নববর্ষকেন্দ্রিক মেলা, পার্বন, উত্সব, লোকাচার
সবিতা রায় বিশ্বাস
প্রাচীন যুগে বাংলা কোনো অখন্ড রাজ্য ছিলা না| সমগ্র বাংলা বিভিন্ন নাম, বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল| রাজা শশাঙ্ক সব জনপদ একত্রিত করে গৌড় নামের জনপদ গড়ে তোলেন| তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা| সব রাজ্যগুলোতেই বাংলা নববর্ষ প্রথা চালু ছিল| ঐতিহাসিকদের মতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে একই দিনে এই উত্সব পালিত হয়| বর্তমানে যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই নববর্ষ বাঙালিদের সার্বজনীন উত্সবে পরিণত হয়েছে|
নববর্ষ ও নারী যেন সমার্থক| কারণ কৃষি আবিষ্কারে নারীই পথিকৃত, ফলে 'আমান' বা 'আমানি' নামক নারীকেন্দ্রিক উত্সব প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে| প্রতি বছর পয়লা বৈশাখের আগের রাতে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির রাতে একটি ঘটে আতপ চাল পরিষ্কার জলে ভিজিয়ে তার উপরে পাঁচ বা সাত পাতা বিশিষ্ট কচি আম্রপল্লব দিয়ে রাখা হত| পরদিন সকালে সেই চাল সবাইকে খেতে দেওয়া হত এবং ঘটের জলে আম্রপল্লব ডুবিয়ে সারা বাড়িতে, সবার মাথায় ছিটানো হত| মনে করা হত এভাবে সারা বছর সকলে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে, জমিতে ভালো ফসল হবে| এই প্রথা এখনো বহমান| নববর্ষের সকালে যেমন বাড়িতে পুজো হয় তেমনই বিভিন্ন মন্দিরে ভীড় জমান পুণ্যার্থীরা| কালীঘাট বা তারাপীঠের মন্দিরে পুজো দিয়ে খেরোর খাতা মায়ের মায়ে ছুইঁয়ে আনে|
চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত| একজনের কথা না বলে অন্যজনের কথা বলা যায় না| চৈত্র সংক্রান্তির দিন হিন্দু বাঙালি বাড়িতে তেল ছাড়া নিরামিষ রান্নার প্রচলন ছিল, এখনো কেউ কেউ এটি বজায় রেখেছেন| চড়ক পুজোকে কেন্দ্র করে বসে গাজনের মেলা| এই চড়কপুজোকে কেন্দ্র করে পুরো চৈত্রমাস অনেক ভক্ত সন্ন্যাস গ্রহণ করে এবং শেষদিন পিঠে বঁড়শি বিধিয়ে চড়কগাছে ঘোরে| কখনো বা জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে বা কাঁটার উপর দিয়ে হেঁটে যায়| চৈত্রমাস জুড়ে সন্ন্যাসীরা শিব-পার্বতী সেজে গৃহস্থ বাড়ি থেকে চাল-ডাল-ফল সংগ্রহ করে| এদের সঙ্গে থাকে নন্দী-ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব, এরা শিব-পার্বতীকে ঘিরে নাচ-গান করে| একটি গান হল-
'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা
মধ্যেখানে চর
তার মধ্যে বসে আছে
শিব সদাগর
শিব গেল শ্বশুরবাড়ি
বসতে দিল পিঁড়ে
জলপান করতে দিল
শালিধানের চিঁড়ে
শালিধানের চিঁড়ে নয় রে
বিন্নি ধানের খই
মোটা মোটা সবরীকলা
কাগমারি দই'|
গাজনমেলা থেকে গৃহস্থ নতুন বছরের জন্য সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে| গ্রামীন মেলায় মাটির হাঁড়ি, কলসি, বাঁশের ঝুড়ি, প্লাস্টিকের জিনিস সংগ্রহ করে| কোথাও কোথাও এই মেলা নববর্ষের দিন হয়| নববর্ষের সকালে ব্যবসাদার দোকানে নতুন খাতা মহরৎ করে| আম্রপল্লব, কচি আম, রঙিন কাগজের শিকলি দিয়ে দোকান সাজায়| লক্ষ্মী-গণেশ পুজো করে| সন্ধ্যায় মিষ্টি সহযোগে গ্রাহকদের আপ্যায়ন করে এবং পুরনো হিসেব মিটিয়ে নেয়| অর্থাৎ ধার-বাকি মিটিয়ে দিয়ে গ্রাহক নতুন খাতা খোলে| এতে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় থাকে|
যদিও আধুনিক যুগে অনেককিছুই বদলে গেছে তবুও আদলটা রয়ে গেছে| বাড়িতে গো-মাতার পুজো উপলক্ষে সব গোরুকে ভালো করে স্নান করিয়ে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে গলায় মালা পরানো হয়| গোয়ালঘরে অস্থায়ী উনোন করে পিতলের সরা করে দুধ উথলানো বা পায়েস রান্না করা হয়| এছাড়াও দুপুরে খাবার পাতে থাকে ১৩ বা ২১ রকমের শাক দিয়ে তৈরী পদ, ডাল, বিভিন্ন রকম মাছের ঝোল, কচি আমের টক| বর্তমানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ঘরে ঘরে বিভিন্ন রকম ইলিশ ভাজা বা ভর্তার সাথে পান্তা খাবার চল হয়েছে|
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ একটি সার্বজনীন উত্সব| নববর্ষ শুরু করেছিলেন সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য| অর্থনৈতিক ব্যাপার থাকলেও নববর্ষ বঙ্গজীবনের আনন্দ-উত্সবের সঙ্গে জড়িত| নববর্ষ উপলক্ষে আগে থেকেই মানুষ ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, নতুন জামাকাপড় ও ব্যবহার্য জিনিস কেনে| ঘরবাড়ি নতুন করে সাজায়| নতুন জামা-কাপড় পরে পুজো অর্চনা করে সকলের মঙ্গল কামনা করে| নতুন বছর যেন সকলের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি বয়ে আনে এই প্রার্থনা করে| বিভিন্ন রকম খাবারের আয়োজন করে| আত্মীয়-স্বজন সকলের সাথে ভাগ করে খায়| একে অপরকে 'শুভ নববর্ষ' বলে স্বাগত সম্ভাষণ জানায়|
নববর্ষকে বরণ করতে বাঙালি মেয়েরা লালপাড়ের শাড়ি, হাতে চুড়ি পরে মাথায় ফুল দেয়| কপালে থাকে লাল টিপ আর গলায় ফুলের মালা| ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে একসাথে 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো' গান গাইতে গাইতে পথ পরিক্রমা শেষে সমবেত হয় ছায়াঘেরা কোনো স্থানে| সেখানে সমবেত সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে নববর্ষকে আহ্বান করে| এই ধরণের অনুষ্ঠান মূলত শহরাঞ্চলে হয়| তবে আজকাল গ্রামেও বিভিন্ন সংগঠন এইরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে|
বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই বাড়ির তুলসীতলায় দেওয়া হয় 'বসনঝারা'| নতুন কেনা মাটির ভাঁড় ফুটো করে সেটা ঝোলানো থাকে তুলসীগাছের উপরে| এই ভাঁড়ের ফুটোতে দূর্বাঘাস গোঁজা থাকে| ভাঁড়ে জল ঢাললে সারাদিন ফোঁটা ফোঁটা করে জল পড়ে গাছে| আসলে গ্রীষ্মের খরতাপ থেকে তুলসীগাছকে বাঁচাতে এই লোকাচারের উদ্ভব| লোকসংস্কৃতি গবেষক সুস্নাত জানার কথায় প্রতিটি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা বিজ্ঞানমনস্কতা কাজ করছে|
এছড়া নববর্ষের দিন সকালে শুকনো পাতা কুড়িয়ে একজায়গায় রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে আঁশবটি গরম করে সেটি দিয়ে বাড়ির লোকজন ও গবাদিপশুর পায়ে ছ্যাঁকা লাগানোর প্রথা আছে| লোকগবেষক ঝর্ণা আচার্য বলেন, আসলে এইসময় শুকনো পাতা জমা হয় বাড়ির আশেপাশে| সেগুলো জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলে পরিচ্ছন্ন করা হয় অঙ্গন আর গরম ছ্যাঁকা লাগিয়ে জীবাণু মুক্ত করা হয়| এছাড়া বাঁশের ঝাড়ে মাটি দেওয়া, গরুকে স্নান করিয়ে শিং এ তেল মাখানো, ধান ক্ষেতে গোবর সার দিয়ে হাল চাষ করা এগুলো সবই নববর্ষের লোকাচারের মধ্যে পড়ে| নববর্ষের দিন গ্রামাঞ্চলে মুড়ির ছাতু খাওয়ার রেওয়াজ আছে| সেইসাথে ক্ষৌরকারের দেওয়া কাঁসার চকচকে আয়নায় মুখ দেখেন বাড়ির সবাই| লোকসংস্কৃতির লেখক ড. শ্যামল বেরা বলেন সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালি কোনভাবেই তার সংস্কৃতিকে ভোলে না| এগুলোর হাত ধরে এগিয়ে চলে|
বাংলার কৃষি মানচিত্রে নববর্ষের যোগাযোগ অটুট| খনার বচনে আছে- "খনা বলে শুন কৃষকগণ/হাল লয়ে মাঠে যাবে যখন/শুভক্ষণ দেখে করিবে যাত্রা/পথে যেন না হয় অশুভ বার্তা/আগে গিয়ে করো দিক নিরূপণ/পূর্বদিক হতে কর হল চালন/তাহা হলে তোর সমস্ত আশয়/হইবে সফল নাহিক সংশয়|" চাষী ভাইয়েরা এই বচন মেনে চলন এখনো|
নববর্ষকে উত্সব মুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা| এটা মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা| এই মেলায় আঞ্চলিক সঙ্গীত পরিবেশন করে সেখানকার শিল্পীরা| যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান মানুষকে আকর্ষণ করে| রাধা-কৃষ্ণ বা লায়লা-মজনুর আখ্যান উপস্থাপিত হয়| বাচ্চাদের জন্য থাকে পুতুল নাচের আসর| সেইসাথে মেলা প্রাঙ্গনে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা|
শান্তিনিকেতনে চৈত্রসংক্রান্তির দিন পুরনো বছরকে বিদায় জানাতে জহরবেদিতে সাদা আল্পনা দেওয়ার পরই নতুন বছরকে বরণ করে অভ্যর্থনাস্বরূপ সেই আল্পনাকে রঙিন করে তোলার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণ উত্সব| ভোর পাঁচটায় গৌরপ্রাঙ্গনে বৈতালিকের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই বর্ষবরণ উত্সব| সকাল সাতটায় উপাসনা গৃহে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে নববর্ষকে আহ্বান জানানো হয়| ভোর হতেই ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক, আশ্রমিকরা জড়ো হন উপাসনা গৃহের সামনে| সকাল ন'টায় ঘন্টাতলায় বর্ষবরণের আসর বসে| গৌরপ্রাঙ্গনে সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় নৃত্যনাট্য| শান্তিনিকেতনের নববর্ষের আনন্দে সামিল হতে আসেন দেশী-বিদেশী বহু পর্যটক|
নববর্ষ মানেই পুরনো কালিমা মুছে ফেলে নতুনকে বরণ করে নেওয়া| নববর্ষেই শপথ নিতে হয় আগামী দিনগুলোকে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলবো| হিংসা, দ্বেষ দূরে রেখে সকলকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেব| রবিঠাকুরের গানে গলা মিলিয়ে বলব, "মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক ধরা/অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা|"
----
শব্দ সংখ্যা- ১০০০
Sabita Ray Biswas
Flat - 3k Block -4,
Shankar Tower,
33 Sukanta Sarani, Italgachha
Kolkata 700079
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন