ছেলেদের বললাম,সবাই কথা কম বলবে আর খুব আস্তে ৷চড়াই উতরাই পথে কোন ভাবে ড্রাইভার এর মনোসংযোগ যেন বিঘ্নিত না হয় ৷
ছোট ছোট ছেলেদের কতক্ষণ বুঝিয়ে শান্ত রাখা যায় ? পাহাড়ি পথের দুধারে কত নাম না জানা ফুল, ফল, লতা আর গাছ গাছা ততক্ষণে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলে ছিল ৷এ যেন কপালকুন্ডলার নবকুমার এর স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ- "আহা,কি দেখলাম! জন্ম জন্মান্তরে ও ভুলিব না "৷
নিউজলপাইগুড়ির বালাসন ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি যখন ছুটছিল তখন হাঁ করে মাথা তুলে তাকিয়েছিলাম ৬২০০মিটার সুউচ্চ পাহাড়টাকে ৷ আর এখন সেই পাহাড়ের উপর খাড়াই পথে ছুটছে আমাদের গাড়ি ৷সরু পাহাড়ি পথের দুপাশের গাছগাছালি যেন পরষ্পরে মাথা নুইয়ে পথটাকে আরো গ্রাস করে নিতে চায় ৷সে পাহাড়ি পথ বড়ো জোর ছ-সাত ফুট চওড়া হতে পারে ৷ একদিকে গভীর খাদ আর অন্য দিকে উঁচু পাহাড় ৷এখানে রেলিং এর কোন বালাই নেই। পাহাড়ি পথের ড্রাইভার এর বুকে সত্যিই যম দূতের সাহস ৷
পাহাড়ি পথের ঢালে ঢালে পাহাড়ি মানুষের কি সুন্দর ঘর বাড়ি ৷ এত উপরে হাট বাজার দোকান পাট ৷ দেখলাম পথের ধারে এক পাহাড়ি পোল্ট্রি ফার্ম খুলেছে ৷ এখানে ঘর গুলো পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করা ৷
সমতল থেকে উঠেছি অনেক আগে ৷ গরম বোধ অনেক আগেই কমেছে ৷ তবে যেটা শুনেছিলাম শীতের জামা কাপড় সোয়েটার ,মাফলার,জ্যাকেট মোটা চাদর অবশ্যই লাগবে ৷ যারা পাহাড়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা এমন কথা বলেন ৷কিন্তু আমি তো একটা গেঞ্জির উপর একটা ফুল হাতা জামা পরেই রয়েছি ৷ আমার বেশ আরাম বোধ হচ্ছিল ৷ এবার মেঘগুলো আমাদের গাড়ির মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে বুঝতে পারলাম ৷এখন আমরা সবাই মেঘ রাজ্যের বাসিন্দা ৷ আমার দলের একটি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলেই ফেলল, আমার স্বপ্ন সার্থক হল ৷ আমি মেঘে হাত দিচ্ছি ৷ আমরা তাকে হাত গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে বলি ৷ পাহাড়ি পথে কোন অজানা বিপদ আসতে পারে কে বলতে পারে ৷ মূহূর্তে আমরা কালো মেঘে ডুবে গেলাম ৷ একটা সময় নামল মুষল ধারে বৃষ্টি ৷ সে বৃষ্টি থামার যেন কোন লক্ষণ ই নেই ৷ড্রাইভারের পাশের সিটে আমি ছিলাম ৷প্রবল বৃষ্টিতে কোনটা পথ,কোনটা খাদ আর কোনটা উঁচু পাহাড় তা ঐ সময় আমি ঠাওর করতে পারি নি ৷ আমার কাছে সবটা সমান মনে হচ্ছিল ৷সেই বৃষ্টি ভেজা চড়াই পথে অন্যান্য গাড়িকে যে ভাবে আমাদের গাড়ি পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে ৷এভাবে দীর্ঘ পথ চলার পর মেঘ কাটলো, রোদ ফুটল ৷আমাদের গাড়ি হঠাৎ একটা জায়গায় এসে একটু টার্ন নিয়ে একটা ছোট্ট মাঠে ঢুকলো ৷
এসে গেছি সবাই নামো নামো ৷ ড্রাইভার এর কথায় গাড়ি থেকে নেমেই এক অভূতপূর্ব শীতল বাতাসের মুখোমুখি হলাম আমরা ৷ আমি অবাক চোখে চারদিকে তাকাচ্ছি ৷ ড্রাইভার বলল এটাই মিরিক ৷আমার চোখে মিরিকের আকাশ ,বাতাস অপূর্ব স্বপ্নের রঙ ছড়িয়ে দিল ৷ পাহাড়ের এত উপরে এত সৌন্দর্যে মোড়া মিরিক লেকের রূপ সত্যিই অভাবনীয় ৷ভ্রমণ পিপাসু সুশোভন বাবুকে ঘিরে ধরেছে অনেক ছাত্র ছাত্রী ৷ আমি তো মিরিক লেকের এক উঁচু পাইন গাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম৷ হাল্কা বাতাসে তখন কাঁপছে মিরিক লেকের জল ৷সাথে মনটা ও যেন দুলে দুলে উঠছে ৷ ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ প্রবীর বাবু ভোলে ভালা নিপাট ভালো মানুষ ৷ কোমরে জড়ানো গামছা ৷ আমি তো চমকে উঠলাম ৷ প্রবীরবাবু কি এখন লেকে নামবে নাকি ৷ হিম শীতল জল ৷ ধারে ধারে বাঁধা বোট ৷ দেখলাম উনি ও পাইন তলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়লেন ৷
কিছুক্ষণ এখানে বসার পরে উঠে দাঁড়াতেই সনৎ বাবু আর তরুন বাবুর সঙ্গে দেখা ৷ এখানে পাহাড়নিরা নাকি ভালো মোমো তৈরি করে ৷ আমরা তিন জন একটা চালা ঘরে মোমো খেতে ঢুকলাম৷ এখানে ফুল কুঁড়ির মালার মতো লতানো নাম না জানা বন্য ফুলে কি মাধুর্য ভাবা যায় না ৷ এর পর চায়ে যখন চুমুক দেব বলেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম গরম চায়ের কাপ তখন ই ড্রাইভার হাঁক দিল গাড়ি ছাড়া হচ্ছে ৷
ম্যাল রোডের কাছাকাছিতে ছিল আমাদের হোটেল ৷ গাড়ি চলছিল আপন বেগে৷ আমি ধিরে ধিরে ডুবে যাচ্ছিলাম স্বপ্নরাজ্যে ৷ চারিদিকে সবুজের বিচিত্র সমাবেশ ৷ সবুজ বন,পাহাড় মেঘমূলুকেই ডুবে আছে ৷ ভাসমান মেঘগুলো কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে দূরের পাহাড়ে ছিল কিছু ক্ষণ আগে ৷ এ আবার চলে এসেছে এ পাহাড়ে ৷ কখনো বা এরা উপত্যকায় বিচরণ করে ৷ কবিল কল্পনায়--
"এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে ৷"
এই পরিষ্কার আকাশ তো এই মেঘ মুষল ধারে বৃষ্টি ৷ বন আকাশ , পাহাড়,কালো পিচ রাস্তা পাড়া গাঁর সদ্য বিবাহিত বধূর মতো যেন পুকুর জলে স্নান করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছে তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে ৷
হোটেলে আসার সময় দেখলাম লোকজনে পরিপূর্ণ পাহাড়ি স্টেশন ঘুম ৷ যাত্রীরা প্রতীক্ষা করছে টয় ট্রেনের জন্য৷ আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল হোটেলের দিকে ৷ আমরা হোটেলে পৌঁছে অতি ঠান্ডা জলে ভয়ে ভয়ে স্নান সারি ৷ এইবার মনে হল কোট,জ্যাকেটের ভীষণ দরকার ৷ আমাদের ন'টা গাড়ি হোটেলে পৌঁছালে ও একটি গাড়ি আসে নি ৷পরে জানলাম ,ওরা পশুপতি মার্কেট হয়েই এসেছে ৷ আমাদে দুর্ভাগ্য আমরা নেপাল বর্ডারে এসেও পশুপতি মার্কেট এ ঢুকতে পারলাম না ৷
সন্ধ্যার কাছাকাছি আমরা পরিপূর্ণ শীতের পোষাক পরে ম্যালে গেলাম ৷কি সুন্দর মনোরম পরিবেশে কবি ভানু ভক্তের মূর্তির পাশে বেদিতে বসলাম ৷ কত পর্যটক,স্থানীয় মানুষ জন ঘুরছে ফিরছে ৷ পথের দুপাশে অজস্র অস্থায়ী দোকানপাট ৷ কম দামে শীতের জিনিস পেয়ে ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা প্রাণ ভরে জিনিস কিনল ৷ ওই ম্যালের পাশেই ছিল মহাকাল বাজার ৷জমজমাটি বাজার বটে ৷এখানে একটা বড় চা দোকান থেকে বেশ দমি ভালো চা কিনলাম ৷ এখানে যে মহাকাল অর্থাৎ শিবের মন্দির আছে তা জানলাম পরের দিন ৷ রাত আটটার দিকে আমরা গির্জার পাশের রোড ধরে হোটেলে ঢুকলাম ৷ পরের দিন রাত সাড়ে তিনটেয় উঠতে হবে টাইগার হিল অভিযানে ৷ টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান ৷ এখানকার আকাশ সব সময় মেঘলা ৷আমরাও আশা করিনি ৷তবু ও আমাদের গাড়ি ভোর রাতে হোটেলের দরজায় থামতে অগত্যা উঠে পড়ি ৷আকাশে চাঁদ,তারা তখন ঝলমল করছিল ৷ ভাবলাম সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য কপালে জুটলে ও জুটতে পারে ৷গাড়ি টাইগার হিলের অনেক উপরে নামিয়ে দিয়েছিল ৷ সেখান থেকে আরো অনেকটা উপরে আমাদের উঠতে হবে ৷ পাহাড়ি বাঁশবনের মাথা সোনালি আলোয় ঝলমল করে উঠল ৷সূর্য. হয়তো উঠে গেল , আমি আর প্রদীপ বাবু ছুটতে শুরু করলাম ৷ টাইগার হিলে তখন রীতি মতো লোকে থিকথিক করছে ৷ গভীর প্রত্যাশায় আমরা উদ্গ্রীব হয়ে আছি কখন সূর্য উঠবে ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন