Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। রাধারাণী কথা ।।  মিঠুন মুখার্জী

রাধারাণী  কথা

 মিঠুন মুখার্জী

 
আজ আমি এমন একটি বিষয় সকলের সামনে আলোকপাত করতে চলেছি, যেটি সকলেরই জানার প্রয়োজন। কলিযুগে দাঁড়িয়ে ফিরে যাচ্ছি দ্বাপর যুগে। দুষ্টের দমন ও সৃষ্টির পালনে ধরাধামে এসেছিলেন বসুদেব নন্দন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ সংগঠিত করেছিল কুরুক্ষেত্র মহারণের। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আড়ম্ভের পূর্বে অর্জুন তার প্রিয়জনদের হত্যা করার চিন্তায় মর্মাহত হয়ে পড়েন। তার গান্ডীব মাটিতে নুইয়ে পড়ে। যুদ্ধ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন তিনি। সেই মুহূর্তে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মনের সংশয় দূর করার জন্য বাণী বর্ষণ করেছিলেন। মানব জীবন ও মানব জীবনের রজ-তম-সত গুণ নিয়ে বুঝিয়েছিলেন তাকে।বলেছিলেন কর্মযোগের কথা। তুমি কোন্ কর্ম করলে কোন্ ফল লাভ হবে, কি ক্ষতি হবে, তা চিন্তা না করে কর্ম করে যাও। পরিণামের কথা চিন্তা করবেন ঈশ্বর। বলেছিলেন--- মানব দেহ পঞ্চভূত নিয়ে গড়ে ওঠে এবং একদিন পঞ্চাভূতেই বিলীন হয়ে যায়। আত্মা অবিনশ্বর, তার ধ্বংস নেই। সে নতুন নতুন দেহ পাল্টায়। পরমাত্মার অংশ আত্মা। যারা এটি জানেন, তারা কোনো অন্যায় করার আগে দশবার ভাবেন এবং পাপকর্ম থেকে সদা বিরত থাকেন। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায় উৎসাহ দান করানোর জন্য ও এই পৃথিবীতে  ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন। শেষমেষ অর্জুন  বাস্তব জীবন সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে গান্ডীব দৃঢ়ভাবে ধরেছিলেন আপন অধর্মাচারীদের হত্যা করার জন্য।" --- বৈষ্ণবী রাধারাণী দেবী মায়াপুরের এক আশ্রমে বসে তার গুরু ভাইবোনদের কাছে দ্বাপরের এই গল্প বলেছিলেন। নিজের জ্ঞাতিদের সঙ্গে ঝামেলা করে, সন্তানদের অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে, সংসার ত্যাগ করে তিনি বছর পাঁচেক আগে মায়াপুরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে তিনি রাধামাধবের প্রতিদিন সেবা করেন এবং সেখানেই ভোগ পান। পার্থিব বিষয়বাসনা ও মায়া তিনি একেবারে ত্যাগ করে দিয়েছেন। সন্তানরা মায়ের অনেক খোঁজ করেছেন, কিন্তু তার হদিস পাননি। মাঝে মাঝে সন্ধ্যা বেলা আশ্রমের অন্যান্য বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের কৃষ্ণ কথা শোনান তিনি।
            কলিযুগে কৃষ্ণ নাম ছাড়া গতি নাই--- এই কথা প্রতিটি মানুষকে বারবার বলতেন তিনি। তাইতো খুব নিষ্ঠার সহিত প্রতিটি প্রহরে কৃষ্ণ সেবা করতেন তিনি। তাকে অনেকেই কৃষ্ণদাসী বলে ডাকতেন। মাত্র দশ বছর বয়সে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে কৃষ্ণদাসী ওরফে রাধারাণী দেবী স্বামী গৃহে গিয়েছিলেন। সেই সময় সংসারের কোনো কাজই তিনি করতে পারতেন না। কৃষ্ণভক্তি তখন তার জীবনে প্রবেশ করেনি। শাশুড়ির হাতে মার খেয়ে খেয়ে ও মুখের গালাগাল খেয়ে অনেক কষ্টে সংসারের কাজ শিখেছিলেন। স্বামী রাধাগোবিন্দ কুন্ডুর বয়স তখন সতের বছর। বাবার মুদিখানার দোকানে বসে বাবার কাছ থেকে তখন একটু একটু করে রাধা গোবিন্দ ব্যবসা শিখছিলেন। শ্বশুর যদিও একটু আধটু রাধারাণী দেবীকে সমর্থন করতেন, শাশুড়ি একেবারে নয়। বিয়ের পাঁচ বছর তাদের এক ঘরে কোনদিন শুতে দেননি তিনি। রাধারাণী দেবীর স্বামী তার শ্বশুরের কাছে ও তিনি তার শাশুড়ির ঘরে ঘুমাতেন। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট চেপে রেখে সংসার করেছেন তিনি। কখনো কখনো দুচোখে বারিধারা নেমে এসেছে তার। কিন্তু তিনি শাশুড়ির বিরুদ্ধে যাননি।
         রাধারাণী দেবীর প্রথম সন্তান যখন হয়েছিল, তখন তার বয়স সতেরো বছর। সন্তান প্রসব করার সময় তার  খুব খারাপ অবস্থা। চোখের সামনে ছিল রাধামাধবের ছবি। রাধারাণী দেবী বারবার রাধামাধবকে ডেকেছিলেন আর বলেছিলেন--- 'এ যাত্রা আপনি আমায় ও আমার সন্তানকে রক্ষা করুন প্রভু। আমি আপনার প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ  থাকবো।'  প্রভুর কৃপায় দুজনেই সেই যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন। ছেলেকে দেখতে পুরো গোপালের মতো হয়েছিল। রাধারাণী দেবী মনে মনে ভেবেছিলেন, তার ঘরে বোধয় গোপাল এসেছেন। এক বছর পর বাড়ির পাশের এক ইসকন মন্দির থেকে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তারা স্বামী-স্ত্রী। সেই সময় থেকেই বাড়িতে রাখা শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহকে তিনি নিয়ম নিষ্ঠার সহিত মেনে আসছেন। শাশুড়ি ধীরে ধীরে তার প্রতি স্নেহশীলা হয়ে ওঠেন। রাধারাণী দেবী যে এই বাড়ির গৃহলক্ষী, তা তিনি বুঝতে পারেন। প্রথম  সন্তান পুত্র হওয়ায় শাশুড়ি বৌমার প্রতি আরো সন্তুষ্ট ছিলেন। নাতির নাম রাখেন শ্রীনিবাস। নাতিকে নিয়ে দাদু- ঠাকুমার আনন্দের অন্ত ছিল না।
           দেখতে দেখতে নাতি শ্রীনিবাস  সকলের সামনে বেড়ে ওঠে। দশ বছর পেরিয়ে যায়। দাদু- ঠাকুরমার চুলে পাক ধরে যায়। নাতি অন্ত প্রাণ তারা। ছেলে রাধাগোবিন্দের উপর দোকানের ভার পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে বাবা বাড়িতে সব সময় নাতিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ও রাধা কৃষ্ণ নামে মেতে থাকেন। প্রায় প্রায় রাধারাণী দেবীর শ্বশুর- শাশুড়ি মিলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্ম স্থানে তীর্থ করতে যেতেন। ছেলে ছোট্ট হওয়ায় রাধারাণী দেবীর ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারেন না। তাছাড়া গোপাল সেবা দেবেন কে?
             শশুর-শাশুড়ির অত্যন্ত জেদাজেদিতে রাধারাণী দেবী আরেকবার সন্তান সম্ভবা হন। এবার তিনি যমজ সন্তান জন্ম দেন। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। শ্রীনিবাস এদের থেকে বারো বছরের বড়। ফলে ভাই ও বোনের দেখাশোনায় কিছুটা সাহায্য সেও করে দেয়। এবার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো বিপদের মুখে রাধারাণী দেবীকে পড়তে হয়নি। পুরো বিষয়টা খুব ভালোভাবে মিটে গিয়েছিল। এবার ছেলের নাম রাখেন গোবিন্দরাজ ও মেয়ের নাম সুভদ্রা। এই নাম দুটি রেখেছিলেন রাধারাণী দেবী স্বয়ং। আগেকার দিনে ঠাকুর দেবতার নামে বেশি নাম রাখা হতো। আর রাধারাণী দেবীর শশুরবাড়িতে সকলেই যেহেতু কৃষ্ণভক্ত, সেহেতু ছেলে- মেয়েদের নামেও কোনো না কোনো ভাবে শ্রীকৃষ্ণের যোগসূত্র লক্ষণীয়।
            রাধারাণী দেবী যেহেতু শ্রীকৃষ্ণের সেবিকা ছিলেন, সেহেতু তারা পুরোপুরি নিরামিষহাড়ি ছিলেন। ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের মানসিকতাও তিনি সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। তারা পিতা-মাতার কথায় এতই বাধ্য ছিল যে, একটা কথা তাদের কোনো সন্তানকে দুবার বলতে হতো না। তবে যত দৌরাত্ম্য ছিল দাদু ঠাকুমার উপর। 
           পড়াশোনায় সকলেই খুব উত্তম ছিলেন। বড় ছেলে শ্রীনিবাস যখন বাংলা নিয়ে বিয়ে পাস করেন, তখন গোবিন্দরাজ ও সুভদ্রা পড়তেন তৃতীয় শ্রেণীতে। ছোটবেলা থেকেই চাকরি করার স্বপ্ন দেখতেন শ্রীনিবাস। এম.এ ও বি.এড করে তিনি স্কুল শিক্ষক হন। শিক্ষকতার দশ বছরের মাথায় নিজের পছন্দে একটি মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে আসেন। মেয়ের পরিবার আমিষহাড়ি হওয়ায় রাধারাণী দেবী এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু দাদু-ঠাকুমার প্রশ্রয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি। এই পরিবার ঠাকুর দেবতা তেমন একটা বিশ্বাস করতেন না। শাশুড়ির কথার উপরে তিনি কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে সংকল্প করেন, 'তিনি কোনোদিনও শ্রীনিবাসের বউকে মন থেকে মেনে নেবেন না এবং তাদের বাড়ি যাবেন না।' শ্রীনিবাসের এই কর্মের জন্য রাধারাণী দেবী  অভিমানে ও কষ্টে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। মা কথা না বলায় মায়ের পা ধরে শ্রীনিবাস ক্ষমা চান। সন্তানের প্রতি রাধারাণী  দেবী আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না।
              এদিকে দাদার যখন বিয়ে হয়, তখন গোবিন্দরাজ ও সুভদ্রা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে পা রেখেছেন। তারা দাদার এই কাজকে সমর্থন জানান। কারণ তারা দুজনও এ যুগের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তান। ভবিষ্যতে তারাও যে দাদার দেখানো পথে পা বাড়াবে না তা কেউ বলতে পারে না। বি.এ দ্বিতীয় বর্ষে যখন সুভদ্রা পড়েন, তখন তার মা রাধারাণী দেবী নিরামিষ পরিবার দেখে একজন স্কুল মাস্টারের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। রাধামাধবের কৃপায় ভালই ভালই তার বিয়ে হয়ে যায়। গোবিন্দরাজ একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন। যার পরিবারও নিরামিষহাড়ি ছিল না। ফলে প্রায়ই তাদের সম্পর্ক নিয়ে তারা চিন্তিত থাকতেন। তবে পড়াশোনায় এর প্রভাব কখনো পড়তে দেখা যায়নি। রাধারাণী দেবীকে তিন ছেলে-মেয়ে খুব ভয় পেতেন। কেবলমাত্র শশুর-শাশুড়ির কারণেই রাধারাণী দেবী যেভাবে ছেলেমেয়েদের শাসন করতে চেয়েছিলেন,সেভাবে পারেননি। শ্রীনিবাসের শশুরবাড়ির লোকেদের সাথে রাধারাণী  দেবীর একটুও বনতো না। তারা আসলে তিনি একেবারে চুপচাপ থাকতেন। শ্রীনিবাসের বউও শাশুড়িকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। অথচ জামাই সদানন্দ ও তার বাড়ির লোকেদের সঙ্গে রাধারাণী দেবীর খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা আসলে তাদের যত্নার্তির কোনো ত্রুটি হতো না। এটি বড় বৌমার মনে খুব আঘাত দিত। তিনি ছোটো ছেলে গোবিন্দ রাজের ভালোবাসার কথা জানতেন। মনে মনে বলতেন, 'আমিও দেখব ছোট ছেলের বউ এলে আপনি তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেন। তখন আপনার এই অপমানের যোগ্য জবাব আমি দেবো ।'
       কিছুদিন পর একটা অঘটন ঘটে। রাধারাণী  দেবীর সুখের সংসারে কার নজর লাগে। তার শশুর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর শাশুড়ি একেবারে মনমরা হয়ে যান। শ্বশুরের কাজ মিটে যাওয়ার পর শাশুড়ি রাধারাণী দেবীকে জানান--- 'তোমার শ্বশুর চলে যাওয়ার পর আমার মন সংসারে আবদ্ধ থাকতে চাইছে না। তাই এক বছর হলে আমি বৃন্দাবন চলে যাব। তোমার কাছে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে যাব।' রাধারাণী দেবী সেদিন বুঝেছিলেন সেও বেশি দিন সংসারে আবদ্ধ থাকতে পারবেন না। তার ছেলেদের নিয়ে সেও এই সংসার জীবনে শান্তি পাননি। শশুর গত হওয়ার পরবর্তী এক বছর তিনি শাশুড়িকে ঠাকুর যত্ন করেন। তাকে বলেন--- "মা আমিও আপনার সঙ্গে বৃন্দাবনে চলে যাব। এই সংসার আর ভালো লাগেনা।" রাধারাণী দেবীর কথা শুনে শাশুড়ি বলেছিলেন--- "তোমার তো এখনো ছোট ছেলের বিয়ে হয়নি। তাছাড়া পরকালের কর্ম করার মতো বয়সও তোমার হয়নি। এখন সংসারে থেকে রাধা মাধবকে সেবা করো। যখন সকলের একটা হিল্লে করে সংসার আর ভালো লাগবে না, তখন ধর্মস্থানে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে। তুমি চলে গেলে এ সংসার কানা হয়ে যাবে।"
        এক বছর পর রাধারাণী দেবীর শাশুড়ি সকলকে ছেড়ে বৃন্দাবনে বাসের জন্য চলে যান। চোখের জলে সকলে বিদায় জানান। ছেলে রাধাগোবিন্দ মাকে একেবারের জন্য চলে যেতে বাঁধা দিয়েছিলেন। কিন্তু মাতা শোনেন নি। তিনি বলেছিলেন--- "আমায় পেছন থেকে ওভাবে মায়ার বন্ধনে আটকাস না খোকা। বাকি জীবনটা আমি রাধা মাধবকে উৎসর্গ করতে চাই। তবে তোদের ইচ্ছা হলে তোরা আমায় বৃন্দাবনে দেখে আসতে পারিস।" রাধারাণী দেবীকে বলেছিলেন--- " বউ সব রইল, আজ থেকে সংসারের সব দেখাশোনার দায়িত্ব তোমার হাতে দিয়ে দিলাম। সবাইকে সাবধানে রেখো। মন খারাপ হলে কিংবা খারাপ সময় এলে রাধা মাধবের দ্বারস্থ হবে। উনি তোমাকে পথ দেখাবে।" নাতি-নাতনিরাও ঠাকুমার কথা মনে রেখেছিলেন।
       রাধারাণী দেবীর শাশুড়ি চলে যাওয়ার বছরখানেক পর গোবিন্দরাজ মেয়ের বাবা-মার অমতে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। শ্রীনিবাস বাবার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ছোট ছেলে একপ্রকার বেকার বললেই চলে। মা বাড়িতে জায়গা হবে না বললে গোবিন্দরাজ মায়ের বিপক্ষে গিয়ে বলেন, 'দাদা যদি একই কাজ করে এ বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারেন, তবে আমি আশ্রয় পাবো না কেন? আমার বেলায় দুচোখ কেন?' ছোট ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে যান রাধারাণী দেবী।স্বামী রাধাগোবিন্দ তাকে মেনে নিতে বলেন। তিনি বলেন--- "সবই রাধামাধবের ইচ্ছে। ওরা যদি সুখী থাকে তবে আমাদের বলে কি হবে। আমরা এই আছি, এই নেই। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে আমাদের।" স্বামীর কথা মতো এবারও ছোট ছেলে ও ছোট বউকে বাড়িতে আশ্রয় দেন তিনি । কিন্তু তিনি মন থেকে বড় বউয়ের মতো ছোট বউকেও মেনে নিতে পারেন নি।  এরপর যত দিন যায় দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে ওঠে। বৌদের মধ্যে বচসা বেড়ে যায়। চোখের সামনে সন্তানদের মারামারি গালাগালি রাধারাণী দেবী সহ্য করতে পারেন না। স্বামীর সাথে কথা বলে সম্পত্তি চার ভাগে ভাগ করে দেন তিনি। বড় ছেলে শ্রীনিবাস, ছোট ছেলে গোবিন্দরাজ, মেয়ে সুভদ্রা ও নিজেদের দুজনের জন্য একভাগ রাখেন। বৃহৎ মুদিখানার দোকান দুই ছেলে ও রাধাগোবিন্দ কুন্ডু মিলে চালাবেন ঠিক হয়। সারা মাসে যা আয় হবে তার সমস্ত লভ্যাংশ সমান তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে বলে জানান রাধারাণী দেবী। বড় ছেলে মায়ের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না। তিনি বলেন--- "আমি ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে  এই ব্যবসার উন্নতিতে সহযোগিতা করেছি। এখন ভাই কেন সমান অংশীদার হবে!!" রাধারাণী  দেবী  বুঝতে পারেন বড় ছেলের অন্তর লোভ ও হিংসায় পরিপূর্ণ হয়েছে। ত্যাগের মন্ত্রে ওকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি বলেন--- "ঠিক আছে, আমি ও তোর বাবা যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমাদের ভাগের টাকায় আমরা চলব। যখন আমরা থাকবো না, তখন আমাদের ভাগটা তুই পাবি।" মায়ের এই সিদ্ধান্তে আবার ছোট ছেলে গোবিন্দরাজ অখুশি হয়েছিলেন। কিন্তু সকলের সামনে কিছু না বলে চুপচাপ ছিলেন।
          এরপর একই বাড়ির মধ্যে তিনটি হাড়িচড়া শুরু হয়। দোকানের সামান্য সামান্য কারণ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে তর্কাতর্কি হত। মাসের শেষে বাবা রাধাগোবিন্দ কুন্ডু সমস্ত হিসাব নিকাশ কষে দেখেন, যতটা পরিমাণে লাভের টাকা হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। এর ফলে তার মনে সন্দেহ জেগে ওঠে। তিনি দুই ছেলেকে কিছু না বলে নজরে নজরে রাখেন। একদিন তিনি বাথরুমের নাম করে বাইরে গিয়ে ভিতরে কি ঘটছে তা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন। তিনি দেখেন বড় ছেলে ছোট ছেলেকে গুদাম ঘরে পাঠিয়ে ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা চুরি করছেন। সেদিন রাধাগোবিন্দ কুন্ডু কিছু বলেন না। তিনি এরপর আরো কয়েকদিন বড় ছেলের এই অপকীর্তি দেখেছিলেন। লাভের টাকা ভাগ করার সময় তিনি  টোটাল লভ্যাংশ টাকার চল্লিশ শতাংশ করে নিজে ও ছোট ছেলেকে দিয়ে বাকি কুড়ি শতাংশ বড় ছেলেকে দেন। বড় ছেলে বিষয়টা বুঝে উঠতে না পেরে অবাক হয়ে যান। এরকম ভাগের কারণ বাবার কাছে জানতে চাইলে বাবা সমস্ত বিষয়টা সকলের সামনে খোলসা করে বলেন। বড় ছেলে পুরো বিষয়টা অস্বীকার করেন। দোকানের মধ্যে বাবার সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু হয় শ্রীনিবাসের। বাবার উপর রুখে রুখে যান তিনি। এটা দেখে ছোট ছেলে গোবিন্দরাজ সহ্য করতে পারেননি। এক কথায় দু-কথায় দুজনার মধ্যে মারধর শুরু হয়। খরিদ্দাররা তখন কেউই দোকানে ছিলেন না। বাজারের অন্যান্য খরিদ্দাররা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কীর্তি দেখছিলেন আর হাসছিলেন।
        রাধাগোবিন্দ কুন্ডু বাজারের অন্যান্য লোকেদের হাসি দেখে অপমানিত বোধ করেছিলেন। একেবারে চুপচাপ সেদিন বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি খুব রেগে আছেন। বাড়ি ফিরে রাধারাণী দেবীকে তিনি সব জানান। বড় ছেলে শ্রীনিবাস বাড়ি ফিরলে তাকে রাধারাণী দেবী বলেন--- "তোর বাবার মুখ থেকে যা শুনলাম সব কি সত্যি? যে মানুষটা সংসারের কথা ছাড়া কোনদিন অন্য কিছু ভাবেননি, সেই মানুষটিকে এভাবে তুই অপমান করলি। ঠিক আছে আমি আর তোর বাবা এক সপ্তাহের মধ্যে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তোরা ভাল থাক।" মার সামনে শ্রীনিবাস চুপ করে থাকেন। সে ভালো করেই জানতেন মাকে রাগিয়ে দিলে দোকানের যে ভাগটি বাবা-মার অবর্তমানে তার পাওয়ার কথা, সেটা থেকে সে বঞ্চিত হবেন। তাই বাবার পা ধরে শ্রীনিবাস ক্ষমা চেয়ে নেন। আর বলেন---"আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কোনদিন দোকান থেকে টাকা নেব না।" সে যাত্রা রাধারাণী দেবী ও তার স্বামী বড় ছেলেকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু তারা বুঝেছিলেন, কেন সে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
          রাত্রে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাধারাণী  দেবী ও তার স্বামী ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আলোচনা করেন। রাধারাণী  দেবী বলেন--- "আজকালকার ছেলে-মেয়েরা টাকা ও সম্পত্তি ছাড়া কিছুই বোঝেন না। বাবা-মার কোন ভ্যালু নেই তাদের কাছে। তাই সংসারের বন্ধনে আর না থেকে, চলো আমরা দুজন পরকালের কর্ম করতে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের দোকানের ভাগ মেয়ে সুভদ্রার নামে লিখে দেবো। কারন সেও তো আমাদের সন্তান। কেউ যাতে বলতে না পারেন আমরা অন্যায় বিচার করেছি।" রাধারাণী  দেবীর কথাগুলি তার স্বামী মেনে নেন। দুই-তিন দিন পর এক ভোরের অন্ধকারে তারা দুজন মিলে মায়াপুরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। চলে যাওয়ার আগে তাদের ভাগটি মেয়েকে লিখে দিয়ে যান। প্রথমে তারা দুজন ভেবেছিলেন বৃন্দাবনে মায়ের কাছে যাবেন। কিন্তু মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পদধূলি পড়া মায়াপুরেই তাদের মন টানে। এখানে আসার তিন বছরের মাথায় অসুস্থতায় রাধাগোবিন্দ কুন্ডু পরলোকে পারি দেন। রাধারাণী দেবী  বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের সেবিকা রূপে নিয়োজিত হন। মায়াপুর ও নবদ্বীপের মানুষের কাছে কৃষ্ণ নাম বিলিয়ে দেন তিনি। সকলের কাছে তিনি খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন।  ছোট ছেলে ও মেয়ে-জামাই তাকে অনেক খোঁজ করলেও খুঁজে পান না। তাদের প্রতি অভিমানে রাধারাণী  দেবী আর কখনো সংসারে ফিরে যান নি। তিনি সকলকে বলতেন--- 'এ জগতে সবই মায়া, 'সত্য শুধু কৃষ্ণ প্রেম।'

=================

মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252





মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩