বিজয়া দেব
বিপিএল স্কলারশিপ পেয়েছে ইতি। প্রি- মেট্রিক স্কলারশিপ। ৫৫০ টাকা। ক্লাশ দিদিমণি ইতিকে বললেন - তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে?
-জানি না দিদিমণি।
-জানিস না মানে?
-শোনো যারা যারা বিপিএল আছো, তোমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নং ইস্কুলে জমা দিতে হবে। এই নং গুলো ইশকুল থেকে আমরা সরকারের কাছে পাঠাব। তারপর তোমাদের অ্যাকাউন্টে ৫৫০টাকা স্কলারশিপ জমা পড়বে। তিনদিনের ভেতর অ্যাকাউন্ট নং জমা করতে হবে।
ইতি ভালো করে বুঝল না ব্যাপারটা। একে ওকে জিজ্ঞেস করল। ওরা কীসব বলল পরিষ্কার হলো না। সে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরল। মাকে পাঠাতে হবে ইশকুলে।
বাড়িতে এখন মা নেই। ঠাকুদ্দা পরমেশ আছে। ডান পা ওর অকেজো। টেনে টেনে হাঁটে। একটু হাঁটলেই হাঁফিয়ে যায়। পথে বেরোয়। গল্পগুজব করে লোকজন পেলে। একে ওকে হাঁক পেড়ে ডাকে। বলে - একটু দাঁড়াও তো। অত ছুডো ক্যান? দুটো কথা না কইলে পরাণডা হালকা হয়? বুকে কথা জইম্যা জইম্যা পাত্থর হয়্যা গেল।
কেউ দাঁড়ায় কেউ দাঁড়ায় না। দাঁড়ালেই বুড়ো দু'চার কথা বলে বিড়ি চায়। বিড়ি পেয়ে গেলে চোখদুটো হাফবোজা করে কী সুখটান! লোকে নাম দিয়েছে - "বিড়ি বুড়ো"। ইতির ভারি লজ্জা করে। সঙ্গীসাথীরা হাসাহাসি করে। মার হাতে টাকা এলে বিড়ি এনে দেয়। ঠাকুদ্দাকে বলে বলে হয়রান হয়ে গেছে ইতি - ঠাকুদ্দা অতো বিড়ি খাইও না। মাইনষে হাসে। বুড়ো বোঝে না। বলে - হাসুক গা। তোগো লইজ্জা করে তো আমার কী!
বাড়ি ফিরে ইতি বলে - ঠাকুদ্দা গো, আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলন লাগে।
বুড়ো কপাল কুঁচকে শোনে। তারপর কালো কুচকুচে ভাঙ্গাচোরা দাঁত দেখিয়ে হাসে।
ইতি বলে - হাসো ক্যানে?
-তাইলে কান্দুম?
-কানবা ক্যান?
-তাইলে নাচুম?
-নাচবা ক্যান? আমি টাকা পামু। কলারশিপ। জলপানি। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলন লাগব।
-জলপানি পাইবি? ক্যানে? টায়েটোয়ে পাশ যাছ্ আবার জলপানি! কিওর জলপানি?
-আরে বিপিএল সাট্টিফিকেট আছে না? ঐটা জেরক্স কইরা ইশকুলে জমা দিছিলাম। তে সরকার টাকা দিব। ৫৫০ টাকা। আমি ভালা কইরা বুঝি নাই। তুমি একবার ইশকুলে যাবা?
-তুই জলপানি পাইলে আমার কি? বিড়ি কিন্যা দিবি? তার বেলা তো লবডঙ্কা।
ইতি জানত বুড়োকে বলে কোন লাভ নেই। টাকা
নাকি সোজা গিয়ে জমা পড়বে ইতির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
'নবম শ্রেণির ছাত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট! কালে কালে আরও কত কী শুনতে হঈব' ,ইতির বুড়ো ঠাকুদ্দা পরমেশ ভাবে। বুড়োটা ভাবেই শুধু। সব কাজ তো করতে হয় সরসীকে। বাপহারা ইতি। মা সরসী। দু'বেলা পরের বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, তায় চার চারটে বাড়ি। তার ওপর বেআক্কেল বুড়ো শ্বশুরকে সামলানো।
নৃত্যময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের পিওন কৃত্তি তৃতীয় পিরিয়ডের ঘন্টা মারল -ঢং! তারপরই নজরে পড়ল সরসীকে।
-এখানে কি?
-"ইয়ে মানে আমার মেয়ে বিপিএল কলারশিপ পাইছে ৫৫০ টাকা।''
-ভাল কথা।
-ব্যাংকে বই করন লাগে।
-এটা ব্যাংক না, ইশকুল।
-ইটা জানি। ক্যামনে কী করন লাগবো? - বড় রাস্তার বাঁক ঘুরে মাথাউঁচু
দালানবাড়ি? তার তিনতলায় ব্যাঙ্ক। ঐখানে যাও।
রাজপথের ঐ বাঁকটা পেরোলেই নাকি ব্যাংক। শ্রাবণের শেষ। আর ক'টা দিন পেরোলেই শ্রাবণ সংক্রান্তি। সরসীর পাশের ঘরে মনসাপূজা। সন্ধ্যে হলেই ওঝার দল এসে পদ্মাপুরাণ গায় । সুরটা শুনলে ভেতরটা আকুলিবিকুলি করে। রাতে সরসী গিয়ে বসে। সারাদিনের খাটুনির পর ঐটুকুই ভালো লাগা সময়। গা ধুয়ে একটা ফর্সা কাপড় পরে গিয়ে পদ্মাপুরাণ শুনতে বসে। নিজেকে তখন পরিশুদ্ধ মনে হয়। এখন ব্যাঙ্কের এই কঠিন কাজ ঠিকঠাক শেষ হলে হয়। আজও সন্ধ্যার পর সে যাবে। মাসে মাসে ৫৫০টাকা পেলে আরেকটু ভালো দেখে প্রাইভেট টিউশনে পাঠাবে মেয়েকে সরসী। আগামী বছরেই তো মাধ্যমিক।
কাঁচে ঢাকা সারি সারি কাউন্টার।ব্যস্ত চারপাশ। কাঁচের চৌকোনো ঘরের ভেতর তাড়া তাড়া নোট গুণছে এক মহিলা। কাকে জিজ্ঞেস করে সরসী! সামনে বন্দুক কাঁধে দশাশই চেহারার একটা লোক।ওকে বলা যায়? কাছে গিয়ে বলে,''আমার মেয়ে বিপিএল কলারশিপ পাইছে ৫৫০ টাকা। "
একটু গোঁফ মুচড়ে হাসল লোকটা- বহোত আচ্ছা!
--কিন্তু টাকাটা ইশকুল দ্যায় না।
--কিঁউ? য়্যায়সা কিঁউ? তো আপকো লিয়ে ক্যয়া কর সকতা হুঁ? এক বন্দুক হ্যায় মেরা পাস। ইয়ে লেকর স্কুল মে যানা পড়েগা ক্যয়া?
আশপাশের লোকজন হেসে ওঠে।
--মানে ব্যাংকো এখান বই করন লাগে।
- তো ইয়ে বলো! অন্দর মে যাও।উধর।
লোকটা একটা টেবিল দেখিয়ে দেয়। চশমা পরা এক সুবেশ ভদ্রলোক।
-বাবু আমার মেয়ে বিপিএল...
ভদ্রলোক চোখ তুলে দেখল। তারপর সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল - বসুন।
সরসী বসে না। ইতস্তত করে। কাজ সেরে সে বাড়ি ফেরেনি। চারটে বাড়িতে ঘর মোছা বাসন ধোয়া ইত্যাদি সেরে গেল ইশকুলে তারপর এই ব্যাঙ্ক। শাড়িটা এখনও আধভেজা। এভাবে চেয়ারে বসবে? কী ঝকঝকে কালো চামড়ায় মোড়া চেয়ার। লোকটি আর তাকে দেখছে না। কাজ করছে। সরসীর কি আর সময় আছে? এসময় সে বাড়ি গিয়ে রান্না করে। আজ ইতি বাড়ি গেছে। বলল - মা তুমি ইশকুলে যাও। আমি রান্ধুম আইজ।
ভদ্রলোক কাজ করতে করতে আবার বলে - বসুন। অনেক ভেবেচিন্তে সসংকোচে বসল সরসী। ভদ্রলোক হাতের কাজ সামলে নিয়ে বলল - বলুন।
সরসী আবার বলল। লোকটি মন দিয়ে শুনল, তারপর বলল - কাগজপত্র এনেছেন?
সরসী বোঝে না। বলে - আমি তো পড়ালেখা জানি না। কি কাগজ?
-ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলবেন তো আই ডি প্রুফ অ্যাড্রেস প্রুফ লাগবে!
এসব সরসী কিছু কিছু জানে। বলে - আধার কার্ড?
-বিপিএল কার্ডও আনবেন।
বাড়ি ফিরে তুলকালাম কান্ড। ইতি হারিয়ে ফেলেছে বিপিএল কার্ড। স্কুলে জমা দেবার জন্যে জেরক্স করাতে নিয়ে গেল। বাড়িতে এনে নাকি রেখেছিল। কিন্তু কোথায়? কোত্থাও নেই। ছোট্ট ভাড়াটে ঘরে একখানা পুরনো টিনের ট্রাঙ্ক, সরসীর বিয়ের সময়ের। ওটার ভেতরেই যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি। ইতি অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে বারবার বলছে - আমি তো এখানেই রাখছি। ঠিক মনে আছে।
সরসী হাহাকার করে - অহনে কি হৈব? অহনে কি করন যায়? অসুকে বিসুকে হ্যানা ত্যানায় কামে আসে কিনা তবু একখান ভরসা। কী সব্বোনাশ। বুড়ো পরমেশের হেলদোল নেই। বসে বসে দেখে। তারপর একটু ভেবে বলে - "এক কাম করো, মাখনরে একখান খবর দ্যাও।
সরসী রেগেমেগে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে - এই পোড়ামুখি, মাখনরে ডাইক্যা আন যা।
বস্তি এলাকার করিৎকর্মা যুবক মাখন। সরকারি অফিসগুলোতে তার যাতায়াত আছে। এই বস্তি এলাকার অনেকের কার্যোদ্ধার করে দেয়।
মাখন এলো। সব শুনে বলে- দালাল ধরন লাগব। টাকা লাগব মাসি।
-টাকা?
-হয়, টাকা। টাকা দিয়া নি পাওন যায়, দেখো!
-কত? কত লাগব মাখন?
-৫০০ তনে ১০০০ রেডি কইরা থোও। কত লাগে দেহি।
-অতো?
-অতো দিয়া নি হয় দ্যাহো! আইচ্ছা আমি ওহনে যাই। টাকা জুগাড় কইরা রাইখ্যো।
পরমেশ মিটিমিটি হাসে। মাখনের সাথে যেন বুড়োর চোখাচোখি হল!
ইতি বলে - বিশ্বাস করো মা। আমি যত্ন কইরা ট্রাঙ্কে রাখছি।
একরাশ দুর্ভাবনা নিয়ে সরসী পদ্মাপুরাণ শোনে-"শোনো ওগো বেহুলা, সায়বেনের ঝি /তোরে পাইল কালনিদ্রা মোরে খাইল কি!"
লক্ষ্মীন্দরের বাঁচার জন্যে কী আকুলতা। বিষাক্ত সর্পদংশনের হাত থেকে তার রেহাই নেই। নিয়তির কী নিষ্ঠুর লীলা।
কখন যেন শেষ হলো পদ্মাপুরাণ পাঠ। সরসী বেরিয়ে আসে। দুধসাদা জ্যোৎস্নায় ভাসছে চরাচর।সরসী দেখে পারাপারহীন অকূল নদী.. নাম নাকি তার গাঙুর। একটা শবদেহের সাথে একাকী বেহুলা... ভেলা ভাসছে... কোন অজানা দেশ... চোখদুটো জলে ভরে এল তার।
.....................................................................
# বিজয়া দেব।
225 পূর্বাচল রোড নর্থ
কলকাতা - 700078
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন