google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re বোশেখি বাঙালি নাকি পোশাকি বাঙালি? ।। দিব্যেন্দু ঘোষ - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

বোশেখি বাঙালি নাকি পোশাকি বাঙালি? ।। দিব্যেন্দু ঘোষ


বোশেখি বাঙালি নাকি পোশাকি বাঙালি?

দিব্যেন্দু ঘোষ


মুঠোফোনে টুং করে নোটিফিকেশন, ফটাকসে ঢুকে পড়ল মেসেজ, 'হ্যাপি নতুন ইয়ার' প্রথমা বোশেখে ভেতো বাঙালি বিরিয়ানি-চাঁপ সাঁটিয়ে দিনেদুপুরে মেসেঞ্জারে হাই তুলছে, কিন্তু ঘুমোচ্ছে না বরং মেসেজের রকমসকম দেখে ছিটকে ছ হয়ে পোশনো তুলছে, 'ইয়ার, মসকরা হচ্ছে! এটা বাংলা নতুন বছরের শুরুয়াৎ, ইয়ার মায়ের দেওয়া মোটা আঙুলকে শিক্ষা দে, বাংলা লেখ হালকা নীল ইনল্যান্ড লেটার গন, হলুদ পোস্টকার্ডও কালের গর্ভে, চিঠি না লিখিস, বাংলা টাইপটা অন্তত কর হতচ্ছাড়া, শুভ নববর্ষ'

     সে গুড়ে বালি

তোমাদের যা কিছু খাওয়ার সাধ হয়, খেয়ে নিপ্রথমা বৈশাখে। গরম ভাতে জল ঢেলে পান্তা, মচমচে ইলশে ভাজা। নতুন কেনা মাটির বাসনে চুমুক দিয়ে চুকচুক করে পান্তার জল খেআর উগড়ে দিতৃপ্তির ঢেঁকুর, আহ, বড্ড বাঙালি হলুম! আমি সেই বাসিভাতই খাব, আগের রাতে ভাতের হাঁড়িতে এক আঁজলা জল ঢেলে যত্ন করে মায়ের রেখে দেয়া ধন;
পেঁয়াজকুচি আর ভাজা শুকনো মরিচ ভেঙে মাখানো, যেন অমৃত, কী স্বাদ, তোমরা জানবে না। না-ভাতে বাঙালি জানবে না ভাগ্যিস হা-ভাতে নয়!

      তবে পয়লা সকালে পান্তা-ইলিশ, যে গালভরা বুলি, এ 'পোশাকি ঐতিহ্য' বাঙালির নয়। এসব বুলিবাজেরাও বাঙালিদের কেউ নয়। আমাদের ছিল ডাঁটাশাক বুনোকচু কলমিলতা, আমাদের ছিল আলুভর্তা কুমড়ো ভাজা মাকলাইয়ের ডাল, আমাদের ছিল খলসে ট্যাংরা চিংড়ি আর পুঁটিমাছের ঝোল, আমাদের ছিল খাল-বিল-পুকুর-ডোবার সহজ জীবন। আমাদের ছিল চৈত্রসংক্রান্তি, গ্রামে গ্রামে মেলা, পাগলা ষাঁড়ের কাছি ছেঁড়া, আমাদের ছিল হালখাতাধান্দাবাজ, পুঁজিবাজ, অর্থখেকো আড়ৎদার আর নির্বোধ মিডিয়ার তৈরি কৃত্রিম 'পান্তা ইলিশের বোশেখ' ছাড়ো। তোমরা আবহমান বাংলার কেউ নও। কোনদিন দেখোনি বাংলার গ্রাম, বাংলার ঘরে যাপন করোনি একটি নিশুতি। সেই তোমাদের মুখে যখন শুনি পান্তা-ইলিশ হইবাংলার ঐতিহ্য, তখন চিত্ত চমকে চ।

     তখন বোশেখি বাঙালি সন্ধে হলেই হালখাতার আমেজে গা সেঁকে নিত জমানা ডিজিটাল, তাই সেই সব হালখাতা গোডাউনে পড়ে পড়ে রংচটা বা পুরনো খাতা-কাগজ বিক্রেতার ঘরে ডাঁই দোকানে দোকানে সেই দেদার ভিড় নেই, হাতে লাড্ডু, গজার প্যাকেট নেই, পেলাসটিকের গেলাসে ঠান্ডা পানীয় বুজকুড়ি কাটে না এখন অধিকাংশ দোকানির ভরসা ডিজিটাল ইনভিটিশেন! পাড়ার মুদিখানাই হোক অথবা জামাকাপড়ের দোকান, সকলেই নিমন্ত্রণ সারে হোয়াটসঅ্যাপে

       এখন বাঙালি বাংলা পয়লায় রেস্তোরাঁয় চাইনিজ সাঁটায় মোদ্দা কথা, পহেলা বোশেখে বাঙালিয়ানার পালে যে হাওয়া লাগত জোরসে, চুপসে চোদ্দ হয়ে যাওয়া ভাষা-সংস্কৃতিতে সে হাওয়া আজ ফিকেতর আসলে শুরুতে বৈশাখ বছরের প্রথম মাস ছিল না, শুরুর মাস ছিল অগ্রহায়ণ। পরবর্তীকালে অগ্রহায়ণকে ক্যাঁত করে লাথ মেরে এ স্থান দখল করে নিল বৈশাখ। অর্থাৎ ঐতিহ্যের হেরফের ঘটল। আসলে চিরন্তন বলে যে কিছু নেই! সুতরাং 'হাজার বছরের সংস্কৃতি' বলাটা আতিশয্য ছাড়া আর কী?

     নববর্ষের সেই মেলা ফুরিয়ে গেছে, ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে নাগরদোলা ঘোরে না, পুতুলনাচ তো কবেই নাচতে নাচতে পগার পারবাঙালির মনের ভেতর আজ শৈশব উঁকিঝুঁকি দেয় না, অসংখ্য এলোমেলো স্মৃতিরা আজ ঝাপসাচিলেকোঠার চুমু-বাহিত শরীরে লেপ্টে নেই ঐতিহ্যের অবলেশ! নাগরিক জীবনে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির ঘেরাটোপে পড়ে থাকে পোশাকি বাঙালি নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামবাংলায় প্রচলিত সংস্কারকে নগর কিংবা উপ-নগরবাসী কতিপয় 'শিক্ষিত' ব্যক্তি নিছক 'কুসংস্কার' বলে উড়িয়ে দিতে চায়, তারা স্বঘোষিত উন্মূল। তারা রাধাকৃষ্ণের প্রেম ঠাহর করতে পারে না, কিন্তু ঠিকই মহাআড়ম্বরে উদযাপন করে ভেলেন্টাইন ডে

     আমার থেকে পৌনে তিন বছরের বড় দাদা বোশেখ পয়লায় প্রণাম আদায়ে বিশেষ উৎসাহী ছিল। আর পয়লা বৈশাখ পার হওয়ার আগেই নব্বই কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে মামাতো দিদির আশীর্বাদ-চিঠি চলে আসত। আমাকে কেউ কখনও প্রণাম করত না। আমার সাড়ে পাঁচ বছরের কনিষ্ঠা ভগ্নীর ওপরে একবার দাদাগিরি ফলাতে গিয়েছিলাম। প্রণাম তো করলই না, উল্টে প্রচণ্ড খিমচে দিল। তার দাগ এখনও আছে।

       বলুন তো বাঙালির নববর্ষ কোন মাসে, মাসের কোন তারিখে? আচ্ছা, এটা কোনও একটা প্রশ্ন হল? গ্যাঁটে পয়সা থাকলে নামী-দামি ক্লাবে ইউরোপীয় খানা এবং ভুঁড়ি ভাসিয়ে নাচানাচির যে দৃশ্য দেখে অন্নপ্রাশনের ভাত মুক্তি খুঁজতে থাকে, সেই একলা জানুয়ারি যে আমাদের পবিত্র নববর্ষ, এ কথা কি বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে? যদি কেউ বলে, 'ওটা ভাই সাহেবদের নববর্ষ, বড়জোর খ্রিস্টানদের বলতে পারেন', তো দশটা মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারাই কেতা দিয়ে কইবে, 'সাহেবরা আমাদের সভ্যি করতে এসেছিল'। এ কথা সবাই বুঝেছিল এক ওই পাপিষ্ঠ বুড়ো গান্ধী ছাড়া।

       একটা কথা ভুললে চলবে না, নামী-দামি ক্লাবে যারা একলা জানুয়ারি বিশ্বায়ন করে, তারা অধিকাংশই সনাতন ধর্মের ধারক ও বাহক। আর বাঙালি সংস্কৃতি? আটশো টাকা সের দরে বাগদা চিংড়ি আর হাজার টাকা সের দরে ইলিশ মাছ কিনে জিনিসটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কারা শুনি?

     আমাদের প্রায় সব উৎসবেই একটু ধর্মের ছোঁয়া থাকে। নববর্ষের ক্ষেত্রে কিন্তু দেবদ্বিজে ভক্তিটা অত প্রকট না। সেক্যুলার বাঙালির মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় ভাল। তবে ধর্মের ব্যাপারটা থাকলে ফলারের ব্যাপারটা বেশ ভালই থাকে। মানে, দেব-দ্বিজ নিয়ে কথা! দেবতাদের যা শুনি, আহারের চেয়ে বিহারেই উৎসাহ বেশি। ইন্দ্র তো কোনও মহিলাকেই ছেড়ে কথা বলেন না, মাস্টারের বউকেও না। শাস্ত্রে বলে, দেবতারা যা-ই করুন, বিপ্রগণ ভোজনে নৃত্য করেন। কিন্তু পয়লা বৈশাখে সেই নাচানাচির সুযোগ কিছু কম। ক্লাবগামী বঙ্গসন্তানরা পয়লা জানুয়ারি কি কোলাকুলিও করেন না? করমর্দন আর নাচানাচিতেই উৎসবের সমাপ্তি? পয়লা বৈশাখে নববর্ষের চিঠি আমাদেরও গণ্ডা গণ্ডা লিখতে হত, এখন অবশ্যি বাংলায় চিঠি লেখা প্রাগৈতিহাসিক যুগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাকে 'শ্রীচরণকমলেষু', আর কাকে শুধু 'শ্রীচরণেষু' লিখতে হয় এই সব অবান্তর ব্যাপার যত্ন করে শেখার প্রশ্নই ওঠে না। সময়বিশেষে সংস্কৃতিটা নিত্যবস্তু, অর্থাৎ, তার যাবতীয় অনুষঙ্গ নিয়ে সব সময়েই উপস্থিত। আমাদের সংস্কৃতি নানা সম্পদে সমৃদ্ধ। তা নিয়ে গর্ব থাকলে কিছু অন্যায় হয় না।

     গর্ব জিনিসটা নিচুস্তরের অনুভূতি। ওটা না থাকলেই ভাল। যদি বঙ্কিম-নজরুল-রবীন্দ্রনাথের ভাষা ভুলে গিয়ে টেঁশু মার্কা 'আরে ইয়ার' জাতীয় হিংরিজিকে মাতৃভাষা বলে আমরা বরণ করি, তা হলে আমাদের সাংস্কৃতিক গতিটা সভ্যতা থেকে অর্ধসভ্যতার দিকে চলমান ধরে নিতে হয়। শুভ দিনে বাংলায় গুরুজন, প্রিয়জনকে চিঠি লেখা, গুরুজনদের প্রণাম, প্রিয়জনদের আলিঙ্গন, নিজেদের ভাষায় বাক্যালাপ এই সব প্রথা জীবনকে সানন্দ করে।

      সুদূর ক্রেনিয়াস গ্রহ থেকে অ্যাং এসেছে বঙ্কুবাবুকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে, এখন যদিও আর আগের মতো নববর্ষের প্রণাম, মিষ্টির আদানপ্রদান, কোলাকুলি ওতটা নেই, তবে অত্যধিক 'বং' হতে গিয়ে 'শুভ নববর্ষ' যেন 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' না হয়ে যায়, বাঙালির একান্ত ঘরের এই উদযাপনের সেই মাটির গন্ধ যেন বজায় থাকে চিরকাল...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন