পয়লা বৈশাখ বাংলার রূপ এবং বাংলার মুখ
সুবল সরদার
'If winter comes,can spring be far behind?' যদি শীত আসে, বসন্ত আসবেই । বাংলায় বৈশাখকে আসতে হয়,তাই তো সে রূপসী বাংলা হয়ে ওঠে । যখন ব্যথিত হৃদয় নিয়ে চৈত্র বিদায় নেয়, তখন বৈশাখ আশা -আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন নিয়ে হংসের মতো সৌন্দর্য্যের ডানা মেলে সরোবরে রূপসী বাংলার বুকে। । কী রূপে, কী সোহাগে বৈশাখ ফেরে বাংলার টানে। বাংলার রূপ এবং মুখ হলো পয়লা বৈশাখ। রূপে- রসে- গন্ধে ভরে, সুজলা -সুফলা- সবুজ রূপে,ফুলে -ফলে -সজলে বৈশাখ আসে শতরূপা হয়ে । মাধবীলতার মাধুরীর প্রাণে ! বট - অশ্বত্থ সুবজ পাতা মেলে দক্ষিণা হাওয়ায় ,তখন তরুছায়া থেকে নির্জনতা ভঙ্গ করে মধুর সুরে ডেকে ওঠে কোকিলের কুহু কুহু ডাক। কত ছবি ,কত মুখ ভেসে আসে বাতাসে! মনে হয় কত সুখের বাতাস বহন করে আনে ! বৈশাখ শুধু নতুনের ডাক দেয় না। পুরাতনের হাতে ধরে এসে নতুনের স্বপ্ন গড়ে। সৌন্দর্য আর ভালোবাসার মুহূর্ত নিয়ে মনে হয় পয়লা বৈশাখ ।
বাংলা- বাঙালি -পয়লা বৈশাখ সব যেন নক্সী কাঁথার মতো কাব্য গাঁথা। পুরানো আর নতুনের দ্বন্দ্ব নিয়ে পয়লা বৈশাখ আসে না। পুরানোর অবসানে পয়লা বৈশাখ আসে নতুনের ডাকে । পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে বাংলার ঘরে ঘরে আলপনা আঁকে। এই প্রতিপদ তিথিতে নতুন তুলসী মঞ্চে জল দান শুরু করে। গোয়াল ঘরে গো মাতার পায়েসের ভোগ করে গো মাতাকে খাওয়ায় । সকালবেলায় মাঠে মাঠ খড়ের আঁটি জ্বালায় অন্তঃস্বত্তা বসুন্ধরাকে সেঁক দিতে। বাংলার এই রীতি হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, পশু সুরক্ষা এবং জলবায়ু দূষণমুক্ত বিশ্বের কথা বলে। বাংলার এই আঞ্চলিকতা বিশ্বায়নের কথা বলে। বাংলার এই রীতি আছে বিশ্ব নীতি। বৈশাখ মাসকে মধুমাস বলে। তখন মৌচাক মধু ভরে ওঠে । অলির গুঞ্জনে কৃষ্ণচূড়ায় রঙ লাগে । লালের সৌরভে সুগন্ধি হয়ে ওঠে পৃথিবীর পরে। নদীমাতৃক বাংলায় ,বনের শীতল ছায়ায়, দক্ষিণা হাওয়ায় ক্লান্ত প্রাণ জুড়ায়ে যায় । শীতের জড়তা কেটে নদী চঞ্চল হয়ে ওঠে । বেগবতী হয়ে সে ছুটে বেড়ায় দেশ হতে দেশান্তরে। বাংলার এই বৈচিত্র্যতার মধ্যে বৈশাখ এসে আরো বৈচিত্র্যময় করে তোলে। বৈশাখ শুধু রূপসী নয়, কখনো সে ভয়ঙ্করী হয়ে ওঠে । কাল বৈশাখী হয়ে ধেয়ে এসে লন্ডভন্ড করে দেয় তার রূপ- বৈচিত্র্যকে । ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি, বৃষ্টির সঙ্গে শিলা,বৃষ্টি শিল্প হয়ে ওঠে শিলা বৃষ্টির রূপ ধরে । আনন্দের শীল হয়ে পড়ে ঝুরি ঝুরি দুহাতে নেব লুটি লুটি । এতো আনন্দ কে নিয়ে আসে রে এই ধরণীর পরে! বৈশাখ তুমি বৈশাখী হয়ে ফিরে আসে এই বাংলায়, এই তৃষিত হৃদয়ে আমার । আমি মুগ্ধ প্রাণে চেয়ে আছি তোমার পাণে। বৈশাখ আমার প্রাণ,হৃদয়ের গান। যত স্বপ্ন ছিল,যত ভাবনা ছিল আজ সব তোমায় দিলাম। বৈশাখ ছাড়া বারো মাসের নতুনত্ব কোথায়, আনন্দ, সৌন্দর্য্য: পূর্ণতা কোথায় ! বৈশাখ ছাড়া পূর্ণতা কখনো পূর্ণ হয়! বৈশাখ ছাড়া পূণ্যতা কখনো পাওয়া যায় । তাই বৈশাখ পূর্ণতাভরা এক পূণ্যতার মাসে। পয়লা বৈশাখ নতুনত্বের কথা বলে, সৌন্দর্যের কথা কথা, সৃষ্টির কথা বলে , ভালোবাসার মাস বলে কথা। একটা মুখ ভেসে আসে। একটা ফুল। একটা নদী । একটা গান । বৈশাখ এলেই তারা ফিরে আসে প্রজাপতির মতো দক্ষিণা হাওয়ায় ডানা মেলে। ।
পয়লা বৈশাখ থেকে নতুন বছর শুরু হয়। শুভ কার্য শুরু করে এই দিন থেকে। ওই দিনে আমরা শুভ কামনা করি, সুন্দরের আরাধনা করি যাতে সারা বছর সুন্দর করে কাটানো যায়। পুরানো জামা -কাপড় ছেড়ে নতুন জামা -কাপড় পরি নতুনের ডাকে নতুন সাজে নবরূপে অভিরূপা হয়ে । দোকানে দোকানে শুভ মহরৎ হয়। লাল ফিতে বাঁধা হিসেবের নতুন খাতা তৈরি হয়। গণেশ পূজা, চড়ক -গোষ্ট মেলা, রবীন্দ্র জয়ন্তী । বারো মাসের তেরো পার্বণের কত পার্বণ এই মাসে ! বৈশাখ তুমি বৈশাখী, তুমি প্রেমিকা, তুমি আমাদের ভালোবাসা । বৈশাখ তুমি পথ ভুলে যেওনা কোথাও। তুমি ফিরে এসো ওই অরণ্য,ওই নদী হতে এই রূপসী বাংলায় দক্ষিণা বাতাসে পাখা মেলে । যত রূপকথার গল্প আছে শুনবো আজ তোমার কাছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন