সমান্তরাল
রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস
- "কিগো শুনছো!"
দোতলার জানলার বাইরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ক। তার স্ত্রী বর্ণালী বহুবার তাকে ডেকে চলেছে। অন্যমনস্ক অর্ক বর্ণালীর কোনো কথাই যেন শুনতে পাচ্ছে না! ধীরে ধীরে বর্ণালী এগিয়ে গেল অর্কর কাছে। আলতো ভাবে অর্কর কাঁধে হাত রাখলো। বর্ণালীর হাতের স্পর্শে চমকে উঠলো সে।
- "কখন থেকে ডাকছি তোমায়! এতো টেনশন করোনা!"
অর্ক হালকা করে ঘাড় নেড়ে বলল -"হু, বলো।"
- "একটু জল কিনতে পারো কিনা দেখো না! এই এক বোতল জলই অবশিষ্ট আছে।"
অর্ক পাশের চেয়ারে আস্তে আস্তে বসল। মোবাইলটা টিপে টিপে আবার দেখতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর বলল
- " কিছু নেই! কিচ্ছু নেই! বর্ণালী! বিগ বাস্কেট, মিল্ক বাস্কেট এভরিথিং ইজ আনঅ্যাভেলেবল !"
একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ণালী বলল
- "কি করে এতগুলো লোকের চলবে বলতো!"
ভুঁড়ু কুঁচকে গেল অর্কর। মাথায় হাত দিয়ে ঘাড় নিচু করে চেয়ারে বসে রইল সে।
মাথায় হাত বুঝি গোটা শহরবাসীর! ক"দিনের আকাশ বন্যায় বিধ্বস্ত শহর। কোথাও গলা ছুঁই ছুঁই আবার কোথাও বুক ছুঁই ছুঁই জল। আকাশের মন ভালো হওয়ার অপেক্ষায় সবাই!
- " হ্যাঁ রে, নিচের দোকানটাতে তো একটু দেখতে পারতিস, খোকা! " শয্যাশায়ী অনুরাধা বলে উঠল। অর্ক হঠাৎ কেমন রেগে গেল! বলল
-" সারাদিন শুয়ে থাকো। তাই বুঝতে পারছ না কি অবস্থা চারিদিকে। আমাদের নিচের তলা জলে ভাসছে। সারা শহর জলে থৈ থৈ! কে তোমার জন্য এখন দোকান খুলে রেখেছে বলতো মা?"
- " ইচ্ছে করে কী আর শুয়ে থাকি বাবা! উঠে বসার ক্ষমতাটাই ভগবান কেড়ে নিল যে! বাঁচিয়ে যে কেন রেখেছে!"
অনুরাধার কথাটা শুনে অর্কর খারাপ লাগলো খুব। সে তো সত্যিই তার মাকে এমন করে বলতে চায়নি! আসলে এই ক'দিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার মাথা কাজ করছে না। বাড়িতে বৃদ্ধ মা, ছোট ছোট দুটো বাচ্চা। কি করবে! কোথায় যাবে! তাও তো দোতলা বাড়ি বলে ওপরে ভালোভাবে থাকতে পারছে। একতলা ভেসে গেছে। রান্নাঘর, ফ্রিজ সব একতলায়। জলের তলায়। সংগৃহীত শুকনো খাবার, জল সবই ফুরানোর পথে। কদিন স্নান করে না কেউ। চারিদিকে জলে জল তবুও বাড়িতে জলের অভাব।
- " মা ... মাগো... ওরে বাবা... কত বড় একটা সাপ ঘরের মধ্যে! ওরে বাবা.. "
ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক ছুটে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছোট্ট তুলি। সাপটা যেন তুলির দিকেই ধীর ধীরে এগিয়ে আসছে। দিদির কথা শুনে ছোট বোন তুতুনও কাঁদতে লাগলো। বাচ্চা দুটোকে কোলের কাছে টেনে নিল বর্ণালী। সে নিজেও যে সাপের ভয় পায়। বিশাল লম্বা সাপটা খাটের নিচে ঢুকে গেল।
- "এভাবে এ বাড়িতে থাকা অসম্ভব। গভর্নমেন্টের সাহায্য না নিলে হবে না।"
ফোনটা হাতে নিয়ে কি যেন দেখতে দেখতে বলল অর্ক।
-"গভর্নমেন্টের সাহায্য! তার মানেই তো গ্যাদারিং করে থাকা!"
- " তাহলে থাক এই জলের মধ্যে! পাওয়ার ব্যাংকের চার্জটাও ফুরিয়ে এসেছে। ফোনটাও এরপর অকেজো হয়ে যাবে। মোমবাতি, দেশলাই ফুরিয়ে যাবে।"
হঠাৎ প্রচন্ড চিৎকার করে বলতে শুরু করলো অর্ক।
- "গ্যাদারিং করে থাকবে নাকি এই বাড়িতে জলে ডুবে পচে মরবে ভেবে নাও বর্ণালী।"
- "বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। আমরা তো কোন হোটেলে গিয়েও উঠতে পারি।"
অর্কর কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বলল বর্ণালী।
- "মাকে কিভাবে নিয়ে যাবে সেটা ভেবেছ? লোকাল থানায় যোগাযোগ করলে ওরা একটা ব্যবস্থা নেবে। আমাদের নিজেদের পক্ষে যা অসম্ভব এই মুহূর্তে।" বর্ণালীর হাতটা কাঁধ থেকে সরিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুক্ষভাবে বলে উঠলো অর্ক।
অর্কদের বাড়ির সামনের স্কুলের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য মানুষ। সরকারি ব্যবস্থা। স্কুলের দোতলার বারান্দায় কচিকাচাদের ভিড়। রেলিং ধরে ঝুঁকেঝুঁকে উপর থেকে দেখছে জলমগ্ন শহরকে। যেন মহাসাগরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বাড়ি। জলের ভিতর থেকে যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে অট্টালিকার দল। মেঘে ঢাকা সূর্যকে যেন খুঁজে চলেছে তারা। ন' দশ বছরের কমলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারই বয়সী ছোট্ট রেণুর দিকে। রেণুও কমলাকে লক্ষ্য করছে আড় চোখে। কিছুক্ষণ পর রেণুই প্রথম কথা বলল
- "তোমার নাম কি?"
- "কমলা। তোমার নাম?"
-" আমার নাম রেনু মন্ডল। কোথায় ছিল তোমার ঘর?"
কমলা আস্তে আস্তে রেনুর হাতটা ধরে মুচকি হেসে বলল
- "ঘর তো আমাদের ছিল না! এই রাস্তাটা বেঁকে ডান দিকে গেলে যে ফুটপাত সেখানেই আমরা থাকতাম গো। ভালোই হয়েছে বিষ্টি পড়েছে। জল জমেছে। জল চলে গেলেই তো আবার আমাদের ফুটপাতেই ফিরে যেতে হবে।" বলতে বলতে কমলার চোখটা ছল ছল করে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রেণুকে জিজ্ঞেস করল
- "তোমার ঘর আছে?"
-" ছিল তো! এই যে সামনের বড় রাস্তাটা দেখছ। তার ডান দিকে একটা ছোট গলি দেখেছো?"
রেণু মুচকি হেসে বলল
" দেখেছি তো।"
-" ওইখানে অনেকগুলো ঝুপড়ির মধ্যে একটা ঝুপড়ি আমাদের ছিল।"
বলতে বলতে কমলার হাসিমুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
- "সব জলে ভেসে গেল! এবার জল সরে গেলে সব যখন আগের মত হয়ে যাবে তখন আমরা কোথায় যে থাকবো!"
আকাশে মেঘ ডেকে উঠল। সূর্য ডুবে গেছে যেন সাত সকালে! ঝমঝমিয়ে নেমে আসলো বৃষ্টি। অর্কর ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। লোকাল থানা থেকে বোধ হয়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে বর্ণালী। এখনই এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় না নিলেই নয়। সিঁড়ি ভেঙে ক্রমশ উপরে উঠছে জল!
সবাই ছন্নছাড়া। গৃহহীন। প্রকৃতির কাছে অসহায়। গরিব বড়লোক চেনে না প্রকৃতি। তার কাছে যে সবাই সমান্তরাল!
###
রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস
Pride Apartment,
Dollars Colony, Bengaluru 560076.
খুব সুন্দর গল্পটা
উত্তরমুছুনKhoob sundar laglo !!
উত্তরমুছুনEtai Sotti !!