পেট পুরে বকা খেয়ে আব্বাস কাজে চলে গেলো। মন খারাপ, কিন্তু মুখে হাসি৷ মন নীরব, কিন্তু মুখ সরব। কাজ করতে করতে সে বললো, মাঠে মাঠে কাজ করি আমার বৌ তার জন্য খুব কষ্ট পায়। ঘামে সিক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দেয়। এক গ্লাস শরবত খেতে দেয়। শরীরের ক্লান্তি এক নিমিষেই কেটে যায়। আমার ঘামে ভেজা গামছাটা বুকে জড়িয়ে আমার কষ্টটুকু উপলব্ধি করতে থাকে। এমন ভালো একটা বৌ পাওয়া সত্যই ভাগ্যরে।
এসব কথা শুনে শামীমসহ আরো যারা কাজ করছিলো সবাই দীর্ঘশ্বাস কাটলো। এই দীর্ঘশ্বাসের অর্থ স্পষ্ট, কিন্তু কেউ ঘরণীর নিন্দা করে না। স্ত্রী ঘরে যতই অচেনা আচরণ করুক বাইরে এসে সমালোচনা কোন পুরুষই করে না। ঘরের অশান্তি বাইরে প্রচার কেউ-ই করে না। ঘরে অশান্তি সৃষ্টিকারিনীকে পুরুষই ঘরের রানী, ঘরের মালা, ঘরের অলংকার বললেও এই বিশেষণগুলো যারা দেয় তারা ঘরে কেউ ভালো নেই। কিন্তু সবাই ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে। এই অভিনয় যে পুরুষ যত ভালো ভাবে করতে পারছে, সংসার করা তার কাছে তত সহজ হয়ে উঠছে। সুচারু পুরুষ তো তারায়, যারা সংসারের মধ্যমণিকে সামলাতে জানে।
বাবা মা, ভাই-বোন যে সংসারে আছে সে সংসারে বৌ সামলানো খুবই কঠিন ও জটিল কাজ। বাইরে থেকে আসা মানুষটাকে যেমন ঘরের মানুষ সহজে গ্রহণ করে না, বাইরের মানুষটাও ঘরের সবাইকে এক নজরে দেখে না। তিলে তিলে সাজানো সংসারটার চাবি বাইরে থেকে আসা নতুন অতিথিকে দিতে কেউ চায় না, অধিকার জন্মানো বাইরের মানুষটিও অধিকার বুঝে নিতে তৎপর। মধ্যখানে পিষ্ঠ হতে থাকা আব্বাস বুদ্ধির সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েও জিতে যেতে পারে না। বৌকে তিনটে শাড়ি কিনে দিতে পারে সে, বোনকে একটা থ্রি পিস কিনে দিতে ভয় পায়। বোন বলে ভাই পর হয়ে গেছে। বোন ভুল বুঝলেও সংসারে অশান্তি আসে না, স্ত্রী ভুল বুঝলে সংসারে শান্তির টুকরোও থাকবে না। বৌয়ের মুখের হাসি দেখবে বসে বসে বলে বিয়ে করেছিলো, অথচ সেই হাসি মুখ দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। কারণ বোন বা মায়ের নিন্দা করলেই বৌয়ের মুখে হাসি জাগে। বৌয়ের মুখের মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনবে বলে বিয়ে করেছিলো সে, অথচ আজ বৌয়ের মুখের কোন কথায় তার ভালো লাগে না, কারণ বৌয়ের মুখের যত কথা সব বোন-মা-বাবা বিরুদ্ধ। মেজাজ ঠিক থাকে না। মাথায় রক্ত উঠে যায়। এমন অত্যাচার মানা যায় না, কাউকে বলা যায় না। অথচ মেনে নিতে হয়, না বলে থাকতে হয়। প্রশংসা করে করে শান্ত রাখতে হয়। একটা ঘর কয়েকটি মানুষ মিলে থাকা যায় না। একই পরিবার, কেউ কাউকে ভুল বোঝাবুঝি বাদে থাকে না। নিজেরাই যদি নিজেদের ভালো না বুঝি শান্তি তো কেউ ঘরে এনে দিয়ে যাবে না। 
প্রতিদিনের মতো বিকালে সবাই চায়ের দোকানে বসে চা-বিস্কুট খায়। নাসির এসে নিজের বৌয়ের রান্নার গল্প করছে, কত বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সে গল্প করছে, কথা-বার্তা, আচার-আচরণে কত বেশি ভালো সে গল্পও করছে, খুঁটিনাটি বিষয়েও কত সজাগ সে গল্পও করছে। আব্বাস শুনে মনে মনে হাসছে। বোনের, ভাইয়ের, মায়ের, বাবার প্রশংসা মানুষ বাইরে করলেও বৌয়ের প্রশংসা কেউ বাইরে করে না। বৌয়ের প্রশংসা করে না পুরুষ, কারণ লজ্জা। নাসিরের সাথে সুর মিলিয়ে আব্বাসও বৌয়ের প্রশংসা করে বললো, বৌয়ের কর্মের মূল্য দিই না আমরা। আমার জন্য রান্না করে, আমার জামা-কাপড় ধৌত করে, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে। অথচ আমরা তার কাজকে চোখেই দেখি না। সময়ে আমাকে বকতেই পারে, কারণ আমার ভালো সেই-ই চায়। আমাকে ভালোবাসে বলেই আমাকে বকে। বকাটা দেখি, ভালোবাসাটা দেখি না। কাজ করার জন্য দূরে যেতে বলে, আদর করার জন্য কাছে ডাকে কে? সেই-ই। নিজের বৌয়ের শুধুই দোষ ধরতে নেই, পরের বৌয়ের সাথে তুলনা দিতে নেই। 
নাসির বললো, ঠিক। নিজের স্বভাব পরিবর্তন করতে পারি না, ভুল ধরার মানুষ ঘরে এলে তার কথা মানি না। নিজেকে জানতে হবে, তাকেও জানতে হবে, নিজেকে বুঝতে হবে, অন্যকেও বুঝতে হবে; বুঝতে পারার আনন্দ বোঝার পরেই বোঝা যায়। 
শামীম কান পেতে শুনছে আর রাগে ফুসছে, কিন্তু কিছু বলছে না। ঘরে যে প্রজাতি দুদণ্ড শান্তি দেয় না, বাইরে সেই প্রজাতির প্রশংসা শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায়। তবুও রাগ প্রকাশ করে না, করে না ন্যূনতম প্রশংসাও। আব্বাস বাড়ি এলো। কারো না কারো সাথে ঝগড়া করে গো-ধরে বসে থাকে রজনী। আব্বাসকে দেখলেই আদ্যোপান্ত বলতে থাকে। বাড়ির পাশে কে কে খারাপ সব বলে। অথচ আব্বাস কখনোই তাদের কাছ থেকে খারাপ আচরণ পায়নি। কার সাথে কার লাগে, কার সাথে কার বাঁধে বলা দায়। নিজে না ভালো হলে সবার সাথে দ্বন্দ্ব বাঁধে। আব্বাস শুধুই শোনে। কানের কাছে ঝগড়ার কারণ আর ঝগড়া কতক্ষণ শুনতে ভালো লাগে! মায়ের কাছে গেলো। মাও বলতে থাকেন বৌমা এ বলেছে তা বলেছে। নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না আব্বাস। আবার চায়ের দোকানে চলে গেলো। নাসির, শামীম তখনো দোকানে বসে আছে। আব্বাসকে দেখেই নাসির বললো, বাড়ি যা। বৌটা তোর পথ চেয়ে।
আব্বাস বললো, হ্যাঁ, যাবো। তোদের ভাবীর মুখের মিষ্টি কথা অমিয়সমান। মিষ্টি মুখটা পদ্মপ্রায়। মিষ্টি হাসিটা কল্লোলিত নদীর স্রোতে ঝিকমিক সূর্য কিরণ। কত দারুণ তার সংসারজ্ঞান। অভিভূত হয়ে যাই। আমাকে, আমার সংসারকে মানুষটা ভীষণ আপন করে নিয়েছে। এমন একটা মানুষ পাশে পেয়েছি যার কথাতে আশা পাই, হাসিতে ভাষা পাই, ছোঁয়াতে মায়া পাই। তাকে পাওয়ার পর থেকে মনে হয় ধনে গরীব হতে পারি, মনে অনেক ধনী আমি।
এসব কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শামীম দূর আকাশে নিষ্পলকে চেয়ে থাকলো। নাসির বললো, ভালো ঘরণী পাওয়া সত্যই ভাগ্যের। ঘরে শান্তি না থাকলে বাইরের হাজার শান্তির কোন অর্থ নেই। ঘর আলো করে আছে ঘরে বৌ। সুখের ফোয়ারা ঝরিয়ে ঘরে আছে বৌ। যেমন বৌ স্বপ্নে চেয়েছি, তেমন বৌই পেয়েছি। যত যত গুণ মনে মনে চেয়েছিলাম আমি আমার বৌয়ের মধ্যে পুরোটাই আছে। কথা শোনে, বেশ চুপচাপ স্বভাবের, চাহিদা নেই বললেই চলে, না বুঝলে বুঝিয়ে বললে বোঝে আর কিছু চাই না।
রাত দশটা বেজে গেছে কিন্তু তিনজনের কেউ-ই বাড়ি ফেরে না। তিনজনের কারোরই বাড়ি ফেরার মায়া নেই।  কারোরই ঘরের প্রতি টান নেই। ঘরে ফেরার মায়া মরে গেছে। ঘরে ফিরতে বিতৃষ্ণা জন্মেছে, জন্মেছে অজানা ভয়, আতঙ্ক। এত পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করেও কারো মনে ঠাঁই হচ্ছে না, এ যে কত যন্ত্রণার বলা অসম্ভব। কত কত স্বপ্নবাজ মানুষের কত কত স্বপ্ন, ইচ্ছা একটু অসহযোগিতার, না বুঝতে জানার কারণে মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত তার ইয়ত্তা নেই। প্রিয় মানুষটার অকারণ অনভিপ্রেত আচরণে মায়ার নদীটা শুকিয়ে যায়। কাছের মানুষটার না বুঝতে জানার ব্যর্থতায় প্রেম টইটম্বুর হৃদয়ে ভাটার রাজত্ব ভর করে। মনের মাঝে বিরাজিত বৈষয়িক ব্যাপারের প্রাবল্যতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখগুলো আলোমুখ না দেখেই মরে যায়। না বুঝতে জানার কারণে আর অনাকাঙ্ক্ষিত কথা বলতে জানার গুণে জীবন থেকে সুখগুলো টুক টুক করে দূরে সরে যায়।
দোকানদার বললো, তোরা তিনজন আছিস, আয় তাস খেলি।
আব্বাস দোকানদারের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসে। বিয়ে করার পর প্রথম প্রথম সে সন্ধ্যা বেলাতেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতো।


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩