বুনো কালীর মাঠ
✍️ অঞ্জন
দিনটা ছিল বছরের শেষ দিন। শীতের রাতে বর্ষ বরণের পার্টি সেরে একা মোটরসাইকেল চালিয়ে ফিরছিল বাবাই। বাবাই পেশায় রাজ্য পুলিশের হোম গার্ড। আগের দিন রাতে নাইট ডিউটি করে একেবারে মর্নিং ডিউটি সেরে নিয়েছিল সেদিন। রাতে বন্ধু বান্ধবদের সাথে বছরের শেষ রাতটা কাটানোর জন্য বাকি দিনটা ছুটি নিয়েছিল সে। যেখানে পার্টি হচ্ছিল, সেই ক্লাব টা বাবাই এর বাড়ি থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে বেরিয়ে যখন বাবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো, তখন রাত প্রায় একটা। শহর পেরিয়ে যখন সে গ্রামের রাস্তায় ঢুকলো, তখন দুটো বেজে গেছে। বুনো কালীর মাঠের কাছে বাইক টা স্ট্যান্ড করলো সে। কোমর ধরে গেছে, টয়লেট ও পেয়েছে জোরে। বাইক থেকে নেমে হালকা হয়ে, কোমর টা একটু ছাড়িয়ে নিয়ে,একটা সিগারেট ধরিয়ে বাবাই সবে গাড়িতে উঠতে যাবে, এমন সময় সে দেখলো চারটে ছায়া মূর্তি তার দিকে এগিয়ে আসছে। বাবাই ছিলো অকুতোভয়, ফলে ভূতের ভয় সে পেতো না। তবে ওই বুনো কালীর মাঠ জায়গাটা খুব একটা ভালো নয়, কারণ ওই মাঠে রাত বিরাতে মাঝে মাঝে সমাজ বিরোধীরা মদের আসর বসায়। বার দুয়েক পুলিশ রেড করে ঘাঁটি ভেঙ্গে দিয়েছিল, অ্যারেস্ট ও হয়েছিল বেশ কয়েক জন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে আবার যে কে সেই। সবচেয়ে বিপদজনক হলো, মদের পয়সা তুলতে রাত নটার পর ওই রাস্তায় যে যেত, তাকে ছিনতাই করে সব কিছু কেড়ে নেওয়া হত এবং বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে খুন করে পুঁতে ফেলা হতো বুনো কালীর মাঠে।
বাবাই নিজেও রেড করার সময় একবার ছিল, রণেন বলে এক সমাজবিরোধীকে যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ ভ্যানে তখন রণেন বলছিলো," তোকে দেখে নেবো।" কিন্তু সেদিন ওসব হুমকি পাত্তা দেয়নি বাবাই।
যাই হোক, অন্ধকারের মধ্যে চারটে ছায়া মূর্তি দেখে বাবাই একবার চিৎকার করে বললো," কে রে?" ছায়া মূর্তি গুলো এবার আরো কাছে এগিয়ে এলো। বাবাই তখনও মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিতে পাড়ে নি। পকেট থেকে মোবাইল টা বের করে টর্চ টা ওই ছায়া মূর্তি গুলোর দিকে ফেলতেই সে দেখতে পেল রণেন আর তার সাথে তিন সঙ্গী। সবাই মদ খেয়ে চুর। বাবাই আবার হাঁক দিল," ওই, রাস্তা ছাড়।" রণেন বলে উঠলো," ধর তো মাল টা কে।" সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত আরো তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবাই এর উপর। তিনজনে মিলে বাবাই কে মাটিতে ফেলে জাপটে ধরলো। কিছুক্ষন ধস্তাধস্তির পর একজন বাবাই এর হাত দুটো কে পেছন থেকে মুচড়ে ধরলো, আর এক জন বাবাই এর গলায় ধরে রইলো একটা ধারালো ছুরি। এইবার আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো রণেন। বাবাই এর মোবাইল টা ধস্তা ধস্তির সময় হাত থেকে পড়ে গেছিলো, সেটা উঠিয়ে বাবাই এর মুখে আলো ফেলে সে বলে উঠলো," সেই পুলিশের বাচ্ছা না? এইবার তোকে পেয়েছি। সেদিন খুব টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলিস, অনেক আজে বাজে কথা বলছিলি। আজ তোকে কোন্ বাবা বাঁচাবে?" বাবাই একবার চেঁচিয়ে উঠলো," পুলিশের গায়ে হাত তুলছিস, এর ফল জানিস?" রণেন শিয়ালের মত খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বললো," দূর শালা, কে আমাকে কি করবে? তোকে আজই এখানে পুঁতে ফেলবো, কেউ জানতেও পারবে না।" এই বলে রণেন পকেট থেকে একটা বড় ছুরি বের করে সোজা চালিয়ে দিলো বাবাই এর পেটে। তারপর সেটা টেনে বের করে আবার আমূল বিঁধিয়ে দিলো, বাবাই এর বুকে। যে লোকটা গলায় ছুরি ধরেছিল, সে ততক্ষনে ছুরিটা টেনে দিয়েছে বাবাই এর গলায়। আর একজন শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে আছে বাবাই এর হাত দুটো। নলি কাটা বাবাই চিৎকার করার চেষ্টা করলেও গলা দিয়ে চিৎকার বেরোলো না। পর পর পেটে আর বুকে ছুরির আঘাত সহ্য করতে পারলো না বাবাই। পরে গিয়ে কিছুক্ষন কাটা পাঁঠার মত ছটকালো, তারপর সব শেষ। রণেনের নির্দেশে তার চেলা চামুণ্ডা গুলো বাবাই এর কাছে যা ছিলো টাকা পয়সা সব বের করে নিলো। মোবাইলের সিম টা খুলে ফেলে দিল দূরের ঝোপের মধ্যে। তারপর বাবাই এর মৃতদেহ টা চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল বুনো কালীর মাঠে। সেখানে বাবাই এর বাইক থেকে পেট্রোল বের করে বাবাই এর গায়ে ভালো করে ছিটিয়ে তারপর বাইক সমেত বাবাই এর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। দাউ দাউ করে ধরে গেলো বাবাই এর মৃত দেহ। কিছুক্ষন পর তারা মাঠ টপকে চলে গেল মাঠের অন্য পাড়ে। তখন ভোর হয়, হয়।
সারা রাত ছেলে বাড়ি না ফেরায় বাবাই এর বাড়ির লোক খোঁজ খবর শুরু করলো। প্রথমে বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে যখন জানতে পারলো বাবাই একটা নাগাদ বেরিয়ে গেছে পার্টি থেকে, তখন থানায় রিপোর্ট করতে হলো। বিকাল বেলা বুনো কালীর মাঠ থেকে উদ্ধার হলো বাবাই এর বাইকের এবং সেই সঙ্গে বাবাই এর পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া দেহ। দেহ তুলে পোস্ট মর্টেম করে দাহ করতে করতে রাত দুপুর হয়ে গেলো, যদিও পোস্ট মর্টেম করার মতো কিছু আর ছিলনা বাবাই এর শরীরে।
এই ঘটনার পর কেটে গেছে বেশ কিছু দিন। প্রথম প্রথম বুনো কালীর মাঠের রাস্তায় সন্ধ্যার পর লোক চলাচল কমে গেলেও সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়, বুনো কালীর মাঠ ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না।
পরের বছরের পুজোর পরের ঘটনা। নিম্নচাপের বৃষ্টি হচ্ছে কার্তিকের মাঝে। কালী পুজোর আর সপ্তাহ খানেক বাকি। শহরের হসপিটালে ভর্তি হয়েছে কেষ্টদার বাবা। হঠাৎ করে বুকে ব্যথা শুরু হওয়ায় আগের দিন রাতেই তাঁকে নিয়ে যেতে হয়েছে শহরে। পরদিন সকাল থেকে এই টেস্ট, ওই টেস্ট আর ডাক্তার দের পেছনে ছুটতে ছুটতে দিন শেষ। রাত সাত টা নাগাদ হসপিটালের ভিজিটিং আওয়ার শেষ করে বাবাকে রেখে কেষ্টদা বাস স্ট্যান্ড এ নেমে সাইকেল নিয়ে যখন বুনো কালীর মাঠের পাশে এলো, তখন প্রায় রাত সাড়ে নটা। ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতাটা কাঁধের পাশে চেপে ধরে কোনো রকমে সাইকেল টা চালাচ্ছিল কেষ্ট দা। চারদিকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আলো বলতে কেষ্ট দার পকেটে থাকা মোবাইলের টর্চের আলো, তাও আবার কিছুক্ষন পর পর নিভে যাচ্ছে, সাইকেল থামিয়ে জ্বালাতে হচ্ছে। বুনো কালীর মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মোবাইলের আলো গেলো নিভে। ওটাকে জ্বালাতে অগত্যা সাইকেল থামাতে হলো কেষ্টদা কে। সাইকেল টা যখন থামালো, তখন কেষ্ট দার মনে হলো, মাঠের পাশে ঝাঁকড়া বুনো গাছটার নিচে কে যেনো দাড়িয়ে আছে। কেষ্ট দা মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখলো,কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। মনের ভুল ভেবে কেষ্ট দা আবার সাইকেলে উঠে সবে দু একটা প্যাডেল মেরেছে, কেষ্ট দার মনে হল, ক্যারিয়ার টা ধরে কেউ টানলো। ব্যালেন্স হারিয়ে মাঠের রাস্তার পাশে সাইকেল সমেত ধড়াম করে পড়লো কেষ্ট দা, এবং সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা কোথায় যেন ছিটকে পরে গিয়ে আলো বন্ধ হয়ে গেলো। এবার নিকষ অন্ধকারে ঝিপ ঝিপ্ বৃষ্টিতে কেষ্ট দা পুরো একা। একটা কুকুর ও নেই সেই রাস্তায়। পড়ে যাওয়ার দরুন জামা কাপড় জলে ভিজে গেছে। ছাতা টাও কালো রঙের হওয়ায় অন্ধকারে কোথায় যে উড়ে গিয়ে পড়েছে তার ইয়াত্তা নেই। ঠান্ডা মেঠো ভিজে হাওয়া বইছে মাঠের উপর দিয়ে, সেই ঠান্ডায় শির শির করে উঠছে কেষ্ট দার সারা শরীর। আর সেই অন্ধকারে কেষ্ট দা অনুভব করছে একটা আবছা অবয়ব এগিয়ে আসছে কেষ্ট দার দিকে। ভয়ে ভয়ে কেষ্ট দা একবার জিজ্ঞাসা করল," ক ক কে ওখানে?" উত্তর কিছু এলো না, শুধু কেষ্ট দা দেখতে পেলো, এক মাঝারি উচ্চতার কালো রঙের অবয়ব এগিয়ে আসছে তার দিকে। হঠাৎ কেষ্ট দার মনে হলো সেই অবয়ব টা কেষ্ট দার শরীরের খুব কাছে চলে এসেছে, এক্কেবারে কাছে। একটা তীব্র পচা গন্ধ অনুভব করলো কেষ্ট দা, গা গুলিয়ে উঠলো, পেট টা যেনো ফুলে উঠলো ওই গন্ধে। তারপর কেষ্ট দার মনে হলো, সেই ছায়া আস্তে আস্তে মিশে গেলো কেষ্ট দার শরীরের মধ্যে। মুহূর্তে গা ভারী হয়ে গেলো কেষ্টদার। মাথা টা হঠাৎ ঘুরে গিয়ে চোখ উল্টে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো সে। কতক্ষন এই ভাবে পড়ে ছিল জানে না, তারপর একসময় আচমকা চোখ খুললো কেষ্ট দা। কী আশ্চর্য্য, ওই অন্ধকারের মধ্যে চারদিক একদম পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। পড়ে যাওয়ার জন্য মানুষ যে ব্যাথা অনুভব করে, সে সব কোনো ব্যথায় নেই কেষ্ট দার গায়ে। দিব্যি সাইকেল টা তুলে প্যাডেল করে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলো কেষ্ট দা। বাড়িতে যখন ঢুকলো সে, তখন রাত প্রায় বারো টা। কেষ্ট দার মা চিন্তা করছিলেন। একে কেষ্ট দার বাবা হসপিটালে, তার ওপর ছেলে ফিরছিলো না, কেষ্ট দা আসতেই তার মা ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেষ্ট উপর," এতক্ষণ কোথায় ছিলি হারামজাদা, আমি এদিকে চিন্তা করে মরছি।" কেষ্ট দা কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সাইকেল টা দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে বারান্দায় স্ট্যান্ড করছিল। উনি আবার চেঁচিয়ে উঠে বললেন," কি হলো, কথা কানে গেলো না? বলছি এতক্ষণ কোথায় ছিলি শুনি?" কেষ্ট দা এবার ধরা ফ্যাস ফ্যাসে গলায় উত্তর দিলো," হ্যাপি নিউ ইয়ার কাকিমা, আমি বন্ধুদের সঙ্গে সেলিব্রেশন করছিলাম তাই রাত হয়ে গেলো। আমি খেয়ে এসেছি। আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন।" কেষ্ট দার মা এইবার আরো জোড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন," হ্যাঁরে তোর মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে, এখন নিউ ইয়ার? তোর বাবা নাকি হসপিটালে, আর তুই বন্ধুদের সাথে ঘুরছিলি? তোর লজ্জা করে না? তোর বাবা কেমন আছেন এখন?" কেষ্ট দা চুপ করে ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর মা ওর হাত ধরে হির হির করে টানতে গেলেন, কিন্তু হাত যেনো পাথরের মত ঠান্ডা, আর গায়ে কি জোর, রোগা পাতলা কেষ্ট দার এক ঝটকা তে ওর মা সজোরে দরজার গায়ে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়লেন। মা এর দিকে একবার চাইলো কেষ্ট দা, যেনো মরা মাছের মত চোখ দুটো, এত ঠান্ডা দৃষ্টি। সে শুধু বললো," কাকু কে কাল ছেড়ে দেবে হসপিটাল থেকে। " তারপর নিজের ঘরে ঢুকে গেলো কেষ্ট দা। সেই রাতে কেষ্ট দার মা আর ঘুমোতে পারলেন না। সারা রাত জেগে চিন্তা করতে লাগলেন ছেলের এহেন বদলের কারণ, আর মাঝে মাঝে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারতে লাগলেন কেষ্ট দার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে।
পরদিন সকালে কেষ্ট দা সকাল সকাল উঠে কোথায় যেনো বেরোবার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। কেষ্ট দার বাড়ি হলো বাবাই দের পাড়ায়। পাড়ায় শিক্ষিত বেকার হিসাবে কেষ্ট দার খুব নাম ডাক ছিল। প্রায় বছর চল্লিশের রোগা পাতলা চেহারার কেষ্ট গ্রাজুয়েট হয়ে থেকে প্রায় সব চাকরির পরীক্ষায় বসে ফেলেছে কিন্তু ভাগ্য লক্ষ্মী তার সাথ না দেওয়ায় এখনও বাবার হোটেলেই তার দিন কাটে। বাবা ছিলেন সরকারী ক্যারানি। পেনশন এর টাকায় তিনটে পেট কোনো রকমে চলে আর টিউশন করে নিজের হাত খরচ জোগাড় করে কেষ্ট। বর্তমানে হসপিটাল গত বাবা কে দেখতে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোথাও যাওয়ার মত জায়গা নেই কেষ্ট দার যে সকাল সকাল স্নান করে বেরোতে হবে। কেষ্ট দার মা ভয়ে ভয়ে কেষ্ট দার জন্য চা নিয়ে আসতেই কেষ্ট দা বলে উঠলো," কত দিন বলেছি আপনাকে কাকিমা যে আমি চা খাই না, দুধ বিস্কুট খাই।" এইবার কেষ্ট দার মা হাউ মাউ করে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো," ওগো আমার কি সব্বনাশ হলো গো! কেষ্ট টা আমার পাগল হয়ে গেলো।" তাঁর চিৎকার শুনে চারিদিকের লোকজন সব ছুটে এলো। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে কেষ্ট দার মা গতকাল রাত থেকে এখনও পর্যন্ত যা যা হয়েছে সব খুলে বললো। এর মধ্যে ঘটে গেলো এক অবাক করা কান্ড। স্নান করার জন্য গামছা হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল কেষ্ট দা। হঠাৎ এতো গুলো লোককে বাড়ির সামনে দেখে কেষ্ট দা কেমন জানি ক্ষেপে উঠলো। উঠোনে পড়ে থাকা একটা লাঠি তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলতে আরম্ভ করলো, " তোদের সাহস তো কম নয়, তোরা থানা ঘেরাও করতে এসেছিস, দাঁড়া, আজ তোদের মজা দেখাচ্ছি।" এই বলে কেষ্ট দা লাঠির বাড়ি সামনে যাকে পেলো মারতে আরম্ভ করলো। উত্তেজিত লোকজনের চিৎকার চ্যাচামিচিতে প্রায় সারা গ্রামের লোক এক জায়গায় জমা হয়ে গেলো। তাদের মধ্যে জনা দশেক যুবক লাঠির ঘা উপেক্ষা করে তেড়ে গেলো কেষ্ট দার দিকে। তারা কেষ্ট দা কে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু ওই রোগা পাতলা কেষ্টের গায়ে দানবের মতো জোর কোথা থেকে এসে উপস্থিত হলো, যে তাকে ভেতরে টানা ত দূর, তার হাতের এক একটা ঝটকা তেই দশ জন জোয়ান ছেলে তাকে ধরে রাখতে হিম সিম খেতে লাগলো। শেষ মেষ কোনো ক্রমে তাকে ভেতরে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর দড়ি দিয়ে ভালো করে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো। কেষ্ট দা তখন উন্মাদের মত চ্যাচাছে আর থুতু ছুঁড়ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকদের উদ্দেশ্যে।
উপস্থিত গ্রামবাসীদের মধ্যে বয়স্ক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মোটামুটি সবাই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে কেষ্ট দা কে ভূতে ধরেছে। পাশের গ্রামে এক জন মস্ত বড় ওঝা ছিল, নাম নিশি ওঝা। তাকে ডাকতে দুজন ছেলেকে পাঠানো হলো, বলা হলো একেবারে ধরে নিয়ে আসতে। আর যতক্ষন না আসে, ততক্ষন কেষ্ট দা কে ওই বাঁধা অবস্থায় রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ওই পাড়াতেই বাবাই এর বাড়ি, কেষ্ট দার বাড়িতে এ হেন চিৎকার চ্যাচামিচি শুনে বাবাই এর বাবা ও উপস্থিত হয়েছিল সেখানে। সবাই শুনতে পেলো কেষ্ট দা ওই ঘরের মধ্যে থেকে বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করছে," বাবা, তুমি এসেছো? মা কে কেনো আনলে না? দেখো আমি ফিরে এসেছি। হ্যাপি নিউ ইয়ার বাবা।" বাবাই এর বাবা এসব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী করবেন, কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। পাড়ার বয়স্ক লোকেরা ওনাকে ওখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে নিশি ওঝা এসে উপস্থিত হলো। গ্রামের মুরুব্বীদের কাছ থেকে সবটা শুনে নিশ্চিত হলো যে কেষ্ট দা কে ভূতেই ধরেছে। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো কেষ্ট দার ঘরের সামনে। তাকে দেখেই কেষ্ট দা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বললো," তুই এসেছিস আমায় তাড়াতে? তোর সাহস তো কম নয়? পালা এখান থেকে, নয়তো এখানেই ঘাড় মটকে দেবো। পালা, থু।" বলে এক গাল থুতু ছেটালো নিশি ওঝা কে লক্ষ্য করে। নিশি ওঝা নিজের গা ভালো করে মন্ত্র পড়ে বেঁধে নিলো। তারপর কেষ্ট দার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলো, " তুই কে?" কেষ্ট দা খিঁচিয়ে উঠে জবাব দিল," তোর বাপ।" নিশি ওঝা খানিক টা কালো সরষে নিয়ে বির বির করে মন্ত্র পরে ছুঁড়ে মারলো কেষ্ট দার গায়ে। কেষ্ট দা অমানবিক চিৎকার করে উঠলো," আমায় ছেড়ে দে বলছি।" নিশি ওঝা আবার ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলো," তুই কে?" কেষ্ট দা ফ্যাস ফ্যাস করে উত্তর দিলো," আমি বাবাই।" নিশি ওঝা জিজ্ঞাসা করলো," কেষ্টের শরীরে ঢুকলি কেনো?" কেষ্ট দা মাথা নিচু করে বসে বসে গোঙাতে লাগলো। নিশি ওঝা এবার কয়েকটা শুকনো লঙ্কা মন্ত্র পড়ে কেষ্ট দার গায়ে ছুঁড়ে মারতেই সে হাউ মাউ করে উঠলো," জ্বলে গেলাম, জ্বলে গেলাম।" নিশি ওঝা আবার প্রশ্ন করলো," বল, কেষ্ট কে কেনো ধরলি?" এবার কেষ্ট দা উত্তর দিলো," ওকে আমি খুব ভালো বাসতাম। পাড়ায় ওই আমার খুব কাছের ছিলো, আমার অনেক উপকার করেছে। তাই ওকে ধরলাম যাতে ওর মাধ্যমে বাবা মা কে একটা বার দেখতে পারি আর আমার মৃত্যু কী ভাবে হলো তা লোক জনকে বলতে পারি।" নিশি ওঝা আবার জিজ্ঞাসা করলো," তুই কিভাবে মারা গেলি?" কেষ্ট দা এবার গোঙাতে গোঙাতে বললো," রণেন আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে। ও কিন্তু এখনো ঘুরে বেড়ায়। ওর বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।" নিশি ওঝা বললো," ঠিক আছে, তুই কেষ্ট কে ছেড়ে দে। ওর বাবা অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।" কেষ্ট দা বললো," কাকু কে আজ ছেড়ে দেবে।" নিশি ওঝা বললো," তুই কেষ্ট কে ছেড়ে চলে যা।" কেষ্ট দা তখন চিৎকার করে বললো," না, যাবো না। আমি আমার বাবা মা কে দেখতে পাবো, আমি বন্ধুদের দেখতে পাবো, ওই মাঠের ধারে আমি একা একা ঘুরে বেড়াই আমার খারাপ লাগে। আমি যাবো না।" এইবার নিশি ওঝা পায়ের জুতো টা খুলে খুব জোরে জোরে কেষ্ট দা কে মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো, " বল যাবি ? বল কেষ্ট কে ছেড়ে দিবি?" কেষ্ট দা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগলো," আমায় ছেড়ে দে, আমি চলে যাবো, আমি কেষ্ট দা কে ছেড়ে দেবো, আর মারিস নি।" নিশি ওঝা এইবার জিজ্ঞাসা করলো, " কী ভাবে বুঝবো তুই চলে গেলি?" কেষ্ট দা বললো," আমি কিন্তু ওই বুনো কালীর মাঠেই থাকবো। আর যাকে পাবো, তার ঘাড়ে আবার চাপবো।" এইবার নিশি ওঝা ঝোলা থেকে একটা বড় কাঁচের বয়াম বের করলো। বয়ামের ঢাকনা টা খুলে কেষ্ট দা কে বললো," চুপ চাপ এর ভেতর ঢুকে পর।" কেষ্ট দা বললো," কক্ষনো না, তুই আমাকে বন্দী করে রাখবি, আমি বুনো কালীর মাঠেই থাকবো। ওখানেই ঘুরবো, ফিরবো।" তখন নিশি ওঝা আবার জুতো খুলে যেই দু ঘা দিয়েছে কেষ্ট দার পিঠে, অমনি কেষ্ট দা চেঁচিয়ে উঠলো," ঢুকছি, ঢুকছি"। নিশি ওঝা এইবার ঘরের মেঝেতে একটা কাঁসার ঘরা করে এক ঘরা জল রাখতে বললো। তারপর কেষ্ট দা কে বললো," এই ঘরা টা দাঁতে করে নিয়ে বাইরে উঠোন পর্যন্ত আই। ওখানে কাঁচের বয়াম টা রাখছি তার মধ্যে ঢুকে যাবি। যদি অন্যথা করেছিস, তাহলে কিন্তু তোর একদিন কী আমার একদিন। কেষ্ট দা বললো," না, না, যাচ্ছি যাচ্ছি।" এরপর কেষ্ট দার দড়ি খুলে দেওয়া হলো। কেষ্ট দা দাঁতে করে ঘরা ভর্তি জল নিয়ে উঠোনে রাখা কাঁচের বয়াম পর্যন্ত এলো। সেই দৃশ্য দেখতে প্রায় গোটা গ্রাম ভেঙ্গে পড়লো সেখানে। নিশি ওঝাও কেষ্ট দার পাশে পাশে এলো বয়াম অবধি। তারপর হঠাৎ কেষ্ট দা বয়ামের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। তার মুখ দিয়ে গ্যাজা বেরিয়ে এলো। সবাই তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। নিশি ওঝা বয়ামের মুখ টা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে বির বির করে মন্ত্র পরে বয়ামের মুখ টা বেঁধে দিলো। তারপর বয়াম টা ঝোলায় পুড়ে একজন কে বললো," আমাকে বুনো কালীর মাঠে নিয়ে চল।" সেখানে পৌঁছে মাঠের মাঝখানে একটা গর্ত করে বয়ামটা সেখানে পুঁতে দিলো নিশি ওঝা। তারপর কয়েকটা পেরেক বের করে মন্ত্র পরে পুঁতে দিলো ওই বয়ামের উপর চাপা দেওয়া মাটির উপর। বাবাই বন্দী হয়ে রইলো বুনো কালীর মাঠেই। তারপর থেকে আর কেউ কোনোদিন বুনো কালীর মাঠের কাছে কাউকে দেখতে পাইনি।।
=========================
অঞ্জন রায় চৌধুরী
বহরমপুর
মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন