পুরনো সেই দিনের কথা
করবী নেয়ে
আজ পয়লা বৈশাখ।রোজকার দিনের মতো আজও ঝালমুড়ির পসরা সাজিয়ে পুরুলিয়া স্টেশনে হাজির অসীম।অসীম ওরফে দীপ ব্যানাজী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে ইংরাজী সাহিত্যে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট বয়। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস।কষ্টের সংসারে ঘানি টানতে সে আজ এ পেশায়।
"বললেন না তো, আপনাকে আমি কোথায় দেখেছি?"
ঝালমুড়িওয়ালা মন দিয়ে ঝালমুড়ি মাখতে মাখতে বললো, "সেটা আপনি মনে করুন স্যার। আমি তো আপনাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এই শহরে এই জায়গায় আমি আজ প্রায় বছর চারেক ঝালমুড়ি বিক্রি করি, দেখেছেন হয়তো। "
অনিকেত জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বললো, "অসম্ভব। আমি এই প্রথম পুরুলিয়া এলাম। আপনি যদি এই শহরের বাসিন্দাই হন তাহলে আপনার মুখটা আমার অত্যন্ত চেনা চেনা কেন লাগছে! আপনি কি কখনও ট্রেনে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন?"
"ও অসীম কাকা নারকেলটা দাও গো", একটা ছোট মেয়ে ঝালমুড়ির ঠোঙাটা হাতে নিয়েই চেঁচালো।
অসীম হেসে বললো, "এই তো মা, এই নাও। কথা বলতে গেলে কাজে ভুল হয়ে যায়।"
দুটো আঙুলের মাঝে নারকেলটা নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ছুঁড়ে ঠিক ওর মুড়ির ঠোঙায় দিয়ে দিলো অসীম। মেয়েটা হেসে চলে গেলো।
অনিকেত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝালমুড়িওয়ালা অসীমের হাতের দিকে। অন্যদের ঝালমুড়ি মাখার সঙ্গে এ ব্যক্তির কোথায় যেন একটা পার্থক্য আছে।
অভিজ্ঞ চোখে অনিকেত তাকিয়ে আছে।
অনিকেতের বয়েস ছত্রিশ। রেলে চাকরী করে। কাজের সূত্রে নয় একমাত্র শ্যালিকার শ্বশুরবাড়ি পুরুলিয়ায়,তাই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে বেড়াতে।
পাঁচ বছরের মেয়ে তিতলি, স্ত্রী পায়েলকে নিয়ে পায়ে পায়ে পুরুলিয়া ঘুরতে বেরিয়েছে বিকেলে।
কলকাতায় থাকায় আর প্রাইভেট কারে সর্বত্র যাতায়াতের কারণে রেলে চাকরি সত্ত্বেও লোকাল ট্রেনে ওঠা হয় না। পায়েলের আবার লোকাল ট্রেনে চড়তে খুব ভালো লাগে। ট্রেনের বাদাম আর ঝালমুড়ির নাকি আলাদা টেস্ট। তাই ঝালমুড়িওয়ালা দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছে পায়েল।
অনিকেত বললো, "কিছুতেই মনে করতে পারছি না জানো, এই অসীমবাবুকে আমি কোথাও আগে দেখেছি। "
পায়েল কনুই দিয়ে ঠেলে বললো, "উনি বিরক্ত হচ্ছেন। এক কথা বারবার বলো না। ঝালমুড়িটা নাও দিয়ে চলো। "
টাকাটা দিয়ে ঠোঙা দুটো হাতে নিয়েও আরেকবার ভালো করে তাকালো অনিকেত। এতটা ভুল ওর হয় না। কলিগদের মধ্যে ওর স্মৃতিশক্তি নিয়ে রীতিমত চর্চা হয়। ব্যানার্জীদা বলেন, "অনিকেতের মাথায় খান কুড়ি প্রকোষ্ঠ বেশি আছে। " সেই অনিকেত মনে করতে পারছে না এটা ভেবেই যেন বিজবিজে অস্বস্তিটা আরেকটু মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তবুও পায়েলের কথা মতোই ঝালমুড়ির ঠোঙাটা নিয়ে এগিয়ে এলো।
সবুজ মাঠে বসে পা ছড়িয়ে ওরা ঝালমুড়ি খাচ্ছে। পায়েল জিভে তৃপ্তির আওয়াজ করে বললো, "আচ্ছা অনি বাড়িতে এত ঘটা করে মাখলেও এমন টেস্ট কেন হয় না বলতো! উফ, দুর্দান্ত মেখেছে কিন্তু লোকটা।"
অন্যমনস্ক অনিকেতের মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে ওই অসীম নামক লোকটাকে। এত চেনা লাগছে মুখটা অথচ মনে করতে পারছে না। অনিকেত ঘাড় নেড়ে বললো, "হ্যাঁ ভালো লাগছে খেতে।
পায়েল বিরক্তির গলায় বললো, "তুমি এখনও ওকে কোথায় দেখেছো মনে করার চেষ্টা করে চলেছো তো! আশ্চর্য লোক বটে। রাস্তাঘাটে এরা ঘুরে বেড়ায়, দেখেছো হয়তো কোথাও একটা।"
অনিকেত অন্যমনস্কভাবে বললো, "আচ্ছা ধরো পায়েল তুমি একজন মানুষকে রোজ ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করতে দেখতে, আচমকা তাকে স্কুলে পড়াতে দেখলে তখন অবাক হবে না?"
কোথায় দেখেছে অনিকেত এই ঝালমুড়িওয়ালাকে? আদৌ কি দেখেছে, নাকি মনের ভুল? নাকি এমন কোথাও দেখেছে সেটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না!
ভোলারই নয় পুরনো সেই দিনের কথা।অনিকেতের স্মৃতি ঝাপসা হলেও দীপের মন বলতে চাইছিল..."আবার যদি হল দেখা প্রানের মাঝে আয়...."।
ছয় বছর বয়সে দীপের প্রথম দিনের স্কুলজীবনে এসেছিল জিগরিদোস্ত অনিকেত। পড়াশোনায় শুধু ভালোই নয় সাংস্কৃতিক জগতে দু'জনের বিচরন ছিল অবাধ। নববর্ষের অনুষ্ঠানে "হে নূতন দেখা দিক আরবার....." রবি গানে দ্বৈতকন্ঠস্বর আজও কানে বাজে।আজও সেই নববর্ষ কিন্তু দূ'জনের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে।
......********.........*******.......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন