Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

ভ্রমণকাহিনি ।। স্বপ্নময় দার্জিলিং ।। জীবন পাইক

স্বপ্নময় দার্জিলিং

জীবন পাইক



          গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চল সুন্দর বন নদ নদী পরিবেষ্টিত সমতল ভূ ভাগ ৷এখানে চারপাশে নদ নদী ,খাল বিল,আর জলাশয়ের অন্ত নেই ৷আমি এই সমতলের মানুষ ৷এখানকার জল হাওয়া  আর নোনা মাটিতে আমি আশৈশব লালিত হয়েছি  ৷ গায়ে আমার এখনো লেগে আছে নোনা হাওয়ার গন্ধ ৷ বঙ্গোপসাগরের কলমর্মর রূপ আমি দেখেছি দীঘার সমুদ্র সৈকতে ৷ পুরীতে ও সমুদ্রের লবণাক্ত সফেন জলে ভেসেছি প্রাণোচ্ছ্বাসে ৷সমুদ্রের সে রূপ, মুগ্ধতার আবেশ দীর্ঘ সময় জড়িয়ে ছিল আমার চোখে মুখে ৷
             কিন্তু  পাহাড়ি শোভা ছিল আমার কাছে এক স্বপ্ন রাজ্য ৷ বিভিন্ন ভ্রমণ কথায় দার্জিলিং এর দূর্গমতা , রহস্যময়তা আর সৌন্দর্য বর্ণনা আমাকে প্রলুব্ধ করে ৷

 


                তাই স্বপ্নময় দার্জিলিং আমাকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিত ৷একদিন এসে গেল সেই আকাঙ্ক্ষিত সোনালি দিনটি ৷আমাদের বিদ্যালয়ের উদ্যোগে ব্যবস্থানা ৷ঠিক হল আশি জন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে আমরা জনা কুড়ি শিক্ষক শিক্ষিকা চলতি বছরের অক্টোবরের ৯ তারিখে পাঁচ দিনের জন্য একটি শিক্ষা মূলক ভ্রমণের উদ্দ্যেশে দার্জিলিং সফরে রওনা দেব ৷
          আমাদের বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী নিশ্চিন্ত পুর স্টেশন সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের ৷ শিক্ষক  শিক্ষিকদের ও অনেকে ডায়মন্ডহারবার লক্ষ্মীকান্তপুর আর কাকদ্বীপের বাসিন্দা ৷ আমাদের যাত্রা ৯ই অক্টোবর রাত ১১.২০টায় পদাতিক এক্সপ্রেসে ৷
            ঐদিন আমরা রাত ন'টার মধ্যেই সবাই শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে যাই ৷ স্টেশন চত্ত্বরে সে দিনের আনন্দ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই খুব দূরুহ৷সে দিনের সেই সুখকর অনুভূতি আমরা যারা গাঁ গেরামের মানুষ সব সময় বাইরের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠে না ,তাদের কাছে সত্যি দুর্লভ ৷ প্ল্যাটফর্মে যে যেমনটা পেরেছে লাগেজ রেখে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে ৷আমরা প্ল্যাটফর্মে কৌটো করেই ভাত আর কষা মাংস দিয়ে নৈশ ভোজ সারলাম৷ সবাই এর আনন্দ মুখর পরিবেশে কখন যে ১১.১৫ বেজে গেল বুঝতে পারি  নি ৷ঝমঝম করে পদাতিকের আগমনে আমার যেন সম্বিত ফিরল ৷ অনেকে তো নৈশ ভোজের কিছু খেয়ে ডাস্টবিন এ ফেলে লাগেজ নিয়ে ট্রেনে ওঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ 
           কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রত্যেকেই নিজের নিজের সিট পেয়ে যায় ৷ জমিয়ে বসে শুরু হয় তাদের গল্প ৷ বহুদিনে জমানো গল্প যেন মনের চোরা কুঠুরিতে সকলের জমা ছিল ৷ প্রত্যেক মাস্টার মশাই সময়ে সময়ে সবার কাছে এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিলেন ৷
             দুই প্রবীণ মাস্টার মশাই প্রদীপবাবু আর কুন্ডুবাবু আমাদের একশ জনের দলের দুই মুখ্য মুখ ৷ সারা রাত তাঁরাও জেগে ৷ ভোর রাতে মালদা স্টেশনে গাড়ি ঢোকার ঠিক আগেই ওনারা একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ৷ সকালেঘুম ভাঙতেই কুন্ডুবাবুর বিষন্ন মুখ দেখে হতভম্ব হয়ে উঠি ৷কি ব্যাপার!কুন্ডু বাবুর দামি মোবাইল ছিনতাই হয়ে গেছে ৷অনেক সাধের ফোন ৷ফোনের পেজে পাহাড়ের কত সুখকর স্মৃতি বিজড়িত ছবি জায়গা করে নিত ৷প্রাণোচ্ছ্বল মানুষটা মুহূর্তে মন মরা হয়ে গেলেন ৷
              আমাদের ট্রেন ছুটছে ঝড়ের বেগে ৷ সবার বুকে টগবগ করে ফুটছে এক অজানা আনন্দের অনুভূতি ৷আমার ঠিক মনে আছে, আমরা এন.জে.পি তে নেমেছিলাম ১০তারিখের সকাল সাড়ে ন'টার কাছা কাছি ৷ আমাদের ট্যুর ম্যানেজার প্রবীর বাবু খুব ভালো মানুষ ৷ আমাদেরকে যাতে নতুন জায়গায় কোন সমস্যায় না পড়তে হয় তার জন্য আগাম সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন ৷ আমাদেল জন্য দশটি বলেরো চার চাকা উনি ঠিক করে রেখেছেন ৷প্রতি গাড়িতে আটজন স্টুডেন্ট ও দুজন স্কট থাকবে আগে থেকেই ঠিক ছিল ৷

 

           আমাদের গাড়িতে আমি আর ত্রিদিববাবু আর আটজন ছাত্র ৷ গাড়ি ছুটছিল ঝড়ের গতিতে ৷ড্রাইভার ছিল হিন্দি ভাষী ৷যাতায়াতে অনেক কিছু জানার ইচ্ছা থাকলেও পাহাড়ি রাস্তায় মনোসংযোগ নষ্ট করার পক্ষপাতি আমি না ৷যত গাড়ি এগোচ্ছে কালো ধোঁয়াটে পাহাড় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার চোখের সামনে ৷প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধিরে ধিরে অবগুণ্ঠন খুলে
 আমাদের দৃষ্টি পথে প্রকট হচ্ছিল ৷ মাঠের পর মাঠ চির সবুজ চা বাগিচা ৷মাঝে মাঝে ছায়াদান কারি বনস্পতি৷ এখানে সেগুন আর পাইনের জঙ্গল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৷

 

হেনরিখ হাইনেক এর কথাটি বেশ মনে পড়ে "পাইন দাঁড়িয়ে আকাশে নয়ন তুলি ৷"এখানে পিঠে ঝুড়ি বেঁধে চা বাগানের মেয়েরা চা পাতা তোলায় ব্যস্ত ৷চারদিকে চা বাগিচা,ঘাস,আর জঙ্গল ৷সেখানে গোরু চরে বেড়াচ্ছে ৷ খবরের কাগজে চা  বাগানে চিতার হানার কথা মাঝে মধ্যে প্রকাশ পায় ৷ যদি এমনটা হয় তাহলে মানুষ , গোরু নির্বিঘ্নে এভাবে চলাচল করছে কেমন করে ? আমাদের ড্রাইভার জানিয়েছিল বেশির ভাগ সময় সন্ধ্যার দিকে এদের দেখা মেলে ৷ তার গাড়ির সামনে নাকি বার তিনেক চিতা বাঘ লাফিয়ে পড়েছিল ৷ সেই রোমাঞ্চ কর কথা শুনতে শুনতে দেখলাম পাহাড়ি বিছের মতো গাড়িটা আমাদের পাহাড়ের খাড়াই পথ আরোহণ করতে শুরু করেছে ৷

 

ছেলেদের বললাম,সবাই কথা কম বলবে আর খুব আস্তে ৷চড়াই উতরাই পথে কোন ভাবে ড্রাইভার এর মনোসংযোগ যেন বিঘ্নিত না হয় ৷
ছোট ছোট ছেলেদের কতক্ষণ বুঝিয়ে শান্ত রাখা যায় ? পাহাড়ি পথের দুধারে কত নাম না জানা ফুল, ফল, লতা আর গাছ গাছা ততক্ষণে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলে ছিল ৷এ যেন কপালকুন্ডলার নবকুমার এর স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ- "আহা,কি দেখলাম! জন্ম জন্মান্তরে ও ভুলিব না "৷
            নিউজলপাইগুড়ির বালাসন ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি যখন ছুটছিল তখন হাঁ করে মাথা তুলে তাকিয়েছিলাম ৬২০০মিটার সুউচ্চ পাহাড়টাকে ৷ আর এখন সেই পাহাড়ের উপর খাড়াই পথে ছুটছে আমাদের গাড়ি ৷সরু পাহাড়ি পথের দুপাশের গাছগাছালি  যেন পরষ্পরে মাথা নুইয়ে  পথটাকে আরো গ্রাস করে নিতে চায় ৷সে পাহাড়ি পথ বড়ো জোর ছ-সাত ফুট চওড়া হতে পারে ৷ একদিকে গভীর খাদ আর অন্য দিকে উঁচু পাহাড় ৷এখানে রেলিং এর কোন বালাই নেই। পাহাড়ি পথের ড্রাইভার এর বুকে সত্যিই যম দূতের সাহস ৷
            পাহাড়ি পথের ঢালে ঢালে পাহাড়ি মানুষের কি সুন্দর ঘর বাড়ি ৷ এত উপরে হাট বাজার দোকান পাট ৷ দেখলাম পথের ধারে এক পাহাড়ি পোল্ট্রি ফার্ম খুলেছে ৷ এখানে ঘর গুলো পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করা ৷
             সমতল থেকে উঠেছি অনেক আগে ৷ গরম বোধ অনেক আগেই কমেছে ৷ তবে যেটা শুনেছিলাম শীতের জামা কাপড় সোয়েটার ,মাফলার,জ্যাকেট মোটা চাদর অবশ্যই লাগবে ৷ যারা পাহাড়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা এমন কথা বলেন ৷কিন্তু আমি তো একটা গেঞ্জির উপর একটা ফুল হাতা জামা পরেই রয়েছি ৷ আমার বেশ আরাম বোধ হচ্ছিল ৷ এবার মেঘগুলো আমাদের গাড়ির মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে বুঝতে পারলাম ৷এখন আমরা সবাই মেঘ রাজ্যের বাসিন্দা ৷ আমার দলের একটি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলেই ফেলল, আমার স্বপ্ন সার্থক হল ৷ আমি মেঘে হাত দিচ্ছি ৷ আমরা তাকে হাত গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে বলি ৷ পাহাড়ি পথে কোন অজানা বিপদ আসতে পারে কে বলতে পারে ৷ মূহূর্তে আমরা কালো মেঘে ডুবে গেলাম ৷ একটা সময় নামল মুষল ধারে বৃষ্টি ৷ সে বৃষ্টি থামার যেন কোন লক্ষণ ই নেই ৷ড্রাইভারের পাশের সিটে আমি ছিলাম ৷প্রবল বৃষ্টিতে কোনটা পথ,কোনটা খাদ আর কোনটা উঁচু পাহাড় তা ঐ সময় আমি ঠাওর করতে পারি নি ৷ আমার কাছে সবটা সমান মনে হচ্ছিল ৷সেই বৃষ্টি ভেজা চড়াই পথে অন্যান্য গাড়িকে যে ভাবে আমাদের গাড়ি পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে ৷এভাবে দীর্ঘ পথ চলার পর মেঘ কাটলো, রোদ ফুটল ৷আমাদের গাড়ি হঠাৎ একটা জায়গায় এসে একটু টার্ন নিয়ে একটা ছোট্ট মাঠে ঢুকলো ৷
             এসে গেছি সবাই নামো নামো ৷ ড্রাইভার এর কথায় গাড়ি থেকে নেমেই এক অভূতপূর্ব শীতল বাতাসের মুখোমুখি হলাম আমরা ৷ আমি অবাক চোখে চারদিকে তাকাচ্ছি ৷ ড্রাইভার বলল এটাই মিরিক ৷আমার চোখে মিরিকের আকাশ ,বাতাস অপূর্ব স্বপ্নের রঙ ছড়িয়ে দিল ৷  পাহাড়ের এত উপরে এত সৌন্দর্যে মোড়া মিরিক লেকের রূপ সত্যিই অভাবনীয় ৷ভ্রমণ পিপাসু সুশোভন বাবুকে ঘিরে ধরেছে অনেক ছাত্র ছাত্রী ৷ আমি তো মিরিক লেকের এক উঁচু পাইন গাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম৷ হাল্কা বাতাসে তখন কাঁপছে মিরিক লেকের জল ৷সাথে মনটা ও যেন দুলে দুলে উঠছে ৷ ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ প্রবীর বাবু ভোলে ভালা নিপাট ভালো মানুষ ৷ কোমরে জড়ানো গামছা ৷ আমি তো চমকে উঠলাম ৷ প্রবীরবাবু কি এখন লেকে নামবে নাকি ৷ হিম শীতল জল ৷ ধারে ধারে বাঁধা বোট ৷ দেখলাম উনি ও পাইন তলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়লেন ৷
                 কিছুক্ষণ এখানে বসার পরে উঠে দাঁড়াতেই সনৎ বাবু আর তরুন বাবুর সঙ্গে দেখা ৷ এখানে পাহাড়নিরা নাকি ভালো মোমো তৈরি করে ৷ আমরা তিন জন একটা চালা ঘরে মোমো খেতে ঢুকলাম৷ এখানে ফুল কুঁড়ির মালার মতো লতানো নাম না জানা বন্য ফুলে কি মাধুর্য ভাবা যায় না ৷ এর পর চায়ে যখন চুমুক দেব বলেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম গরম চায়ের কাপ তখন ই ড্রাইভার হাঁক দিল গাড়ি ছাড়া হচ্ছে ৷ 
              ম্যাল রোডের কাছাকাছিতে ছিল আমাদের হোটেল ৷ গাড়ি চলছিল আপন বেগে৷ আমি ধিরে ধিরে ডুবে যাচ্ছিলাম স্বপ্নরাজ্যে ৷ চারিদিকে সবুজের বিচিত্র সমাবেশ ৷ সবুজ বন,পাহাড় মেঘমূলুকেই ডুবে আছে ৷ ভাসমান মেঘগুলো কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে দূরের পাহাড়ে ছিল কিছু ক্ষণ আগে ৷ এ আবার চলে এসেছে  এ পাহাড়ে ৷ কখনো বা এরা উপত্যকায় বিচরণ করে ৷ কবিল কল্পনায়--
"এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে ৷"
এই পরিষ্কার আকাশ তো এই মেঘ মুষল ধারে বৃষ্টি ৷ বন আকাশ , পাহাড়,কালো পিচ রাস্তা পাড়া গাঁর সদ্য বিবাহিত বধূর মতো যেন পুকুর জলে স্নান করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছে তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে ৷
               হোটেলে আসার সময় দেখলাম লোকজনে পরিপূর্ণ পাহাড়ি স্টেশন ঘুম ৷ যাত্রীরা প্রতীক্ষা করছে টয় ট্রেনের জন্য৷ আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল হোটেলের দিকে ৷ আমরা হোটেলে পৌঁছে অতি ঠান্ডা জলে ভয়ে ভয়ে স্নান সারি ৷ এইবার মনে হল কোট,জ্যাকেটের ভীষণ দরকার ৷ আমাদের ন'টা গাড়ি হোটেলে পৌঁছালে ও একটি গাড়ি আসে নি ৷পরে জানলাম ,ওরা পশুপতি মার্কেট হয়েই এসেছে ৷ আমাদে দুর্ভাগ্য আমরা নেপাল বর্ডারে এসেও পশুপতি মার্কেট এ ঢুকতে পারলাম না ৷
             সন্ধ্যার কাছাকাছি আমরা পরিপূর্ণ শীতের পোষাক পরে ম্যালে গেলাম ৷কি সুন্দর মনোরম পরিবেশে কবি ভানু ভক্তের মূর্তির পাশে বেদিতে বসলাম ৷ কত পর্যটক,স্থানীয় মানুষ জন ঘুরছে ফিরছে ৷ পথের দুপাশে অজস্র অস্থায়ী দোকানপাট ৷ কম দামে শীতের জিনিস পেয়ে ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা প্রাণ ভরে জিনিস কিনল ৷ ওই ম্যালের পাশেই ছিল মহাকাল বাজার ৷জমজমাটি বাজার বটে ৷এখানে একটা বড় চা দোকান থেকে বেশ দমি ভালো চা কিনলাম ৷ এখানে যে মহাকাল অর্থাৎ শিবের মন্দির আছে তা জানলাম পরের দিন ৷ রাত আটটার দিকে আমরা  গির্জার পাশের রোড ধরে হোটেলে ঢুকলাম ৷ পরের দিন রাত সাড়ে তিনটেয় উঠতে হবে টাইগার হিল অভিযানে ৷ টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান ৷ এখানকার আকাশ সব সময় মেঘলা ৷আমরাও আশা করিনি ৷তবু ও আমাদের গাড়ি ভোর রাতে হোটেলের দরজায় থামতে অগত্যা উঠে পড়ি ৷আকাশে চাঁদ,তারা তখন ঝলমল করছিল ৷ ভাবলাম সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য কপালে জুটলে ও জুটতে পারে ৷গাড়ি টাইগার হিলের অনেক উপরে নামিয়ে দিয়েছিল ৷ সেখান থেকে আরো অনেকটা উপরে আমাদের উঠতে হবে ৷ পাহাড়ি বাঁশবনের মাথা সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠল ৷সূর্য. হয়তো উঠে গেল , আমি আর প্রদীপ বাবু  ছুটতে শুরু করলাম ৷ টাইগার হিলে তখন রীতি মতো লোকে থিকথিক করছে ৷ গভীর প্রত্যাশায় আমরা উদ্গ্রীব হয়ে আছি কখন সূর্য উঠবে ৷

 

আকাশের কালো অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে একটা সময় রক্তিম সূর্যের উদয় হল ৷যেন সোনায় মোড়া একটা থালা ৷ অনবরত ঠিকরে পড়ছৈ সোনালি আভা ৷ সেই সোনালি রঙ ছড়িয়ে পড়েছে ভাসমান প্যাঁজা তুলোর মতো মেঘে ৷ কি আশ্চর্য এখানকার মেঘ নড়ে ও না চড়ে ও না ৷ একেবারে যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে ৷ এ মেঘের কি জ্যোতি !কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না ৷ হঠাৎ ভূগোলের মাস্টার মশাই অমিত বাবু বলেন,এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে ৷সত্যি কিছু সময় পর দেখলাম দূরে ধোঁয়ার মেঘ সরতেই চোখের সামনে শুভ্রতার অনাবিল সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷ কি সেই অপূর্ব রূপ ৷ তা কোন ভাবে ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন ৷ ওখান থেকে পাহাড়ি ঝর্ণা দেখতে আমাদের রক গার্ডেন অভিমুখে যাত্রা হল ৷ কি সুন্দর লোহার ছোট্ট সেতু পার হয়ে ঝর্ণা ধারার খুব কাছে এসে পৌঁছালাম ৷কতো রকমের পাহাড়ি লতা দেখলাম ৷কমলা লেবুর গাছে দেখলাম ঝুলন্ত ফল, পাহাড়ি চেরি লংকা ৷রক গার্ডেন ছাড়িয়ে এবার আমাদের গাড়ি ছুটল বাতাসিয়া লুপের দিকে ৷ ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেলাম ৷
      এখানে চারদিকে ছড়ানো কত সৌন্দর্য ৷ভিন্ন ভিন্ন ফুলের বাগান ৷ এখানে বেশ কিছু লোক জন  দূরবীনে পর্যটকদের  টাকার বিনিময়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপকে দেখানোর চেষ্টা করছে ৷মেঘ মুক্ত আকাশে আমরা এখান থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপে মোহিত হয়ে পড়েছিলাম৷ চারপাশে খাসি পুরুষ ও রমনির পোষাকে সজ্জিত হচ্ছিল পর্যটকেরা ৷আমাদের ছাত্রীরা কেউ কেউ তা পরে খুব  মজা অনুভব করতে থাকে ৷আমরা দেখেছি তেনজিং নোরগে রক৷
এক সকালে আমরা দার্জিলিং জুতে এসে পৌঁছাই ৷ বন্য জীব জন্তুর মধ্যে নীল গাই, হরিণ, বনবিড়াল, ভাল্লুক, বাঘ চিতা, রেড পান্ডা বন মানুষ দেখলে ও এখানকার সংগ্রহশালায় তেন জিং নোরগে ও অন্যান্য এভারেস্ট জয়ীদের পোশাক,আইস কুঠার,রোপ,কাঁটা বুট,অক্সিজেন সিলিন্ডার আমাকে এক নিমিষে তাদের পার্বত্য অভিযানের অতীত ইতিহাসে আমাকে হাজির করে ৷ চিড়িয়াখানার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি রোদ ঝলমল পরিবেশ তখন ৷হঠাৎ কালো মেঘ মুহূর্তে আমাদের ঢেকে ফেলল৷ আমাদের পোষাক হাল্কা হলেও ভিজিয়ে দিয়ে মেঘটা আস্তে আস্তে পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে ভেসে চলল ৷
              পরের দিন কারসিয়াং জঙ্গলের পাশ দিয়ে টয় ট্রেনের আঁকা বাঁকা লাইনের পাশ দিয়ে নাম না জানা ফুল আর পাইন জঙ্গলকে পিছনে ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে অবতরণ করতে থাকে আমাদের চার চাকা ৷ রাত আটটায় আমরা পদাতিক ধরেই রওনা দিলাম শিয়ালদহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে ৷ আমাদের দার্জিলিং ভ্রমণ কতটা যে সুখকর হয়ে উঠল তা বর্ণনাতীত ৷আমাদের স্মৃতিতে তা এক মাইল স্টোন হয়ে থাকবে ৷

 ====================

   জীবন পাইক

সুভাষগ্রাম, সোনারপুর, পশ্চিমবঙ্গ

 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক