নগতা মেয়ের জীবনসঙ্গী
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
আগামীকাল ভোরে নৌকা যাত্রা-- ব্যবসার সামগ্রী দু'দিন আগে থেকেই কুলাইয়া এবং নাইয়ারা নৌকা ট্রলারে তুলছে । লোকজন প্রায়ই এসে গেছে। দু' চারজন লোক আসেনি। প্রত্যেক বছরই এরকম কিছু লোক থাকে। ওরা সারাজীবন ওই প্রকৃতির। কেউ জুয়াড়ি- বাচাল- চিটিংবাজ -মদখোর মাতাল - লোফার ইত্যাদি হয়ই। দাদন টাকা নিয়ে সময় মত আসে না। তাদের খুঁজে খুঁজে ধরে আনতে হয়। আবার কেউ কেউ ধরা ছোঁয়ার বাইরেও থাকে। তেমনই আলোচনা হচ্ছে মালিক অর্থাৎ বহর্দার এবং সব মাঝি ও ম্যানেজারের সঙ্গে।
কালনাগিনী নদীর চর। মালপত্র বলতে জাল- বাঁশ -দড়ি -কাছি - লোহার তার- হোগলা - চাল খাদ্যসামগ্রী জল ও তেলের প্লাস্টিক ড্রাম আরও অনেক কিছু চরে কাঁড়ি করা ছিল । মালপত্র যেহেতু তোলার কাজ শেষ , নির্ধারিত দাদনী লোকজন ঠিক আছে কিনা মহাজনের সাথে আলোচনা হচ্ছে। মহাজন সতীশ দাস বলল, মাঝি -- কুলাইয়া বেগ্গিন আইস্যে নে ? ম্যানেজার বলল , --- নঅ। দু' চার জন নঅ আইয়ে ফানলা।
---- ইতারারে লই আয়ন পরিব ত।
----- হইঅ ।
------ ফুন নাম্বার আচে ন্যা? ফুন করি চুঅ ত?
ম্যানেজার সাড়ে চার মাসের চ্যূক্তিতে শ্রমিককে দাদন দিয়ে ধরে। যাবতীয় হেপা তাকেই নিতে হয় । যদি না শ্রমিক যায় দাদন টাকার ঝুঁকি দায়ভার ম্যানেজারের উপর বর্তায় । আবার শ্রমিক কম হলেই নগতে শ্রমিক ধরে কাজ সামাল দিতে হয় । নৌকায় অথবা ট্রলারের লোক সবাই এসেছে । পইন্যার ট্রলারে তিনজন আগামীকাল সরাসরি খটিতে যাবে। তাদের বাড়ি বিহার রাজ্য হওয়ায় ট্রেনের সময়সূচী মেনে নিতে হয়েছে ।
নৌকাগুলো সারিবদ্ধভাবে বাঁধা। ছয়খানা নৌকা ও তিনখানা ট্রলার এবং কুলের একশ' কুড়ি জন শ্রমিক মিলিয়ে সংখ্যাটা কম হয়নি । মাত্র দু'শো পঁয়তাল্লিশ জনের যেন মেলা বসেছে। এভাবেই যাদের শুকনো মাছের ব্যবসা আছে প্রত্যেকেই দুর্গা পূজার পরে নৌকা যাত্রা করে । যাকে ওদের ভাষায় "সাবাড়" ব্যবসা বলে । বহু শ্রমিক শীত মরশুমে সাবাড়ে যায় ।
সতীশ কয়েকদিন পরে যাবে। কারণ অস্থায়ী হোগলা ছাউনি করা হয়নি। শ্রমিকরা গেলে জঙ্গলের কাঠ কেটে বাঁসা করার সাথে সামুদ্রিক মাছ শুকনো করার দাওর - খাঙ - খলা তৈরি করবে । সাথে সাথে মাঝিরাও সমুদ্রে মাছের খাঁড়ি খুঁজে খুঁজে দক্ষতার সাথে ফাঁড় রেডি করবে । যেখানে বাঁউজ্যা বাঁশ - লোহার গোঁজ/ খুঁটি - লোহার তার ইত্যাদি দিয়ে সুকৌশলী পন্থায় মাছ ধরার জন্য ফাঁড়ের স্বত্ত্ব নেয়। প্রায়ই প্রয়োজনীয় জিনিস নতুন করে কিনে যাত্রা শুরু । ত্রিপল- ঝুড়ি -লাটবাড়ি- সবই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছেছে । না আসা কিছু লোককে না নিয়েই প্রত্যেক বছরের মত এই বছরেও আসতে হলো। এমন সময় কাজের লোক পাওয়াও মুশকিল । কুলের লোক চালিয়ে নেওয়া যাবে নগতা লোক লাগিয়ে কিন্তু নৌকায় পাওয়া যায় না । অপেক্ষা করতে হয় । নতুন করে লোক ধরে তবে পাঠাতে হয়। কারণ সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটার মধ্যে জালের কাজ কম অথচ দক্ষ লোক ছাড়া হয় না ।
বালিতে খড় - উলু- জংলি ঘাস পেতে জালের শক্ত টানে খলা তৈরি হচ্ছে । সাড়ে চার মাস অস্থায়ীভাবে থাকার ঘরের পাশে শুকনো মাছের গোডাউন- রান্নাঘর - মন্ডপসহ দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য সবকিছুই তৈরি ।
সতীশ এসেছে চরে। প্রথম কোটালে দশমীতে মন্ডপে পূজা দেওয়া হয়েছে । পৈন্যা ট্রলারে মাছ তত বেশি আসেনি । তাহলেও লোকের দরকার । মাছের কথা বলা যায় না ।
কিন্তু দ্বিতীয় কোটাল থেকে মাছ বেশি হচ্ছে। শ্রমিকের প্রয়োজন খুব ।
স্বদেশ হাজরা দালাল । জনা প্রতি পাঁচ টাকা করে মজুরি থেকে কেটে রাখে প্রত্যেক শ্রমিকের থেকে । এখানে সতীশ ছাড়া মিলন -কমল- সঞ্জয়- গদাধর- অনিল আরো কতজনের খটি আছে । এসবের খটিতে স্বদেশ হাজরা শ্রমিক জোগান দেয় । সাড়ে চার মাসে শ্রমিকরা হাজিরা বা মজুরি যা-ই পাবে না কেন স্বদেশের দালালি টাকা কম হয় না ।
সাগরদ্বীপের অধীনস্থ কিছু আদিবাসী লোক এই শীত মরশুমের সময় চরে যায়। তাদের মুখের কথ্য ভাষা পৌন্ড্র বা পোদ সম্প্রদায়ের ভাষা । ফলে স্বদেশ হাজরার সাথে যোগাযোগ রেখে পরিবারের কর্মঠ দের নাম নথিভুক্ত করায় । নগতা কাজের সাথে আর্থিক স্বচ্ছতার যোগ । মরশুমে ভালোই উপার্জন করে । সতীশের খটিতে আজকে পঁচিশ জন নগতা লোক কাজ করছে । কিশোর - কিশোরী- যুবক- যুবতী - প্রৌঢ় বুড়ো বুড়ি সবার বেতন সমান । সন্ধ্যা নামলেই হাজিরা খাতা ধরে ম্যানেজারকে জানিয়ে দিয়ে যায় ।
জনা চারেক ফুটফুটে কিশোরী- যুবতী ওই দলে । শ্রাবণী- মেঘা - কুন্তী - ললিতা ছাড়াও বউ বাচ্চা সমেত অনেকেই খটির শ্রমিকদের সাথে মাছ বাছাই - ফিতে মাছ বাঁধা- নীহারুর মাছ দাঅরে বেঁধে তোলা - ফ্যাসা পাতার সটিং - পমপ্লেট,মেদ, সংকর, ম্যাকরেল, ফাল চিরুনি,হাঙর কেটে শুকনো করতে দেয়। স্থায়ী বেতনভুক্ত কর্মীরা জোড়ায় জোড়ায় ঝুড়িতে মাছ নিয়ে শুকানোর ব্যবস্থা করে দেয় যেভাবে ঠিক তেমনই অস্থায়ী নগতা মজুররাও ভারি মাছের ঝুড়ি ধরে শুকানোর ব্যবস্থা করে দেয় ।
শ্রাবণী - মেঘা আর কুন্তী- ললিতার জোড় সব সময় পরিলক্ষিত হয় ।
ওরা মাইনাস করতে গেলেও একসাথে যায়। এখানে স্থায়ী কোনও সৌচাগার নেই। বালি চরে দাঅরের আড়ালে পেচ্ছাপ করে। ম্যানেজার বারণ করেছে ইতিপূর্বে। কিন্তু অস্থায়ী হোগলা ঘেরা টয়লেটে যেতে কিন্তুবোধ করে। সেদিন ম্যানেজার পবিত্র নিজে দাঅরের আড়ালে মাইনাস করতে গিয়ে ললিতার চোখ পড়ে যায় । চোখাচোখি হতেই নিজের দোষ ঢাকতে ললিতাকে ইশারায় ডাকে ।
সে দেখতে শ্যামলা হলেও সুন্দর মুখের গড়ন। যেন অপরাজিতার নীল বর্ণ লুকিয়ে আছে ।
----- ওয় শুন। ম্যানেজার বলল।
----- কি কওট ? সে এগিয়ে যায় ।
----- তোকে না আমার খুব ভালো লাগে ।
---- তোমার তো বউ আছে? নজর খারাপ কেনি ? ---- থাউ । আমি তোকে বিয়ে হ'বা ।
---- রাখব কাই ? বাব্বা বাই তো কম নেই দেখিটি !!
----- আবার ঘর করিয়া লিতে কত সময় যাবে না কি?
---- বেশ । আমি রাজি আছি । আমারও তোমাকে ভালো লাগে। কথা দিতে পারি সবসময় আমাকে লিয়া রইব ত ? সে মাথা নীচু করে লাজুক লতার মতো গুটিয়ে বলল।
----. সত্যি সত্যি কউটু ত ? না -- ইয়ার্কি মারিস না । সেও যেন একপায়ে খাড়া।
---- তুমার টকাছানা নেই ত ?
-----নাঃ। বউ আমার বাঁজা । তিন বছর বিয়ে হয়া কিচ্ছু হয়নি। কি কষ্টে যে আছি সে আমি জানি। ডাক্তার দেখাইছি বউর দোষ ধরা পড়ছে।
----- জমিজমা লেখি দিলে তবে আমি রাজি আছি।
----- শুন --- এ কথা যেন কেউ নেই জানে। আমি তোকে সব দুবা আয় - আয় - কাছে আয় না । আয়---
----- দূঃ । আমার লজ্জা করেটে। কেউ যদি দেখতে পায়।
---- আয় না আমিই তো আছি। কে শ্লা কি কইবে?
এক ঝটকায় ডানা ধরে টেনে ললিতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সে একটা কিস করে । মাছ হাতে আঁশটে গন্ধ।
---- তুইও একটা হামি দে ।
---- উম্ -- তোমার তো চুলে দাড়ি ভর্তি ।
তবুও সে চুমু খেলো।
ললিতা ফিরে এলে খাঙের আড়ালে শ্রাবণী ডেকে নিয়ে বলল, তুই অত সময় কাঈ যেথলু হাঁ হ মাগী ? মালিক আসিয়া হাজিরা লোকের মাথা গুণিছে।
----- তুই কিছু কউনু ?
----- কইছি হো। তুই তো আমানকের সাথে যাউ বাইরে একসাথে। একলা যেছু কেনি ?
----তোকে আমি পরে একটা কথা কইবা।
পরে জানাজানি হলো । ললিতার মনের কথা শ্রাবণীর মুখ থেকে সকলের কানে গেল । চরের মাঝি অর্থাৎ ম্যানেজারকে নিয়ে সতীশ দাশ খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। ব্যবসায়ী হয়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে এইসব নোংরামি মেনে নেওয়া যায় না । রটে যাওয়া কথাটায় সত্যতা যাচাই করতে মরা কোটালে কাজের ফাঁকে একদিন সন্ধ্যাবকাশে বসল মন্ডপের সামনে । অস্থায়ী শ্রমিকদের সামনে মুখোমুখি বসিয়ে ম্যানেজার সরাসরি মিথ্যা কথা বলল।--- আমার সাথে ওনকের কারুর কোনও সম্পক্ক হয়নি। তোমান্যে রটাও যদি আমি কি করতে পারি ?
স্বদেশ বসে সামনে । বালির উপরে পলিথিন পেতে সবাইও বসেছে । স্বদেশ আবারও বলল, ললিতা গরীব লোকেরে মেইঝি । আমি দায়িত্ব করিয়া লিয়া আসথিলি -- মা-বাপ নেই মামুর ঘরে মানুষ । তোমান্যে সকলে কও কি করা যাবে ? ম্যানেজার বাবু তো অস্বীকার করেটে ।
----- ঠিক আছে, মেইঝি নিজে কউ ? ললিতা --
ললিতা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে কথা বলতে পারছে না। অবশেষে বলল , মিথ্যা কথা কওট কেনি ? তুমি কি পস্তাব দও নি? আমাকে লিয়া সুখে ঘর করার কথা কওনি? তুমি এতগুলা লোকের সামনে আর মন্ডপের ঠাকুরের সামনে বুকে হাত দিয়া কও ত তুমি সত্যি কওট ? আমিও কইটি তুমাকে ছাড়া আর কাউকে জীবনসঙ্গী করবানি ।
সকলে হো হো করে হেসে উঠল। একটু পরে পইন্যা ট্রলার সমুদ্রের কিনারে এসে সিগন্যাল দিচ্ছে। খলার কাঁচা মাছ এসে গেছে সকলকে উঠতে হল।
===================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন