বাংলা ভাষা ও নববর্ষ উৎসব
দীপক পাল
বাংলা ক্যলেনডারের প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বাংলায় এবং বাংলার বাইরে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়। এই বাংলা নববর্ষ সন্মন্ধে বলতে গেলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও প্রসার সন্মন্ধে কিছু জানা দরকার। আজ থেকে দেড় হাজার বছরের আগে গুপ্ত যুগে ভারতবর্ষের দক্ষিণ পূর্বাংশে বঙ্গ রাজ্য ও উত্তরাঞ্চলে গৌড় রাজ্যে বাংলা ভাষা দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এরপর রাজা শশাঙ্কের আমলে বাঙালী ও বাংলা ভাষা বিশেষ ভাবে মর্যাদার আসনে স্থান করে নেয় যা পাল যুগে তা আরও প্রসারিত হয়। তাদের আমল থেকেই বাংলা সংস্কৃতির এক নিজস্ব ধারা পরিলক্ষিত হয় সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, গীত বাদ্য, ললিত কলায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করে। আগে বাংলা সন শুরু হতো চৈত্র মাস থেকে। দিল্লীর সম্রাট আকবর বঙ্গদেশে খাজনা আদায়ের কিছু অসুবিধার জন্য বাংলা সন শুরু করান বঙ্গে বৈশাখ মাস থেকে। আর তখন থেকেই বঙ্গের ক্যালেন্ডারে বছর শুরু হয় বৈশাখ মাস থেকে এবং নববর্ষ পালিত হয় পয়লা বৈশাখে। নববর্ষ উৎসব এখন শুধু ভারতের পশ্চিম বাংলাতেই হয়না, ভারতের বহু প্রদেশেই তা ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে বাঙালী বিভিন্ন সূত্রে বসবাস করে সেখানেই তারা একত্রিত হয়ে নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা সাহিত্য সঙ্গীত নৃত্যকলা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য বয়ে চলেছে। এই উৎসব যজ্ঞে বাঙালী অবাঙালী সবাই সামিল হয়ে থাকে। তাই বাংলা নববর্ষ এখন জাতীয় উৎসব হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। তাছাড়া দেশের বাইরেও যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ইত্যাদি দেশগুলোতেও বাংলা নববর্ষ পালিত হয় এবং সেই সব দেশের স্থানীয় কিছু আদিবাসীদের যোগদানের ফলে তা আরও সাফল্যমন্ডিত হয়।
কলকাতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী, নন্দন ও রবীন্দ্রসদনের মাঠে খুব বড়ো করে একদম ভোর থেকে নববর্ষ উপলক্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর বসে। এই আসরে সব বড় বড় শিল্পীরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে আসর মাতিয়ে দেন। কিন্তু এইসব জায়গায় একটার বেশী গান গাওয়ার নিয়ম নেই। নন্দন নির্মাণ হওয়ার আগে আমরা অনেকে মিলে সকাল সাতটার পর রবীন্দ্র সদনে পৌঁছে যেতাম। অসম্ভব ভীড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে গান শুনতাম প্রায় কয়েক বছর। এছাড়া দক্ষিণ কলকাতার বসুশ্রী সিনেমায় মন্টু বসুর তত্ত্বাবধানে এক মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান হতো। এতে উত্তম কুমার, অনিল চ্যাটার্জি, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, রবি ঘোষ ইত্যাদি সব শিল্পীরা ধুতি পাঞ্জাবী পরে আসতেন। চলতো আড্ডা ও তার সাথে চলতো গান বাজনা অর্কেস্টা ইত্যদি। একেবারে জমজমাটি ব্যাপার। দুরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলে নতুন বছরের আহ্বানের মাধ্যমে রাতে নববর্ষকে স্বাগতম জানানো হয়। অনেক রাত পর্য্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলে। এই আড্ডায় গান আবৃত্তি হাস্য কৌতুক ইত্যাদি হয়।
পশ্চিম বাংলায় হালখাতা একটা বিশেষ অনুষ্ঠান। এখানকার ব্যবসাদাররা পয়লা বৈশাখে নতুন বছরের জন্য নতুন খাতা খোলেন। ভোরে স্নান সেরে খাতার ওপরে সিঁদুর লাগিয়ে ও স্বস্তিকা চিন্হ এঁকে পুরোহিত দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা দেয়। কেউ কেউ গঙ্গা স্নান ও তার সাথে কলাবৌ স্নান করিয়ে দোকান বা শোরুমের বাইরে দুপাশে বসিয়ে দেয়। মন্দিরেও পূজো দেওয়া হয়। এতে বাড়ীর সবায়ের উপস্থিতিতে পূজা সম্পন্ন হয়। তারপর বিকালবেলা থেকে শুরু হয় হালখাতার অনুষ্ঠান। দোকানের নিয়মিত খরিদ্দারদের আগেই নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে দেওয়া থাকে। নিমন্ত্রিত খরিদ্দাররা একে একে আসতে থাকে। আগে নিমন্ত্রিদদের বসিয়ে খাওয়ানোর চল ছিল। তারপর মাটির ভাঁড়ে চায়ের পর্ব। খেতে খেতে খরিদ্দার ও দোকানীর মধ্য রসালাপ হতো। তারপর যাবার সময় নিমন্ত্রিতদের একটা করে নতুন বছরের বাংলা ক্যলেন্ডার পাওনা হতো। এখন হালখাতা অনেক কমে গেছে। কিছু কিছু ব্যবসাদারের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ আছে এখনও। যেমন সোনা রূপের দোকান, বিভিন্ন বস্ত্রালয়ে, বড়ো বড়ো বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সেটাও হয় অনেকটা যান্ত্রিকতার সাথে। যাও নিমন্ত্রণ পত্র দেখাও, তারা হাসিমুখে নিমন্ত্রণ পত্রে যে নাম লেখা আছে সেই নামটি তারা তাদের নতুন খাতায় অগ্রিম পাওনা হিসাবে যে যেমন দেয় সেটা লিখে নিয়ে হাতে খাবারের একটা প্যাকেট ও নতুন বছরের একটা ক্যলেন্ডার ধরিয়ে দিয়ে নমস্কার করে অন্য খদ্দেরের দিকে মন দেয়।
নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন পাড়ায় সাংস্কৃতিক উৎসব চলে। গান বাজনা, নৃত্যকলা, নাটক, যাত্রানুষ্ঠান, বসে আঁকা প্রতিযোগীতা চলে সারাদিন ব্যাপি এইসব অনুষ্ঠানে।
__________________________
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন