নব বরষে নব হরষে
পুষ্প সাঁতরা
নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে
উৎসারিত নব জীবননির্ঝর উচ্ছাসিত আশা গীতি
অমৃত পুষ্প গন্ধ বহে আজি এই শান্তিপবনে'। ----- রবীন্দ্রনাথ
বাংলা পঞ্জিকা ধরে আসে বাঙালির 'নববর্ষ ', নববর্ষের সাজ ঘরে লাগে নব হিল্লোল,প্রকৃতিও সেজে ওঠে আপন খেয়ালে।বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ হল বাঙালির প্রাণের উৎসব।যেহেতু নববর্ষ তাই এই অনুষ্ঠানে কিছু মাঙ্গলিক কর্ম অনুষ্ঠিত হয়।কেননা বছরের প্রথম দিনটিকে সাদরে বরণ করাই হল মূখ্য উদ্দেশ্য-- মূখ্যত গৃহ, দোকান, মন্দিরের চারপাশ ফুল মালায় সাজানো হয়।সারা বছরই যেন আনন্দে মন ভরপুর থাকে।যেখানে সুন্দর সেখানেই আনন্দ ধাম।পূজার্চনা খাওয়া দাওয়ার মধ্যে নববর্ষ কে বরণ করা।এ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের রূপরেখা চিহ্নিত করে।নববর্ষের প্রথম দিন,এই পয়লা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত আবেগতাড়িত স্মৃতিমালা।চৈত্র সংক্রান্তিও চড়কের পরেই বছরের প্রথম দিনের আনন্দ উপভোগ করা; বাঙালির নববর্ষের ইতিহাস লিখতে গিয়ে,বিংশ শতাব্দীর কথা এসে পড়ে,বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জমিদারি প্রথা যখন কায়েম হয়েছে ,তখন এই দিনটিতে শোভাবাজার,বাগবাজার জোড়াসাঁকোর বাঙালি বাবুরা নিজেদের বাড়ির নাচঘরে নাচের,এবং গানের আসর বসিয়ে আনন্দ উপভোগ করতেন।এই নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে,হালখাতা বা নতুন খাতার মহরতের সঙ্গেও; পনরশ ছাপান্ন খ্রিস্টাব্দের দশই মার্চ বা ন'শত বিরানব্বই হিজরিতে বাংলাসন গণনা শুরু হয়।এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময়, (পাঁচই নভেম্বর পনরশ ছাপান্ন) থেকে প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।মুঘল আমলে খাজনা আদায় হতো হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কিন্ত তাতে খাজনা আদায়ের অসুবিধা হোত।আকবর তার বিখ্যাত জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতে উল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সনের সংস্কার আনার নির্দেশ দেন।তিনি সেই নির্দেশ অনুসারে হিন্দুদের সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন।আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়,এবং বাংলা ক্যালেন্ডারকে সরকারীভাবে প্রবর্তন ও করা হয়।
হাল আর খাতার ইতিহাস কৃষির প্রসারেও যুক্ত, লাঙল আর হালের সঙ্গে খাতা যুক্ত হত তখন তালপাতাতে হিসাব রাখা হত। হালখাতা আবার নতুন ফসলের ও সূচনা করে এই নববর্ষ কে কেন্দ্র করে।আসলে হালখাতা হল বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি।নববর্ষ- হালখাতা যেন একই অঙ্গে দু'রূপ! রাজা বা নবাবগণ মিষ্টান্ন ফল বিতরণ করতেন প্রজাদের মধ্যে এখন নববর্ষ উদযাপনের রূপ বদলেছে। হালখাতা বা পয়লা বৈশাখের দিন,সিদ্ধিদাতা গনেশ, লক্ষী-নারায়ণের পুজা করা হয়,সিঁদুরের ছাপ দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে মায়ের পায়ে রাখা থাকে।আমপাতায় সিঁদুর দিয়ে বাড়ির চারপাশে টাঙানো হয়। নববর্ষ উদযাপনের এই যে কৌলিন্য তা আজ অনেক টাই ফিকে। কৃত্রিম তা গ্রাস করেছে,সব টুকু যেন দেখনদারি মনে হয়।অতি আধুনিকতায় মোড়া হাইটেক নববর্ষ! নববর্ষ মানে সত্য নারায়ন পুজা, সিন্নি প্রসাদ, গৃহস্থ বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আগমনের সাথে সাথে পুজার পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হত,কিন্ত দিন বদলেছে দোকানদার খেরোর খাতা নিয়ে মন্দিরে চলে যান টাকার সিঁদুরের ছাপ নিতে।এখন যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে, তাই নববর্ষের পুজা আচ্চা যতটা না করলে নয় ঠিক ততটাই হয়। তার থেকে বেশি আড়ম্বর দেখা যায় ঘোরাফেরা আর কোন দামি দামি রেস্টুরেন্টের খাওয়া- দাওয়া করতে । বাংলা নববর্ষের থেকে ইংরেজী নববর্ষের আনন্দ বেশী উপভোগ করে। দোকানদার--- ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট সাদরে দিতে চান না,যারা খদ্দের তারাই প্যাকেট পান, পূর্বে এ প্রথা চালু ছিল না, অবশ্য ব্যতিক্রম ও কিছু আছে যাঁরা পুরানো চলনটাকে ধরে রেখেছেন। তাই নববর্ষের সেকাল আর একালের মিল খুঁজলে আর পাওয়া যাবে না-- নববর্ষের মধ্যে যে সহজ মিলনের সুরটি গাঁথা হয়ে আছে তা এখন অনেকটাই ধূসর!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন