বহুরূপী
মিনাক্ষী মন্ডল
সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে পাবলিক বাস 'যোগমায়া'। পেছনের বাসকে টেক্কা দিতে এই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা। এসব দেখে শিবেন রোজই অভ্যস্ত, সমস্যা হচ্ছে আজকের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছে কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। বন্ধ জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে হাওয়া ঢুকে শিবেনের শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। সামনেই 'কলাইবাড়িতে' স্টপেজ সেখানে পাঁচ-দশ মিনিট প্রায় সব বাস থামে।শিবেন ভাবল সেখানে এক কাপ চা খাবে।
কিন্তু 'কলাইবাড়ি' ঢুকতেই দেখে, দশ থেকে পনেরো বছরের বেশ কয়েকটি বাচ্চা বহুরূপী সেজে বাসে উঠছে...সাথে বাচ্চাদের দায়িত্বে আরও জনা চারেক লোক।
চা আর কি খাবে!
শিবেন যেন নিজের ছেলেবেলা ফিরে পেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ... তাদের গ্রামের সুরকি পাড়ার মাঠে 'চৈত্র সংক্রান্তি' উপলক্ষে যে মেলা হত সেই দিনগুলো। মেলায় শিবের গাজন হতো আর এই গাজনের প্রধান ছিলেন শিবেনের বাবা হরিহর মহন্ত। তিনি গাঁয়ের বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের বহুরূপী সাজিয়ে শহরে নিয়ে যেতেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা মনোরঞ্জন করে দান সংগ্রহ করে আনতো বহুরূপী বাচ্চারা। কেউ শিব-দুর্গা, কেউ রাধা-কৃষ্ণ কেউ আবার নন্দী-ভৃঙ্গি সেজে অভিনয় করত। ছেলেবেলায় ভুঁড়ি থাকার কারণে শিবেনকে বরাবর শিব সাজানো হতো।
উৎসবের তিন-চার মাস আগে থেকে চলতো বাচ্চাদের তালিম দেওয়া। পুরো গ্রাম এই নিয়ে আনন্দে মশগুল হয়ে থাকতো। যে ভক্ত চড়ক গাছের সাথে ঘুরত তার শরীরে মাস দুয়েক ধরে গাওয়া ঘি মাখানোর রীতি ছিল, চৈত্র সংক্রান্তির দিন অনেক উঁচু চড়কগাছে সেই ভক্তকে চাকার সাথে বেঁধে ঘুরিয়ে দেওয়া হতো। আর তার ঘি মাখানো পিঠে জ্বলন্ত বাণ শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এই নৃশংস খেলা শিবেন এর ভালো লাগতো না কিন্তু এটাই নাকি গ্রামবাসীদের প্রচলিত নিয়ম, প্রতিবছর নিয়ম করে আলাদা আলাদা ভক্ত এইভাবে চড়ক গাছে ঘুরতো। গ্রামবাসীর কাছে এটা খুব পুণ্যের কাজ। যে ভক্ত চড়কগাছের সাথে ঘুরবে তার নাম আগে থেকেই শিবেনের বাবা হরিহর মহন্তর কাছে নথিভূক্ত করতে হতো। শেষ যে বছর উৎসব হয়েছিল, সে বছর চড়ক গাছের সাথে ঘুরেছিল শিবেনের দাদা লখাই।
কি যে হয়েছিল সেদিন! শিবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি,সে তো তখন জিলেপির দোকানে জিলেপি কিনতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ সকলের চিৎকারে ছুটে গিয়ে দেখে, দাদার লখাই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে।আর বড়শির মত জ্বলন্ত বান শলাকা দাদার পিঠের অনেকটা মাংস সমেত ঝুলছে, নিমেষের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেল! গাঁয়ের সকলের ধারণা সৎ মা ঠিক ভাবে নিয়ম পালন করেনি তাই দাদা লখাই-এর এমন পরিণতি হলো। বছর দুয়েক পর দুঃখ-শোকে শিবেনের বাবাও মারা গেলেন।
তারপর থেকেই পেটের দায় মেটাতে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিবেনের নতুন কাজ শুরু হয়। শহরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারকেল গাছ ঝাড়াই বাছাই করে নারকেল বিক্রি করে।
এমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল শিবেন, বাস কন্ট্রাক্টরের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল।
'এবার নামতে হবে তো, গাড়ি স্ট্যান্ডে এসে গেছে'!
আজ আর শিবেনের শহুরে বাবুদের নারকেল গাছে উঠতে ইচ্ছে করলো না।
নারকেল গাছের উচ্চতাও তো কম নয়!
=================
Minakshi Mandal
Khamarpara,Roy Lane
Po. Bansberia
Dist, Hooghly
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন