'বেগমপুরের ইতিহাস' :
অনুসরণযোগ্য জন্মগ্রাম-গাথা
— অরবিন্দ পুরকাইত
আজন্ম যে স্থানে মানুষের শৈশব-কৈশোর কাটে, যৌবন কাটে, তার স্মৃতি সচরাচর অবিস্মরণীয়। যত নগণ্যই হোক না সে স্থান। প্রত্যক্ষভাবে যদি না-ও হয়, আমরণ ছায়াসঙ্গী যেন তা মানুষের! আমাদের ইতিহাসচেতনা বলবার মতো নয়। একাধিক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব এ আক্ষেপ করে গেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের কথা তো স্বত-ই মনে আসে। আমরা এমনকি ইতিহাস নিয়ে ভাবি-ই না তেমন করে! মৌখিক পরম্পরা একসময় হারিয়ে যেতে থাকে আগের প্রজন্মের মানুষের একের পর এক প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে, তার লিখিত বা অন্য রূপ তেমন ধরে রাখতে না পারার কারণে।
কেবল শৈশব-কৈশোর-যৌবনই নয়, জন্মতক দেবব্রত নস্করের প্রায়-সাতদশকজোড়া জীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে কেটেছে তাঁর ধাত্রী, পালয়িত্রী বেগমপুরে — দুশো-আড়াইশো বছর আগে বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার দাড়া গ্রাম থেকে এসে তাঁদের পূর্বপুরুষদের জঙ্গল হাসিল-করা স্থানেই। জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধতাস্বরূপ লিখেছেন তিনি তাঁর জন্মগ্রামের কথা। বহু মানুষেরই স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ তাঁদের জন্মভূমির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সেই জন্মভূমির প্রতি প্রায় মানুষই ঋণী মনে করে নিজেকে। প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে একসময় চিরপ্রস্থানে চলে যেতে হয় মানুষকে, তার আগে সেই ঋণ স্থায়ীভাবে স্বীকার করে যেতে চায় কোনও কোনও মানুষ। জীবনের একটি পর্যায় হিসাবে আত্মস্মৃতি, জীবনী ইত্যাদিতে জন্মভূমির কথা তার বহু সুসন্তান বা তাঁদের জীবনীকারদের কলমে উঠে আসে, বিশেষত কৃতী মানুষের স্মৃতিকথায়। সামগ্রিকভাবে নিজের গ্রামকে নিয়ে, অতীত থেকে তার চলমানতার সাক্ষ্যগুলোকে অনুপুঙ্খ ধরার চেষ্টা করে শতপৃষ্ঠাজোড়া স্বতন্ত্র আস্ত পুস্তক রচনার নজির সেইভাবে চোখে পড়ে না। সাম্প্রতিক অতীতের আর একটি দৃষ্টান্ত ভাল লেগেছিল, পূর্ণেন্দু ঘোষের 'ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক্যানিং' গ্রন্থের 'গ্রাম-পরিক্রমা' অধ্যায়টি, যেখানে শতাধিক পৃষ্ঠাজুড়ে আলাদা করে আটাশটি গ্রামের সংক্ষেপে সার্বিক পরিচয় তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ করি আমরা।
দেবব্রতবাবু সরাসরি ইতিহাসই লিখেছেন, ইতিবৃত্তের আবডাল খোঁজেননি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে যা প্রায় 'পিঠ-বাঁচানিয়া' প্রচেষ্টারই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। তা সেই ইতিহাস লিখতে গিয়ে ভূমিপুত্র-তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে তাঁর এতদিনের নিবিড় অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নথিপত্র ঘাঁটা, ক্ষেত্রসমীক্ষা, পূর্ববর্তী প্রজন্মের বহু মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা ইত্যাদির উপর। সর্বোপরি যেটা ঘটনা, ভূমিকায় সাহিত্যিক শঙ্করপ্রসাদ নস্করের অনায়াস-অনবদ্যতায় লেখা এই বাক্যটি থেকে তা বিশদভাবে বোঝা যাবে, 'এই গ্রাম তাঁর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তাই গ্রামটাই ঘর হয়ে গেছে।'। ইতিহাস লিখনের উপাদান তথা শর্তগুলিকে — নিজের জন্মগ্রাম বলে — উপেক্ষা করেননি দেবব্রতবাবু।
উপযুক্ত সময়ে কাজটি তিনি সমাপ্ত করেছেন, একইসঙ্গে তাঁর চর্চা ও যাপনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে কাজে লেগেছে। তিনি ছাড়া এই কাজ এত উপযুক্ততার সঙ্গে সমাপ্ত হতে পারত না বলেই বিশ্বাস। সবচেয়ে বড় কথা, এ কাজে হাত দেওয়ার মতো মানুষই বা ক'জন! সেই হিসাবে তাঁর এই দায়বদ্ধতা তাঁর এই ঋণস্বীকারপ্রচেষ্টা তাঁর জন্মভূমিকে পরিচিত করানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও যে মহিমান্বিত করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
গ্রামের চৌহদ্দি থেকে তার নামকরণ, গ্রামস্থ পাড়ারগুলির পরিচয়দান-সহ তিনি তাঁর জন্মভূমির মানুষজনের পদবি ('ব্যতিক্রমী কৌলিক পদবী' কৌতূহলোদ্দীপক), সেখানকার পথ-ঘাট, পুকুর-খাল, বাজার-হাট, সংঘ-সমবায়, মঠ-মন্দির, উৎসব-অনুষ্ঠান, শিল্প-সংস্কৃতি, খেলাধুলা-শরীরচর্চা, বিদ্যালয়-পাঠাগার, প্রতিষ্ঠান, সমাজশিক্ষা, পানীয় জল, চিকিৎসাব্যবস্থা, বেতারগোষ্ঠী ইত্যাদির কথা মেলে ধরেছেন, অনুসন্ধান করে তুলে এনেছেন বিগত কমবেশি শতবর্ষজোড়া অতীতকে। সেখানকার অভিনয়শিল্পীদের তালিকা, সেখানকার শিক্ষিত মানুষদের তালিকা স্থান পেয়েছে তাঁর পুস্তকটিতে। উঠে এসেছে সে গ্রামের পরিবর্তনশীলতার চিত্র। সে গ্রামের কৃতী মানুষ-তাঁর হাতে সে গ্রামের অবস্থান অর্থাৎ অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ থেকে শুরু করে তার বিস্তৃত পরিচয় বিধৃত হয়েছে বইটিতে। সাতটি অধ্যায় এইভাবে বিন্যস্ত হয়েছে — বেগমপুর গ্রাম পরিচিতি, পরিবার পরিচিতি, প্রতিষ্ঠান পরিচিতি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, স্বাস্থ্য সচেতনতা, কৃতী মানুষ-স্নাতক-স্নাতকোত্তর ও সমতুল এবং পরিশিষ্ট। বোঝা যায় অনায়াসে যে কাজটি তাঁর হঠাৎ খেয়ালের নয়। তিনি লোকসংস্কৃতির ছাত্র, দীর্ঘদিনের লোকসংস্কৃতির সুযোগ্য চর্চাকারী। তাঁর সমৃদ্ধ, সুবিন্যস্ত লিখনে প্রকাশিত গ্রন্থ 'চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবী ঃ পালাগান ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা' (দে'জ পাবলিশিং), 'দক্ষিণ ভারতের লোকদেবতা ও লোকাচার ঃ বাংলার লোকসংস্কৃতি সম্পর্ক' (দে'জ), 'সুন্দরবন সভ্যতা ও লোকসংস্কৃতি অন্বেষণ' (দে'জ), 'বাংলার লোকদেবতা ও সমাজসংস্কৃতি' (আনন্দ পাবলিশার্স) বিদ্বৎসমাজে সমাদৃত। কাজটি যে তাঁর হঠাৎ খেয়ালের নয়, দীর্ঘদিনই তাঁর অন্তরে লালিত, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণও রয়েছে গ্রন্থটিতে যেখানে এমন বহু মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার কথা রয়েছে যাঁরা আজ আর এ পৃথিবীতেই নেই।
বেগমপুরের ইতিহাস কেন পড়তে যাবে লোকে — নিতান্ত এক গ্রামের ইতিহাস! অনেকসময় যাকে বলা হয় আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাস। উলটে বলা যায়, পড়বেই না বা কেন মানুষ! কোনও এক গ্রামের বলেই কি তার ইতিহাস হেলাফেলার হতে পারে? সেই গ্রাম কি তার অঞ্চল-থানা-জেলা-রাজ্য ইত্যাদি পেরিয়ে দেশলগ্ন নয়? সেই দেশেরও তো আকার প্রকার পালটে যায় কোনও সিদ্ধান্তের ফলে! এক মুহূর্তের জন্যে মনে মনে আমরা যদি দেখি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বিভাজন-রেখাগুলো উধাও হয়ে গেছে, কেমন বোধ হয়! একটা বৃহত্তরতায় অন্বিত হয়ে ওঠে না কি! স্বামীর মৃত্যুর পর কমলা মণ্ডলের (মাল) শহর থেকে আনা দাগি-পচা শাকসবজি, কমদামি নোনা মাছ ইত্যাদি নিয়ে কাঠপুলের কাছে আমগাছের নিচে বসে অল্প পয়সায় গ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের জীবনধারণের সুবিধা করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তান-সহ নিজের জীবিকার বন্দোবস্ত করাটা যে ওতপ্রোত হয়ে রইল একটি বাজারের সূচনার সঙ্গে, সত্যিই কি এ বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা? ধন্যবাদ লেখককে, কাটাখাল বাজারের পত্তনকারিণী হিসাবে তাঁর কথা এবং আলোকচিত্র উপস্থাপন করার জন্যে। কাটাখাল বাজার গড়ে ওঠার আগে কাঠের পুলের দক্ষিণে অবস্থিত কয়েকটি মুদিখানার, পানবিড়ি ও চায়ের দোকানের পর্যায়ক্রমিক তালিকা দিতেও ভোলেন না লেখক। শুধু লিখে রাখবার অভাবে, ধরে রাখার অনীহায় হারিয়ে যায় কত যে জন্মলগ্নের কথা — জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর কথা! অথচ কালে সে বাজার বা হাটের হতে পারে বিরাট হাঁকডাক, প্রতিষ্ঠানের বিশাল প্রতিপত্তি। প্রথাগত শিক্ষায় বলার মতো তেমন কিছু নয়, গান্ধিবাদী সরল জীবনযাপনের কার্তিকচন্দ্র ভট্টাচার্যকে কেবল স্থানীয় বা আঞ্চলিক মানুষ বলে কে গুরুত্বহীন ভাববে, যিনি তাঁর নিজের যাপনকেই দৃষ্টান্ত করে তুলেছিলেন মানুষ গড়ার, সমাজ গড়ার কারিগর হিসাবে! এমন মানুষ আর একেবারেই ছিল না কোনো গ্রামে তা তো নয়। মূলত শহরকেন্দ্রিক ব্যক্তিত্ব — যাঁদের উপর সভা-সমিতির আলো পড়ে, প্রচার মাধ্যম সহজে পেয়ে যায় যাঁদের, তেমন মানুষরাই বিভিন্ন জায়গায় উল্লিখিত হয়ে থাকেন বেশি করে। একটি বিদ্যালয়ের গড়ে ওঠার পথে কতবার যে ঠাঁইনাড়া হতে হয় তাকে, কত চড়াই-উতরাই পেরোতে হয় তারও নজির এ পুস্তক, যে নজির কত যে পেতে পারতাম আমরা এমনভাবে গ্রামগাথা লেখা হতে থাকলে! অন্তত বর্তমান আলোচকের গ্রাম ও তার আশেপাশে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিত্ব হিসাবে এমন নজির রয়েছে।
কোনো পুস্তকের আলোচনায় কার্তিকবাবুদের বা এক বাজারের সূচনা থেকে তার সমকালীনতা বা তার সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কমলা মণ্ডলদের মতো মানুষদের বিস্তৃত পরিচয়দানের কথা নয়, তা তোলা থাকার কথা তার পাঠকদের জন্য। বলার কথা এই যে, ধরে রাখতে জানলে ইতিহাসের কত না কালখণ্ডে মর্যাদার আসনে আসীন থাকতেন এঁরা! আসলে পরিবার, সমাজ হয়ে যেমন রাষ্ট্র ইত্যাদি, গ্রাম-থানা-জেলা ইত্যাদি থেকে রাজ্য হয়ে তেমন দেশ, দেশ ছাড়িয়ে পৃথিবী। এক্ষেত্রে, ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে তাই, বিশ্বসাথে যোগে যেথায় 'বিরাজ'। আমরা ধরে রাখতে পারিনি, অন্বিত করে উঠতে পারিনি — সে ধারা গড়ে ওঠেনি আমাদের, তাই আগাপাস্তলা লিখতে হচ্ছে দেবব্রতবাবুদের, নইলে কেবল 'বাকি ইতিহাস' লিপিবদ্ধ করে চললেই হত। শ্রী নস্কর তাঁর নিবেদন-এ লিখেছেন, 'মানুষের ইতিহাস লুকিয়ে আছে প্রতিটি পরিবারে, পূর্বপুরুষের কীর্তিকলাপে, দেশাচারে, সংস্কার সংস্কৃতিতে, ভৌগোলিক পরিবেশে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি ক্ষেত্রে। আঞ্চলিক ইতিহাসের সম্মিলিতরূপ প্রকৃত অর্থে দেশ ও জাতির ইতিহাস। এই ইতিহাসের লেখক ও পাঠক বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে, এটাই আশার কথা।' বইটি উৎসর্গও করেছেন তিনি 'বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস সচেতন মানুষের উদ্দেশে।'
বেগমপুর দেবব্রত নস্করের মতো গুণী সন্তানকে পেয়েছিল বলে তাঁরই হাতে রচিত হল তার ইতিহাস। গ্রামগঠনের পথে ভূমিকা রেখে যাওয়া কত যে মানুষের কথা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে ভাস্বর করে রাখলেন তিনি! ভুবনডাঙা-পর্বে সে স্থানের কথা কতটুকু লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু শান্তিনিকেতনের ইতিবৃত্ত ইতোমধ্যে কম রচিত হয়নি। সরকারি বা বেসরকারি দু-একটি উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত তথা শীর্ষছোঁয়া দু-এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিত্বের সুবাদে কোনও গ্রাম বা তার জেলা প্রচারের আলোয় চলে আসতে পারে, তার চেহারা-চরিত্র পালটে যেতে পারে (যেমন, সাম্প্রতিক অতীতে দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার সঙ্গে যেমন তাঁর জন্মগ্রামে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ সংযোগের ঘটনা জড়িয়ে রইল), তখন মাত্রাগতভাবে তার ইতিহাসকে পূর্বের মতো করে আর আঞ্চলিক বা স্থানীয় বলে দেগে দেওয়া যায় কি সেভাবে! একদা তাকে নিয়ে একাধিক ইতিহাস রচিত হতে পারে, কিন্তু তাতে করে পূর্বলিখিত তার ইতিহাস গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে না, বরং তার কদর বেড়ে যেতে পারে। বিশেষত গ্রামে পরিবর্তনটা বেশি করে চোখে পড়ার কথা, আগের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে তফাৎটা বিশেষ করেই মালুম হওয়ার সম্ভাবনা।
স্বতঃস্ফূর্ত সমাজবীক্ষণেরও স্বাক্ষর শ্রী নস্করের এ বই, যেখানে সমাজবীক্ষণের জন্য লেখককে আলাদা করে কোনো প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। যেমন ঝোড়াচুবড়ি বোনা, ঢোল-কাঁসি বাজানো, অন্যের বাড়িতে মজুরখাটা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারী 'কাওরা' সম্প্রদায়ের কথা বলেছেন তিনি, উচ্চবর্গীয়দের কাছে যাঁরা মানবিক সম্মানটুকুও পেতেন না; 'কাঙালি' অভিহীত যাঁরা অনাহুতভাবে অন্য সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানবাড়িতে উপস্থিত হয়ে বাইরে অপেক্ষা করতেন একমুঠো খেতে পাওয়ার আশায়। অন্যের উচ্ছিষ্ট পর্যন্ত খেতেন তাঁরা, বা সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরতেন। বর্তমান আলোচকও তার গ্রামে এমনটি দেখেছে। লেখকের আক্ষেপ ফুটে ওঠে, 'অথচ স্বাধীন ভারতে এঁদের দিকে কারোর নজর দেবার অবকাশ ছিল না। মনুষ্যত্বের এমন অপমান চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কেবল ভোটের সময় ভোট কর্তারা ভোট চাইতে এই পাড়ায় ঢুকতেন। ভোটের সময় সামান্য অনুদান (চাল গম মদ টাকা ইত্যাদি) দিয়ে ভোট নিজেদের পক্ষে চাইতেন।' 'একাধিক গ্রামের লোকশিল্পী একসাথে মিলিত হয়ে গানের দল তৈরি করে গান বাজনা নিয়ে মেতে থাকত। বেঁচে থাকার প্রতিকূলতাকে সে সময়ের মানুষ যাত্রা, পিরুলিগান, পাঁচালগান, তরজা, টপ্পা, পুতুল নাচ, রামায়ণ গান প্রভৃতির মধ্যে ডুবে থেকে জয় করার চেষ্টা করত।' — লিখেছেন তিনি। এও লিখতে ভোলেননি, 'তখন খেঁজুরে তাড়ি বা তালের তাড়ির খুব কদর ছিল। তাড়ির ভাঁড়কে কেন্দ্র করে ও যাত্রা নাটক ইত্যাদির উপলক্ষ রেখে অনেক প্রতিভাবান বড় মানুষকে এক জায়গায় করা সম্ভব হত।'
বেগমপুরের মানচিত্র তার প্রধান অপ্রধান সড়কের অঙ্কিত নকশা এবং মঠ-মন্দির-মূর্তি, বিদ্যালয়, বাজার, ব্যক্তিত্বের একাধিক ছবি বইটিকে আরও বিশ্বস্ত এবং আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বর্ণনাপর্ব পেরিয়ে, রঙিন চিত্রে রয়েছে/রয়েছেন হাঁদোলের ভগ্ন দোলমঞ্চ, হাঁদোলের শিবমন্দির, হাঁদোলের বিবিমার থান, নারায়নীতলার বিবিমা, চণ্ডীতলার মাঠে দেবী চণ্ডীর মন্দির, নারায়ণীতলার নারায়ণীর থান, হাঁদোলের কালীমাতা ও পঞ্চানন্দের থান, বিশ্বনাথ প্রামাণিকের কালীমন্দির, কামরা বেগমপুর নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়, বেগমপুর জ্ঞানদাপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন, বেগমপুর সমাজ শিক্ষণ পাঠাগার ও ডাকঘর, কার্তিকচন্দ্র ভট্টাচার্য, কাটাখাল বাজার, কাটাখাল বাজারের পত্তনকারিণী কমলা মণ্ডল (মাল), নারায়ণীতলার দেবী নারায়ণী ও বেগমপুর শ্রীগুরু সেবাশ্রম। কিছু কিছু বাড়তি প্রাপ্তিও ঘটে যায়, যেমন ১৯১৫ সালের বাজারদরের একটি তালিকা।
নিজ গ্রামের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নিয়ে বলতে গিয়ে যাত্রাগান, গোষ্ঠগান, পাঁচালি, তরজা, রবীন্দ্রজয়ন্তী, টপ্পা, কীর্তন, বৈঠকি, যন্ত্রসংগীত, নৃত্য ইত্যাদির পরিচয় দিয়েছেন লেখক। লেখক স্বয়ং 'রবীন্দ্র তরজা' গানের সৃষ্টি করেছিলেন জেনে খুব ভাল লাগল। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের নাট্যরূপও দিয়েছেন লেখক, যা অভিনীত হয়েছে গ্রামে। এ গ্রামে প্রথম আবৃত্তিচর্চার শুরুও শ্রী নস্করের পরিবারে।
লেখকের প্রতি আলাদা করে সম্ভ্রম অনুভূত হয় যখন দেখা যায় যে নাটমন্দির নির্মাণে প্রধান মিস্ত্রিদের নাম দিতে ভোলেন না তিনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলে যেতেই অভ্যস্ত আমরা। সকল মানুষকে সম্মানসূচক সম্বোধন করেছেন তিনি এটা বিশেষভাবে ভাল লাগার নিশ্চয়ই (অনবধানবশত নিতান্ত দু-এক জায়গায় ছুট গেছে)। প্রায় পাঁচ বিঘের হাঁদোল পুকুরে মে ১৯৮৯, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দে যে পাকা স্নানের ঘাট তৈরি করা হয় তার মিস্তিরি রঞ্জিতকুমার সরদারের নাম রয়েছে দেখেও ভাল লাগল।
তাঁর ভূমিকাটি তাঁর কাজের প্রেরণা এবং তাঁর অন্তর্নিহিত ভাবনার পরিচয়বাহী। সাহিত্যিক শঙ্করপ্রসাদ নস্করের ভূমিকাটি এক কথায় অনবদ্য। ভাবনা, যুক্তি এবং লিখনশৈলীর গুণে নিটোল রত্ন যেন সেটি! একটু/একটি দৃষ্টান্ত দিই। ইতিহাসের আঞ্চলিকতা প্রসঙ্গে একস্থানে লিখেছেন তিনি, "ইতিহাস ইতিহাসই 'আঞ্চলিক' হতে পারে না। রোম, স্কটল্যান্ড, ভুটান প্রভৃতি এমন বহু রাষ্ট্র আছে, যা পৃথিবীর এক সামান্য অংশ মাত্র। তার ইতিহাস কি আঞ্চলিক হবে? বাঁকুড়া, বীরভূম, হুগলি, হাওড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার ইতিহাস আছে কিন্তু তা আঞ্চলিকতায় আক্রান্ত নয়। বেগমপুর একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম — আয়তনে বেশ বড়। তার বহুদিনের পালিত একটা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে। সুতরাং তার নিজস্ব শক্তি ও গুণমাধুর্যে নিজেই একটা ইতিহাসের দাবিদার হতে পারে। সে নিজের আলো নিজেই জ্বালতে পারে এবং জ্বালিয়ে রাখতে পারে।"
বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ খামতির কথা না বললেই নয়। যে-কোনো সভ্যতার ধারক বলতে গেলে আজও কৃষি। কারণ কৃষিই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, আর না বাঁচলে শিল্প হয় না, সাহিত্য হয় না, সংস্কৃতি শুকিয়ে যায়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক তৈরি হয় না। যাঁদের বিচিত্র কর্মভারের উপর ভর দিয়ে 'চলিতেছে সমস্ত সংসার' (রবীন্দ্রনাথ), তাঁদের অন্যতম প্রধান কৃষক এবং তাঁদের কৃষি যথাযোগ্য গুরুত্ব ও মর্যাদা পেলে ভাল লাগত। একথা বলার পিছনে আক্ষেপ আছে বই-কি! একজন কৃষক যত ফসল ফলান না কেন, যত বিঘা বাঁশ-গাছপালা থাকুক না কেন তাঁর, বৃক্ষরোপণ উৎসবে বৃক্ষটি রোপণ করছেন কোন মহাজন! কোনও রাজনীতিক, আমলা, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, গবেষক আদি — তাঁর হয়তো চাষবাস-বৃক্ষরোপণের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই নেই! একটা বিবৃতি বা প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষরের সময় পাশে পরিচয়ে লেখা হচ্ছে অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ডাক্তার, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি — একজন কৃষকের সইয়ের পাশে (অবশ্য এঁদের সই নেওয়ারই যোগ্য নয় বলে মনে করেন বহু মানুষই, এমনই আমাদের শিক্ষাদীক্ষা!) কবে দেখব 'কৃষক' লেখা! এই কৃষক-শ্রমিক লেখা যেদিন থেকে গুরুত্ব পাবে, মানুষের মর্যাদার প্রকৃত মূল্য-দিতে-শেখা সে দেশ-পৃথিবীকে অন্য রূপে দেখতে পাব আমরা। আজও মানুষ উদ্ভিজ্জ, কৃষিজ বা প্রাণীজ উপাদানের বাইরে গিয়ে এমন কোনো কৃত্রিম খাদ্য বা ওষুধ তৈরি করে উঠতে পারেনি যা গ্রহণ করে দীর্ঘদিন কৃষি আদিকে কাঁচকলা দেখিয়ে বাঁচা যাবে। বর্তমান আলোচকের পিতা প্রায়শই একটি উক্তি করত, 'নাড়ার গোড়ার রস বেড়ার গোড়ায়।' যেসব প্রেক্ষিতে ও যে অভিব্যক্তিতে বলত তাতে এই সত্যই প্রকাশ পেত যে সবকিছুর রস, উৎস, মূল বা নির্ভর ওই ধানগাছের গোড়া — নাড়া — তথা খাদ্যশস্যে। তাই কৃষিকথা গ্রামীণ পটভূমির এমন একটি ইতিহাস বইয়ে অবশ্যই ভূমিকা নিতে পারত। প্রসঙ্গক্রমে এবং বিচ্ছিন্নভাবে একটু আধটু বাগানচাষ বা কৃষির কথা এসেছে, কিন্তু আলাদা করে কৃষি শিরোনামে কোনও অধ্যায় না হোক, অন্তত অনুচ্ছেদ এ বইয়ে পেতে পারতাম আমরা।
কোনও কোনও মানুষের, বিশেষত যাত্রাশিল্পী ইত্যাদির মতো সংস্কৃতিকর্মীদের সংস্কৃতিচর্চার পথে বা অনুষঙ্গে সুখ-দুঃখের বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকে সচরাচর, তেমন কোনও কোনও স্মৃতি সন্নিবিষ্ট হলে ভাল হত। তথ্য সমাবেশের মাঝে মাঝে এগুলো পাঠককে অন্য স্বাদের অবসর দিত। তালিকা মূলত তথ্যসর্বস্ব, অনুসন্ধিৎসুজনের প্রয়োজন মেটানোর; সহিতত্ব থেকে স্মৃতি এগিয়ে থাকে সাহিত্যের দিকে, রসপিপাসু পাঠকের যা তৃপ্তিদান করে।
২৬ পাতায় বেগমপুর পূর্বপাড়ায় মাধ্যমিকে ০৩ ও উ.মা.-তে ৭ দেখানো হয়েছে, এখানে কোনও ছাপার ভুল হয়েছে কি? ৪২ পাতায় 'বেণিপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জ্ঞানরঞ্জন চক্রবর্তী ' লেখা হয়েছে, জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হবে। ৪৪ পাতায় ১৪১৬ সাল ছাপার ভুলে ১৩১৬ হয়েছে, ৭৮ পাতায়, আর্টের প্রতি কার্তিকবাবুর দখলের কথায় ছাপা 'তুলো দিয়ে'টা 'তুলি দিয়ে' হবে কি?
ভবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের অভিনীত যাত্রাপালার দীর্ঘ তালিকা বা প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের তালিকা পরিশিষ্টে দিলেই ভাল হত। বস্তুত সপ্তম অধ্যায়ে লিখিত বেগমপুর গ্রামের পূজাপার্বণ, পরিবেশ ও মানুষের কথা উক্ত অধ্যায়ের অধীনেই ঠিক ছিল, অধ্যায়ের নিচে আবার পরিশিষ্ট উল্লেখ করবার দরকার ছিল না। ওগুলো পরিশিষ্টের বিষয় নয়, আর পরিশিষ্টের নিজের কোনো অধ্যায়ের অধীন থাকবার দরকার পড়ে না।
পুরোনো ধরনের বানান, বানানের হেরফের রয়ে গেছে বেশ ভালরকমেই।
অভিজিৎ সরদারের প্রচ্ছদ ভাল।
পরিশেষে শ্রী নস্করকে অশেষ ধন্যবাদ এমন একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করার জন্য যা অন্য অনেকের কাছে প্রেরণা ও দিশারীর কাজ করবে বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে যায়।
...........................
পুস্তকের নাম : বেগমপুরের ইতিহাস
লেখকের নাম : ড. দেবব্রত নস্কর
প্রকাশকের নাম : প্রবাহ প্রকাশন (কলকাতা—৯)
প্রকাশকাল : আগস্ট ২০২২
মূল্য : ২০০ টাকা
=======০০০========
26পেজ এ লিখিত তথ্য একটি সমীক্ষা রিপোর্ট, যেমন পেয়েছি, যাচাই করা হয় নি। কার্তিক বাবুর আর্ট তুলোদিয়ে আলমারির পাল্লায় ভিতরে তৈরি বা নির্মাণ। 42পেজ শিক্ষক
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনজ্ঞানরঞ্জন নামটি সাক্ষাতকার সূত্রে পাওয়া, সঠিক জ্ঞানেন্দ্রনাথ জানলাম। পরিশিষ্ট অংশটি বিশেষ ঘটনাক্রমে হয়েছে। বানান বিষয়ে আরও সতর্কতার বিষয় মানছি। লেখক।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুন