নববর্ষ–আমার পিতৃতর্পণ
গৌতম ঘোষ-দস্তিদার
জ্ঞানত নববর্ষ বলতে আমরা তখন বাংলা মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েরা বাংলা নববর্ষকেই জানতাম। ইংরেজিতে যেটা কেবলই একটা নিউ ইয়ার ছিল, নতুন বছর হয়ে ঠিক যেন উঠতে পারেনি। আমাদের সময় কিন্ডারগার্টেন বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। আমরা ডিরেক্ট ফ্লাইট ধরে চলে যেতাম ক্লাস ওয়ানের বন্দরে। পড়াশোনার যে আধুনিক চাপ-উত্তাপ সেটা আদ্যিকালের এই বদ্যি বুড়োর দল আমরা তেমন ভাবে টেরই পাইনি। তার উপর পরীক্ষা বছরে মাত্র দুটো – বছরের শেষে আর গরমের ছুটির পর আধা বছরের। আর শিক্ষা-বছরও তখন শেষ হত গ্রেগরিয় বছরের শেষে মানে খ্রিষ্টজন্মের আগের সপ্তাহে। কাজেই বাংলা নববর্ষ আমাদের কাছে মনের ভিতর জেগে ওঠা একটা সত্যিকারের গোটা উৎসব ছিল। মোমো খেয়ে আর অ্যাকশন মুভি দেখে নষ্ট হত না। আমার তো নয়ই।
আমার পিতৃদেব প্রয়াত শঙ্কু মহারাজ সপ্তাহের প্রতি সোমবার বিকেলে বইপাড়া যেতেন প্রকাশকদের সঙ্গে আর্থিক ও পারমার্থিক আলোচনার কাজে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ যে বারই পড়ুক না কেন, সকাল না হতেই আমায় আক্ষরিক পাঁজাকোলা করে কলেজ স্ট্রিট ছুটতেন।
কলকাতা বিমানবন্দর থেকে তখন পৃথিবীর বহু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরাসরি উড়ান ছিল। এখন শুধু দুখানি – দুবাই আর দোহা – তা-ও মধ্যপ্রাচ্যের বদান্যতায়। সেই তুলনায় কিন্তু সরকারি বাস ছিল অনেক বেশি। ঢাকুরিয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার দু দুটো জনপ্রিয় বাস ছিল ১৬ নম্বর আর ৮বি। এখন যাদবপুরে ৮বি বাসস্টপ আছে, বাস নেই। আর ঢাকুরিয়ায় বিরাট বড় সরকারি বাস টার্মিনাস ছিল – ১৬ আর এস১৫-র জন্য। দিঘা যাওয়ার দূরপাল্লার বাসও ছিল। নতুন সহস্রাব্দে সে পালা উঠে গেছে। এখন সেই জমিতে গড়ে ওঠা সরকারি বহুতল বাড়িতে বড় বড় আমলারা থাকেন জনসাধারণের করের টাকায়।
যাই হক, আমরা বাপ-ব্যাটা ১৬ নম্বরে আরাম করে বসে ষোলো দুগুণে বত্রিশ মিনিটে দশ পয়সার টিকিট কেটে কলেজ স্ট্রিট চলে যেতাম। গিয়েই প্রথম যেতাম মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের দপ্তরে – শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে। সেখানে আড্ডায় লিড করতেন স্বয়ং মিত্র ও ঘোষ মানে গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুমথনাথ ঘোষ। বালিগঞ্জ ফার্ন রোডের জগদবন্ধু ইন্সটিটিউশনে ক্লাস এইটে পড়াকালীন এঁদের বন্ধুত্বের গোড়াপত্তন। তখন থেকেই দুজনে প্রকাশনার স্বপ্ন দেখতেন। নিজেদের সৃষ্টিতে এবং সামুহিক প্রকাশনায় এঁরা ছিলেন অলরাউন্ডার। সুমথ দাদু ছোটখাটো মানুষ ছিলেন, কথাবার্তাও ছিল ছোটখাটো। আর গজেন দাদু ছিলেন একদম উল্টো – বচনে এবং অবয়বে দুয়েতেই তিনি ছিলেন মহৎ, তবে স্থূল কখনোই নন। গজেনদাদু আর নারায়ণ-জেঠু (সান্যাল) – এঁদের মতো বাগ্মী আমি আর মাত্র দুজনকেই দেখেছি – অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর অবশ্যই শঙ্খ ঘোষ – আমার মাস্টারমশায়। সেদিন মিত্র ও ঘোষের দপ্তরের আড্ডা জমাতেন আরো বেশি করে প্রনাবি মানে প্রমথ নাথ বিশি। সে ছিল যেন বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের সভা। আসলে বইপাড়ার এই নতুন বছরের উদযাপন শুরুই হয়েছিল মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের হাত ধরে। ওখানে ওদিন এত মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছি যে, তার পর আর কিছুই বোধহয় পাওয়ার থাকতে পারে না।
ওখান থেকে বেরিয়ে যেতাম দেজ পাব্লিশিং-এর অফিসে – বঙ্কিম চ্যাটারজি স্ট্রিটে। সেখানে সুধাংশু-কাকার আপ্যায়নের একটা বিশেষত্ব ছিল ডাব আর জলভরা তালশাঁস সন্দেশ। এখানে অবশ্য কাকা মানে সুধাংশুশেখর দে গল্পের আসরে মুখ্য ভূমিকা নিতেন না। তিনি অতিথি-আপ্যায়নে বেশি মন দিতেন। এখানে এসে গল্প করতেন মূলত মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় মানে সবার প্রিয় শঙ্কর আর কালেভদ্রে আসতেন নিমাইজেঠু মানে নিমাই ভট্টাচার্য।
কলেজ স্ট্রিটের এই বইয়ের হালখাতার আসরে আমার শেষ যাওয়া ১৯৮৯ সালে যেদিন আমার প্রথম বই "সংহতি পথে পথে" প্রকাশ পেল দেজ পাব্লিশিং থেকে। আমার বই বলাটা পুরোপুরি ঠিক হবে না। বাবার বইগুলো থেকে মূলত দেশপ্রেম ও ধর্মীয় সংহতির কিছু গল্প বেছে নিয়ে এই সংকলন।
১৯৯০ থেকে ২০০১ অবধি প্রদেশের বাইরে আর ২০০২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দেশের বাইরে কেটে গেল আমার পয়লা বৈশাখ। কখন এসছে গেছে জানতেই পারিনি প্রায় ঠিকমতো। কখনো এলাহাবাদ, আজমের, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কখনো বা মাস্কাট, স্ত্রাসবুর্গ, ডেনভার, দুবাই, দোহা, অ্যামস্টারড্যামে মাধুকরী করতে হয়েছে।
এখন কলকাতায় আছি। কলেজ স্ট্রিট আছে। নববর্ষও আছে। নিমন্ত্রণ আসে। শুধু ষোলো নম্বর বাস নেই, সহযাত্রী বাবা নেই, থোল-খরচ দেওয়ার জন নেই…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন